অপ্রাপ্তি পর্ব-০৫

0
1174

#অপ্রাপ্তি 💔
#ইবনাত_আয়াত
~ পর্ব. ০৫

সন্ধ্যার শেষ। পাখিরা নীড়ে ফিরেছে। সাথে কর্মীরাও আপন নীড়ে ফিরছে। নামাজ পড়া শেষে স্কুলের ফেসবুক গ্রুপে স্কুলের রুলস সম্পর্কে আলোচনা করছিলাম অন্যান্য টিচার্সদের সঙ্গে। তন্মধ্যে রুমে প্রবেশ করে রিশান। একবার তার দিকে তাকিয়ে মুখ ফিরিয়ে নিলাম। ম্যামসদের সঙ্গে চ্যাট করতে করতে হঠাৎ তাদের সাথে মশকরামূলক কথা হওয়ায় হেসে ফেললাম। রিশান সন্দিহান চোখে তাকাল। এগিয়ে এসে বলল, ‘কী করছো তুমি?’

‘আপনাকে বলতে হবে কী করছি?’

রিশান হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠে, ‘হ্যাঁ বলতে হবে কারণ আমি তোমার স্বামী। আর তুমি কী করছো না করছো সব আমার জানার অধিকার আছে।’

সাথে আমিও চেঁচিয়ে উঠি, ‘তাহলে আমারও অধিকার আছে আপনি কী করছেন না করছেন সব জানার। কিন্তু..? আপনি কী বলেন? আপনি কী বলেন যে আপনি অফিসের নাম করে বান্ধীবে কে নিয়ে রেস্টুরেন্টে খেতে যান? তাকে ফ্লায়িং কিস দেন? আপনি কী বলেন যে আপনি বান্ধবীকে নিয়ে খালের পাড়ে বাদাম খেতে যান? বলুন কখনো বলেছেন? তাহলে আমি কেন বলব?’

রিশান থমকে গেল। আমতা আমতা করে বলল, ‘ও.. ও জাস্ট আমার ফ্রেন্ড আর কিছুই না।’

‘তাহলে বলতে অসুবিধা কী? আপনি যদি না বলেন আমি কেন বলব?’

রিশান চুপ করে থাকে কিছুক্ষণ। হঠাৎ বলে উঠে, ‘বুঝতে পেরেছি। এখন তো আমাকে দিয়ে হবে না। নতুন নাগর জোগাড় করেছিস তাই না?’

বলতে দেরি কিন্তু আমার হাত চলতে দেরি নয়। ‘ঠাস’ করে চড় লাগিয়ে দিলাম তার গালে। রিশান গালে হাত দিয়ে হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। দাঁতে দাঁত চেঁপে বললাম, ‘আপনি লম্পট হতে পারেন আমি নই। আপনি নতুন মেয়ে জোগাড় করতে পারেন নিজের জন্য কিন্তু আমি ইবনাত নই৷ আর নিজেকে আমার স্বামী হিসেবে পরিচয় দেওয়ার চেষ্টা করবেন না। আমার স্বামী তো সেই কবেই মরে গেছে আমার কাছে।’

রিশান তাকিয়ে রয় শুধু। আমি হন হন করে মোবাইল নিয়ে রুম থেকে বের হয়ে মিহিরের রুমের দিকে পা বাড়ালাম।

.

‘আম্মু!! আম্মু!!’

রুমির চিৎকারে সবাই তার দিকে ফিরল। ডাইনিং রুমে আছি সবাই। আমি আর মিহির ববারবর’ই সোফায় বসে নিজ আলোচনায় মত্ত। রবিউল হাসান পত্রিকা পড়ছেন আর রাহেলা বেগম পান চিবুচ্ছেন। নিশাত আপু বসে আছে মোবাইল নিয়ে। আজ রিশানের অফ ডে। ইশান রিশান দুজন’ই বসে আছে বিপরীত সোফায়। আর মোবাইল টেপাটেপি করছে। এই সময়ে রুমি চিৎকার করতে করতে নামল। রাহেলা বেগম বললেন, ‘কী হয়েছে বউমা?’

‘মা আমি তোমার থেকে প্র‍্যাক্টিক্যাল কিনার জন্য টাকা নিয়েছিলাম। ওগুলো কোথায় জানো?’

‘কোথায় জানি মানে? ওগুলো তো তোমাকে দিয়েছিলা।’

‘না মা ওগুলো রুমে নেই। আমি বেডের তলায় রেখেছি। কিন্তু ওখানে একটা টাকাও নেই।’

‘তাহলে কোথায় যাবে?’

‘ঘরে তো চোরের অভাব নেই মা।’

‘মানে?’

‘দেখো কেউ চুরি করেছে নাকি।’

‘এই কে আমার বউমার টাকা চুরি করেছে?’

মিহির বলল, ‘আমি এখন টিউশনি করি। এতে আমি অনেক টাকাই পাই। সো আমার বাইরের মানুষের টাকার প্রয়োজন নেই। আর আমি আমার রুম ব্যতিত কারো রুমে পা রাখিনা। সো আমায় এসব জিজ্ঞাসা করো না।’

‘তাহলে কে চুরি করবে? ইশান তুই?’

ইশান রেগে যায়, ‘কী বলছো এসব মা? আমি টাকা ইনকাম করে তোমার হাতে দিই। আর তুমি রুমিকে দিয়েছো৷ আর আমি কেন তার টাকা আমি কেন চুরি করব?’

‘কেউ চুরি করেনি? বউমা ভালো করে দেখেছো তো?’

‘দেখেছি মা রুম তন্নতন্ন করে খুঁজেছি।’

‘তাহলে কোথায়?’

রুমি আমার দিকে এগিয়ে এসে বলল, ‘এই কালনাগিনী ছাড়া কেউ চুরি করবে না আমি জানি। মা এই চুরি করেছে।’

মুখ থমথমে হয়ে গেল। আমি কিছু বলার পূর্বেই মিহির বলে উঠে, ‘কোন প্রমাণ আছে তোমার কাছে?’

‘আছে তো। মা ওর রুম তল্লাশি করতে হবে।’

মিহির আর আমি সন্দিহান চোখে একে অপরের তাকাই। রাহেলা বেগম উঠে দাঁড়ালেন। আমি বললাম, ‘রুম কেন তল্লাশি করবেন? আমি চুরি কেন করব অন্যের টাকা? তাছাড়া আমার নিজের চাকরি আছে।’

‘দেখেছো মা? মুখোশ সবার সামনে খুলে যাবে বলে করতে দিচ্ছে না।’

‘ঠিক আছে। করুন। আমি কিছু বলব না।’

রুমি, নিশাত আপু আর রাহেলা বেগম আমাদের রুমের দিকে এগিয়ে গেলেন। সাথে ইশান আর রিশানও এলো। তারা কেউ বেডের তলে, তো কেউ আলমারিতে, তো কেউ ড্রয়ারে। কিন্তু খুঁজে পেল না। তা দেখে হাসলাম। আমি চুরি করব তাও আবার রুমির রুম থেকে? অসম্ভব! কিন্তু.. আমার ধারণাকে পাল্টে দিয়ে রুমি আমার স্কুলের রুলস সম্পর্কিত একটা ফাইল থেকে কিছু হাজার টাকার নোট বের করল। থমকে গেলাম আমি৷ মিহির আমার দিকে অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে তাকাল। আমি না বোধক মাথা নাড়লাম। রুমি টাকা গুলো সবাইকে দেখিয়ে বলল, ‘দেখেছো? আমি বলেছিলাম না? এই চোর টাই চুরি করেছে।’

রিশান বলল, ‘ছিহ্ ইবনাত! আমার কাছে কী টাকার কমতি ছিল যে তুমি রুমির টাকা চুরি করতে গেলে?’

ইশান বলল, ‘তোমার থেকে এটা আশা করিনি ভাবী। এতই যদি টাকা লাগে তো আমায় বলতে?’

আমি বললাম, ‘দেখুন সবাই বিশ্বাস করুন আমি কিছুই করিনি।’

রাহেলা বেগম এসে থাপ্পড় দিতে লাগলেই মিহির হাত ধরে ফেলে আর ছুড়ে ফেলে। তারপর অন্যদিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, ‘এদের তোমাকে বিশ্বাস করানোর কোন দরকার নেই ভাবী।’

বলেই যেদিকে সে তাকিয়ে ছিলো সেদিকে এগিয়ে গেল। ড্রয়ারের পাশে পড়ে থাকা কিছু একটা তুলে নিল হাতে। কিছুক্ষণ খুঁটিয়ে দেখল। তারপর আমাদের দিকে এগিয়ে আসে। তারপর তার হাতে থাকা জিনিস টাকে ঝুলিয়ে ধরে। নূপুর! হ্যাঁ একটা নূপুর। এটা দেখে রুমি থতমত খেয়ে গেল। সাথে চুপসে গেল। মিহির ভ্রু নাঁচিয়ে বলল, ‘কী ভাবী জান? এটা চিনতে পেরেছো?’

রুমি হাত কঁচলাতে শুরু করল। রাহেলা বেগম বললেন, ‘কী এটা?’

‘আহ্ মা! তুমি অন্ধ নাকি? দেখতে পাচ্ছো না এটা নূপুর।’

‘তো কী হয়েছে নূপুর?’

‘সবাই.. একটু ছোট ভাবীর পায়ের দিকে তাকাও তো।’

সবাই তাকায়। তার ডান পায়ের নূপুর টা নেই। আর বাম পায়ে থাকা সেইম নূপুর মিহিরের হাতে ঝুলছে। আমি যা বুঝার বুঝে নিয়েছি। মিহির বলল, ‘কী ভাবী? কিছু মনে পড়ছে?’

ইশান বলল, ‘কী বুঝাতে চাইছিস তুই মিহির?’

‘আহারে ভাইয়া। এই নূপুর টাতো তুমিই গিফট করেছিলে ভাবীকে। কিন্তু.. এই নূপুর টা, বড় ভাবীর রুমে কী করছে?’

‘আমি কী জানি?’

‘তুমি না জানলেও ছোট ভাবী তো জানবে।’

রুমি বলল, ‘আ-আমি কী করে জানব? হয়তো আমার পা থেকে চুরি করে নিয়ে এসেছে। টাকা যদি চুরি করে পারে তো নূপুর কেন পারবে না?’

আমি এগিয়ে গেলাম রুমির দিকে। কেউ কিছু বুঝে উঠার আগেই ‘ঠাস’ করে চড় মেরে দিলাম। উপস্থিত সবাই আবারো হতভম্ব আমার কাজে৷ চিৎকার করে বললাম, ‘কালাপানিতে যা ফঁকির কোথাকার! কী ভেবেছিস? আমি কিছুই জানি না? হাহ্! আমি সব দেখেছি যে তুই আমার রুমে এসে কী করছিস না করছিস। কী ভেবেছিস নিজে খুব চালাক? হাহাহা! হাসালি তো। আরে ওই সময় আমি রুমের বাইরেই ছিলাম। রুমে ঢুকতেই যাচ্ছিলাম তখন দেখি তুই আমার রুমে খটখট করে কিছু করছিস। তখন দেখি.. তুই আমার স্কুলের ফাইলে কিছু রাখছিস৷ আর তখনই ড্রেসিং টেবিলের খুঁটির সঙ্গে লেগে তোর নূপুর পড়ে যায় কিন্তু তুই ব্যথার ছলে তা খেয়াল করিস নি৷ তুই চলে যাওয়ার পর আমি ফাইল টা চেক করেছি। ওখানে তিন হাজার টাকা রাখা ছিল। আর তোর নূপুর টাও ওখানে পড়ে ছিল। কিন্তু? আমি কিছুই সরাই নি। কারণ আমি জানি তুই আমায় অপমান করতেই এসব করছিস। তাই আমিও একটু দেখছি তুই কীভাবে আমায় অপমান করিস। আমার চাল তুই কখনোই বুঝতে পারবি না হাহ্। আমায় অপমান করতে এসে নিজেই হয়েছিস। একেই বলে নিয়তির খেলা। জবাব টা আমি নই স্বয়ং আমার আল্লাহ্ দিয়েছেন। নিজের কাজে নিজেই ফেঁসে গেছিস। সত্যি! তোর তুলনা হয় না রুমি।’

হাসতে শুরু করলাম আমি। সাথে মিহিরও। ইশান ধমকে বলল, ‘তোমার সাহস দেখে দিন কে দিন অবাক হচ্ছি আমি ভাবী। কোন সাহসে তুমি আমার সামনে রুমির গায়ে হাত তুলেছো?’

থামিয়ে বললাম, ‘খবরদার ইশান। রুমি আমার ছোট, অপরাধ করলে ওকে আমি মারতেও পারব, বকা দিতেও পারব। আর মনে রেখ তুমিও আমার ছোট। বয়সেও। সম্পর্কেও। তোমাকেও শাসন করার অধিকার আমার আছে। আমার সঙ্গে বে-আদবী করলে তার শাস্তি আমি অবশ্যই তোমাদের দিতে পারব।’

ইশান চুপ করে রইল। রাহেলা বেগম এসে বলল, ‘ওহ্ আচ্ছা? তাহলে আমাকেও শাস্তি দিবি?’

‘হুম দিব। কিন্তু আমি না। আমার আল্লাহ্ দেবেন।’

মিহির চিল্লিয়ে উঠে, ‘দোষ তোমার বউমা করেছে তাও তুমি ভাবীকে থ্রেট দিচ্ছো? লজ্জা করছে না?’

রাহেলা বেগমও চুপ করে রইলেন। রিশান কিছু না বলে বেরিয়ে গেল। সাথে ইশানও। রাহেলা বেগম কিছুক্ষণ রুমির দিকে তাকিয়ে বেরিয়ে গেলেন। বাকি রইল রুমি। মিহির নূপুর টা তার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল, ‘নেক্সট টাইম কোন প্লান করলে ভেবে চিন্তে কাজ করবে। অন্যথায় নিজের কাজে নিজেই ধরা খাবে।’

রুমি দাঁতে দাঁত চেঁপে কিছুক্ষণ আমাদের দিকে তাকিয়ে রয়। তারপর প্রস্থান করে। আমি আর মিহির উচ্চস্বরে হেসে ফেললাম।

[চলবে.. ইনশা আল্লাহ]

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে