#অপ্রিয়_জনাব
#Mehek_Enayya(লেখিকা)
#পর্ব_০৬
-না এটা হতে পারে না। উনার সংসারে উনাকে যে প্রয়োজন! আমি খনিকের মেহমান মাত্র এই গৃহের।
উপমাকে স্থির ভাবে ধরে রাখতে পারছে না তারা। এহেন পাগলের মতো আচরণ করতে দেখে সাইয়েরা আচমকা উপমার গালে চড় দিয়ে বসে। মুহূর্তেই চোখ খুলে ফেলে উপমা। হাঁসফাঁস করতে থাকে। গলা শুকিয়ে আসে তার। বড় বড় চোখ করে আশেপাশে তাকায়। জানালা দিয়ে সূর্যের আলো কক্ষের ভিতরে প্রবেশ করছে। মাথা ব্যাথায় একদম ফেটে যাচ্ছে। ডানপাশে ফিরতেই তাহেরাকে শুয়িত অবস্থায় দেখতে পায় উপমা। শরীরের ওপর থেকে কাঁথা সরিয়ে উঠে বসতে যাবে তখনই পিঠে ভয়ংকর ব্যাথা অনুভব করে। আধশোয়া হয়ে বসে গতরাতের কথা ভাবতে থাকে। তার মা আর নেই দুনিয়ায়। সম্পূর্ণ একা সে। বুকে হাত দিয়ে বড় বড় নিঃশাস নিলো কয়েকবার। চোখের শেষ অশ্রুটুকু মুছে নিজেকে কঠিন করতে লেগে পরে। একের পর এক বুঝ দিতে থাকে নিজেকে।
তাহেরার ঘুম ভাঙতেই উপমাকে আধশোয়া অবস্থায় দেখে ত্বরিত উঠে বসে। উপমাকে জড়িয়ে ধরে বলল,
-ছোট ভাবিজান আপনি ঠিক আছে? আমি আপনার জন্য ভীষণ চিন্তিত ছিলাম।
-আপা কেমন আছে?
তাহেরা চমকিত নয়নে তাকিয়ে রইলো। সে ভেবেছিলো প্রথমে তার মায়ের কথা জিগ্যেস করবে। অবাক স্বরেই বলল,
-আল্লাহর রহমতে বড় ভাবিজান ভালো আছে। কিন্তু এখনও জ্ঞান ফেরেনি।
তপ্ত নিঃশাস ছাড়লো উপমা। তারপর কাঁপা কাঁপা স্বরে বলল,
-আমার মাকে কবর দেওয়া হয়েছে?
-হ্যাঁ, রাতেই তাকে কবর দেওয়া হয়েছে। খোদা তাকে বেহেশতবাসি করবেন।
উপমা মনে মনে আমিন বললেন। তাহেরা বিছানা থেকে নেমে পরে। আলমিরা খুলে একটা সুতির শাড়ী বের করে উপমার হাতে দিয়ে বলল,
-এটা পরে নেন ভাবিজান। আমি আপনার জন্য খাবার আর ঔষধ নিয়ে আসছি।
তাহেরা চলে যায়। উপমা কিছুক্ষন শাড়ীটির পানে তাকিয়ে থেকে ধীরেসুস্থে পরতে শুরু করে।
তুলসী আর মিনা হাসপাতালে গিয়েছে। সাইয়েরা ইয়ামিন আর রুমকিকে খাইয়ে দিচ্ছে। রসইকক্ষে কাজ করছে তুলি, ফাতু। তাহেরা খাবারের থালি নিয়ে সিঁড়িতে পা দিবে তার পূর্বেই তার নজর পরে উপমার ওপর। কোমর ধরে সিঁড়ি বেঁয়ে নিচে আসছে সে। সুন্দর মুখটি অতিরিক্ত কান্নার ফলে সবসময়ের মতো শ্রী দেখাচ্ছে না। তাহেরা বলল,
-আপনি কষ্ট করে কেনো আসলেন ভাবিজান আমিই তো যাচ্ছিলাম।
-আমি আগের থেকে একটু ভালো অনুভব করছি তাই নিজেই আসলাম। এসো দুইজন মিলে খেয়ে নেই তারপর হাসপাতালে যাবো।
-কিন্তু আপনি নিজেই তো অসুস্থ আম্মাজান আপনাকে যেতে বারণ করেছেন।
উপমা চুপ হয়ে গেলো। তাহেরাকে নিয়ে ভোজনশালা গিয়ে চেয়ারে বসে পরে। তাহেরা খেতে খেতে বলল,
-জানেন ভাবিজান প্রথমদিন থেকেই আপনাকে দেখলে আমার কেমন যেনো আপন আপন অনুভূতি হয়।
উপমা স্মিত হাসলো। ধীর কণ্ঠে বলল,
-রক্তের টান বলে তো একটা কথা আছে!
-মানে?
তাহেরা উপমার কথার মানে বুঝলো না। নির্বোধ ভঙ্গিতে তাকিয়ে রইলো। উপমা আর কিছু বলল না।
বাহির থেকে হঠাৎ চিৎকারের আওয়াজ শুনে বুক কেঁপে উঠলো উপমার। চেয়ার থেকে উঠে দ্রুত অন্দরের দ্বারে যেয়ে দাঁড়ায়। বাঁশের সাথে বেঁধে তিনজনকে ইচ্ছেমতো পেটাচ্ছে সোহরাব। পরনে নতুন একটা পাঞ্জাবী। ঘামে সেটাও ভিজে যাচ্ছে। চোখ, মুখে ছড়িয়ে পরছে হিংসতা। গতকাল এই লোকগুলোও ছিল তাঁদের ওপর আক্রমণকারিদের সাথে। হয়তো সৈন্যদল এই তিনজনকেই ধরতে পেরেছে। সোহরাব শেষ বারের মতো তাঁদের জিগ্যেস করলো,
-বল হারা’মজা’দা তোদের কে পাঠিয়েছিল? সহজেই উত্তর দে মুক্তি পাবি আমাকে বেশি ক্লান্ত করলে তোদের পরকালে পাঠাতে আমার এক মিনিটও সময় লাগবে না।
একজনও মুখ ফুটে কিছু বলল না। উপমার মায়া হলো লোকগুলোর ওপর কিন্তু তারা যা করেছে তাঁদের সামনে এই মারও ক্ষীণ। গৃহের ভিতরে চলে যায় উপমা। তাহেরা তাকে বলে,
-মধ্যরাতে ভাইজান গৃহে এসেছেন। শত্রুর দলের লোকদের পাওয়া গেছে শুনে খুশি হয়েছিল তিনি। ভোর থেকে তাঁদের মুখ থেকে কথা বের করার প্রয়াস করছেন। কিন্তু কেউই কিছু বলছে না।
-ওহ।
_____________________
কেটে যায় পনেরোদিন। যত দিন এগোচ্ছে তত সকলের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি হচ্ছে উপমার। মায়ের মৃত্যুর শোক এখনও কাটিয়ে উঠতে পারেনি। যখনই মনে পরে ডুকরে কেঁদে উঠে সে। ছায়াকে সাতদিন আগে গৃহে আনা হয়েছে। সম্পূর্ণ বিশ্রামে থাকতে বলা হয়েছে তাকে। উপমা প্রতিদিন সময় করে একবার ছায়াকে দেখে আসে। ইয়াশার শহরে চলে গিয়েছে। তার আর তাহসিয়ার সামনে পরীক্ষা।যাওয়ার আগে শেষ একবার উপমার সাথে কথা হয়েছিল ইয়াশারের। সোহরাবও ছয়দিন আগে চলে গিয়েছে। ছায়ার জন্য বেশ অনেকদিন গৃহে থেকেছে। সে একজন ডাক্তারও। এতদিন ছুটি কী আর মানায় তাকে।
রাতে খাওয়া শেষ করে নিজ কক্ষে যাচ্ছিলো উপমা। কী মনে করে ছায়ার কক্ষের স্মুখীন পা’জোড়া থেমে যায় তার। একা একা কী করছে ছায়া সেটা দেখার ইচ্ছে জাগলো মনে। ইচ্ছেকে আর দমিয়ে রাখলো না উপমা। দরজা মৃদু আওয়াজ তুলে বলল,
-আসতে পারি?
শুয়ে শুয়ে বই পরছিলো ছায়া। উপমার আগমনে খুশি হলো সে। একা একা কক্ষে নিজেকে মৃত লা’শ মনে হয় তার। প্রশস্ত হেসে বলল,
-এসো এসো।
এগিয়ে আসতে আসতে উপমা বলল,
-আপনাকে বিরক্ত করলাম নাতো আপা?
-একদম না। আমি ভীষণ একা অনুভব করছিলাম।
উপমা হাসলো। ছায়া উপমাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বলল,
-বসো আমার পাশে।
উপমা বসলো। মাথা থেকে ঘোমটা সরিয়ে আরাম করে বসলো। ছায়া বলল,
-মায়ের জন্য খারাপ লাগে?
-যখনই মনে পরে আমার বুঁকের বা’পাশে ভীষণ পীড়া অনুভব হয়।
-আমার জ্ঞান ফেরার পর তার কথা শুনে অনেক কষ্ট পেয়েছিলাম আমি।
উপমার হাসি হাসি মুখ রূপ নিলো ব্যথার্ত। শুকনো ঢোক গিলে বলল,
-আগে তো তাও মনে হতো দুনিয়ায় আমি একা নই আমার মা আছে। এখন যখনই মনে পরে আমি সম্পূর্ণ একা কলিজা কেঁপে উঠে আমার।
ছায়া উপমার এক হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বলল,
-এটা বলো না। তুমি একা কোথায় আমি তোমার বড় বোন রূপে পাশে আছি না?
উপমা হালকা হাসলো। হ্যাঁ বোধক মাথা নাড়ালো। ছায়া নিজের ওপর বিরক্ত হয়ে বলল,
-উফফ আমিও না! কী সকল কথা নিয়ে বলেছি।
-আপা আমাকে আপনাদের বিবাহের কাহিনী শুনান না।
-শুনবে?
ছায়া যেনো আগ্রহ পেলো উপমার কথা শুনে। নিজ জীবনের সুন্দর মুহূর্তের কথা বলতে কার না ভালো লাগে! উপমা প্রতিউত্তরে ফের মাথা নারায়। ছায়া চলন্ত পাখার দিকে তাকিয়ে বলতে শুরু করে তার জীবন কাহিনী।
-বুঝের বয়স হওয়ার পর থেকে আমি সোহরাবকে চিনতাম, দেখতাম। কোনো পারিবারিক অনুষ্ঠান হলেই আমরা একজন আরেকজনের বাসায় বেড়াতে যেতাম বা তারা আসতো। যখন আমার বয়স পনেরো তখন আমি অনুভব করি সোহরাবের প্রতি আমার কোনোরকম ভাইয়ের অনুভূতি হয় না এক অন্যরকম অনুভূতি তার প্রতি আমার। সর্বক্ষণ মন চাইতো তার আশেপাশে ঘুরাঘুরি করি। তাকে নয়নের সামনে বসিয়ে রাখি। ঐ কৃষ্ণবর্ণ পুরুষকে আমার চোখে অত্যাধিক সুদর্শন মনে হতো। মনে হতো তার চেয়ে সুদর্শন পুরুষ এই পৃথিবীতে নেই। কিন্তু সে ছিল একরোগা মানুষ। কারো সাথে প্রয়োজন ছাড়া কথা বলতো না। বেশি হাসতো না।
আমার অন্য বোনরা যখন জানতে পারলো উনার প্রতি আমার প্রেম প্রেম অনুভূতি তখন তারা আমাকে নিয়ে মজা করে। তৃস্কার স্বরে বলে ছায়া রে তুই আর পুরুষ পেলি না ভালোবাসার জন্য কোথায় ও কালাচান, কোথায় তুই সাদাচাঁদ। তাঁদের সেই কথায় আমার কিশোরী মন ক্ষুন্ন হয়। এক সপ্তাহ তাঁদের সাথে কথা বলিনি। আমার অনেক সময় মন চাইতো সোহরাবকে আমার মনের কথা বলি কিন্তু তাকে দেখলেই ভয়ে হাত পা কাঁপতো। সময় যেতে থাকে তার সাথে আমার অনুভূতি গুলোও বিশাল বড় আকারে রূপ নেয়। আমি সব কিসমতের ওপর ছেড়ে দিলাম। হঠাৎই একদিন ফুপ্পিমা মানে আমার আম্মাজান আমার জন্য বিবাহের প্রস্তাব দিলেন আম্মা আব্বার কাছে। সেইদিন আমার জীবনের সবচেয়ে বেশি আনন্দময় দিন ছিল।
সকলের মতামতে আমাদের বিবাহ সম্পূর্ণ হয়। তখন আমার বয়স বিশ আর উনার বয়স সাতাশ। বিবাহের প্রথম রাতে বোন, ননদরা মিলে ফুলে সজ্জিত কক্ষে বসিয়ে দিয়ে যায় আমাকে। প্রিয়তমকে নিজের করে পাওয়ার হাজারো স্বপ্ন দেখতে থাকি আমি বসে বসে। আমাকে বেশিক্ষন অপেক্ষা করতে হয়নি। কিছুসময় পরই তার আগমন ঘটে কক্ষে। ভুল করেও একবার আমার দিকে তাকায় না। নিজের মাথার পাগড়ি খুলতে খুলতে গম্ভীর স্বরে বলে, “পোশাক পরিবর্তন করে শুয়ে পড়ুন আপনি “। তার মুখ থেকে আপনি শুনে মেজাজ গরম হয়ে যায়। বিবাহের আগে সে কখনই আমার সাথে কথা বলেননি। আমি বড় ঘোমটা তুলে তাকে বলি,”আজ আমাদের বিবাহের প্রথম রাত”। প্রতিউত্তরে সে যা বলেছিলো সেটা আমি আজ পর্যন্তও ভুলতে পারিনি। “আমি আপনাকে আগে আমার বোনের নজরে দেখতাম এখন এতো জলদি আপনাকে স্ত্রীর নজরে দেখতে পারছি না আমি। আর আমার মনে হয় না আমি কখন আপনাকে মন প্রাণ থেকে স্ত্রী মানতে পারবো ছায়া “। সেইসময় আমার ছোট মন ভয়ংকর ভাবে ভেঙে যায়। সে কক্ষ থেকে বেরিয়ে যায়। সারারাত কান্না করতে করতে শেষ হয় আমার। তারপর নিজের সাথে নিজেই ওয়াদা করি বেহায়ার মতো তার কাছে নিজের স্ত্রীয় অধিকার চাইবো না। যেদিন সে মন থেকে আমাকে ভালোবাসবে, আমাকে নিজের করে চাইবে সেদিনই আমার ভালোবাসা পূর্ণতা পাবে। অতঃপর সেই দিন আর আসলো না।
শেষের কথাটা বলতে গলা আটকে যায় ছায়ার। একটানা এতক্ষন কথা বলে হাঁপিয়ে উঠেছে সে। উপমা পানি ভর্তি গ্লাস এগিয়ে দিলে মাথা উঁচু করে এক চুমুকেই সবটুকু পানি শেষ করে ফেলে। ছায়া বড় একটি নিঃশাস নিয়ে বলল,
-একটা গোপন কথা শুনবে উপমা?
-হুম হুম।
-সোহরাবের সাথে আমার আজ পর্যন্ত স্বামী স্ত্রীর কোনো সম্পর্ক হয়নি।
আকস্মিক কথায় চমকে ছায়ার দিকে তাকিয়ে থাকে উপমা। অবাক স্বরে বলে,
-কিন্তু আম্মাজান তারপর সবাই যে বলছিলো আপনার আর বাচ্চা হবে না?
-উইযে মাত্রই বললাম না নিজেকে আর বেহায়া হিসেবে তুলে ধরবো না। বিবাহের পর সোহরাব গৃহে বেশি একটা আসতো না আর আসলেও সকলের অগোচরে রাতে আমি অন্য কক্ষে যেয়ে ঘুমাতাম। বিবাহের ঠিক ছয়মাসের মাথায় সোহরাব একদিন রাতে আমাকে নিজের কাছে টেনে নেয়। আমিও প্রেমিক পুরুষের চোখের দিকে তাকিয়ে বশ হয়ে যাই। কিন্তু সে যে নিজ ইচ্ছায় আমাকে কাছে টেনে নেননি সেটা বুঝতে পেরে আমি অন্য কক্ষে চলে যাই। তারপর আর আমাদের মধ্যে তেমন কিছু হয়নি। কেউ সন্তানের কথা জিগ্যেস করলে বলতাম আমার কারণে হয় না। তারপরই আমার ক্যান্সার ধরা পরলো। যেই মিথ্যে বলতে বলতে আমি এইপর্যন্ত এসেছিলাম শেষে সেই মিথ্যেই সত্যিতে রূপান্তরিত হলো। ডাক্তারই বলল আমি আর মা হতে পারবো না।
উপমা স্তব্ধ নয়নে সম্পূর্ণ কথা শুনলো। ছায়া রুদ্ধ শ্বাস ত্যাগ করে বলল,
-জানো উপমা এই সবকিছুর মধ্যে আমি উনার দোষ দেখি না। সে কয়েকবারই আমাকে কাছে টেনে নিতে চেয়েছিলেন কিন্তু আমিই বাধা দিয়েছি। সে হয়তো মনে করে আমি তাকে পছন্দ করি না। জোর-জবরদস্তির সংসার করছি। তাই নিজেকে আরো দূরে সরিয়ে নেন আমার কাছ থেকে।
-আপনি উনাকে নিজের মনের কথা কখনই বলেননি আপা?
চটজলদি প্রশ্ন করে বসে উপমা। ছায়া স্মিত হেসে বলে,
-কখনই না। আমি ভীষণ চাপা স্বভাবের মানুষ। নিজ মনের কথা যে পর্যন্ত নিজ মুখে না বলি সে পর্যন্ত কেউই বুঝতে পারে না। বিবাহের আগে বা পরে কখনই উনি বুঝতেও পারেননি আর আমিও বুঝানোর প্রয়াস করিনি। বিবাহের প্রথম রাতে তার কথা আমার আত্মসম্মানে আঘাত লেগেছিলো। তবুও আমার আম্মা আর আম্মাজান জানে উনার প্রতি আমার অনুভূতি। এই কয়দিন হাসপাতালে ছিলাম প্রতিদিন তাকে দেখতাম,তাকে অনুভব করতাম, তার আমার প্রতি যত্ন, রাতের পর রাত আমার সিউরে বসে থাকা, সবকিছুই আমার জন্য স্বর্গীয়সুখ ছিল।
এভাবেই একজন আরেকজনের জীবনের কাহিনী বলে একসাথেই পার করলো পুরো রাত। উপমার আর নিজ কক্ষে যাওয়া হলো না। ছায়া প্রথমদিন উপমাকে বলেছিলো সে কখনোই উপমাকে নিজের বোন হিসেবে মানতে পারবে না। অথচ আজ তারা দুইজন দুইজনের বোনের থেকেও উর্ধে!
______________________
জমিদার গৃহ ভরে উঠলো সকাল হতেই। তুলিকা ও তারনা এসেছে বেড়াতে। দুইদিন ছুটি নিয়েছিল সোহরাব তাই তাহসিয়াকে নিয়ে সেও এসেছে। সকালের নাস্তা করে বৈঠকখানায় বসেছে সবাই। উপমা তুলি আর ভৃত্যদের নিয়ে দ্বিতীয় স্তরের বদ্ধ সবকয়টা কক্ষ পরিষ্কার করাচ্ছে। গৃহে যেহেতু মেহমান এসেছে তাই বেশি কক্ষের প্রয়োজন। একদম কিনারের একটা কক্ষ উপমা সবসময়ই তালাবদ্ধ দেখেছে। তাই আজ মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলো এই কক্ষটি খুলে দেখবেন। কেনো সবসময় বন্ধ রাখা হয়! তালায় হাত দিতেই তুলি বলে উঠলো,
-ছোডু ভাবিজান এই ঘর পরিষ্কার করবার দরকার নাই।
-কেনো? আর কেনোই বা এই কক্ষ সবসময় বন্ধ রাখা হয়?
তুলি আমতা আমতা করে বলল,
-আমিও জানি না কেল্লেগা বন্ধ।
উপমা সন্দীহান নজরে তুলিকে দেখে কক্ষের সামনে থেকে সরে যায়। পিছনে ফিরে তাহসিয়াকে আসতে দেখে দাঁড়িয়ে পরে উপমা। তাহসিয়া পাশ দিয়ে যাচ্ছিলো উপমা তাকে ডাক দেয়। থেমে যায় তাহসিয়া। প্রশ্নবোধক দৃষ্টি নিক্ষেপ করে।
-আপা ভালো আছেন?
-আপনার মনে হয়না আপনি বেশি আধিখ্যেতা দেখাচ্ছেন?
তাহসিয়ার কথা শুনে উপমা চুপসে যায়। তাহসিয়া কিছু না বলেই চলে যায়। উপমা বুঝে উঠতে পারে না কিসের জন্য এই মেয়ের এতো রাগ সবার ওপর। শুধু তার সাথেই নয় সোহরাব বেতীত গৃহের প্রত্যেকটা সদস্যের সাথেই সে এইরকম ব্যবহার করেন। তার আব্বাকে তো সে দু’চোখে সহ্যই করতে পারেননা। ভাবাভাবি শেষ করে কাজে মন দেয় উপমা।
সবার সাথে সাক্ষাৎ শেষ করে সোহরাব ছায়ার কক্ষের সামনে এসে দাঁড়ায়। দরজায় মৃদু টোকা দিয়ে ভিতরে প্রবেশ করে। আধশোয়া অবস্থায় বসে ছিল ছায়া। সোহরাবকে দেখে অপ্রস্তুত হয়ে পরে। মাথায় আঁচল তুলতে নিলে সোহরাব গম্ভীর স্বরে বলে,
-সমস্যা নেই শান্ত হয়ে বসুন।
ছায়া তাকালো সোহরাবের পানে। স্বরে টান এনে বলল,
-তা জমিদারের পুত্র সোহরাব মির্জা আমার কক্ষে এসেছেন কোনো বিশেষ কারণে?
সোহরাব মুখে গম্ভীর্যতা ফুঁটিয়ে তোলে শান্ত রইলো। এদিকসেদিক তাকিয়ে বলল,
-আপনি এখন কেমন বোধ করছেন? আগের থেকে একটু ভালো?
-অনেক ভালো। সোহরাব মির্জা জিগ্যেস করায় এখন আরো ভালো হয়ে উঠলাম।
সোহরাব চোখ তুলে তাকালো। খানিক সময়ের ব্যবধারে দৃষ্টি সরিয়ে ফেললো। দৃঢ়তার সাথে বলল,
-আমার প্রতি অনেক ঘৃণা আপনার মনে?
-একদমই না। আপনাকে ঘৃণা বা ভালোবাসা কোনোটার প্রতিই ইচ্ছুক নই আমি। উপমা মেয়েটাকে কেনো উপেক্ষা করছেন? ও আপনার স্ত্রী সেটা কেনো ভুলে যাচ্ছেন আপনি?
অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো সোহরাব। সে দৃষ্টির দিকে কিঞ্চিৎ তাকিয়ে মাথা নত করে ফেললো ছায়া। কয়েক পল নীরবতা কাটিয়ে সোহরাব শান্ত ভণিতায় বলল,
-এখন আপনার কথা মতো কাজ করতে হবে আমায়?
-শুধুই বললাম। আমি ঐরকম স্ত্রী নই যে নিজের স্বামীকে বলবে তার দ্বিতীয় স্ত্রীকে আপন করে নিতে। আমি আবার ঐরকম নারীও নই যে অন্য একটি নারীর অধিকার থেকে বঞ্চিত করা দেখে চুপ থাকবে।
অকারণেই ছায়ার কথায় তেঁতো হয়ে উঠলো সোহরাব। শান্ত চোয়াল শক্ত হয়ে এলো। ছায়ার কথা ভ্রুক্ষেপ না করে চলে যেতে নিলে কী মনে করে যেনো আবার পিছনে ফিরে তাকায়। ছায়া ছলছল আঁখিজোড়া সেইসময় তার দিকেই নিবদ্ধ ছিল। খনিকের জন্য দৃষ্টি মিলন ঘটে গেলো দুইজনের। সোহরাব ঈষৎ হেসে বলল,
-একজনকে নিজের সাথে জড়িয়ে তার জীবন নষ্ট করেছি আর কাউকে নিজের সাথে জড়াতে ইচ্ছুক নই আমি। সেইসময় আম্মাজানের কথায় জ্ঞানশূন্য হয়ে বিবাহ করেছিলাম। এখন শান্ত মস্তিকে ভেবেছি তাকে তালাক দিয়ে দেবো আমি। তারপর আম্মাজান আমাকে চিরকালের জন্য গৃহ থেকে বিদায় নিতে বললে আমি মাথা পেতে সেটা মেনে নিবো।
গটগট পায়ে চলে গেলো সোহরাব। কম্পিত নয়নে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষন। নিজের বক্ষস্থল চেপে ধরে মৃদু হাত দিয়ে। নেত্রপলব বন্ধ করে বিড়বিড় করে বলল,
-কয়েক বছর পূর্বেও সেই আঁখিজোড়ায় আমি আমার জন্য সর্বনাশ দেখেছিলাম আজও তাই দেখলাম! আপনাকে ঘৃণা করা যে আমার সাধ্যে নেই। তবে ধীরে ধীরে আপনি আমার অপ্রিয় হয়ে উঠছেন জনাব।
>>>>চলবে।