অপ্রিয় সে পর্ব-০৩

0
1909

#- অপ্রিয় সে
#- সানজিদা সন্ধি
#- পর্ব -৩

রায়হান খানের কিছু করার ছিলোনা। তার ছেলের ইচ্ছে তার বউকে যেন সবচেয়ে বেশি স্পেশাল লাগে। তাই পার্লার থেকে রিমুকে সাজানোর জন্য লোক আসে।

বিয়ের ঝক্কি ঝামেলা আর নানান টেনশনে এসি রুমের মধ্যে থেকেও ঘামতে থাকে রিমু। এসময় যদি সাদিয়াকে কোনোভাবে কাছে পেত তাহলে বড্ড উপকার হতো তার। সাদিয়া রিমুর বেস্ট ফ্রেন্ড। পারিবারিক যান্ত্রিকতা থেকে বেরিয়ে এই বন্ধুমহলেই সে একটু স্বস্তির প্রশ্বাস ছাড়তে পারে। রিমুর সব বন্ধুরা বিয়ের দিনই অ্যাটেন্ড করবে বলে জানায়। রিমুর ভীষণ মনখারাপ হয়। কিন্তু কিছু বলতে পারে না সে। জোর করে কিছু পাওয়াতে বিশ্বাসী নয় সে।

পার্লারের মেয়েগুলো রিমুর মুখের মধ্যে যখন মেকাপের দুই ইঞ্চির প্রলেপ লাগাতে ব্যাস্ত তখনই সাদিয়া, প্রাপ্তি, আহানা, সাজ্জাদের আগমন। হুট করে এসে চমকে দিলো তারা। রিমু তাদেরকে দেখে নিজেকে সামলাতে পারেনি। কীসের সাজ কীসের কী! বিছানা ছেড়ে সাদিয়াকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে দেয় সে। সাদিয়া রিমুর পিঠের মধ্যে কষিয়ে একটা থাপ্পড় দেয়। রিমু ব্যাথায় ” কুত্তিইইই” বলে চেঁচিয়ে ওঠে। সাজ্জাদ টিটকারি করে বলে যাক শেষ অবধি তুইও ময়দার সাগরে ডুব দিলি। খুব তো বড় বড় কথা বলেছিলি। কী হলো এখন?

সাজ্জাদের কথা শুনে রিমুর মুখে যেন আষাঢ়ের মেঘ নেমে এলো। সাহস করে পার্লার থেকে আসা মেয়ে দুটোকে ঘর থেকে বেরিয়ে বাকিদের দেখতে বলে ঘরের দরজা আটকে দিলো সে। রিমুর বন্ধুরা একপ্রকার আঁতকে উঠেই বললো, ” রিমু রূপম ভাইয়া জানলে তোর কিন্তু অবস্থা খারাপ করে ছাড়বে।” সবার মুখে একপ্রকার দুশ্চিন্তা দেখা গেলেও সাদিয়াকে বেশ খুশিই মনে হলো।

সে উচ্ছ্বসিত গলায় বললো, ” রূপম ভাইয়ার জন্য নিজের ইচ্ছে আর বিসর্জন দিসনা রিমু। আর কত সহ্য করবি তুই? ছোট থেকে রূপম ভাইয়ার জ্বালাতন সহ্য করতে করতে এই পর্যায়ে এসেছিস। এখন বিয়েটাও নিজের ইচ্ছের বিরুদ্ধে করছিস। এ বিয়েতে তোর মত নেই সবাই জানে। কতবার বললাম পালিয়ে চলে যা। থানায় জিডি কর। তুই এখন প্রাপ্তবয়স্ক। এখন কেউ কী করে তোকে জোর করতে পারে? হ্যাঁ রে! তোর কী আত্মসম্মান বলতে কিচ্ছু নেই? যেখানে বিন্দুমাত্র কদর পাসনা সেখানে আজীবন থাকবি কী করে? ”

রিমু ফোঁপাতে লাগলো। ভাঙাভাঙা গলায় বললো, ” আমি এখনো বলছি করতে চাইনা এই বিয়েটা। কিন্তু বাড়ির লোক তো কথা শুনবে না। তাহলে আমি কী করতে পারি বল? তোর কী মনে হয় আমি রূপম ভাইকে বিন্দুমাত্র শ্রদ্ধা করি? তার প্রতি সমস্ত শ্রদ্ধা আমি কবেই হারিয়ে ফেলেছি। নিজের আত্মমর্যাদা বজায় রাখতে গিয়ে যতটা সম্ভব তাকে এড়িয়ে চলেছি। কিন্তু একটা কথা কী জানিস? যারা নিজের চেয়ে অন্যদেরকে বেশি ভালোবাসে তাদের অহেতুক কষ্টই পেতে হয়। এই বিয়েতে হাজার বার না বলা স্বত্তেও কেউ শুনলো না। আত্মহত্যার ভয় দেখালাম তাও মানলো না। কারণ তারা জানে আমি তাদেরকে কতটা ভালোবাসি। এই ভালোবাসার জন্য তারা যা বলবে আমি ঠিক সেটাই করবো। আরেকটা বিষয় আত্মসম্মান থাকলেও অনেক সময় পরিবারের কথা ভেবে চুপ হয়ে ছিলাম। এখনও বিষয়টা ঠিক সেরকমই আছে। আমি এমন কিছু করবোনা যাতে তাদের অসম্মান হয়। এখন তুই হয়তো বলতে পারিস যারা আমার কথা ভাবে না আমি তাদের কথা কেন ভাববো? ওই একটাই উত্তর আমার। ভালোবাসি যে তাই। এই ভালোবাসাটা আমার অকারণে আসে। তাদের মুখ থেকে একটু ভালো কথা শুনলে আমার আবেগে কান্না পায়। তারা যদি আমার ভালো চাইতোই তাহলে কখনোই জোর করতো না। ইচ্ছার বিরুদ্ধে যেতোনা আমার। কখনোই না। যেহেতু তারা সেটা করেনি তাদের ইচ্ছে বোঝাই যাচ্ছে। আর আমিও তো সবটা বললাম! আশা করি সবাই বুঝেছিস সবটা।”

সবার মনটা বিষিয়ে গেলো। তারা চোখের সামনে তাদের বন্ধুর সর্বশেষ ভালো থাকার লেশ টুকু হারানোর আশঙ্কায় বিমর্ষ।

টপিক ঘোরাতে আহানা বলে উঠলো, ” রূপম ভাইয়াকে দুই শব্দে ব্যাখা কর। আর হ্যাঁ ব্যাখাটা সেভাবে করবি যেভাবে তুই তাকে দেখিস। তার জন্য অনুভব করিস। ” আহানা ভেবেছিলো রিমু হয়তো রাক্ষস জল্লাদ টাইপের উত্তর দিবে আর সেও কথা ঘুরিয়ে নেবে। কিন্তু বিষয়টা হলো পুরোপুরি ভিন্ন।

রিমু জোর গলায় বললো রূপম ভাই ইজ ইকুয়াল্টু ” অপ্রিয় সে “।

সবাই বুঝলো বিষয়টা অনেক সিরিয়াস পর্যায়ে গড়াচ্ছে। সাজ্জাদ পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার হালকা চেষ্টা করলো। মুখ চোখের ভঙ্গিমা ব্যাঙ্গাত্বক করে বললো, তুই কী এই চোখের জলে প্যাতপ্যাতা হওয়া মেকাপ নিয়ে হলুদের স্টেজে যাবি? ইশ এমন পেত্নী সেজে স্টেজে গেলে মানসম্মান থাকবে না আমাদের বন্ধু সমাজের। যা মুখ ধুয়ে আয়!”

সাজ্জাদের চেষ্টা সফল হলো। ফিক করে হেসে দিয়ে রিমু ফ্রেশ হতে গেলো। হাজার মনখারাপ তার খানিকক্ষণের জন্য কেটে গেলো। আসলেই বন্ধু থাকলে সব সম্ভব।

বিউটি শিয়ান দুজনকে ঘর থেকে বের হতে দেখে রূপম তাদের কাছে গিয়ে বললো, ” বাহ্ এতো তাড়াতাড়ি সাজানো শেষ? ” রূপম এ ঘরের পাশ দিয়েই যাচ্ছিলো।

মেয়ে দুজন মেঝের দিকে চোখ নামিয়ে বললো,” ম্যামের বন্ধুরা আসায় তিনি আমাদেরকে অন্য কাউকে সাজাতে বললেন স্যার। তার ভাবভঙ্গি দেখে মনে হলো তিনি সাজবেন না। তিনি কাঁদছিলেনও। আমার মনে হয় তাকে জোর করা ঠিক নয়। ”

রূপম সবটা শুনে হালকা হেসে অন্য রুমে যেতে বললো তাদের। কিন্তু ভেতরে ভেতরে রাগে গজগজ করতে লাগলো। রিমুর ইদানীং বড্ড সাহস বেড়েছে। তার কথা, তার ইচ্ছে অমান্য করার সাহস সে কী করে পেলো? এর শাস্তি তো রিমু পাবেই। কী শাস্তি দেবে সেটা ভেবে সে চলে গেলো।

বিয়েবাড়ি সেজে উঠেছে আলোকসজ্জা আর নানান রকম ফুলের বাহারে। ক্যামেরা,আলো, মিডিয়ার লোকজন, ফটোগ্রাফার সবকিছু মিলিয়ে এক অন্যরকম অবস্থা। সবাই এসেছে বিশিষ্ট গায়ক রূপম খানের গায়ে হলুদের সন্ধ্যাকে ক্যামেরায় বন্দি করতে।

রূপমের মনের রাগটা ক্রমাগত বাড়তে লাগলো। কিন্তু তারপরেও হাসিমুখে সবটা সামলাতে লাগলো। খানিকটা পরে রিমুর আগমন হলো। হলুদ একটা শাড়ি, মাঝখানে সিঁথি করে সমস্ত চুলগুলো পিঠ জুড়ে ছড়ানো। কপালে কালো টিপ, চোখে কাজল। ব্যাস এটাই তার সাজ। রিমুর ঠোঁট গুলো এমনিতেই গোলাপি। তাই মনে হচ্ছে লিপস্টিক লাগিয়েছে সে। এই হালকা সাজেই তাকে অসম্ভব স্নিগ্ধ লাগছে। রূপমের চোখে চোখ পড়তেই চোখদুটো নামিয়ে নিলো রিমু। ভয়ে একটা ঢোক গিললো। সে জানে অবাধ্যতার জন্য তাকে শাস্তি পেতেই হবে। সেই শাস্তি কতটা ভয়ানক হবে সেটাই এখন চিন্তার বিষয়। জেদ দেখিয়ে নিজের মনমতো সেজে তো নিলো। কিন্তু এরপর মায়ের মনখারাপ মিশ্রিত খোঁচানো কথা কেউ সহ্য করতে পারবে তো?

রিমুকে স্টেজে নিয়ে আসা হলো। ক্যামেরার আলো আর অতিরিক্ত ভীড়ে সে অস্বস্তি বোধ করতে লাগলো। কিন্তু কিছু করার নেই। মিষ্টি জাতীয় খাবার একদমই পছন্দের নয় রিমুর। তাকেই এখন মিষ্টি, পায়েস এসব গিলতে হচ্ছে।

কিছুক্ষণ পরে রিমুর গায়ে হলুদ ছোঁয়াতে রূপম এলো। সাথে তার বন্ধুরা। এদের মধ্যে একজনকে দেখে খানিকটা ভালো লাগলো রিমুর। ঋষি চৌধুরী এসেছেন। সেলিব্রিটিদের পছন্দ না হলেও তাদের গুণকে সম্মান জানাতে জানে রিমু। ঋষি চৌধুরির গানের গলা তার ভীষণ ভালো লাগে। ঋষি রিমুর গায়ে হলুদ ছোঁয়ানোর পরে রূপমকে বললো, ” মাম্মা ভাবী তো হেব্বি। পুরাই আগুন। ”

কমপ্লিমেন্টটা পছন্দ হলো না রিমুর। এ কেমন ধরনের কথা? সুন্দরভাবেও তো বলা যেত। ঋষির কথার ধরন এমন হবে ভাবেনি রিমু। এর আগে সে অনেকবার এ বাসায় আসলেও রিমু কখনো তার সামনাসামনি যায়নি। রূপমের কোনো কিছুতেই রিমুর আগ্রহ নেই।

রূপম গায়ে হলুদ ছোঁয়াতে নিলেই হুট করে লোডশেডিং হলো। জেনারেটর চালু করার আগেই রূপম টুপ করে রিমুর গালে একটা চুমু খেয়েই হাতের মধ্যে জোরে একটা চিমটি দিয়ে একটা চিরকুট ধরিয়ে দিলো।

তাজ্জব বনে গেলো রিমু। চিমটি কেউ কাউকে দেয়? ছোট বাচ্চা হলে মানা যেন কিন্তু রূপম! তাছাড়া চুমু কেন দিলো সে? রিমুর গা গুলিয়ে এলো। হাতের চিরকুটটা শক্ত করে মুঠোবন্দি রাখলো।

এদিকে রূপম মিটমিটিয়ে হাসতে লাগলো। কিছুক্ষণের জন্য হলেও রিমুকে জব্দ করেছে সে। আহা শান্তি! শান্তি!

চলবে,,,,,,

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে