#অপ্রাপ্তি 💔
#ইবনাত_আয়াত
~ পর্ব. ০৩
পড়ন্ত বিকেল। গোধূলীর আলোয় আলোকিত চারপাশ। আকাশে লাল আভার প্রকুপ। শূণ্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি ব্যস্ত শহরের মানুষগুলোর দিকে। আকস্মিক উৎকন্ঠা মিহিরের গলা শুনতে পেলাম, ‘ভাবী!’
পাশ ফেরার আগেই সে পাশে এসে বসল। তাকে দেখে বিষন্ন মনে হচ্ছে। ভাবনার মাঝেই সে দুঃখ ভারাক্রান্ত মনে বলে বসল, ‘ভাবী জানো? আজ খুব.. খুব খারাপ কিছু আমি দেখে ফেলেছি।’
চমকে উঠলাম, ‘মানে কী মিহির?’
মিহির সামনের দিকে শূণ্য দৃষ্টিতে চেয়ে বলল, ‘ভাইয়া.. ভাইয়াকে দেখলাম।’
‘কোথায়?’
‘আমাদের স্কুলের থেকে দূরে যে খাল টা আছে? ওটার কাছে।’
‘কী?’
‘জানো ভাবী? ভাইয়া তোমাকে ধোঁকা দিচ্ছে।’
‘মানে?’
‘ভাবী। ভাইয়া একটা মেয়ের সাথে ছিল। আর তারা.. খুব ঘনিষ্ঠ অবস্থায় ছিল।’
‘ক-কীহ্!’
বুঝতে বাকি রইল না রিশান আসলেই রিলেশনে আছে। আর মিহিরও ব্যাপার টা জেনে গেছে। মিহির বলল, ‘ভাবী। আমি জানতাম এমন কিছুই হয়েছে। নয়তো ভাইয়া কখনো এমন করতো না।তোমাকে কত্ত ভালোবাসতো কত্ত কেয়ার করতো।’
‘ওটাকে ভালোবাসা বলে না মিহির। যদি সত্যি আমায় ভালোবাসতো তাহলে এমন করতো?’
বলতে বলতে গলা আটকে আসছে। মিহির বলল, ‘তবু কেন পড়ে আছো এখানে ভাবী? ভাইয়া তোমার পাশে নেই। আম্মু, আপু, ছোট ভাবী সবাই তোমাকে অপমান করছে, আহত করছে গায়ে হাত তুলছে। তবু কেন পড়ে আছো বলো? তোমার কী আত্মসম্মান নেই? চলে যাও ভাবী। আমি নিজেই তোমাকে বলছি। চলে যাও।’
তার দিকে নিরুত্তর ভাবে তাকিয়ে রইলাম। মেয়েটা আমায় বুঝে। আফসোস যার বুঝার সেই বুঝল না। কিন্তু.. আমি কোথায় যাব? আমার তো যাওয়ার জায়গা নেই। বাবা তো চান নি এই বিয়ে হোক। আমার সুখ মেনে বিয়ে দিয়েছেন। আমি এখন কোন মুখে তাদের কাছে যাব? ভাঙা গলায় বললাম, ‘আমার কেউ নেই মিহির। কার কাছে যাব আমি?’
মিহির আমাকে তার বুকে জড়িয়ে নিল। যেন সে আমার বড় বোন। মিহির বলল, ‘কে বলেছে তোমার কেউ নেই? আমি আছি না? আমি আছি কী করতে?’
কেঁদে ফেললাম। বললাম, ‘বাবা এই বিয়ে কখনোই মন থেকে দেন নি। তিনি রিশানকে তেমন পছন্দ করেন নি। কিন্তু আমার সুখের কথা ভেবে তিনি রাজি হয়েছেন। আর এখন.. তার কথা আমি শুনিনি। কোন মুখে যাব আমি তার কাছে বলো মিহির?’
মিহির বলল, ‘কোন মুখে যাবে মানে? বাবা কী কখনো মেয়ের খারাপ চায় বলো ভাবী?’
কিছু বললাম না। মিহিরের মতো মেয়ে ননদ হিসেবে আর বোন হিসেবে পাওয়া সত্যিই ভাগ্যের ব্যাপার।
.
‘ভাবী আমি তোমার জন্য একটা জব পেয়েছি। মোটামুটি খুব ভালো।’
সবজি কাটছিলাম। মিহিরের কথা শুনে তার দিকে ফিরলাম। উৎফুল্ল হয়ে বললাম, ‘সত্যি? কেমন জব?’
‘টিচার। একটা বেসরকারি স্কুলে আবেদন করেছিলে মনে আছে?’
‘হ্যাঁ প্রায় দু’মাস আগে।’
‘হুম! ওখানে এখন টিচার্সের প্রয়োজন। তাই তোমার এপ্লিকেশন একসেপ্ট করেছে।’
‘সত্যি মিহির?’
‘হুম ভাবী। এখন তোমার মুক্তি পাওয়ার অন্তত একটা পথ খোলা আছে।’
‘হয়তো তুমি ঠিকই বলছো।’
‘ভাবী! কাল স্কুলে যাবে। আর সব ঠিক ঠাক করে আসবে ঠিক আছে? আর আমারও কাল স্কুল নেই আমি তোমার সাথে যাব।’
‘তুমি এত ছোট মেয়ে এসব করার কী আছে বলো তো মিহির?’
‘ভাবী আমি ১৬ পেরিয়ে এখন ১৭+। আর তুমি বলছো আমি ছোট?’
‘আহারে আমার বোনু। ঠিক আছে তোমার কথাই রইল।’
‘ভাবী আরেকটা কথা।’
‘কী?’
‘আচ্ছা কাজ শেষ করো নির্জনে বলব এখানে তো আবার জাসুস আছে জানোই তো।’
‘হুম।’
‘আসো আমি সহ সাহায্য করি। এতে কাজ তাড়াতাড়ি হবে।’
‘আরে না দরকার নেই মিহির।’
‘চুপ করো তো।’
মিহির কাটা সবজিগুলো তেলে ছেড়ে দিল। মিহির প্রায় ভালোই রান্না পারে। পড়ার আর স্কুলের ফাঁকে আমাকে সাহায্য করতে করতে কাজ প্রায় শিখে গেছে। যদিও আমায় সাহায্য করাতে অনেক বাঁধা বিপত্তি পেয়েছে পরিবার থেকে। তবু সে নিজ সিদ্ধান্তে অটল থাকে সর্বক্ষণ। একবার মা এসেছিলেন। মিহিরকে তার পড়ার টেবিলে যেতে বললে মিহির পাত্তাই দেয় না। এতে তিনি কিছু করতে না পেরে মুখ বেঁকিয়ে চলে যান।
.
কাজ প্রায় শেষ। মিহির আর আমি ছাদে গিয়ে দাঁড়ালাম রেলিং ধরে দু’জন। মিহির বলল, ‘ভাবী। আমার মনে হয় তোমার ভাইয়াকে হাতে নাতে ধরা উচিত।’
বললাম, ‘আমি পারব না মিহির। এতে সে কেমন রিয়েক্ট করবে?’
‘ভাবী? আর ইউ ম্যাড? একটা ছেলে তোমায় নির্যাতন করছে বার বার ধোঁকা দিচ্ছে অন্য মেয়েতে আসক্ত। আর সে কেমন রিয়েক্ট করবে ভেবে তুমি প্রতিবাদ করছো না?’
আসলেই তো। রিশান তো আমার নয়। সে তো আমার সাথে অন্যায় করছে। তাহলে আমি কেন চুপ করে আছি? কেন তার প্রতিক্রিয়ার কথা ভেবে তাকে আমার মতই অপদস্থ করছি না? মিহির আমাকে উৎসাহ দেয়। সে বলল, ‘ভাবী! আমরা কাল ভাইয়াকে ফলো করব। উই নিড টু ডু ইট।’
মাথা নাড়লাম। মিহির ঠিকই বলছে। আমি রিশানকে এত সহজে ছেড়ে দেব না।
.
রিশানের কার্যকলাপ লক্ষ করছি। কী সুন্দর সেজেগুজে অফিস যাচ্ছে। এত সাজার কী আছে? কাজ করতে যাচ্ছে সেখানে সাজার কী? যদিও জানি কেন। রিশান ভ্রু কুঁচকে বলল, ‘এভাবে তাকিয়ে আছো কেন?’
‘এমনি।’
‘এভাবে তাকিয়ে থেকো না। বুকে লাগে।’
গা জ্বলে উঠল। এখন এসব কথাবার্তা শুধুই আমার কাছে নোংরামী। রিশান বেরিয়ে গেল। একটু পর মিহির রুমে এলো। সে রেডি হয়েই এসেছে। আমাকে তাড়া দিয়ে বলল, ‘রেডি হয়ে নাও ভাবী। ভাইয়া বেশি দূর যায় নি।’
‘না গেলে হয় না মিহির?’
‘ভাবী? তুমি নিজের আত্মসম্মানের কথা ভুলে তোমার লম্পট স্বামীর ভালোর কথা ভাবছো? সত্যি তুমি পাগল হয়ে গেছো ভাবী।’
‘না না মিহির। আমি ওর কথা ভাবছি না। আমি.. ওর কথা কিছুতেই ভাববো না কখনোই না।’
‘চলো ভাবী।’
‘হুম।’
রেডি হয়ে রুম থেকে বের হলাম আমি আর মিহির। নীচে যেতেই মা আর রুমির মুখোমুখি হলাম। রুমি ভ্রু কুঁচকে বলল, ‘কোথায় যাচ্ছো মিহির?’
মিহির বলল, ‘যাচ্ছি কোন এক জায়গায়। তোমাকে বলতে হবে নাকি?’
‘মানে কী? এসব কোন ধরণের বে-আদবী মিহির? আমি তোমার ভাবী তোমার গুরুজন। কোথায় যাচ্ছ না যাচ্ছ এসব কী আমার খেয়াল রাখার জিনিস নয়?’
‘তাহলে তুমি কই যাচ্ছো না যাচ্ছো এসব আমাদের বলে যাও না কেন?’
রুমি চুপ মেরে গেল। মা বললেন, ‘কোথায় যাচ্ছিস তোরা?’
‘রেস্টুরেন্টে যাচ্ছি আম্মু। ভাবীকে নিয়ে কিছু ভালো-মন্দ খেয়ে আসি।’
‘মানে কী? ঘরে কী খাবার নেই?’
‘তা আছে। কিন্তু ঘরের খাবার ক’দিন খাব?’
‘ঠিক আছে তুই যা। তোর ভাবীর কাজ আছে।’
‘কোন ভাবীর?’
‘কোন ভাবীর মানে? তোর বড় ভাবীর।’
‘ঠিক আছে ভাবী দু’টো আছে ছোট ভাবীকে বলো সব কাজ সেরে নিতে।’
রুমি ফোড়ন কেটে চেঁচিয়ে উঠে, ‘কী বলছো এসব মিহির? আমার ভার্সিটি যেতে হবে আমি কাজ করব মানে?’
‘কেন ভাবী? বড় ভাবী তো প্রতিদিন’ই কাজ করছে। আজ নাহয় তুমি করো।’
‘মিহির বেশি বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে কিন্তু।’
‘আজব কী বাড়াবাড়ি করলাম ভাবী?’
‘আমি কোন রান্না করতে পারব না আজ ইম্পর্ট্যান্ট ক্লাস আছে।’
‘ঠিক আছে তোমার কলিগ আশফাক ভাইয়া থেকে খেয়ে নিও। তোমরা তো প্রতিদিন শেয়ার করে খাও তাই না?’
রুমি চুপসে গেল। আমতা আমতা করে বলল, ‘ম-মানে?’
‘মানে আবার কী?’
মা সন্দিহান দৃষ্টিতে রুমির দিকে চেয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। রুমি বলল, ‘মা দেখো তোমার মেয়েও এই কালনাগিনীর গোলাম হয়ে গেছে। আমার নামে উল্টাপাল্টা রটাচ্ছে।’
মিহির বলল, ‘এখন তো আমি উল্টাপাল্টা রটাবোই। ভাবী চলো এখন পেঁচাল পেড়ে লাভ নেই।’
মিহির তাদের সামনে আমাকে টেনে সদর দরজা দিয়ে বের হয়ে গেল। আর তারা হতবাক হাবলার মতো চেয়ে রইল। কিছুই বলার সুযোগ রইল না।
.
‘তোমার ভাইয়া নিশ্চয়ই অফিসে পৌছে গেছে মিহির। আমরা এখন কোথায় যাব?’
‘ওকে আমার ভাই বলো না। ভাই বলতেও লজ্জা করে আমার। এখন চলো আমরা আজকে সারা শহর ঘুরব। তারপর ওই খালের কাছে যাব। ওখানে অনেক ভালো পরিবেশ আছে। ওর লাঞ্চ ব্রেকে যাব। আর এমনিতেও মি. রিশান ওখানেই আসবেন প্রেমিকাকে নিয়ে।’
দু’জন আজ খুব ঘুরলাম। শুধু ভাবছি পাশে সেই আগের রিশান টা থাকতো। দু’জন ফুচকা, আইসক্রিম থেকে শুরু করে বিরিয়ানি পর্যন্ত খেয়েছি৷ আসার সময় মিহির তার মায়ের থেকে যে বই কেনার টাকা নিয়েছিল সেগুলো নিয়ে এসেছিল। মূলত এই উদ্দেশ্যেই নিয়েছিল যে একদিন আমায় নিয়ে একাই সারা শহর ঘুরবে। ঘুরাঘুরি শেষে তার কথা মতো দু’জন সেই খালের ব্রিজের পাশে বাগানে গিয়ে বসলাম। এখানে আম, কাঁঠাল, আঙুর গাছ থেকে শুরু করে সব আছে। এখানে আমি আর রিশান প্রায় আসতাম। মিহির বলল, ‘জানো ভাবী? তোমার সাথে ভাইয়ার রিলেশন হওয়ার আগে আমি, আপু আর ভাইয়া এখানে আসতাম৷ কত্ত মজা করতাম। মনে আছে একবার তোমাকে সহ নিয়ে এসেছিল? কিন্তু.. ওই রুমি আর আম্মু সব মজা মিটিয়ে দিল। আর এখন ভাইয়া.. আমার পুরো পরিবারটাই ধ্বংস হয়ে গেছে।’
আমি মনমরা হয়ে বললাম, ‘সব আমার জন্য হয়েছে তাই না মিহির?’
‘আরে আরে কী বলছো ভাবী? তোমার জন্য কেন হবে? পারলে তুমি উপকার করেছো। এই পরিবারের আসল রূপ সামনে এনেছো আমার।’
দু’জন প্রায় বিশ মিনিট এভাবেই গল্প-গুজব করলাম। একটু পর হঠাৎ মিহির একদিকে তাকিয়ে আস্তে করে বলে উঠল, ‘ভাইয়া!’
তার দেখাদেখি আমিও তাকালাম। বুকটা ধক করে উঠে। তার মানে সত্যি সে.. রিশান এক হাতে এক মেয়েকে জড়িয়ে ধরে হেসে হেসে এগিয়ে আসছে। মেয়েটা তার দিকে বাদাম এগিয়ে দিচ্ছে। রিশান খাচ্ছে আর মাঝে মধ্যে হুট করে কামড় বসিয়ে দিচ্ছে। সাথে সাথে চোখ সরিয়ে নিলাম আমি। কী বাজে দৃশ্য! রিশান আর মেয়েটা খালের ধারে শুকনো মাটিয়ে বসল। মিহির বলল, ‘ভাবী। এটাই সঠিক সময়। এক্ষুণি ভাইয়াকে ধরো।’
‘না মিহির। আমি ওকে ধরবো না।’
‘মানে কী ভাবী? তাহলে আমি ধরছি তুমি যাও।’
‘না মিহির। এত সহজে ওকে আমি ছাড়ব না। এতদিন সহজ আমিকে দেখেছো। এখন কঠিন আমিকে দেখবে।’
‘কী করবে তুমি?’
‘করব। এত সহজে এই পরিবার কে আমি ছাড়ছি না। আমার সাথে দু’বছরে যা করেছে সব শোধ নিব। তবে সেই শোধ আমি নই। আল্লাহ্ নেবেন। আমি সব তার উপর ছেড়ে দিয়েছি। ব্যস আমি শুধু দেখে যাব। আর..’
‘আর কী?’
‘দেখে যাও।’
দেখলাম মিহিরের মুখে চিলতে হাসি ফুঁটে উঠেছে। তারপর দু’জন মিলে রওনা দিলাম বাড়ির উদ্দেশ্যে। খুব কঠিন একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমি। খুব কঠিন!
[চলবে.. ইনশা আল্লাহ্]
[ ভুলত্রুটি মার্জনীয়। গঠণমূলক মন্তব্য আশা করছি।]