#অপ্রিস সে
#সানজিদা সন্ধি
# পর্বঃ১৭
আহানা তার ছোট্ট কিচেনে রান্না করতে ব্যাস্ত হয়ে পড়লো। রিমু আর সাদিয়াও তার সাথে গেলো। রিমু হাতে হাতে সাহায্য করছে আর সাদিয়া চুপচাপ বসে আছে।
একসময় অন্য মনস্ক হয়ে সাদিয়া বলে উঠলো, ” জানিস রিমু? রূপম ভাইকে আমার ভীষণ পছন্দ হয়েছে। কত ভালো মানুষ তিনি। যদিও তার কারণে তুই অনেক কষ্ট পেয়েছিস! কিন্তু বিশ্বাডলস কর। সে অনেক ভালো। ”
সাদিয়ার কথা শেষ হওয়ার সাথে সাথেই রিমু বলে উঠলো, ” বুঝলাম! তাহলে অন্যের দালালী করতে এসেছিস। আমার খোঁজ নিতে নয়। ”
দালালী শব্দটা কেমন জানি ঠেকলো সাদিয়ার কাছে। সে সচকিত হয়ে বললো, ” রিমু তোর শব্দচয়ন বাজে ঠেকলো আমার কাছে। তোর মধ্যে আচরণ গত সমস্যা দেখা দিচ্ছে। ঠিক করে নেওয়ার চেষ্টা করা উচিৎ। আগের নম্র আচরণ টাই কাম্য তোর কাছে।
রিমু আরো রেগে বললো, ” এখন আমার কথা কেন ভালো লাগবে তোর কাছে? আমার সাধারণ কথাবার্তাও তোর কাছে বিরক্তিকর, ভন্ড মনে হবে৷ কী বলতো অন্যের দালালী করতে এসেছিস তো তাই!”
চ
বারবার দালালী দালালী বলাতে সাদিয়ার মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো। সে কথা না বাড়াতে চেয়ে উঠে যেতে ধরলো।
রিমু তার পথ আটকে বললো, ” কী রে দালালীতে সুবিধা করতে না পেরে বুঝি চলে যাচ্ছিস? আহারে। শোন কারো হয়ে আমার সামনে সাফাই গাইতে আসবি না। আর আপাতত আমি তোর মুখটাই দেখতে চাচ্ছি না দয়া করে দেখাতে আসিস না। ”
এতক্ষণ রাগ লাগলেও এবার মনে প্রচন্ড রকম আঘাত পেলো সাদিয়া।
সে নম্র ভাবে বললো, ” রিমু আমি তোর সাথেই দেখা করতে এসেছিলাম। কারো দালালী করতে নয়। আর তুই না বুঝে না শুনে যা নয় তাই বললি। কথাবার্তা বুঝে শুনে বলা উচিত। এটার উপর অনেক কিছু নির্ভরশীল। সুন্দর সম্পর্ক নষ্ট হয়ে যেতে পারে অযৌক্তিক কথার কারণে আবার সুন্দর সম্পর্ক গড়তেও পারে সুমিষ্ট কথার কারণে। আজকে তুই অনেক বেশিই বলে ফেললি। আমার মুখ দর্শন করতে চাইছিস না ঠিক আছে। আমি দেখা দেবো না। কিন্তু কোনো একদিন এমনও হতে পারে আমার মুখ দেখতে চাইবে অনেক করে। কিন্তু পাবিনা। ভালো থাকিস। অযৌক্তিকতায় আজ মনে কষ্ট দিয়ে ফেললি।” কথাগুলো বলে এক মুহুর্তের জন্যেও দাঁড়ালো না সাদিয়া। পেছন থেকে আহানা ডাকলো তাকে বেশ কয়েকবার। কিন্তু পিছু ফিরে তাকালো না সাদিয়া।
বাসায় ফিরে ঋষির ফোন পেলো সে। রিসিভ করতেই ঋষি জিজ্ঞেস করলো, ” রিমুর সাথে কথা হয়েছে আপনার? ”
সাদিয়া ধরা গলায় বললো, ” হু। ” তার গলাটা শুকিয়ে এসেছে। কান্নাগুলো দলা পাকিয়ে গলাতেই আটকে আছে। তবে এখন তৃষ্ণা মেটাতে পানি পান করলে আরো বেশি তেষ্টা পাবে তার।
ঋষি সাদিয়ার কন্ঠস্বর শুনে জিজ্ঞেস করলো, ” এনি প্রবলেম? ”
সাদিয়া এবার হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো একজন সল্প পরিচিত মানুষের সামনে। যেখানে তার কান্না দেখা বা শোনার সুযোগ খুব কম মানুষেরই হয়েছে। নিজের ভেতর জ্বলে পুড়ে গেলেও কাউকে জানতে দেয়না সে। অথচ আজ প্রিয় বান্ধবীর আচরণ তাকে এতটাই মর্মাহত করেছে যে সে সামলাতেই পারছে না নিজেকে।
হুট করে সাদিয়ার কান্না শুনে বিব্রত হলো ঋষি। সাথে তার ভীষণ কষ্টও হচ্ছে। সে বুঝতে পারছেনা কেন সে এমনটা অনুভব করছে। একজন সল্প পরিচিতার কান্নায় এমন কী আছে যা তাকে প্রভাবিত করছে? এর সাথে তো শুধুমাত্র ফ্ল্যাট করাই উদ্দেশ্য ছিলো ঋষির। কোনো ভাবে সে মায়ার বাঁধনে জড়িয়ে পড়ছে না তো?
ঋষি শান্ত হতে বললো সাদিয়াকে। তারপর ধীরে ধীরে সবটা জানতে চাইতেই সাদিয়া বললো, ” বন্ধুত্বে মান অভিমান। ”
মানুষ মাত্রই কৌতুহল প্রবণ। ঋষিও এর ব্যাতিক্রম নয়। কৌতুহল বশত সে জানতে চাইলো কী নিয়ে মান অভিমান হয়েছে।
সাদিয়া প্রশ্নটা শুনে বিরক্তবোধ করলেও সহজভাবে জবাব দিলো, ” বন্ধুদের মাঝে অনেক কিছু নিয়েই মান অভিমান হয়। আবার ঠিকও হয়ে যায়। এসব বন্ধুমহলেই সীমাবদ্ধ থাকা ভালো। এসব নিয়ে বাহিরে আলোচনা করা পছন্দ নয় আমার। কিছু জিনিস একান্তই থাক!”
ঋষি মুগ্ধ হলো সাদিয়ার কথায়। মেয়েটার ব্যাক্তিত্ব আছে বলতে হবে। তারপরও বললো কিছু জানানোর মতো হলে নির্দ্বিধায় জানাতে পারবেন। আমি অপেক্ষায় থাকবো। এবার আর কাঁদিয়েন না। কষ্ট হচ্ছে আমার।
সাদিয়া কৌতুহলী হয়ে বললো, ” আমার জন্য কষ্ট? তাও আবার পাবেন আপনি? ”
মুহুর্তেই গলার স্বরে তার পরিবর্তন এলো। খানিকটা কৌতুকের স্বরেই বললো সাদিয়া, ” আপনি তো ফ্ল্যাটিং এর কোনো র্যাংক থাকলে সেখানে ফার্স্ট হতেন। এতো ভালো ফ্ল্যাটিং শিখেছেন কার কাছে?
ঋষি গলা খাকাড়ি দিয়ে বললো, আমার শুদ্ধতম অনুভুতি গুলোকে ফ্ল্যাটিং মনে হচ্ছে? এটা কী ঠিক?
সাদিয়া বললো, ” আসলে কী বলুন তো! আপনি এখন ঠিকঠাক ফ্ল্যাটিংটা শিখতে পারলেন না। আফসোস। ”
ঋষি খানিকটা চকমক করে বললো, ” শিখতে পারিনি এখনো তাতে কী? একদিন ঠিক শিখবো। ”
রিমু রেগে বললো, ” আর শিখে কাজ নেই।”
রূপমের কিছুই ভালো লাগছে না। ডাইনিং টেবিলে গিয়ে সে দেখলো রেহনুমা আর রিয়াজুল করিমের মুখ থমথমে হয়ে আছে। মেয়ে বাড়িতে না থাকাতে দুজনেই মুখই থমথমে।
রূপম সবার সামনেই তাদের সরি বললো তারপর বললো, ” আমার জন্য এত বাজে কিছু হবে এ যেন কল্পনাতীত ছিলো আমার জন্য। কিন্তু চোখের সামনে এত কিছু নিতে পারছিনা আমি। কোনক্রমেই পারছিনা। সবাই আমাকে মাফ করে দিন।
রিমুর বাবা বললো, ” শুধুমাত্র নিজেকে দোষী করা বন্ধ কর রূপম। আমাদের দোষও অনেক আছে। আমরা রিমুকে অবহেলা করেছি। সেখানে তোর দোষ কী করে থাকতে পারে? আমার কী পুতুল না কি যে আমাদের ভালো মন্দ বিচারের ক্ষমতা নেই? তুই যেভাবে নাচাবি সেভাবেই নাচবো? মোট কথা আমাদের স্বদিচ্ছার অভাব ছিলো মেয়েকে আগলে রাখার। সেখানে তুই কোনোভাবেই দ্বায়ী হতে পারিসনা। ”
রূপম বললো, ” আর স্বান্তনা দিও না চাচ্চু।
এতো স্বান্তনার ভার বইতে পারছিনা আমি। এতো করুণা, দয়া কী করে নিবো আমি? ইচ্ছে করছে মরে যাই। রূপমের মতো শক্ত ছেলেটার মুখে এমন কথা সবাইকে মর্মাহত করলো।
রূপম খাবার টেবিলে বসেই রিমুকে ফোন দিয়ে বললো সে খেয়েছে কী না! রিমু আবার ছোট বড় বেশকিছু কথা শুনিয়ে দিলো। রিমুর কথার ধরণ শুনে সবাই বিরক্ত বোধ করতে লাগলো। রূপমের ইচ্ছে হলোনা পূণরায় রিমুর সাথে যোগাযোগ করতে। কারণ তার কথাবার্তা কেমন কেমন যেন হয়ে গেছে কদিনেই। কিন্তু যোগাযোগ না করলেও শান্তি পাবে না রূপম।
সে কঠোর ছিলো তখনই ভালো ছিলো। যেই নিজের আবেগ অনুভূতিকে প্রশ্রয় দিলো অমনি নিজেকে হারিয়ে ফেলতে শুরু করলো। এজন্যই বোধহয় নিজেকে শক্ত খোলসে আবৃত রাখাই ভালো। নিজের ভালোর জন্য।
রূপম কিছু না খেয়েই উঠে গেলো। সে খুব ভালোই বুঝতে পারলো দিন দিন সে ডিপ্রেশনে পড়ে যাচ্ছে। কিন্তু নিজেকে ডিপ্রেশনে ফেলার মানেই নেই তার। বেশ কয়েকদিন ধরে মন মতো গান গাওয়া হয়নি রূপমের। বলা চলে সুযোগ পায়নি। রূপম তার প্রিয় গিটারটা হাতে নিয়ে টুং টুং সুর তোলার চেষ্টা করলো। কিন্তু সে কিছুতেই পারছেনা ঠিকমতো সুর তুলতে। এভাবে আরো বেশ কয়েকবার চেষ্টা করেও যখন দেখলো কোনো লাভ হচ্ছে না তখনই সে বেলকনিতে উঠে এলো। একটুখানি স্বস্তির আশায়। বেলকনিতে বেশ কয়েকটা লতা বাহারের গাছ আছে। পাতা বাহারও আছে বেশ কয়েকটা। রূপম হাত দিয়ে স্পর্শ করলো সেগুলো। তার মনে হলো রিমুর সাথে দেখা করাটা দরকার তার। ভীষণ রকমের দরকার।
চলবে,,,