#অপ্রিয় প্রেয়সীর ভালোবাসা — [৯]
#মুনিয়া_মিরাতুল_নিহা
#অন্তিম পর্ব
______________________
-‘ বারবার বলছি যা হয়েছে ভুলে মন দিয়ে সংসার কর। যে মানুষটা আমাদের খোঁজও নেয়নি তার জন্য এতোকিছু করে লাভ নেই। ‘
-‘ কি দিয়েছেন ওই মানুষটা আমাকে? বাবার আদর তো দূরের থাক পিতৃপরিচয়টুকুও দেননি। উনি উনার দুই মেয়ে তানহা আর মিরাকে নিয়ে সুখে শান্তিতে সংসার করছেস! উনার নাকি দু’টো সন্তান! এদিকে আমি যে উনার আরো একটি সন্তান হই এটা তো উনি মানেনই না। উনার মান সম্মান নষ্ট হয়ে যাবে সমাজে তোমার কথা জানলে এইজন্যই তোমাকেও সীকৃত্বী দেয়নি কখনো। কতো অপ’মা’ন, অবহেলা সহ্য করে আমাকে বড়ো করেছো তুমি এই সবটা ভূলে যেতাম এতো সহজে মা? এটা সম্ভব নয়। আমাদের কি দোষ বলো? উনি সর্বদা তোমাকে বলে এসেছেন উনার দু’টো মেয়ে তাদের নিয়ে সুখী থাকতে চায় তো যে বাবা আমাকে সুখে থাকতে দেয়নি, আমাকে পরিচয় ও দেননি নিজের সন্তানের কারনে সেই সন্তানকে আমি কি করে এতো সহজে সুখে থাকতে দিবো মা? এটা তো কখনোই হতে পারে না! তাই জানোতো সেই কলেজে রাসেলকে দিয়ে সেদিন আয়মানকে আমিই ডাকাই আর তানহা যে ওয়াশরুমে যেতে চাইছিলো সেখানেও লোক আমিই ঠিক করাই যাতে ও আয়মানের সঙ্গে সেই রুমে ধরা পড়ে। আর সর্বশেষে আমিই ছিটকিনি এটে দিই! সাড়া কলেজ, মহল্লায় সবখানে তানহার নামে ছি ছি পড়ে কিন্তু ওই মিজান সাহেব উনি তো মহান! তানহা তো উনার সেই সন্তান যার জন্য উনি আমাদের ছেড়ে দিছে তাই সেই মহত্ব প্রমান করতে সে তানহাকে অন্যত্র পাঠিয়ে দেয়! ‘
-‘ এতেও তোর শান্তি হয় নি? আর কি কি করেছিস তুই? এসব কিচ্ছু আমাকে কেনো বলিস নি আগে?
-‘ শোনো, ভেবেছিলাম এটুকুতে হবে কিন্তু তা না মিজান সাহেব তার বড়ো মেয়ের বিয়ে ঠিক করলো ধুমধাম করে আর আমি থাকতে সেটা কি করে হতে দিতাম মা? সেইজন্যই তো মিরা যখন জেনেছিলো নির্জনের সঙ্গে তানহার বিয়ে হবে আর সে নির্জনকে ভালোবাসে যখন এটা বলতে গেছিলো আমিই ওকে আটকে দিই! ওর বোনের ভ’য় দেখিয়ে কারন আমি চাইছিলাম বিয়েতে বড়ো সড়ো একটা ধা’মা’কা হউক! আর আমার প্ল্যানমতন আমি সবটা করি বিয়ের দিন মিরাকে দিয়ে মিথ্যা নাটক করাই জানো ও প্রথমে রাজি হচ্ছিলো না যখন তানহার ছোট্ট একটা এ’ক্সি’ডে’ন্ট করালাম তখন সুর সুর করে আমার কথা মেনে নিলো। মনে করেছিলাম মিরার সঙ্গে বিয়েটা ঠিক হউক কিংবা তানহার সঙ্গে বিয়েটা ভাঙু’ক! এই সমাজে যে একটা বিয়ে ভে’ঙে যাওয়া মেয়ের কি করুন পরিস্থিতি হয় সেটা তো সবারই জানা আর সেই করুন পরিস্থিতি তেই ফেলতে চেয়েছিলাম ওই মিজান সাহেবকে যাতে বুঝতে পারে! কিন্তু এবারও অসফল হলাম ওই আনোয়ার সাহেবের জন্য। উনি ধেই ধেই করে উনার বড়ো ছেলের বউমা করে নিলেন তানহাকে! এতোকিছু করেও যেনো কিচ্ছু হচ্ছিলো না মা, কিন্তু ভাগ্য বোধহয় আমার সহায় ছিলো কিছুটা সেইজন্যই তানহা আর আয়মানকে এক করেছে। জানো ওরা এখনো নিজেদের মেনে নেয়নি সেই অতীতের জন্য এটা আমি বুঝেছি। আর এইবার আমার সর্বশেষ পরিকল্পনা মতন আমি রাসেলকে বিয়ে করে ওই বাড়িতে ঢুকে পড়ি।’
-‘ মানে? তুই রাসেলকে ভালোবাসিস না?’
-‘ ভালোবাসা হাহ্! আমি কখনোই তোমাকে ছাড়া অন্য কাউকে ভালোবাসি নি। জানোতো এতোকিছু করেও যখন কোনো কাজ হলো না তখন আজকেই শেষ কাজটা করে দিয়ে এসেছি! ওই তানহার খাবারে বি’ষ মিশিয়ে এসেছি! মিজান সাহেব তার সন্তানকে হারালে বুঝবে কেমন লাগে! ‘
তামান্নার কথা শেষ হতে না হতেই সপাটে দু’টো চ’ড় পড়লো ওর গালে! আর কেউ নয় এটা মে’রে’ছে ওর মা। তামান্না অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে ওর মায়ের দিকে যে মা কখনো ওকে বকা পর্যন্তও দেয়নি সে আজ ওকে চ’ড় মা’র’ছে!
-‘ এই দিনটা দেখার জন্যই কি সমাজের এতো মানুষের এতো কথা শুনে তোকে বড়ো করেছি! সবকিছু ঠিকঠাক ছিলো কিন্তু তুই শেষমেষ বি’ষ! এটা কি করে করতে পারলি? যা ওই বাড়িতে যা এক্ষুনি গিয়ে বি’ষ ফেলে দিয়ে আয়।’
-‘ সে তুমি যাই বলো না কেনো যা হবার তা তো হবেই। এবার আমি আর হারবো না। ওই মিজান সাহেবকে বুঝতে হবে যে সন্তান, সন্তান করে উনি আমাকে অস্বীকার করেছেন সেই সন্তান না থাকলে কেমন লাগে।’
তামান্না ওর মা’কে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে বেড়িয়ে গেলো! তামান্নাকে দেখেই আমি সড়ে গেলাম। তামান্না চলে গেলো। আমি এখনো ঘোর কাটিয়ে ওঠতে পারছি না! কলেজে আমার ব’দ’নাম, বিয়ে ভা’ঙা, এমনকি বি’ষ মেশানোর মতন কাজও করতে পারলো তামান্না? যে কি-না আমার বেস্টফ্রেন্ড ছিলো! বোনের মতন ছিলো সে-ই পিঠে ছু’ড়ি বসালো। কিন্তু ওর তো পুরো দোষ নয়। এর জন্য তো দায়ী আমার বাবা! তামান্না উনার মেয়ে, আমার সৎ বোন! ওকে পরিচয় দেয়নি আমার বাবা। তাও আমার জন্য!
এতোগুলা ধা’ক্কা পরপর নিতে পারছে না তানহা মাটিতে ধপ করে বসে রইলো। নিরবে অশ্রু বির্সজন দিচ্ছে যেনো কোনো কিছু বলার শক্তি তার মধ্যে আর অবশিষ্ট নেই! সকল শক্তি হারিয়ে সে খোলা মাঠে বসে কেঁদে চলেছে এক নাগাড়ে!
কিছুক্ষণের ভেতরই সেই জায়গায় আয়মান এসে উপস্থিত হয়। তখন ওভাবে আয়মানকে এভাবে বলার কারন আবার এখন তানহাকে এভাবে কাঁদতে দেখে ভড়কে যায়!
-‘ তুমি কাঁদছো কেনো? কি হয়েছে? খুলে বলো আমাকে। ‘
তানহারর কান্নার বেগ যেনো আয়মানকে দেখে বৃদ্ধি পেলো। সে ক্রমশ কেঁদেই যাচ্ছে! একসময় আয়মানের কথা মতন ফোন থেকে ভিডিও টি বের করে আয়মানের সামনে তুলে ধরলো! ভিডিও দেখা শেষ করে আয়মান তানহাকে নিয়ে বাড়িতে গেলো। পথিমধ্যে তানহার মা’, বাবাকেও আসতে বললো। বাড়িতে রাসেল, সহ সবাইকে থাকতে বললো। কিছুক্ষণের ভেতর আয়মান তানহাকে নিয়ে বাড়ির ভেতর পৌঁছালো। সবাই আয়মানের কথা মতন ড্রয়িং রুমে বসে আছে! ইতিমধ্যেেই সেখানে তানহার বাবা মা-ও আছেন। এমনকি তামান্নাও আছে।
-‘ কিরে সবাইকে এভাবে ডাকলি কেনো তুই?’
-‘ কিছু দেখাবার আছে সবাইকে। ‘
এই বলে আয়মান তামান্নার মা’কে গাড়ি থেকে বাড়ির ভেতরে আনলেন। তামান্নার মা’কে দেখে মিজান সাহেব ওঠে দাঁড়ালেন! ওনার মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে উনি তামান্নার মা’কে দেখে ঠিক কতোটা ভ’য় পেয়েছে।
-‘ কি হলো বাবা? উনাকে চেনা লাগছে আপনার তাই তো?’
আয়মাের প্রশ্নোত্তরে মিজান সাহেব কিছু বললেন না। তড়তড় করে ঘেমে যাচ্ছেন উনি! মনে ভ’য় ঢুকে গেছে তামান্নার মা’কে দেখে। তাহলে কি আজকেই সেই সত্যি টা এসে পড়বো সবার সামনে?
-‘ সকলের সুবির্ধাথে আমি বলবো না উনি কে তবে ভিডিও টা দেখো তাহলে সবাই বুঝবে।’
ভিডিও চালানো হলো সকলে দেখতে লাগলো ভিডিও টা! ইতিমধ্যেই আয়মানের কথা মতন পু’লিশ এসে উপস্থিত হয়েছে বাড়ির ভেতর। সবাই ভিডিও দেখছে সবার মুখেই অবাকের ছাঁপ লক্ষ্যনীয় তবে সবচেয়ে অবাক বোধহয় মিরা, তানহার মা’ই হয়েছেন! লজ্জা য় ভ’য়ে সব মিলিয়ে মিজান সাহেব ঠায় দাঁড়িয়ে আছে! অবশেষে ভিডিও শেষ হলো আয়মানের পরিবার নিরব দর্শক কারন ঘটনাটা মিজান সাহেবের। কিন্তু তানহার মা চুপ করে রইলেন না তিনি মিজান সাহেবের গা’লে সপাটে দু’টো চ’ড় বসিয়ে দিলেন! মিরাও যেনো এখনো হতভম্ব হয়ে আছে। তার বাবা এরকম একটা কাজ করবে সেটা মিরার কল্পনাতীতও ছিলো না। তানহা এখনো সমানতালে কেঁদে যাচ্ছে!
-‘ এতো বড়ো একটা অন্যা’য় করেছো তুমি ওই মহিলা আর তামান্নার সঙ্গে! তা-ও বুক ফুলিয়ে এতোদিন চলে এসেছো। মনের মধ্যে কোনো অনুশোচনা নেই তোমার? কি করে করতে পারলে এরকম টা? আমার মেয়েদের কথা একবারো ভাবলে না? তোমার জন্য এতোকিছু হয়েছে! কেনো করলে এরকমটা বলো?’
-‘ বাবা! এই বাবা ডকটা বলার জন্যই তামান্না এতোকিছু করেছে। আমাকে জিগেস করলে আমি সবসময়ই বলতাম আমি সবচেয়ে বেশি ভালোবাসি আমার বাবাকে! আর আজকে সেই বাবা-ই এরকম একটা জঘ’ন্য কাজ করবে সেটা ভাবতেও কষ্ট হচ্ছে জানোতো? শতো যাই হউক তুমি তো বাবা! তাই তোমাক বেশি কিছু বলবো না কিন্তু আমার মুখ থেকে তোমার জন্য বাবা ডাক আসবে কি-না সেটা বলতে পারছি না! বোধহয় বাবা ডাকটা তুমি আর শুনতে পারবে না। ‘
-‘ শুধু তুই কেনো আপু? এই লোকটা আমার মুখ থেকে উনার জন্য বাবা ডাক কোনোদিনও শুনতে পাবে না! আমি ভূলে যাবো এই লোকটা আমার বাবা। যিনি এতো বড়ো একটা অন্যা’য় কাজ করেও আমাদের বাবা!সে-রকম বাবাকে বাবা বলার কোনো প্রয়োজন নেই! আজকে উনার জন্য তামান্না এতোটা করেছে! আমাকে দিয়ে কুৎ’সি’ত কাজ করিয়েছে।কিন্তু কেনো? এই লোকটার জন্য করেছে! এই লোকটাকে আর বাবা আমি ম’রে গেলেও করবো না!’
-নিজের মেয়ে, স্ত্রীর মুখ থেকে এসব শুনে নিরবে অশ্রু বির্সজন করছে মা’থা নিচু করে। কিন্তু সত্যি তো সবসময়ই তিক্ত হয়!
এতোক্ষণ চুপ করে ছিলেন তামান্না বেগম এবার তিনিও মুখ খুললেন,
-‘ আপনি আপনার সন্তানের জন্য আমা্র সন্তানকে পরিচয় দেননি যে কি-না আপনারই সন্তান ছিলো! গরিব ঘরের মেয়ে ছিলাম। আমাকে ভুলিয়ে ভালিয়ে বিয়ে করলেন তাও সেটা ছিলো মিথ্যা বিয়ে! যদিওবা পরে সবটা জানি কিন্তু তখন আপনি আপনার বউ, বাচ্চার অযুহাত দিয়ে চলে গেছেন। আমিও মেনে নিয়েছি আমার এই নিষ্ঠুর নিয়তি। কিন্তু আমার কি দোষ ছিলো বলতে পারেন? সে কেনো বাবা ডাকতে পারলো না? বাবার ভালোবাসা তো দূর বাবার পরিচয় টুকুও পেলো না? দেখছেন যা করছেন তা ফিরে পেয়েছেন এখন আপনার সন্তানেরাও আপনার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে! ওদের দৃষ্টি শুধু ঘৃ’না তাও আপনার জন্য! আমার মেয়ে ভূল করেছে কিন্তু তাও আপনার জন্যই!’
-‘ বাবা! কখনো আপনাকে বাবা বলে ডাকতে পারিনি। ছোটোবেলায় যখন দেখতাম সব বন্ধুদের বাবা এসে স্কুলে দিয়ে যায় তখন আমি ভাবতাম আমার বাবা কই? যখন বাবারা মেয়েদের নিয়ে ঘুরতে যেতো আমি ভাবতাম আমার বাবা কই? যখন একসঙ্গে খেলাধুলা করতো তখনও আমি ভাবতাম আমার বাবা কই? এরকম অনেক দেখেছি আর অনেক ভেবেছি নিজের মনে মনে আমার বাবা কই? তখনও কিচ্ছু বুঝিনি জানেন? কিন্তু যখন বড়ো হয়েছি একটু মায়ের কাছ থেকে সবটা জেনেছি তখন থেকেই আপনার আর আপনার সন্তানদেের জন্য মনে ত্রীব ঘৃ’না জন্মায়! কতোভাবে যে ওদের ক্ষ’তি করার চেষ্টা করেছি। আমার মনে শুধু একটাই কথা বাজতো তানহা আর মিরার জন্য আপনি আমাকে সন্তানের পরিচয় দেননি। এখন বুঝতে পারছি দোষ আমারই ছিলো বাবা? সে তো আমার নয়। অযথাই মরিচিকার পেছনে ছুঁটেছি। সবার কাছে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি পারলে ক্ষমা করে দিবেন নতুবা মনে মনে অ’ভি’শাপ দিয়ে যাবেন! আমাকে এরেস্ট করুন ভিডিওতে তো দেখলেনই আমি বি’ষ মিশিয়েছি, এতোকিছু করেছি, আমার বাকি জীবনটা ওই অন্ধকারেই কাটুক।’
-‘ সবটা মানলাম কিন্তু আমার দোষ কি তামান্না? তোমাকে ভালোবেসেছি তাই? আমাকে তুমি তোমার কাজে ব্যাবহার করে আসলে! এরকমটা না করলেও পারতে। ‘
-‘ ভালোবাসা ভালো। কিন্তু ভূল মানুষকে ভালোবাসা ঠিক নয়। তোমার জন্য সেই ভূল মানুষটা আমি ছিলাম এবার সঠিক মানুষকে খুঁজে নাও। আমিও যাচ্ছি আমার পথে।’
-‘ দাঁড়াও! আমার জন্য এতোকিছু হয়েছে না? এর খে’সারত আমিই দিবো! শুধু তামান্না একটিবার আমাকে বাবা বলে ডাকবে?’
তামান্না কোনো কিছু না ভেবে মিজান সাহেবকে জড়িয়ে ধরলেন বাবা বলে! যেনো বহু বছরের তৃষ্ণা মিটলো তার বাবাকে পেয়ে! মিজান সাহবে তামান্নাকে জড়িয়ে ধরলেন। এ-তো উনারই সন্তান!
-‘ পারলে ক্ষমা করে দিস আমাকে। তোদের বাবা হবার যোগ্য আমি ছিলাম না। আমার জন্য এতো কষ্ট সহ্য করতে হয়েছে তোদের! তবে এখন আমি মুক্তি দিয়ে দিবো তোদের। ‘
মিজান সাহবে সিঁড়ি বেয়ে উপরে ছাঁদে ওঠে গেলেন। বাড়িসুদ্ধ সবাই উনার পিছু পিছু গেলেন! উনি ছাঁদে ওঠেই আগে দরজা আটকে দিলেন। সবাই চেচামেচি করছে কিন্তু যা হবার তা তো হয়েই গেলো! মিজান সাহেব ছাঁদ থেকে লাফ দিয়ে নিজের প্রান ত্যাগ করলেন! সবাই দৌড়ে নিচে যায়! এম্বুলেন্সে কল করে কারন তখনও মিজা সাহেব বেঁচে ছিলেন। তানহা, তামান্না, মিরা, সবাই হাউমাউ করে কাঁদছে। মিজা সাহেব আধভাঙ্গা গলায় কথা বলেন,
-‘ তামান্না তো বাবা বলে ডাকলো এবার আমার বাকি দু’টো মেয়ে যদি একবার আমাকে বাবা বলে ডাকতো শেষবারের জন্য তাহলে হয়তো শান্তি পেতাম। পারলে ক্ষমা করে দিস। তোদের চোখে ঘৃ’না দেখে বাঁচতে পারবো না আমি। তোর মা’কে ও বলে দিস যাতে ক্ষমা করে। আমার পা’পের শা’স্তি আমি পেয়েছি। ‘
তানহা, মিরা বাবা বলে চিৎকার করে ওঠলো! ততোক্ষণে মিজান সাহেব দুনিয়ায় মায়া ত্যাগ করে চলে গেলেন! তানহার মা চুপটি করে আছে কোনো কথা নেই। তামান্না আর তামান্নার মা নিরব দর্শক! তবে তামান্নার চোখে অশ্রু জলজল করছে শেষবেলায় তো লোকটা তাকে মেয়ে বলেছে? পেরেছে বাবা ডাকতে! পুরো পরিবেশ নিস্তব্ধতায় গ্রাস করেছে! এভাবে কাঁদতে কাঁদতে তানহা অজ্ঞান হয়ে যায়! জ্ঞান ফিরতেই দেখে মিজান সাহেবের দাফ’ন কার্য সমপন্ন হয়েছে! দুপুর থেকে সন্ধ্যা হয়ে গেছে! শোকে স্তব্ধ আছে এখনো পুরো মানুষজন। ওদিকে দা’ফনের জন্য তামান্নাকে পু’লিশ নিয়ে যায়নি তবে এখন নিতে এসেছে। তামান্না অশ্রুজল চোখে তানহার পাশে গিয়ে দাঁড়ালো।
-‘ আমি দেখেছিলাম তখন তোকে। আমি জানতাম তুই ভিডিও করছিস তাই তো মা’কে বলার আগে সবটা খুলে বলি যাতে আমার অন্যা’য়ের শা’স্তি আমি পাই। আড়চোখে তোকে যখন দেখেছি মাটিতে বসে কাঁদতে তখন কেনো জানি আমারও খুব কষ্ট হচ্ছিলো জানিস? মনে হচ্ছিলো বারবার এই তুই তো আমাকে কম সাহায্য করিস নি। আজকে একটা মানুষের জন্য আমি তোর পিছু লেগেছি! অনুশোচনায় ভুগতে থাকি। তৎক্ষনাৎ সিদ্ধান্ত নিই আমি যা করেছি তার ফল ভো’গ করবো আমি। তাই সবটা খুলে বলতে থাকি যাতে তুই নিজের হাতো আমাকে আমার করা অন্যা’য়ের জন্য শা’স্তি দিস! আর হলোও ঠিক তাই। তুই নিজের হাতেই আমাকে শা’স্তি দিলি। এবার আমি চলে যাচ্ছি শান্তি মতন। শুধু বলবো তোদের এই বড়ো বাড়িটুকুতে আমার মা’কে একটুখানি আশ্রয় দিস। আর পারলে আমাকে ক্ষমা করে দিস।’
-‘ আগেও তুমি ভূল করেছে আর এখনো তুমি ভূল করছো! পু’লিশ তানহা নয় আমি ডেকেছি। যাই হউক কম কষ্ট পাইনি তোমার জন্য আমরা দু’জনে। ভালোবাসতাম তবুও ঘৃ’না দেখেছি তানহার চোখে শুধু তোমার জন্য তাই তোমাকে ক্ষমা করবার মতন মহৎ গুন আমার নেই। ‘
-‘ তুই আমার বেস্ট ফ্রেন্ড ছিলিস সেটা অতীতে তবে এখন আর নেই। যা করেছিস আমার সঙ্গে সেটা কখনোই ভুলতে পারবো না সে যতোই আমার বাবা দায়ী থাকুক না কেনো। তবে যদি শুধরোতে পারিস তবে আসিস মেনে নিবো বোন হিসাবে।’
তামান্না চলে যায়। তামান্নার মা-ও চলে যায়। তানহা আর মিরা ওদের মা’কে নিজের কাছে রেখে দেয়। স্বামীর কর্মকান্ড আর অকস্মাৎ মৃত্যু যেনো উনাকে পাথর করে দিয়েছে!
দেখতে দেখতে বেশ ক’দিন পার হয়ে গেছে। এখনো মিজান সাহেবের শোক থাকলেও সবাই চেষ্টা করছে নিজেকে ওখান থেকে বেরিয়ে আনার। তানহার মা-ও স্বাভাবিক হয়েছে একটু একটু সে এখন তানহার চাচাদের সঙ্গে থাকে। তামান্নার মা-ও সেই বস্তিতেই থাকে। শুধু খরচাটুকু আয়মান দিয়ে দেয়। মিরা আর নির্জন আগের মতনই আছে। রাসেল এখনো অপেক্ষা করে আছে কবে তামান্না সংশোধিত হয়ে ফিরবে কারন তার ভালোবাসা যে সত্যি! সে সত্যিই তামান্নাকে ভালোবাসে আর তার জন্য অপেক্ষা যতোদিন করতে হয় রাসেল করবে। সবশেষে সবাই এগিয়ে গেছে শুধু থম মে’রে আছে তানহা আর আয়মানের জীবন।অফিস থেকে ফেরার পথে একটা লাল টুকটুকে শাড়ি নিয়েছে তানহার জন্য, উদ্দেশ্য সম্পর্কটা আরো একটু এগোবার…..
বাড়িতে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে পুরো রুমে কোথাও তানহাকে খুঁজে পেলো না আয়মান। শেষে বারান্দায় চোখ পড়তেই দেখা মিললো তানহার! এক পলকে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে। মিজান সাহেব যাবার পর থেকেই তানহা এরম চুপচাপ, তামান্নার সত্যি, মিজান সাহেবের মৃত্যু সব মিলিয়ে এখনো পুরোটা কাটিয়ে ওঠতে পারেনি তানহা! আয়মান অতি যত্নে তানহার কাছে গেলো।
-‘ আজও এভাবে দাঁড়িয়ে থাকবে? কেনো জানি মনে হচ্ছে আমি যদি সবাইকে সত্যি টা না বলতাম তাহলে হয়তো তোমার বাবা ওরম করতেন না।’
-‘ আপনার কোনো দোষ নেই। সত্যি লুকানো যায় না। তবে বাবা চলে গেছেন এটা উনার আরো একটা চরম ভূল! নিজের জীবন থেকে তামান্নার থেকে, আমার থেকে, মিরার থেকে, মায়ের থেকে সবার থেকে পালা’তে উনি চলে গেছেন নিঃশব্দে। ভালো থাকুক উনি। ‘
-‘ বেশ আমি ধরে নিবো এতে আমি দায়ী নই যদি তুমি আমার কথা শোনো।’
-‘ বেশ বলুন তাহলে কি কথা?’
-‘ এই শাড়িটি পড়ে চলো আবারো আমরা রাতের শহড়টাকে দেখতে বেরিয়ে পড়ি?’
-‘ চলুন তাহলে।’
তানহা রেডি হয়ে আসলো। বরাবরের মতনই আয়মান তানহার রূপে মুগ্ধ হলো। বেরিয়ে পড়লো রাতের শহড়ে। হাত দু’টি একসঙ্গে ধরে হেঁটে চলেছে অজানা রাস্তায়, যে রাস্তায় শুধু আয়মানই আছে। হাঁটতে হাঁটতে একসময় ক্লান্ত হয়ে রিকশায় চড়ে বসলো। তানহা সযত্নে আয়মানের কাঁধে তার ক্লান্ত মক’থা এলিয়ে দিলো। আয়মানও তানহার হাত দু’টি নিজের মধ্যে রেখে তানহার কপালদ্বয়ে তার উষ্ঠের শীতল পরশ দিলো।
-‘ ভালোবাসি তোমাকে তানহা! সেবারো উত্তর দাওনি এবার বলো?’
-‘ ভালোবাসি আমিও আপনাকে। সকল ভুল বুঝাবুঝির অবসান ঘটিয়ে আমার শুধু আপনাকেই লাগবে। ‘
আয়মানও মুচকি হেঁসে তার প্রেয়সি যে একসময় #অপ্রিয়_প্রেয়সী ছিলো সেই প্রেয়সীকে নিজের কাছে টে’নে নিলো! রিক্সা থেকে নেমে আবারো হাঁটা ধরলো তাদের নিজ গন্তব্য স্থলে। হাত দু’টি দু’জনের একসঙ্গে রেখে। বাড়িতে গিয়ে ক্লান্ত শরীর দু’টো বিছানায় এলিয়ে দিলো। আয়মান আবারো তার প্রেয়সীকে তার নিজ বাহুডোরে আবদ্ধ করে নিলো। এ যেনো বহু প্রতীক্ষার ফল হিসাবে আজকে রাতটুকু এসেছে তাদের জীবনে।
ভালো থাকুক সকল ভালোবাসা।
——————-সমাপ্ত —————