#- অপ্রিয় সে
#-সানজিদা সন্ধি
#-পর্বঃ২
রিমুকে গায়ে হলুদের জন্য তৈরি হতে বলে রূপম চলে যেতে উদ্যত হলেই রিমু তাকে থামালো। মিনমিনে গলায় জানতে চাইলো, ” আমার বুকে যে তিল আছে একথা তুমি কী করে জানলে রূপম ভাই? এ কথা তো আমি ছাড়া কেউ জানে না।”
রূপম এক ভ্রু কুঁচকে অদ্ভুত গলায় বললো, ” কী ব্যাপার রিমু? বুদ্ধিশুদ্ধি কী সব লোপ পেয়েছে? যেহেতু কথাটা তুই ছাড়া কেউ জানে না তারমানে আমি তোর মাধ্যমেই জেনেছি। ওই যে সেদিন! ” এটুকু বলে রূপম ফোনে কল রিসিভ করার ভান করে চলে গেলো।
রিমু স্পষ্ট বুঝতে পারলো কেউ ফোন করে নি। রূপম তাকে জ্বালানোর জন্যই সবটা না বলে ফোন রিসিভ করার ভান করে চলে গেলো ।
রিমুর স্বভাব হলো অতি ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর বিষয় নিয়ে মাথা ঘামানো। কোনো বিষয় তার মাথায় একবার ঢুকলে যতক্ষণ না ওই বিষয়ে সে নিষ্পত্তি করতে পারছে ততক্ষণ সে শান্ত হতে পারে না। কিছুতেই না। আর বুকের তিলের বিষয় রিমুর কাছে মোটেই কোনো সামান্য বিষয় নয়। হওয়া সম্ভবও নয়। এই বিষয়টা রূপম কী করে জানলো সেটা ভাবতে ভাবতেই রিমু অস্থির হয়ে যাবে। রিমু ভালোই জানে তাকে অস্থির দেখলে,অশান্তিতে থাকতে দেখলে রূপম এক অন্যরকম শান্তি পায়। আর সে কারণেই আবারও রিমুর মাথায় বড়সড় জট পাকিয়ে দিয়ে সে উধাও হলো।
রিমু বুঝতে পারে না যেই ছেলে তার অশান্তিতে শান্তি পায়, তাকে জ্বালিয়ে, পুড়িয়ে নিঃশেষ করে দিতে পারলে শান্তি পায় সেই ছেলে কেন কদিন আগে তাকে বিয়ে করবে বলে হল্লা জুড়ে দিয়েছিলো। আর বাড়ির মানুষগুলোও বটে। রূপম বললো আর ওমনি তারা ঢ্যাংঢ্যাং করে বিয়ের আয়োজন করতে ব্যাস্ত হয়ে পড়লো। বিরক্তিকর।
রিমুর এই বিরক্ত প্রকাশের গন্ডিটা নিজের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। ভুলক্রমেও সে কখনো কাউকে বিরক্তি বা রাগ দেখায় না। তবে অভিমান আর জেদ তার ভালোই আছে। বিষয়টা সম্পর্কে বাড়ির সকলেই অবগত। তবে কেউ এই অভিমান,জেদকে বিশেষ পাত্তা দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করে না। একমাত্র রূপমের কারণেই রিমুর ভাগ্যে এতো অবহেলা।
রিমু বুঝে গিয়েছে আর যাইহোক না কেন রূপমের সাথেই তার বিয়েটা হবে। তাই চুপচাপ করে অবাধ্য নোনাজলের টুপটাপ পতনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকার সিদ্ধান্ত নিলো সে।
ওড়না খুঁজে ওয়াসরুমের দিকে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই কোথা থেকে যেন রূপম ঝড়ের বেগে এলো তারপর গম্ভীর স্বরে বললো, গোসল করার পর তোয়ালে পড়ে বের হলে বুকের তিল তো দেখাই যাবে তাইনা? কেয়ারলেস মেয়ে কোথাকার। কখন কী করছে সে বিষয়ে যেন কোনো হুসই নেই। না জানি কাকে কাকে ঠিক কী কী দেখিয়ে বেড়িয়েছে। ” কথাগুলো বলে ঠিক যেমন ঝড়ের গতিতে সে এসেছিলো তেমনই ঝড়ের গতিতেই চলে গেলো। আর পেছনে রেখে গেলো হতবুদ্ধি এক যুবতীকে।
রূপমের কথা শুনে রিমুর কান্না পাচ্ছে। তার জানামতে সে জীবনেও তোয়ালে পড়ে বাহিরে আসেনি। তাহলে রূপম জানলো কী করে? তবে কী সে মিথ্যা বলছে? রূপম মিথ্যা বলছে ভেবে যদিওবা স্বস্তির প্রশ্বাস ছাড়তো রিমু তাও হলোনা। মাথার ভিতরে প্রশ্নেরা আন্দোলন শুরু করেছে। রূপম মিথ্যা বললে সে জানলো কী করে? আর রিমুর জানামতে রূপম সবকিছু নিয়ে ভীষণ সিরিয়াস৷ ফাজলামি তার দ্বারায় কমই হয়।
অশান্ত মন আর নিরব অশ্রুপাতের মধ্যে দিয়ে রিমুর জীবনের ধারাবাহিকতা শুরু হলো।
নিজেদের মধ্যে বিয়ে হওয়ায় আত্মীয়স্বজনও নিজেদেরই। এর বাহিরে যার যার বন্ধুমহল আর আত্মীয়দের আত্মীয়।
রূপম বর্তমান সময়ের একজন জনপ্রিয় সিঙ্গার। দেশ বিদেশে তার খ্যাতি। হাজার হাজার মেয়ের ক্রাশ অথবা ভালোবাসা।
রূপমের এতো জনপ্রিয়তা রিমুর কাছে তাকে আরো বেশি অপ্রিয় করে তুলেছে। জনপ্রিয়তা কোনোকালেই রিমুর সহ্য হয়না৷ সাদামাটা জীবন তার ভীষণ পছন্দের। একজন মানুষকে ঘিরে হাজার হাজার মানুষের পদচারণা, হাহাকার কেমন যেন লাগে রিমুর৷ সবাই যেখানে জনপ্রিয়তার জন্য পাগল সেখানে রিমু ব্যাতিক্রম৷ সেলেব্রিটিদের ভীষণ নির্দয় লাগে তার কাছে। মানুষ পছন্দের কিছু বোধহয় কমই পায়৷ আর অপছন্দের সবকিছু নিয়ে চলতে হয়। বিষয়টা একেকজনের জন্য একেকরকম ভাবে প্রযোজ্য ।
ভেজাচুলে গায়ে কোনোরকম করে একটা শাড়ি পেঁচিয়ে গোসল করে বের হলো রিমু। ঘন কালো কেশ তার সারা পিঠে ছড়িয়ে পড়েছে। চুলের পানিতে সারা পিঠ ভিজে একাকার। রিমু আক্ষরিক অর্থে ভীষণ সুন্দরী। ফর্সা টকটকে তার গায়ের রং। একরাশ ঘন কালো কেশ, চোখগুলো বড়বড় আর চোখের পাপড়িগুলো মনোমুগ্ধকর। কেউ এক দেখাতেই অপলক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে থাকতে চাইবে৷ রূপের প্রসংশা অনেকের কাছে শুনলেও রূপম তাকে বরাবরই পেত্নী বলে ডেকে এসেছে। সাদা পেত্নী। রূপমের উপমা শুনে রিমুর মনে হতো নদীতে ঝাপ দিয়ে মরে যাক সে৷ পেত্নীও সাদা হয় না কি? রূপমের কথানুযায়ী রিমু হলো সাদা মুলা। এমনিতেই ফর্সা তবে আহামরি কিছু নয়। তবে রিমুকে দেখলে হয়তো শ্রদ্ধেয় হুমায়ুন আহমেদ ” মায়াবতী ” উপমাটা শুধু শ্যামবর্ণের মেয়েদের জন্য প্রযোজ্য রাখতেন না।
লম্বা চুল আর এলোমেলো শাড়ি নিয়ে নাজেহাল অবস্থা রিমুর। একটা মানুষ নেই যে তাকে একটু সাহায্য করবে। পার্লার থেকে লোক আসার অপেক্ষায় সবাই যেন বসে আছে। অসহ্যকর। অন্যদিকে হয়তো দেখা যাচ্ছে রূপমের পিছনে ধরা বাঁধা বিশজন রয়েছে।
লম্বা চুলগুলো ভীষণ পছন্দ রিমুর। অথচ সেই চুলের উপরের কম অত্যাচার চালায়নি রূপম।
ক্লাস এইটে টেস্ট পরীক্ষায় ফেল করার পরে রূপম ঘোষণা দিলো ফেল করার শাস্তি স্বরূপ রিমুর চুল কেটে দেওয়া হবে। কথাটা শুনে রিমুর সে কী কান্না। তার অবস্থা দেখে মনে হচ্ছিলো কেউ যেন তার গর্দান নেওয়ার হুকুম করেছে। রিমু সেদিন আকাশ- পাতাল কাঁপিয়ে কেঁদেছিলো। প্রতিজ্ঞাও করেছিলো ভালো রেজাল্ট করবে। কিন্তু রূপমের ইচ্ছে রাখতে ধরে বেঁধে তার চুল কাঁধ অবধি কেটে দেওয়া হয়েছিলো। রিমুর জন্য চুল কেটে দেওয়া হচ্ছিলো রূপম তখন তার সামনে একটা চেয়ারে বসে হাসিহাসি মুখ করে ছিলো। সেদিন বাড়ির সবার আর রূপমের প্রতি ভীষণ ঘৃণা জন্মেছিলো তার। তবে এর স্থায়ীত্ব কাল ততক্ষণ ছিলো যতক্ষণ না তার মা রেহনুমা বেগম এসে তাকে আদর করে দেয়। মায়ের একটু স্বান্তনা বাণীতে নিজের কষ্ট, ক্ষোভ সব মুছে দিয়ে স্বাভাবিক আচরণ করে। রিমু টা না ভীষণ অদ্ভুত। একটু ভালোবাসা পেলেই নিজেকে উজাড় করে দেয়। তবে সেই একটুখানি প্রকৃত ভালোবাসাই তার খুব কম পাওয়া হয়েছে।
রিমুর নাজেহাল অবস্থায় অবসান ঘটাতে আগমন হলো রূপমের মা রায়হান খানের। রিমু খালামনি বলে জাপ্টে জড়িয়ে ধরলো তাকে । এই মানুষটাই রিমুর শত শত মন খারাপের মাঝে একটু হাসির কারণ হয়েছে। তাকে দিয়েছে স্বস্তি। ছেলের বিরুদ্ধে তার কোনো পদক্ষেপ না নেওয়া হলেও রিমুকে সে খানিকটা আগলেছেই। নয়তো ভালোবাসাহীন রিমু হয়তো কবেই মরে যেতো।
রায়হান খান রিমুর খোঁজ নিতে এসে দেখেন সে নাকানিচুবানি খেয়ে বসে আছে। তিনি মৃদুস্বরে ধমকে উঠে বললেন, ” কী ব্যাপার রিমু? একটুপরে তো আবার গায়ে হলুদ ছোঁয়ানোর পরে গোসল করবিই৷ এখন শুধু শুধু গোসল না করলেই হতো না? ঠান্ডা লেগে যাবে তো। ”
রিমু আমতাআমতা করে বললো, ” আসলে খালামনি মেঝেতে গড়াগড়ি খেয়েছি তো তাই কেমন যেন লাগছিলো। তাছাড়া গোসল না করে মেকাপ নিতে পারবোনা আমি। ”
রায়হান খান দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। তিনি জানেন রিমুর মতই নেই বিয়েতে তারপরেও। কথা ঘোরাতে তিনি বললেন” তুই মেকাপ করবি?”
এবার যেন রিমুর খারাপ লাগা আরো বেশি করে বাড়লো। সে নিম্নস্বরে বললো, ” খালামনি তুমি যদি রূপম ভাইকে একটু ম্যানেজ করতে। আমি পারবোনা আটা ময়দা মাখতে। ”
রিমুকে সাজলে মানায়না খুব একটা। তাই রায়হান খানও চাচ্ছিলেন না সে সাজুক। কিন্তু কিছুই তার করার নেই।
রায়হনা খানের মাথায় এখন একটাই চিন্তা। যে বিয়ের আগাগোড়া অসম্মতি সে বিয়ে টিকবে তো?
চলবে,,,