অপ্রাপ্তি পর্ব-০১

0
2649

#অপ্রাপ্তি 💔
#ইবনাত_আয়াত
#সূচনা_পর্ব

কাপড় ধোঁয়ার সময় রিশানের শার্টে লিপস্টিকের দাগ দেখে মনে কিছুটা ভয় ঢুকে গেল আমার। রিশানের শার্টে লাল লিপস্টিকের দাগ? সচরাচর আমি লিপস্টিক দিই না। বলতে গেলে আমার বিরক্ত লাগে। তাহলে রিশানের শার্টে লিপস্টিকের দাগ আসবে কি করে? কেন যেন বিষয়টা আমাকে সন্দেহের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। কোথাও কারো সাথে তার এফেয়ার… না না এসব কি ভাবছি আমি? এটা হতেই পারেনা। আমাদের বিয়ের প্রায় দু’বছর পেরিয়ে গেছে। আর ও আমাকে বরাবর’ই খুব ভালোবাসে। তাহলে এসব? তার মানে কি সত্যি? ভাবতেই কেন যেন ঘেন্না ধরে যাচ্ছে। আর কিছু না ভেবে মনে এক রাশ ব্যথা নিয়ে তার কাপড় সব কেচে ধুঁয়ে শুকাতে দিয়ে এলাম। ঘরে ফিরে দেখি রিশান মোবাইলে মত্ত। মনোযোগী দিয়ে তাকিয়ে আছে ফোনের দিকে। মুখে সেই ভুবনভুলানো হাসি লেগে আছে। অন্য কোন সময় হলে মুগ্ধ হতাম। কিন্তু এখন তা হতে ইচ্ছে করছে না। হাসিটা দেখেই আরো ঘৃণা জমা হচ্ছে মনে। বিছানায় বসলাম ভারাক্রান্ত মনে। ইদানিং তেমন একটা কথা হয় না আমাদের মাঝে। সকাল আট’টায় অফিসে যায় আর ফিরে সন্ধ্যে সাত’টায়। এর মাঝে তেমন কথা হয়না। রাতে সে এক দু’টো কথা বলে আর তারপর সে তার ফোনেই বিজি হয়ে যায়৷ আর আমি ঘুমিয়ে পড়ি। এখন বুঝতে পারছি কেন এমন এড়িয়ে যাওয়া। ছিহ্! ওর মনে এটা ছিল?

‘কী ব্যাপার ইবনাত? এভাবে বসে আছো কেন?’

কিছু বললাম না। নিজের মতোই বসে রইলাম দাঁতে দাঁত চেঁপে। সে এসে এবার পেছন থেকে জড়িয়ে ধরল, ‘ইবুপরি রাগ করেছে?’

বিয়ের আগেও এই নামেই ডাকত সে। আগে মুগ্ধ হতাম কিন্তু এখন! এখন শুধুই ঘৃণা লাগছে। বিরক্ত লাগছে। সাথে তার স্পর্শে গা রি’রি করছে। এক ঝটকায় ছাড়িয়ে উঠে দাঁড়ালাম। সে হতভম্ব। অবাকচিত্তে বলল, ‘কী হয়েছে ইবনাত? এমন করছো কেন?’

‘কিছু হয়নি। ভালো লাগছে না।’

‘ভালো লাগছে না মানে? কেন ভালো লাগছে না?’

‘জানি না।’

বলেই কিচেনের দিকে চলে গেলাম। রান্নাঘরে রিশানের মা মানে আমার শাশুড়ী রাহেলা বেগম দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে চা বানাচ্ছেন। আমাকে দেখামাত্রই উনি উনার বয়ান ঝাড়া শুরু করলেন, ‘এসেছেন নবাবজাদী। এতক্ষণে আসার সময় হলো। তা বলি কি.. এতক্ষণ কই ছিলেন? জামাইকে সময় দিচ্ছিলেন? জামাইকে সময় রাতে দিও এখন না। সেই কবে বললাম চা দিতে, নাহ্ তিনি তা দেবেন না। এখন আমি নিজেই বানিয়ে নিলাম।’

মুখ শক্ত করে বললাম, ‘কাপড় ধুচ্ছিলাম তাই মা। আর আমি শুনতে পাইনি যে আপনি চা বানাতে বলেছিলেন। দুঃখিত।’

‘এহ্! দুঃখিত। দুঃখিত হলেই সব ঠিক হয়ে যায় না। আর কাপড় কি একটু তাড়াতাড়ি ধোঁয়া যায় না?’

‘বেশি ছিল তাই।’

‘হয়েছে হয়েছে। খালি বাহানাই দেখাতে পারো। নাও রাতের রান্না করে নাও।’

‘জ্বী।’

আমি নিজ কাজে লেগে গেলাম। এমন প্রতিদিনই আমার সাথে হয়ে আসছে। রিশান আর আমার প্রেমের বিয়ে। প্রথমে আমার পরিবার মেনে না নিলেও আমার বাবা আমায় প্রচন্ড ভালোবাসেন। তাই তিনি মেয়ের সুখে বাঁধা দিতে চান নি। মেনে নিয়ে আমায় তুলে দিয়েছিলেন রিশানের হাতে। কিন্তু রিশানের পরিবার আমাদের বিয়ে মেনে নিলেও মন থেকে মেনে নেয় নি। রিশান না জানিয়েই বিয়ে সম্পন্ন করে তার দুই বন্ধুকে সাক্ষী রেখে আমায় বিয়ে করে তার ঘরে নিয়ে গিয়েছিল। তা নিয়ে অনেক ঝামেলা হয়েছে। রিশানের মা রাহেলা বেগম আমাকে কিছুতেই পছন্দ করেন নি। সেদিন রিশান বুঝালে তিনি মেনে নেন ঠিক’ই কিন্তু কখনো আমায় পছন্দ করেন নি। বিয়ের পর দিন থেকেই তার সেবায় নিযুক্ত হই আমি। সবসময় সে খুশি হয় এমন কাজ করতাম। কিন্তু তিনি কখনোই খুশি হন নি। রিশানরা দু’বোন দু’ভাই। রিশানের চেয়ে দু’বছরের ছোট তার ভাই ইশান। তার বড় বোন নিশাত। বিয়ে হয়ে গিয়েছে প্রায় দু বছর আগে কিন্তু বর্তমানে বাপের বাড়িতে থাকে৷ আর সবচেয়ে ছোট বোন মিহির। এস’এস’সি পরীক্ষার্থী।

প্রায় দু’বছর পেরিয়ে যায়। আমি ঠিক’ঠাকই তাদের সেবা করে এসেছি কিন্তু কখনো নাম পাই নি। পেয়েছি শুধুই দাসীর টাইটেল। কিন্তু দিন শেষে রিশানের বুকে মাথা রাখলে সব ভুলে যাই। কিন্তু এখন… রিশানও আমার পাশে নেই। সেও আমায় ধোঁকা দিচ্ছে? ভাবতেই চোখ বেয়ে নোনাজল গড়াল দু’ফোঁটা।

.

‘সমস্যা কি তোমার ইবনাত? কিছুদিন ধরেই দেখছি আমায় একদমই ডাকো না৷ কি হয়েছে? আমার কি অফিস নেই? সারাদিন কি তোমার মতো ঘরে বসে থাকি?’

রিশানের কথায় কষ্ট লাগল খুব। কখনো এমনভাবে কথা বলেনি সে। কিছুদিন ধরেই এমন অ্যাগ্রেসিভ বিহেভ করছে। কষ্ট পেলেও তার শেষের লাইনে মাথা চড়ে গেল। ভ্রু কুঁচকে বললাম, ‘সারাদিন ঘরে বসে থাকি মানে? কি বুঝাতে চাইছো তুমি? যে আমি সারাদিন ঘরে বসে থাকি? তুমি কি মনে করো দুনিয়ায় তুমি একাই কাজ করো? আমি কিছু করিনা?’

‘তো? কি করো তুমি? সারাদিনই তো ঘরে শুয়ে বসে থাকো।’

‘হোয়াট ডু ইউ ওয়ান্ট টু মিন রিশান? আমি ঘরে শুয়ে বসে থাকি? তুমি.. কি বুঝাতে চাও তুমি? এই যে রান্না গুলো খাও। এগুলো কে করে? তোমার মা করে নাকি তুমি করো? নাকি তোমার ভাইয়ের বউ এসে করে দিয়ে যায়? তুমি যদি এসির নিচে বসে গণনা করো তো আমি রান্নাঘরের গ্যাসের আগুনের মাঝে কাজ করি তাও দিন রাত। ভাবতে পারো? আমার কি ক্লান্ত লাগে না?’

‘চুপ করো। জ্ঞান ঝারা বন্ধ করো৷ এমনিতেও প্রতিদিন অফিসে দেরি হয় তার উপর তোমার এসব বকবকানি। দিন দিন কেয়ারলেস হয়ে যাচ্ছো৷’

‘রিশান স্টপ! তোমার কি কমন সেন্স নেই যে তোমার অফিস যেতে হবে? তুমি কি নিজে থেকে উঠতে পারো না? আমি মেয়ে বলে আমাকেই আগে উঠতে হবে? আর তাছাড়া রাতে আমি ঘুমও যেতে পারিনা। তোমার মা কখনোই আমায় মেনে নেয় নি। আর না তুমি। সমসময় আমায় খাঁটায় আর ছোট বউকে সাজিয়ে রেখেছে রাজকন্যার মতো। তোমার কি আমার জন্য একটুও দয়া হয় না।’

‘হয়েছে চুপ করো। মাথা টা ধরিয়ে দিল।’

কিছু বললাম না৷ এখন তো আমি পুরনো। সে নতুন কাউকে পেয়েছে৷ কিন্তু আমি এখন কি করব? সেটাই আমার মাথায় আসছে না। রিশান নিচে চলে যায়। যদিও তেমন দেরি হয়নি। তার অফিস ন’টায় আর সে যায় আট’টায়। আগে যেত না। কয়েকমাস ধরেই নজরে আসছে বিষয়টা। নিচে গেলাম। সবাই সব চেয়ার দখল করে বসে আছে। আমার বসার জায়গা টুকুও নেই। প্রতিদিনই এভাবে নিপিড়ীত হয়ে আসছি আমি। সবাই খেয়েই যাচ্ছে। কেউ বলছে না, ইবনাত বসো আমাদের সাথে খাও। একটু পর মিহির লক্ষ করল আমি দাঁড়িয়ে আছি৷ সে ভ্রু কুঁচকে বলল, ‘কী ব্যাপার ভাবী? দাঁড়িয়ে আছো যে? বসো খেয়ে নাও ঠান্ডা হয়ে যাবে।’

আমি কিছু বলার পূর্বেই লাবণ্য মানে ইশানের বউ বলে উঠে, ‘বসার জায়গা কই মিহির? তা ছাড়া কাজের লোকেরা বাড়িওয়ালাদের সাথে খায় না এটা মানায় না।’

‘কাজের লোক মানে বুঝলাম না ছোট ভাবী? আর তাছাড়া বসার জায়গা নেই মানে কি? ভাবী! ছোট ভাবীর চেয়ারটার পাশে বসো।’

রুমি বলল, ‘আরে কি বলছো মিহির? দেখতে পাচ্ছো না আমি এখানে আমার প্রয়োজনীয় ফাইল গুলো রেখেছি।’

‘কেন প্রয়োজনীয় ফাইল গুলো এখানে আনলে কেন? রুমেও তো রাখতে পারতে যাওয়ার সময় নিয়ে যাবে।’

‘আমি আবার উপরের যাব কেন?’

‘আচ্ছা ফাইলগুলো, এখন সোফায় রাখো ভাবীকে বসতে দাও।’

‘সরি মিহির এগুলো প্রয়োজনীয়ে ফাইল হারিয়ে যেতে পারে তাই সাথেই রাখতে হবে।’

‘আশ্চর্য তাহলে কোলে রাখো। তাই বলে কি একটা মানুষকে রাত দিন খাঁটানোর পর এভাবেই দাঁড় করিয়ে রাখবে?’

‘কাজের মেয়েদের খাঁটতে হয় মিহির। তুই খেয়ে নে ওর চিন্তা করিস না।’

মিহির তার ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ভাইয়া তুমিও কী কিছু বলবে না?’

রিশান বরাবর’ই মোবাইলে মনোযোগী। ইদানিং মোবাইলই তার সঙ্গি। মোবাইলের সারাক্ষণ চোখ লেগে থাকে। কি করে সেই জানে। মিহির টেবিলে বারি দিয়ে বলল, ‘ভাইয়া তুমি কি শুনতে পাচ্ছো আমি কি বলছি?’

রিশান বিরক্ত হয়ে বলল, ‘কী? খাওয়ার সময় এত কথা বলছিস কেন? খেয়ে স্কুলে চলে যা।’

‘মানে কী? দেখছো না সবাই ভাবীকে কাজের মেয়ে বলছে, বসার জায়গা টুকু দিচ্ছে না আর তুমি বসে বসে খাচ্ছো? আর তোমার প্রাণের ফোন টিপছো?’

রিশান বিরক্ত হয়ে আবারো ফোনে মনোযোগী হয়। মিহির রাগে গজগজ করছে। শেষে তার চেয়ারের দিকে ইশারা করে বলল, ‘ভাবী তুমি এখানে বসো।’

আমি চমকে বললাম, ‘কী বলছো এসব মিহির? তোমার স্কুলের দেরি হচ্ছে খেয়ে নাও। আমি পরে খেয়ে নেব।’

মিহির জোর গলায় বলল, ‘স্কুল ফ্যাক্ট না। ফ্যাক্ট হচ্ছে একটা মানুষ দীর্ঘক্ষণ কাজ করে খেতে এসেছে আর তার বসার জায়গা নেই? আমি বসে খাবো? সবাই পাষাণ হতে পারে আমি না।’

রাহেলা বেগম ধমকে বললেন, ‘মিহির! চুপ কর বেশি কথা বলিস না। তোর ক্লাস আছে খেয়ে দেয়ে স্কুলে চলে যা।’

মিহির থামে না, ‘ওদের বলে দাও ভাবী। যে পরিবারের খেঁটে যাওয়া মানুষটাকে একটু খাওয়াতে। নয়তো আমি এই খাবার খাব না।’

‘মিহির প্লীজ পাগলামো করো না তোমার দেরি হচ্ছে।’

‘না ভাবী। আমি তোমাকে না খাইয়ে ছাড়ছি না।’

শশুড় আব্বু মানে রবিউল হাসান বললেন, ‘তুই কি বলতে চাইছিস বল তো মিহির?’

‘তোমার ছোট বউকে বলো তার এসব প্র-য়ো-জ-নী-য় ফাইলগুলো সরাতে।’

রবিউল হাসান খাবারে মন দিলেন। মিহির হতাশ আর রাগ হয়। এবার সে উঠে সত্যি সত্যি রুমির ফাইলগুলো সবার সামনে হেঁচকা টান দিয়ে তুলে সোফায় এক প্রকার ছুড়ে মারল। মেয়েটা বড্ড জেদি। রুমি চেঁচিয়ে উঠে, ‘হোয়াট ইজ ইট মিহির? তোমার সাহস তো কম নয় তুমি আমার সামনে এগুলো ফেলে দিচ্ছো? নষ্ট হয়ে গেলে কি এর মাশুল তুমি দেবে?’

মিহির গা ছাড়া ভাব নিয়ে বলল, ‘সোজা কথায় কাজ হচ্ছিল না। তাই বাঁকা পথটাই বেছে নিয়েছি।’

ইশান চিল্লিয়ে বলল, ‘মিহির ভীষণ বে-আদবি করছিস তুই। তুই তোর ভাবীর সঙ্গে বে-আদবি করছিস।’

‘তো ভাবী যে তার বড় ভাবীর সঙ্গে করছে তা কি ভাইয়া?’

ইশান চুপ মেরে যায়। মিহির এগিয়ে এসে আমার হার ধরে টেনে তার পাশে চেয়ারটা টেনে বসিয়ে দিল। আর আমার পাত্রে রুটি সহ পুরো এক বাটি মাংস তুলে দিয়ে নিজে খাওয়ায় মন দিল। সবাই আমাদের দু’জনের দিকে এমন ভাবে তাকিয়ে আছে যেন পারলে খেয়ে ফেলে। কিন্তু মিহিরের ভাবান্তর নেই। সে আপন মনে খেয়েই যাচ্ছে। মুখে এক চিলতে হাসি ফুঁটে উঠল। আর কেউ আমায় পছন্দ না করুক এই মেয়েটা আমায় সবসময় ভালোবাসে তার আপন বোনের মতই। বিয়ের প্রথম দিন থেকেই সে আমায় ভাবী মেনে নিয়েছে। যখন আমাদের বিয়ে হয়েছিল তখন সে ক্লাস নাইনে পড়তো। আর তাকে দেখেই বুঝে গিয়েছিলাম সে খুব জেদি আর একরোখা। আর কেউ যত্ন না করুক সে করবে। আর কেউ খেতে না ডাকুক সে অবশ্যই ডাকবে। আমাকে কাজে সাহায্যও সেই করবে। রাহেলা বেগম জানেন সে জেদি আর রাগী তাই তাকে তেমন কিছু বলতে পারেন না।

.

‘রিশান, জান কবে আসবে তুমি? আমি সেই কখন থেকে তোমার জন্য অপেক্ষা করে আছি। তুমি কি তাহলে আসবে না?’

মেসেজ টা চোখে পড়তেই মস্তিষ্ক খালি হয়ে গেল। রিশান গোসল করতে ঢুকেছে। আর তার অফ-ডে৷ আমি ফোনে মেসেজিং করছিলাম কলেজ লাইফের ফ্রেন্ডদের সাথে গ্রুপে। তখন’ই ভাস টেবিলে থাকা রিশানের ফোন বেজে উঠে। স্ক্রিন অন হয়ে যায় আর লেখাটি স্ক্রিনে ভেসে উঠে। তার মানে কি আমার সন্দেহই ঠিক? রিশান.. নাহ্ আর কিছু ভাবতে পারছিনা আমি। আমায় সব জানতে হবে। সন্তর্পণে তার মোবাইলটা হাতে নিলাম। লক খুলতেই যাব তখনই…

[চলবে.. ইনশাআল্লাহ]

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে