অপ্রাপ্তি পর্ব-১২

0
1155

#অপ্রাপ্তি 💔
#ইবনাত_আয়াত
~ পর্ব. ১২

বিকেলের আলো হারিয়ে নেমে এসেছে সন্ধ্যা। চারদিক কৃত্রিম আলোয় আলোকিত। তবে আমাদের ঘরটা একটু বেশিই রঙিলা। লাল, নীল, সবুজ হলুদ রঙের লাইটিং করা হয়েছে পুরো ম্যানসন জুড়ে। কাছের, দূরের সব আত্মীয়দের সমাবেশ ঘরে। কারণ.. আজ আমার বিয়ে। দ্বিতীয় বিয়ে। হ্যাঁ আজই সেই দিন। যাকে চিনি না জানি না তার সঙ্গে বিয়ের পিরিতে বসছি। অবশ্য আম্মু তো আমায় ছবি দেখাতে চেয়েছিল। আমিই দেখিনি। জানি না সে কেমন। নাকি সেও রিশানের মতোই হবে। যদি তার মতোই হয়? মিহিরও এখানেই আছে। একা বধুসাজে বসে আছি। একটু পর মিহির এলো ভাত নিয়ে। পাশে বসে বলল, ‘মা শা আল্লাহ্ আপু। তোমাকে তো হেব্বি লাগছে। ইশ ভাইয়া তো ক্রাশ খাবে।’

চোখ বড় বড় করে বললাম, ‘কী বলছো এসব?’

‘আচ্ছা। নাও ভাত খেয়ে নাও।’

‘আচ্ছা আমি হাত ধুঁয়ে আসছি।’

‘তোমাকে আমি বলেছি হাত ধুঁতে?’

‘মানে?’

‘হা করো।’

হেসে ফেললাম। হা করতেই মিহির ভাত মুখে পুরে দিল। মিহির মন খারাপ করে বলল, ‘চলে যাচ্ছ? আমিও কাল চলে যাব এখান থেকে।’

‘এভাবে বলছো কেন মিহির? আর চলে যাবে মানে? কেন চলে যাবে?’

‘তুমি থাকবে না তো আমি থেকে কী করব? আর আম্মুও ফোন দিয়েছে। চলে যেতে বলছে। অবশ্য এখানে আছি এক মাসের উপর হতে চলল।’

‘তো, চলো আমার সঙ্গে। শালী হিসেবে।’

‘আরে না। ভাইয়া বলেছে কাল খালামণির বাসায় আসছে আমায় নিতে। আমাকে আগে ওখানে পৌছাতে হবে। নাহয় ধরা খাব।’

মন খারাপ হয়ে গেল। মিহির আমাকে খাইয়ে কিছুক্ষণ গল্প করে চলে গেল। দীর্ঘশ্বাস ফেললাম।

.

কবুল, কবুল, কবুল!

ব্যস! এর ব্যবধানে হয়ে গেলাম আমি অন্য কারো। যাকে আমি চিনিই না। যাওয়ার সময় এক দফা কান্নার পরিবেশের সম্মুখীন হলাম। মিহির দূরেই দাঁড়িয়ে ছিল। ওকে ইশারায় ডাকলাম৷ দু’জন সবার থেকে একটু আলাদা হলাম। ফিসফিসিয়ে বললাম, ‘যদি ওরা তোমায় কিছু করে তাহলে অবশ্যই আমাকে জানাবে। বুঝেছ?’

মিহির মাথা নাড়িয়ে বলল, ‘হুম। আর শুনো। ভাইয়াকে বুঝার চেষ্টা কর। ভাইয়ার সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। উনি খুব ভালো। আমার ভাইয়ের মতো কখনো হবে না ইন শা আল্লাহ্। [অতঃপর দুষ্টু হেসে] আর হা। ভাইয়া কিন্তু হেব্বি হ্যান্ডসাম। রিশান ভাইয়ার থেকেও বেশি।’

লাজুক ভঙ্গিতে মাথা নিচু করলাম। মিহির বলল, ‘বেস্ট অফ লাক।’

দীর্ঘ তপ্ত শ্বাস বেরিয়ে এলো বুক চিড়ে। বাবা অশ্রুজল চোখে চেয়ে আছেন আমার দিকে। বাবাকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলাম। বাবা মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, ‘ও খুব ভালো ছেলে। তোকে কখনো ধোঁকা দেবে না বিশ্বাস কর।’

বললাম, ‘আমি জানি তোমার চয়েস কখনো খারাপ হবে না।’

‘সুখী হ মা।’

দীর্ঘ তিন মাস পর সেই ঘর থেকে আবারো বিদায় নিলাম। গাড়িতে বসলাম। পাশে সেই মানুষ টা বসে আছে। আর সামনে ড্রাইভারের পাশে বসে আছে তার ভাই। মানে ছোট ভাই। আর পেছনে বসে আছে তাদের বড় বোন। মাথা নিচু করে নিঃশব্দে অশ্রু বিসর্জন দিতে লাগলাম। হঠাৎ একটা সুগন্ধি রোমাল এগিয়ে দিলেন পাশে থাকা মানুষ টি। অশ্রুসিক্ত নয়নে পাশে তাকালাম। তিনি মোবাইলে ব্যস্ত। কালো পাঞ্জাবী পড়ে আছেন। হালকা লম্বা চুলগুলো বাতাসে এলোমেলো হয়ে তার কপালে আর চোখে এসে পড়ছে। কিন্তু তার চেহারা টা আমি দেখতে পাচ্ছি না। কারণ তার মুখে মাস্ক ছিল। শুধু বাদামী আঁখিজোড়াই চোখে পড়ল। বেশ চেনা লাগছে। কিন্তু.. কে সে? রোমাল টা হাতে নিলেও ব্যবহার করলাম না। হাতের মুঠোয় রেখে দিলাম। দীর্ঘক্ষণ পর এক বড় ম্যানসনের সামনে গাড়ি থামল। সামনে থাকা তার ভাই আগে নেমে পড়ল। পাশে থাকা ব্যক্তিটাও নেমে পড়ল। সাথে আমিও দরজা খোলে নেমে পড়লাম। তিনি মোবাইল স্ক্রলিং করতে করতে উল্টো পথে হাটা ধরলেন। তাজ্জব হলাম। বাড়ি না গিয়ে কোথায় যাচ্ছেন? তার ভাই বলে উঠল, ‘ওই ভাইয়া? কোথায় যাচ্ছ আবার?’

তিনি দূর হতে তার দিকে তাকিয়ে শুধালেন, ‘ফ্রেন্ডস দের কাছে যাচ্ছি। চলে আসব।’

তার বড় বোন চিল্লিয়ে বলল, ‘আরে পরে দেখা করিস। এখন ঘরে চল।’

কিন্তু তিনি শুনলেন না আর থামলেন না। এগিয়ে হারিয়ে গেলেন রাস্তা পেরিয়ে। ভাইয়া দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ‘এর বিয়ে হয়েছে তবুও ফ্রেন্ডস দের সাথে দেখা করা ছাড়বে না।’

আপু বললেন, ‘চলো বোন। তুমি আমাদের সাথে চলো।’

‘জ-জ্বী।’

গেট দিয়ে প্রবেশ করতে করতে ভাইয়া বলল, ‘ভাবী। আমি তানসিব। আপনার একমাত্র দেবর।’

হেসে বললাম, ‘আপনি তো আমার বড় ভাইয়া। তুমি করে বলবেন।’

‘এই যা কী বলেন ভাবী? সম্পর্কে তো আপনিই আমার বড়।’

‘কিন্তু বয়সে তো আপনিই বড় তাই না?’

‘হ্যাঁ তা তো বড়।’

‘তাই তুমি করেই বলবেন। আমি আপনাকে না হয় ছোট ভাইয়া বলেই ডাকব।’

‘যেহেতু সম্পর্কে তুমিই আমার বড় সো তুমিও ভাই হিসেবে আমার তুমি করে বলবে ওকে?’

‘কথা রইল।’

আপু মাঝে বলে উঠেন, ‘বাব্বাহ্! তো আমি কোথায় গেলাম শুনি?’

হেসে ফেললাম, ‘আপনি তো আমাদের মাঝেই আছেন আপু।’

‘হুম। আমি তনিমা। এই দামড়া দুই ভাইয়ের বড় বোন। কিন্তু বড় বোন বলে পাত্তাই দেয় না।’

‘কেন?’

তানসিব ভাইয়া বলল, ‘এই আপু। আমি তোমায় পাত্তা দেই না?’

‘তা দিস। কথা বললে কথা শুনিস? ওই বড় দামড়া টা কী শুনল? চলেই গেল না?’

‘ভাইয়া শুনে না। আমি তো শুনি তাই না?’

‘হয়েছে হয়েছে। চলেই তো এলাম।’

পেছন থেকে আরো দু’টো মাইক্রোবাস এসেছে। সেখান থেকে অনেকেই নেমে এলো। উনার মা আর বাবা আমায় বরণ করে নিলেন। উনার মা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, ‘কী মিষ্টি মেয়ে!’

অবাক হলাম। রিশানের মা কখনো আমায় এভাবে বলেন নি। মাথা নিচু করলাম। মা বললেন, ‘আচ্ছা হয়েছে লজ্জা পেতে হবে না। তনিমা! ওকে রুমে নিয়ে যা।’

তনিমা আপু হেসে আমাকে নিয়ে উপরে উঠতে লাগল। আমাকে একটা রুমে নিয়ে বিছানায় বসিয়ে বলল, ‘তুমি বসো আমি খাবার নিয়ে আসছি।’

দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাথা নাড়লাম। নিশাত আপু কখনো আমায় এমন করেনি। তনিমা আপু কিছ ফল ফ্রুটস এনে নিজ হাতে খাইয়ে দিল। গোপনে অশ্রু বিসর্জন করলাম। পরপর অবাক হচ্ছি তাদের এমন কার্য দেখে। আমার তো দু’বছরে ইন-ল জিনিসের প্রতি বিশ্বাসই উঠে গিয়েছিল। কিন্তু যদি পরে তাদের মতই এমন করে?

বিকেল থেকে রাত দশটা অবদি শুধু বধু দেখার কার্যক্রমই চলল। আচ্ছা তারা কী জানে না আমি ডিভোর্সী? তাহলে আমায় মেনে নিচ্ছে কীভাবে? নিশ্চয়ই জানে না? আমি বুঝতে পারছি না কিছু। আমিই বোধহয় একমাত্র প্রাণী যে কী না বিয়ে হওয়ার পর এখনো অবদি তার স্বামীকে দেখতে পেল না।

.

প্রায় বারো টা। খাওয়া দাওয়া শেষ। সবাই ঘুমুতে চলে গেছে। শুধু আমিই বাকি আছে। এই লোকটা কোথায় মরতে গেল? ধুর! আই নিড টু গো টু স্লিপ। ধুর ধুর কবে আসবে এই লোকটা?
দরজা খোলার আওয়াজ পেতেই হকচকিয়ে উঠলাম। এইতো! এখন আসার সময় হয়েছে মহাশয়ের। কিছুক্ষণ মাথা নিচু করে রইলাম। আস্তে করে তার দিকে তাকালাম। পরণে সেই কালো পাঞ্জাবী৷ আর মুখে মাস্ক। তাজ্জব হলাম। করোনা চলছে নাকি এখন? মোবাইল টেবিলে রেখে মাস্ক খোলে টেবিলে রাখলেন। সঙ্গে সঙ্গে চমকে উঠলাম। ইনি এখানে? হতবাক হয়ে প্রশ্ন করলাম, ‘তা-ত-তাহসিন ভাইয়া আপনি?’

সঙ্গে সঙ্গে তিনি ভ্রু কুঁচকে তাকালেন। গম্ভীর গলায় বললেন, ‘আমি এখন তোমার ভাইয়া?’

বোকা বনে গেলাম। দাঁত দিতে জিভ কেঁটে বললাম, ‘ন-না মানে আপনি..’

আমাকে বলতে না দিয়ে বললেন, ‘হ্যাঁ আমি। কেন কিছু হয়েছে?’

‘মানে? আপনিই আমার বাবার স-স্টুডেন্ট?’

তিনি ব্যস্ত হলেন। আয়নার সামনে গিয়ে চুল হাত দিয়ে স্লাইড করে বললেন, ‘হুম।’

আচ্ছা? তাই বলেছিল আমায় চেনে? তার মানে তাহসিন ভাইয়ার সাথে আমার বিয়ে.. আমি স্বপ্ন দেখছি না তো? বললাম, ‘আপনি.. জানেন আমি ডিভোর্সড?’

সেভাবে থেকেই তিনি উত্তর দিলেন, ‘হুম জানি।’

‘তবু কেন? কেন আমায় নিজের স্ত্রী বানালেন?’

আমার দিকে শান্ত চোখে তাকালেন তাহসিন ভাইয়া। ধুর কবে থেকেই তাহসিন ভাইয়া বলে যাচ্ছি। উনি কী আমার ভাইয়া? তুইও না ইবনাত। গর্দভ একটা।
তাহসিন শান্ত গলায় বললেন, ‘ওটা এক্সিডেন্ট ছিল তাই এসব ভেবে প্রেশার নিও না মিস. ও সরি মিসেস. ইবনাত।’

‘আ-আপনি আমায় চিনলেন কী করে?’

‘হৃদহরনকারীকে চিনতে কোন কারণ লাগে না ইবনাত।’

কপাল কুঁচকে বললাম, ‘মানে?’

কিছু বললেন না। আয়েশ করে বিছানায় বসলেন। কেঁপে উঠলাম। মাথা নুইয়ে বসে রইলাম। আমি এখনো বিশ্বাস করতে পারছি না যে তাহসিন আমার স্বামী। হঠাৎ তিনি ঘোর লাগা কন্ঠে বলে উঠলেন, ‘তুমি এখনো আগের মতোই আছো হৃদরাণী। শুধু আগের চাঞ্চল্যতা টা নেই।’

[চলবে.. ইন শা আল্লাহ্]

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে