অপ্রত্যাশিত বাসর
০৭.
মৃদু আবহাওয়াতেও তিরতির করে ঘামছে পূণম। ঘেমে-নেয়ে একাকার অবস্থা তার। হাত-পা গুলোও কাঁপছে থরথর করে। গলা শুকিয়ে বিশাল মরুভূমি হওয়ার জোগাড়। জিভ দিয়ে বার বার ঠোঁট ভেজাচ্ছে ও। এতে করে কিছু সময়ের জন্য ঠোঁট ভিজলেও ওর ভেতরটা ঠিকই শুকিয়ে আছে।
আরচোখে সে আর্ভিনের দিকে তাকায়। আর্ভিন ভ্রু কুঁচকিয়ে তার দিকেই তাকিয়ে আছে। চোখে চোখ পড়তেই সে থমথমে গলায় জিজ্ঞেস করে,
– কি সমস্যা? এমন অদ্ভুত আচরণের কারণ কি? স্বামী হই তোমার। তো অধিকার দিতে কি প্রবলেম?’
পূণম শুকনো ঢোঁক গিলে আর্ভিনের । তোতলাতে তোতলাতে জবাব দেয়,
– পানি খাবো আমি। পিপাসা পেয়েছে।’
– পানির কি দরকার? আমি আছি কি করতে? এসো, আমি মিটিয়ে দিচ্ছি তোমার তৃষ্ণা।’
পূণম এবার অসহায় দৃষ্টি নিক্ষেপ করে। আর্ভিন যদি ওর ঘাড় মটকে তাজা রক্ত পান করতো, তা হলেও সে এতটা ঘাবড়ে যেত না। এমন ভয়ংকর পরিণতির কথা জানলে, ফোনের কথা সে ভুলেও আর্ভিনকে জিজ্ঞেস করতো না। আর আর্ভিনও কিছু বুঝতে পারতো না এবং এই ধরনের কথাও সে বলতো না। নিজের উপরই ভয়ংকর রাগ হচ্ছে ওর। ইচ্ছে করছে, নিজেই নিজের ঘাড় মটকে দিতে।
ভেতর থেকে এক পৃথিবী সমান কান্না গলায় এসে দলা পাকিয়েছে পূণমের। সে ভাঙা ভাঙা গলায় করুণ সুরে বলার চেষ্টা করে,
– প্লিজ! আমায় সময়..’
– দিতে চেয়েছিলাম সময় তোমায়। বাট ইউ নো ওয়াট? ইউ ডোন্ট ডিজার্ভ ইট? বাই দ্য ওয়ে, সময় দেওয়ার কথা আসছে কেন? হোয়াই? আমরা হাজবেন্ড অ্যান্ড ওয়াইফ। তাই না? তাহলে কি সমস্যা তোমার?’
ছোট নিঃশ্বাস ফেলে পূণম। কাঠ কাঠ গলায় জবাব দেয়,
– আপনিও জানেন, আমিও জানি, বেঁচে আছে হৃদম। তাহলে কিসের স্বামী-স্ত্রী আমরা? হুওও??’
– তুমি ডিভোর্স পেপারে সাইন করেছো। আর হৃদমও। কিছু ফালতু টার্মস অ্যান্ড কন্ডিশনের জন্য লিগ্যাল পেপার হাতে পাও নি এখনো। আর তুমি নিজে আমাদের রেজিস্ট্রি পেপারে সাইন করেছো। চার দিনও হয়নি। ভুলে গেছো হয়তো। তাই মনে করিয়ে দিতে চাইছি, আমরা কিসের স্বামী-স্ত্রী।’
আর্ভিন নির্বিকার ভঙ্গিতে বেশ শান্ত ভাবেই পূণমের কথার জবাব দেয়। দুই পা এগিয়ে গিয়ে কোলে তুলে নেয় পূণমকে। পূণম ছুটোছুটি করলে সে ধীর পায়ে বিছানায় নিয়ে যায় ওকে। দুই হাতে আবদ্ধ করে নেয় পূণমকে। ঠোঁটের উপর দৃষ্টি স্থির রেখে সামান্য ঝুঁকতেই পূণম কাঁদোকাঁদো কণ্ঠে বলে,
– আপনাকে মানতে পারছি না আমি। প্লিজ এমন করবেন না।’
আর্ভিন পূর্বের ভঙ্গিতেই উত্তর দেয়,
– আজকের পর থেকে মানতে পারবে।’
প্রতিত্তোরে কিছু বলতে পারে না পূণম। রোবটের মতো শক্ত হয়ে থাকে, দম আটকে। আর্ভিন তার কাজে এক ধাপ এগিয়ে গিয়ে মুখ ডুবায় পূণমের গলায়। পূণম হতাশার নিঃশ্বাস ফেলে বলে,
– মেনে তো নেওয়া যায় সুস্থ, স্বাভাবিক কোনো মানুষকে। কিন্ত কোনো বিকৃত মস্তিষ্কের মানুষকে কিভাবে মেনে নেবো আমি?’
প্রত্যাশিত ভারী নিঃশ্বাসেও আওয়াজ না পেলেও পূণমের রিনরিনে গলার অপ্রত্যাশিত কথাটা শুনে আৎকে উঠে আর্ভিন। ধড়ফড় করে সরে আসে পূণমের থেকে। পূণম আবারও শক্ত গলায় জিজ্ঞেস করে,
– বলুন। কিভাবে মানবো আপনাকে?’
আর্ভিন নিরুত্তর। সে বিস্মিত! হতবিহ্বল দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে কেবল।
পূণম বিছানায় উঠে বসে। মৃদু অথচ জোরালো আওয়াজে বলে,
– আপনাকে আমি সাইকো ভাবতাম এতদিন। কিন্তু আপনি আসলে সেটাও নন।’
– মানে? তুমি আমায় কি বলতে চাইছো? আমি পাগল? অসুস্থ?’
– আপনিই বলুন, কোনো সুস্থ মানুষ কি কখনো কারো রক্ত পান করতে পারে?’
পূণমের ভয়াল প্রশ্নে আর্ভিনের হৃৎস্পন্দন বন্ধ হবার উপক্রম। সে তার নীলচে চোখ দুটো গোল গোল করে পূণমের দিকে তাকায়। পূণমও তার দিকে দৃষ্টি রেখে বলে,
– আমি দেখেছি, বেসমেন্টে, কি বিচ্ছিরি গন্ধ সেখানে। ফ্রিজেও ছিল। গুরুত্ব দেই নি প্রথমে। কি..কিন্তু একটু আগেই, আপনি ফ্রেশ হওয়ার সময়। খাওয়ার জন্য ডাকতে এসেছিলাম আমি। তখনও দেখেছি। আপনি রক্ত..’
আর বলতে পারে না পূণম। গলায় কথাগুলো আটকে যায় ওর। ভয়ার্ত চেহারা বানিয়ে আর্ভিনের দিকে তাকায়। আর্ভিন ক্রমাগত তার ঠোঁট কামড়াচ্ছে। তার কি আবার পিপাসা পেয়েছে? রক্তের পিপাসা? ভয়ে কুঁকড়ে উঠে পূণম। আর্ভিন কি এর জন্যই তাকে বিয়ে করে এনেছে? মেরে তার রক্ত পান করতে? আর ভাবতে পারে না পূণম। আবারও ধপ করে বিছানায় শুয়ে পড়ে।
ঝাঁপসা চোখে দেখতে পায় আর্ভিন ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু কোথায়? খুব কষ্টে উঠে দাঁড়ায় সে। বাইরে বের হয়ে আসে। উপর থেকেই দেখতে পায়, আর্ভিনের হাতে কাঁচের সেই বোতলটা। যেটা সে ফ্রিজে দেখেছিল। টকটকে লাল রঙের তরল। এটাই তো রক্ত! ঢকঢক করে যেটা পান করছে আর্ভিন। তার মানে, ওর সন্দেহ ঠিক। আর্ভিন সত্যিই..
শরীরের অবশিষ্ট শক্তিটুকু খরচ করে নিজেকে রুমে টেনে আনে পূণম।
.
.
(চলবে)
#অপ্রত্যাশিত_বাসর
® নবনীতা নূর