#অপ্রিয় প্রেয়সীর ভালোবাসা — [২]
#মুনিয়া_মিরাতুল_নিহা
________________________
-‘ আমি ম’রে গেলেও কিছুতেই এই ছেলেকে বিয়ে করতে পারবো না মা!’
হইচইপূর্ণ পরিবেশ নিমিষেই স্তব্ধতায় গ্রাস করলো তানহার বলা কথা গুলো শুনে। প্রত্যেকের দৃষ্টি নিবদ্ধ তানহার দিকে। সবার মুখশ্রী এখন আগ্রহে পরিপূর্ণ হয়ে রয়েছে কানায় কানায়। সবারই এক প্রশ্ন কেনো তানহা বিয়ে আটকাতে চাইছে? কিছুক্ষণ আগের ঘটনা….
-‘ আপনি কোনো চিন্তা করবেন না। আমার ছোটো ছেলের করা ভুলের খে’সা’রত সে দিয়েছে কিন্তু তার জন্য তানহার যে ক্ষ’তি হলো তার খেে’সা’রত আমি দিবো। এই ছবিটা দেখুন এটা আমার বড়ো ছেলে আয়মান। ও বিদেশে থাকে ফ্যামিলি বিজনেস দেখার জন্য। আজকেই দেশে ফিরবে তার ছোটো ভাইয়ের বিয়ে দেখার জন্য। অলরেডি রাস্তায় আছে আমি ওকে বলে দিয়েছি সবটা ও বাড়িতে না গিয়ে এক্ষুনি এখানে আসবে। সে রাজি হয়েছে। আর পাত্রী পছন্দ করবে না এরুপ কোনো ভয় নেই কারন ও আমাকে কথা দিয়েছে ও মেয়ে না দেখেই বিয়ে করবে।’
তানহা অশ্রু সিক্ত অক্ষিজোরা গিয়ে স্থির হয় ফোনের স্ক্রিনের পানে চেয়ে। স্ক্রিনে থাকা আয়মান নামক মানবটিকে দেখে তানহার কান্নার পরিমান যেনো আরো দ্রুত গতি বেগে বৃদ্ধি পেলো কিয়ৎক্ষনের ভিতরেই। এই তো সেই মানুষ যার জন্য কলেজ ছেড়ে অন্য কলেজে স্থানান্তরিত হতে হয়েছিলো আমাকে। পুরো একটি বছর নষ্ট হয়েছিলো আমার!…
কিছুক্ষণের জন্য মস্তিষ্কে আ’ঘা’ত হানে পুরনো তিক্ত স্মৃতি। চক্ষু জোড়া ঘৃ’নার দৃষ্টি সহকারে ফিরিয়ে নিলাম ফোনের স্ক্রিনে থাকা মানুষটির থেকে। তারপরেই কন্ঠে দৃঢ়তা বজায় রেখে সকলের সামনে বিয়েতে বাঁধা দিলাম….
-‘ তানহা মা আমার তুই কেনো এই বিয়ে করতে পারবি না বল? মিরার তো বিয়ে হয়ে গেলো যেখানে তোর বিয়ের কথা ছিলো আজকে তাহলে? আর সবচেয়ে বড়ো কথা হলো এই বিয়েটা হলে তোরা দু’বোনে একসঙ্গে থাকতে পারবি আর বেয়াই সাহেবের উপর আমার পুরো আস্থা রয়েছে উনাদের সঙ্গে তো আমাদের পরিচয় আগ থেকেই আছে উনি তো তোর বাবার চেনা। আয়মান উনার ছেলে। আস্থা আছে খা’রা’প হবে না। আশা করি তুই এই বিয়ে করে অসুখী হবি না।’
-‘ কিন্তু মা তুমি**
-‘ কিসের কিন্তু তানহা? তোর মা যা বলছে আমারো সেই একই কথা। বিয়েটা করে নে মা। আমি জানি এই সমাজে বিয়ে ভে’ঙে যাওয়া মেয়ের বেঁচে থাকা কতোটা দায়! তুই আর দ্বিমত করিস না। রাজি হয়ে বিয়েতে।’
উপরোক্ত বাক্যগুলো আমার কর্নদ্বয়ে পৌঁছাতেই আমি নিথর দৃষ্টিতে বাবার দিকে তাকালাম। বাবার সেই আকুতি ভরা অক্ষি যুগল দ্বয়ের আবদার কোনোমতেই আমার পক্ষে ফিরিয়ে দেওয়া সম্ভব না! উপায়ন্তর না পেয়ে তার বাবার দিকে গিয়ে মাথা দুলিয়ে হ্যাঁ নামক সম্মতি বোঝালাম যার অর্থ আমি বিয়ে করবো।
ইতিমধ্যেই মিরাকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে রুমের ভেতরে সাজগোজের জন্য। আমি পুতুলের ন্যায় বসে আছে। কিছুক্ষণ পর কি হবে সেটা ভাবতেই অদ্ভুত অনুভুতি হচ্ছে! কি নি’ষ্ঠুর নিয়তি যার থেকে পালানোর জন্য এতোকিছু করলাম সে-ই আমার সঙ্গে থাকবে আজীবন! কিছুক্ষণের ভিতরে শুনতে পেলাম বাহিরের শোরগোল!
‘বর এসেছে’ কথাটি শোনা মাত্রই মায়ের নির্দেশ অনুসারে মাথায় ঘোমটা টেনে বসে রইলাম কনের স্থানে।
একসময় অনুভব করলাম তিক্ততায় ভরা মানুষটি আমার পাশেই বসে রয়েছে।
তানহার মা ঘোমটা বেশ বড়ো করেই দিয়েছে যার ফলে তানহার মুখ দেখা যাচ্ছে না। কাজী বিয়ে পড়ানো শুরু করলো একসময় কবুল বলতে বললে তানহা নির্দ্বিধায় কবুল নামক তিনটি পবিত্র শব্দ উচ্চারণ করে সবার সম্মুখ সমরে আয়মান নামক মানুষটির বউয়ের পরিচয়ে আবদ্ধ হলো! সকলের মুখে এবার দেখা মিললো প্রশান্ত হাসির রেখা। সবশেষে বর আর কনেকে একসঙ্গে সোফায় বসানো হলো মিষ্টিমুখ করানোর জন্য। আয়মান মিষ্টিমুখ করানোর জন্য বউয়ের ঘোমটা খুলে মিষ্টি তার অধরজোরার সামনে থেকেই পড়ে গেলো! তানহার সজল দৃষ্টি তৎক্ষনাৎ যায় আয়মানের নিকট। আয়মান স্তম্ভিত নয়ন নিয়ে তানহার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে। তানহাও তাকিয়ে রয়েছে। আর কারোর বোধগম্য না হলেও তানহা ঠিকই বুঝতে পেরেছে মিষ্টি হাত থেকে পড়ে যাবার কারন। তবে সেই প্রকাশতা নিজের নিকট রেখে দিয়ে চুপটি করে আগের ন্যায় মাথা নিচু করে বসে থাকে। সকলের কথানুযায়ী আয়মান আবারো মিষ্টি খাওয়াতে গেলো এবার খুব সযত্নে মিষ্টি খাইয়ে দিলো।
ওদিকে মিরারও সাজগোজ প্রায় শেষ করে মিরা আর নির্জন দু’জন হাসিমুখে সবার সামনে এসে দাঁড়িয়ে রয়েছে। সবথেকে বেশি উৎফুল্ল লাগছে নির্জনকে অথচ এই তার জন্যই কিয়ৎক্ষন আগে দু’টি মেয়ের জীবন নিয়ে টানা হে’চড়া হচ্ছিলো! আনোয়ার সাহেবের কথায় দুই বধূকে বিদায়ের বন্দোবস্ত করা হলো। মিরা অশ্রুসিক্ত নয়ন জোড়া নিয়ে তার বাবার পদযুগল দ্বয়ের কাছে গিয়ে ঝাপটে ধরে ক্ষমা প্রার্থনা করে নেয়। বাবাও তার মাথায় হাত রেখে আশ্বাস দেয়। যতোই হউক একসঙ্গে দু দু’টো মেয়ে বিদায় নিচ্ছে।
বাবা মা’কে জরিয়ে দু বোনের সেই আপ্লূত কান্না উপস্থিত বেশ কয়েকজনের মনেই নাড়া দিয়ে ওঠলো! একসময় সকল অশ্রুকে বিদায় দিয়ে মেয়ে দু’টোকে বিদায় দিয়ে দেয় দীর্ঘবছর ধরে আগলে রাখা পরম মমতা ভরা বাবা মা! অতিথিরাও চলে গেছে। এখন পুরো বাড়ি শূন্য প্রায় মিরা আর তানহাকে ছাড়া!
___________________________________
মঞ্জিল ভিলা বধূ বরনের আবেশে ছেয়ে গেছে পুরো। তার উপর সব থেকে খুশি হয়েছে আনোয়ার সাহেবের স্ত্রী। আয়মান দেশে ফিরেছে তা-ও বউ সঙ্গে করে নিয়ে! যে কি-না বিয়ে করবে না বলে একটা নিছক অযুহাতে চলে গেছিলো!
তার বড়ো ছেলে বিয়ে করেছে শুনে ছোটো ছেলের কীর্তির কথা বেমালুম ভুলে গেলো। তার বক্তব্য খা’রা’প থেকে যদি ভালো কিছু হয় তাহলে হউক না সে ভালো। এমনিতেই তার বড়ো ছেলে তো বিয়ে করবে না বলেই বিদেশে চলে গেছিলো। এখন তার ছোটো ছেলের জন্য একেবারে বউ নিয়ে ফিরলো এতেই খুশি। একে একে দুই নববধূকে বরন করে সব নিয়ম কানুন মেনে ঘরে প্রবেশ করানো হয়। মিরা আর নির্জনের চোখে মুখে আনন্দের উৎফুল্লতা বেশ লক্ষনীয়। যেনো এই দিনটার জন্যই দুজনে কতো অপেক্ষা করেছে! বোঝাই যাচ্ছে না তাদের বিয়ে কি এক পরিস্থিতিতে হয়েছে।
কিন্তু তানহা আর আয়মান চুপটি করে বসে রয়েছে কোনো কথার রেশ নেই কারো মুখে। সবচেয়ে স্তম্ভিত আয়মান হয়েছে তানহাকে নিজের বধূ বেশে দেখে।
পাড়া প্রতিবেশী সবাই এসে দু বউ দেখে একেবারে ধন্যি ধন্যি! দুই বউই দেখতে যথেষ্ট সুন্দরী। ছোটো ভাই বিয়ে করতে যেয়ে বড়ো ভাইও বিয়ে করে এসেছে এ নিয়ে বেশ কথাও শোনা যাচ্ছে। কিছুক্ষণের ভিতর সবার বউ দেখা শেষ হয়ে যেতেই নির্জন আর মিরাকে তাদের রুমে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
বধূ বেশে আয়মানের জন্য অপেক্ষা করছি ফুলে সজ্জিত খাটের উপর। এতোক্ষণ উনি চুপ করে ছিলেন আশেপাশোর মানুষের জন্য না জানি এখন কি হবে আমার সঙ্গে? জানিনা কিসের প্র’তি’শোধ নিবেন আমার উপর! আমার চিন্তা ভাবনার মাঝখানেই দরজা ঠেলে উনি ভিতরে ঢুকলেন।
-‘ কিচ্ছু শুনতে চাই না আমি তোমার থেকে। আমি জানি বিয়েটা একটা পরিস্থিতির চা’পে পড়ে হয়েছে। নির্জন যদি ওরকম কাজ না করতো তো তুমিই আজকে আমার ভাইয়ের বউ হতে। আমি চাইনি তোমার সঙ্গে আবার দেখা হউক আমার। যাকে ছেড়ে চলে গেছিলাম একেবারের জন্য ভাগ্য তার কাছেই এনে ফেললো!’
বিয়ের প্রথম রাত্রি। নিজের বরের মুখ থেকে এরকম তুচ্ছ তা’ছি’ল্য কথা শুনে বেশ কষ্ট হচ্ছে! যতোই হউক উনি এখন আমার স্বামী। কিন্ত যা হচ্ছে সে তো কেবল আমারই জন্য হচ্ছে সে আমি যতোই অতীত ভুলে থাকতে চাই না কেনো বর্তমান আমাকে বারবার অতীত নিয়ে প্রশ্ন ছুড়বে আর আমাকে সেগুলো নিয়েই এগোতে হবে।
-‘ তাহলে বিয়েটা না করলেই পারতেন। মুক্তই থাকতেন ঠিক তিন বছর ধরে যেরকম চলে গেছিলেন।’
-‘ ভুলে যেও না আমি অতো উৎফুল্ল মনে তোমাকে নিজের স্ত্রী হিসাবে আনিনি। এক প্রকার বাধ্য হয়েই সবটা করতে হয়েছে। তোমার আর আমার রাস্তা তো সেদিনই আলাদা হয়ে গেছিলো ভাবিনি আবারো জোড়া লেগে যাবে! তবে হয়তো আবারো অতীত পুনরাবৃত্তি হলেও হতে পারে। কিংবা যেই রাস্তা টা আলাদা হয়ে গেছিলো সেটা জোড়া লাগলেও লাগতে পারে তবে সেই সম্ভাবনা খুবই কম। অতীতের পুনরাবৃত্তি হবার সম্ভাবনা খুব বেশি।’
#চলবে?