অপ্রিয় জনাব পর্ব-০৫

0
513

#অপ্রিয়_জনাব
#Mehek_Enayya(লেখিকা)
#পর্ব_০৫

সন্ধ্যা পরেছে। আঁধারে ঢেকে গিয়েছে চারপাশ। দূর থেকে শিয়ালের ডাক শোনা যাচ্ছে। বিধ্বস্ত অবস্থায় উপমা ছুটে যায় ছায়ার নিথর দেহের কাছে। শব্দ করে জমিনে বসে পরলো। ছায়ার দেহ নিজ কোলে নিয়ে কয়েকবার ডাকলো। মৃদু চাপর দিলো গালে। সোহরাব ততক্ষনে তাঁদের কাছে চলে এসেছে। ছায়ার হাতের শিরা পরীক্ষা করে দ্রুত তাকে শহরে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করা হলো। কয়েকজন থেকে বাকি সৈন্যদল ছুটে পরলো শত্রুর তালাশে। সোহরাব যাওয়ার পূর্বে তাঁদের উদ্দেশ্যে বলল,
-আমাদের সাথে দুইজন চলো আর দুইজন গৃহে যাও। গৃহের সবাইকে বলবে আমরা ছায়াকে নিয়ে শহরে যাচ্ছি ওর অবস্থা শোচনীয়। বাদ বাকি তোমরা তাঁদের পিছু নেও।

গৃহের বৈঠকখানায় চিন্তিত ভঙ্গিতে বসে আছে সকলে। তুলসী থেমে থেমে কাঁদছে। একবার ছায়ার জন্য তো একবার নিজ পুত্রের জন্য বুক ধকধক করছে তার। তার ওপর মায়া হচ্ছে উপমা নামক যুবতীর জন্য। কিছুক্ষন আগেই খবর এসেছে উপমার আম্মা আর দুনিয়ায় নেই। বিকালে ঘুমিয়েছিল বেশ সময় ঘনিয়ে আসার পরও যখন উঠছিলো না তখন পাশের বাড়ির এক মহিলা তাকে ডাকতে আসে। জানালা দিয়ে দেখতে পায় মাটির ঘরের চকিতে অবচেতন হয়ে পরে আছে সে। কয়েকবার ডাকলো সকলে মিলে। যখন দেখলো কোনো সাড়াশব্দ নেই তখন কাঠের দ্বার ভাঙতে হলো। গ্রামের এক বৃদ্ধ মহিলা এগিয়ে এসে শ্বাসপ্রশ্বাস পরীক্ষা করে দেখলো সে আর জীবিত নেই। যেহেতু তাঁদের পরিবারের আর তেমন কোনো সদস্য নেই তাই গ্রামবাসীরা জমিদার গৃহে খবর পাঠালো।
এখন উপমাকে বলতে তো হবেই। তাই ইয়াশার আর আলাউদ্দিন ত্বরিতগতিতে হাসপাতালের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পরেছেন।

তাহেরা আম্মার পাশে বসে ভাঙা স্বরে বলল,
-আম্মাজান আমার ভাবিজানদের জন্য চিন্তা হচ্ছে। ছোট ভাবিজান কিভাবে সয্য করবে তার আম্মার মৃত্যুর খবর!
-আমিও সেটাই ভাবছি রে মা। ছায়ার আম্মা আব্বা রওনা দিয়েছে। মেয়ের এই অবস্থায় কোন আম্মা আব্বার বসে থাকতে মন চায়!
ফুঁপিয়ে উঠে তুলসী। মিনা তার পাশে বসে সান্ত্বনা দিচ্ছে। সাইয়েরা ইয়ামিনকে নিয়ে বসে আছে। সেইসময় সোহরাবদের গাড়িতে সেও ছিল। মারামারি, র’ক্ত দেখে ভীষণ ভয় পেয়েছে সে।
-আম্মাজান নিজেকে শক্ত করো। দেখিও বড় ভাবিজানের কিছু হবে না।
আম্মাকে জড়িয়ে ধরে তাহেরা। তুলসী এবার শব্দ করে কেঁদে দেয়। বিলাপ স্বরে বলল,
-তোর কথাই যেনো আমার খোদা রাখে মা।

হাসপাতালের বারান্দায় পায়চারি করছে সোহরাব। ললাটে, ওষ্ঠে বিন্দু বিন্দু র’ক্ত জমে শুকিয়ে আছে। পাতানো বসনিতে বসে আছে উপমা। পিঠের আঘাতটা মোটামুটি ভালোই লেগেছে যার জন্য সোজা হয়ে বসতে বা দাঁড়াতে পারছে না সে। উপমার মস্তিকে বারবার ভেসে উঠছে ছায়ার চিত্র। মন বলছে আজ নিশ্চই কোনো খারাপ কিছু হবে। অকারণেই অস্থির অনুভব করছে উপমা। বুক ভার ভার লাগছে তার।

-ভাইজান।
অপরিচিত নারীর কণ্ঠস্বর শুনে ঘাড় বাঁকিয়ে তাকায় উপমা। সুশীল পোশাক পরিহিত, মাথা ওড়না দিয়ে ঢাকা বেনুনি করা কেশ বুকে ছড়িয়ে আছে। অতিরিক্ত ফর্সা স্বচ্ছ মুখশ্রী। মুখের গড়ন অনেকটা সোহরাবের মতোই মনে হলো উপমার।
সোহরাবের দিকে এগিয়ে এসে চিন্তিত, ভয়াত কণ্ঠে বলল,
-ভাইজান আপনে এই অবস্থায় এখনও এখানে দাঁড়িয়ে আছেন! দ্রুত আসেন মুখ পরিষ্কার করে ঔষধ লাগিয়ে নিন।
-এগুলো তেমন কিছু না বোন।
পাশে ফিরতেই সোহরাবের নজর পরে এলোমেলো অবস্থায় বসে থাকা উপমার পানে। তাহসিয়াকে দৃঢ় স্বরে বলল,
-তুমি বরং উনাকে নিয়ে যাও। পিঠে বড়োসড়ো আঘাত পেয়েছেন।
-কে সে? আর বড় ভাবিজানের শরীর এখন কেমন?
-ডাক্তার কিছু বলেনি এখন পর্যন্ত। আর উনি উপমা।

তাহসিয়া আর কিছু জিগ্যেস করলো না। উপমা নাম শুনেছে সে তাহেরার মুখে। অকারণেই এই মেয়ের ওপর অনেক রাগ তার। কেনো সেটা সেও জানে না। ভাইয়ের কথা মতো এগিয়ে যায় উপমার কাছে। আগাগোড়া পরোক্ষ করে বলল,
-আপনি আসুন আপনার চিকিৎসার প্রয়োজন।
-আমি ঠিক আছি।
খানিকটা বিরক্ত হলো তাহসিয়া। দেখাই যাচ্ছে ঠিক নয় তবুও কেনো বলছে ঠিক আছে! বিরক্তমাখা গম্ভীর স্বরে বলল,
-তর্ক আমার পছন্দ নয়। আসুন দ্রুত।
উপমা উঠে দাঁড়ালো। তরুণীর কথা শুনে সে বুঝে গিয়েছে এটা সোহরাবের বোন তাহসিয়া। তার মতোই গম্ভীর আর রুক্ষ স্বভাবের মানুষ। তাহসিয়ার সাথে সামনে এগিয়ে যাচ্ছিলো সেই সময় উপস্থিত হয় ইয়াশার আর আলাউদ্দিন। উপমা দ্রুত এলোমেলো শাড়ী ঠিক করে মাথায় ঘোমটা তুলে। ইয়াশার সোহরাবের উদ্দেশ্যে বলল,
-ভাইজান ঠিক আছে আপনারা?
-এইতো।
ছোট উত্তর দেয় সোহরাব। ইয়াশার দুর্বলচিত্তে একবার উপমা একবার সোহরাবকে দেখে শান্ত স্বরে বলল,
-ছোট ভাবিজানকে এখন আমাদের সাথে যেতে হবে ভাইজান।
ইয়াশারের কথার আগামাথা বুঝলো না সোহরাব ও উপমা। উপমা ছোট ছোট চোখে তাকিয়ে রইলো। সোহরাব প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
-মানে? সেও সুস্থ নয় চিকিৎসার প্রয়োজন এখন কিভাবে যাবে?
-ছোট ভাবিজানের আম্মা মারা গিয়েছে ভাইজান।
কম্পিত ধ্বনি উচ্চারণ করে কথাটা বলল ইয়াশার। বাক্য শেষ হতেই ধপ করে জমিনে বসে পরলো উপমা। মস্তিক কেমন ফাঁকা হয়ে বক্ষস্পন্দন থেমে গেলো তার। ঝাপসা নয়নে ইয়াশারের দিকে তাকিয়ে রইলো শুধু।
তাহসিয়ার ভীষণ মায়া হলো মেয়েটির ওপর। এমনিতেই তো দুর্বল ছিল, এখন এইরকম একটি বাক্য শুনে মেয়েটি সম্পূর্ণ ভেঙে পরেছে। সোহরাব নিস্পলক উপমার পানে তাকায়। মনের ভিতরের ঝড় বুঝার প্রয়াস করলো মাত্র মা হারা মেয়েটির।

সোহরাব এগিয়ে আসতে নিলে উপমা সবাইকে অবাক করে দিয়ে উঠে দাঁড়ায়। যে মেয়ে কিছুক্ষন পূর্বে ব্যাথায় সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারছিলো না সেই মেয়ে এখন টানটান হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মনের পীড়ায় কী মানুষ শরীরের পীড়ার কথা ভুলে যায়! ভাবলো সোহরাব। উপমা ভীতিকর ভাঙা কণ্ঠে বলল,
-আমাকে আমার মায়ের কাছে নিয়ে চলুন।

চমকিত ভঙ্গিতে দৃষ্টি তুলে উপমাকে দেখলো সোহরাব। রুদ্ধ শ্বাস ছেড়ে ইয়াশারকে বলল,
-তাকে নিয়ে যাও ইয়াশার। আমি এখানে থাকি।
-ঠিক আছে ভাইজান।
-ভাইজান আমিও যাই তাঁদের সাথে?
তাহসিয়ার কথায় হ্যাঁ বোধক মাথা নারায় সোহরাব। যাওয়ার পূর্বে সোহরাবের কথা মতো তাহসিয়া উপমাকে জোর করে একটা ব্যাথার ঔষধ খাইয়ে দেয়। অতঃপর তারা বেরিয়ে পরে। হাসপাতালে রয়ে যায় সোহরাব আর আলাউদ্দিন।

______________________
নিজ গৃহের দ্বারে পা রাখতেই সর্বাঙ্গ কেঁপে উঠে উপমার। যেই বাড়ি সবসময় নির্জন নীরব থাকতো আজ সেই বাড়িতে মানুষের সমাগম। উপমাকে দেখে সকলে দূরে সরে যায়। রাস্তা বানিয়ে দেয় তার যাওয়ার জন্য। তাঁদের ছোট উঠানের মধ্যখানে পাটিতে শুয়িত মাকে দেখে বুকের পাঁজরে ব্যাথা অনুভব করলো। হাত পা গুটিয়ে মায়ের মৃত দেহের পাশে বসে পরে। নরম স্বরে ডাকলো,
-মা, ও মা। উঠো না মা। দেখো তোমার মেয়ের বুকে ব্যাথা করছে অনেক, মনে হচ্ছে কেউ ছু’রি চালাচ্ছে। তুমি না তোমার মেয়ের কষ্ট সহ্য করতে পারো না! উঠো না।

অঝোরে কেঁদে দিলো উপমা। মায়ের বুকে মাথা রেখে অশ্রু বিসর্জন দিতে থাকলো। আশেপাশে দাঁড়ানো সকলে করুণ নয়নে দেখতে থাকলো সদ্য এতিম হওয়ার মেয়ের বেদনা। কয়েকজন নিম্নস্বরে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করলো,
-মাইয়াডারে বিয়া দিয়া ভালো করছিলো নইলে অহন কী হইতো।
-হো। এতিম যুবতী মাইয়াডারে বেডারা নিজে গো ভোগের জিনিস বানাইতো।
তাঁদের কথায় তাল মিলিয়ে আরেকজন বলল,
-কিন্তু মাইয়ার জামাইর বাড়ি থেইকা কেউ আহে নাই? হুনছিলাম জমিদারের বড়ো পুলার লগে বিয়া দিছিলো।
-হো। বুঝো না বুইন(বোন), বড়োলোক গো কাসে(কাছে) কী আর গরিব গো দাম আছে নি।
-তাও তো মাইয়াডার রাজ কপাল!কয়জনের নসিব এমন ওহে।

উপমা বুক থেকে মাথা তুলে কাপড় সরিয়ে মুখ দর্শন করে। গালে হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,
-মা গো তুমি তো জানো তুমি ছাড়া এই দুনিয়ায় আমার আপন কেউ নেই। আজ স্বার্থপরের মতো তুমিও আমাকে রেখে চলে গেলে! একা আমি কী করবো? কার সাথে মনের কথা বলবো? কে আমাকে আদর করে ভালো ভালো বুঝ দিবে?

নিঃশাস নিলো উপমা। মায়ের ললাটে চুম্বন করে কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল,
-আমি জানি আমি তোমার নাড়ি ছেঁড়া ধন নই, তুমি আমায় জন্মও দেওনি, তবুও তোমার প্রতি আমার ভালোবাসার যে শেষ নেই মা। মা শব্দের মানেই যে আমি তোমাকে বুঝি। কেনো আমাকে এতো ভালোবাসা দিয়েছো মা? কেনো নিজের প্রতি এতো দুর্বল করেছো আমায়? দেখো তোমার তিলে তিলে তৈরি করা কঠিন, বর্বর মেয়েও আজ চুর্ণবিচুর্ণ হয়ে পরেছে।

ব্যথাহত হয়ে আর্তচিৎকার করে কান্না করতে থাকলো উপমা। ছিটকে কিছুটা দূরে সরে গেলো। সকলের বক্ষ কেঁপে উঠলো উপমার ক্রন্দনরত্ব স্বরে। তাহসিয়ার মতো কঠিন চিত্তের মানুষও দাঁড়িয়ে অশ্রু ঝরাচ্ছে।
উপমা নিজের দুইগাল খামচে ধরে চিৎকার করে বলল,
-মা গো ছেড়ে যেও না আমায়। একা করে দিও না।

আকাশের চাঁদটাও আজ উপমার দুঃখে দুঃখিত। কিছুক্ষন পর পরই সাদা মেঘের আড়ালে নিজেকে লুকিয়ে ফেলছে। একসময় কাঁদতে কাঁদতে উপমার চোখের সামনের সবকিছু ঝাপসা হয়ে এলো। শরীরের ভার হারিয়ে লুটিয়ে পরলো জমিনে।
________________________

রাত কয়টা বাজে জানা নেই। দম বন্ধ, হাঁসফাঁস অবস্থায় আঁখিজোড়া খুলে ফেলে উপমা। মাথায় ভারী বস্তা রয়েছে এমন অনুভূতি হচ্ছে তার। ঘোলাটে নয়নে আশেপাশে তাকায়। বৈদ্যুতিক বাতির আলোয় উপমা বুঝতে পারে সে জমিদার গৃহে নিজ কক্ষে শুয়ে আছে। চট করে উপমার মনে পরে যায় তার মা আর পৃথিবীতে নেই পরকাল গমন করেছেন। ডুকরে উঠে সে। তৎক্ষণাৎ বিছানায় উঠে বসে।
পাশেই বসা ছিল তাহেরা আর সাইয়েরা। উপমাকে বিছানার নিচে নামতে দেখে তাহেরা তাকে ঝাপ্টে ধরে। উপমা পাগলের মতো কাঁদতে থাকে। তাহেরাকে ধাক্কা দিয়ে সরানোর চেষ্টা করে বলল,
-আমি আমার মায়ের কাছে যাবো। তোমরা আমাকে যেতে দেও। আটকিও না আমায়।
তাহেরাও উপমার সাথে কান্নায় ভেঙে পরে। সাইয়েরা উপমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,
-নিজেকে সামলাও বউমা। তোমার আম্মাকে কবর দিয়ে দেওয়া হয়েছে। তিনি বেহেশতবাসি হবেন। এখন না কেঁদে আল্লাহকে ডাকো আম্মার জন্য দোয়া পড়ো।

সাইয়েরার কথা মানতে পারলো না উপমা। বুক ফাটিয়ে চিৎকার করে কাঁদতে থাকে। হঠাৎই তার নাকে গোলাপজলের ঘ্রাণ আসে। বাহিরে কয়েকজনের আজহারী, ক্রন্দনধ্বনি কর্ণকুহর হয় তার। উপমার কান্না থেমে যায়। র’ক্তলাল ফোলা ফোলা নেত্রপল্লব নিক্ষেপ করে সাইয়েরার ওপর। তাহেরা তাকে বুকে জড়িয়ে আরো জোরে শব্দ করে কেঁদে দেয়। উপমা কম্পিত স্বরে বলল,
-আ আপা, আপা কেমন আছে?
সাইয়েরা চোখ মুছে নিস্তরঙ্গ গলায় বলল,
-বড় বউমা আর বেঁচে নেই মা।

>>>চলবে।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে