অপ্রত্যাশিত বাসর
০৬.
পূণম এখন যে জায়গাটিতে বসে আছে, সেটা হলো আর্ভিনের ডুপ্লেক্স বাড়ির অন্ধকার বেসমেন্ট। অন্ধকারের ভ্যাপসা গন্ধে গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে আছে ওর। একটু পর হয়তো টুপ করে জ্ঞান হারিয়ে ফেলবে। কিন্তু এর আগেই গুরুত্বপূর্ণ একটা কাজ সেরে ফেলতে হবে ওকে।
শুকনো ঢোঁক গিলে পূণম। তড়িঘড়িতে চুরি করে আনা আর্ভিনের ফোনটার পাওয়ার বাটনে চাপ দেয়। কিন্তু স্ক্রিনে আলো আসতেই সে হতবাক, সাথে হতাশ। আগেই ভাবা উচিত ছিল আর্ভিন খুব চালাক। সে নিশ্চয়ই ফোনে লক রাখবে। কঠিন কোনো পাসওয়ার্ড। যা পূণমের ভাবার উর্ধ্বে। হতাশার দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে ও।
চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই ভাবলো, একবার চেষ্টা করলে ক্ষতি কি? যদিও ভাগ্যের কাছে তাকে বারবার হার মানতে হয়, তবুও শেষ বারের মতো একটা রিস্ক নেওয়াই যায়। অজস্র ভাবনাচিন্তার মধ্যে আনমনে হৃদমের ফোনের পাসওয়ার্ডটাই টাইপ করলো পূণম। অতঃপর তাকে অবাক করে দিয়ে নিষ্ঠুর হৃদয়ের মানুষটার হৃদয়হীন ফোনটা খুলে গেল।
পূণম জানতো, আর্ভিন বাড়ি ফিরে ওকে ঘরে না পেলে দিশা হারিয়ে ফেলবে। হন্যে হয়ে খুঁজবে তাকে। তখন তার ফোনের কথা মাথায় থাকবে না। এই সুযোগটাই কাজে লাগায় সে। আর্ভিন যখন তাকে তার ঘরে এবং ওয়াশরুমে খুঁজছিল ও তখন বেড বক্সে লুকিয়ে। আর আর্ভিনও তাকে না পেয়ে তার ফোন, ল্যাপটপ, অফিস-ব্যাগ সব বিছানায় ছুঁড়ে বেরিয়ে পড়ে অন্য রুমগুলো চেক করতে।
আর্ভিন চলে যেতেই পূণম চট করে বেরিয়ে পড়ে বেড বক্স থেকে। হাঁপিয়ে ঘনঘন কয়েকটা শ্বাস ফেলে চলে আসে বেসমেন্টে, আর্ভিনের ফোন নিয়ে। ততক্ষণে আর্ভিনও বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে যায়। পূণমকে কোথাও না পেয়ে।
কাজ শেষে পূণম বেশ স্বাভাবিক ভাবেই নিজের রুমে ফিরে আসে। আর্ভিনের ফোনটা আগের জায়গায় রাখে। আর্ভিন ঘরে নেই। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে কিচেনে গিয়ে রান্না বসায়। সকালের পর আর খাওয়া হয় নি ওর। যদিও খাবার ছিল। খেতে ইচ্ছে করেনি। কিন্তু এখন ইচ্ছে করছে।
ফ্রিজে কাঁচা মাছ, মাংস, সবজি সবই আছে। একটা বাঙালী আইটেম করলে কেমন হয়? আর্ভিন কি খেতে পারবে? পারবে হয়তো৷ যে ছেলে এত সুন্দর বাংলা বলতে পারে, সে বাংলার খাবার খেতে পারবে না কেন? সত্যিই তো? আর্ভিন এত চমৎকার বাংলা কি করে বলতে পারে? সে বাংলাদেশেই বা ছিল কেন? কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ে পূণমের। কিন্তু সে ভাঁজ দীর্ঘস্থায়ী হয় না।
আর্ভিনের ভাষা তার কাছে সহজ হলেও, প্রকৃত পক্ষে মানুষটা মোটেও সহজ নয়। ভীষণ দুর্বোধ্য ভাষায় লেখা একটা বই আর্ভিন। যা পূণমের পড়া বা বোঝার বাইরে। ধরা-ছোঁয়ারও বাইরে।
শেষ পর্যন্ত কড়া করে চিকেন ভেঁজে রান্না করে পূণম। টেবিলে সেটা রাখতেই আর্ভিন হাজির হয়। নীলচে চোখের চারিধারে লালের ছোঁয়া। চোখে-মুখে কি গভীর বিষাদ! এলোমেলো চুলে কি অসহায় লাগছে তাকে! হুট করে মানুষটার প্রতি পূণমের হৃদয়ে মায়ার সঞ্চার হয়। মুহূর্তেই আবার অবাধ্য মনটাকে কড়া করে একটা ধমক দেয় সে।
আর্ভিন এসেই ধপ করে বসে পড়ে চেয়ারে। পূণম বিস্মিত। সামান্য কারণে যে ছেলে হামকি-ধামকি দিয়ে একাকার করে ফেলে, সে আজ এত চুপচাপ? এতক্ষণে তো চারটা লাগিয়ে দেওয়ার কথা ছিল। না-কি ঝড় আসার পূর্ব পরিস্থিতি এটা? কিছু বুঝতে পারে না পূণম। থমথমে পরিবেশ। মিনমিন করে পূণম জিজ্ঞেস করে,
– আপনাকে খাবার দেবো? না-কি ফ্রেশ হয়ে আসবেন আগে?’
আর্ভিন চুপচাপ উঠে চলে যায়। খচখচ করছে পূণমের ভেতরটা। আর্ভিনের শান্ত মেজাজ মেনে নিতে পারছে না সে। এর থেকে ভালো ধুমধাম বকা খাওয়া, দুয়েকটা থাপ্পড় খাওয়াও।
আর্ভিন ফ্রেশ হয়ে নিচে নামে। বেশ সতেজ লাগছে তাকে। পূণম দুজনের জন্য খাবার বাড়ে। আর্ভিনের দিকে খাবার বাড়িয়ে দিতেই একটা চিন্তা মাথায় এলো তার। ইশশ! তাকে দেওয়ার আগে একবার টেস্ট করা উচিত ছিল। যদি সকালের মতো হয়? দূর ছাই! বিকৃত ভঙ্গিতে মুখ বাঁকায় পূণম।
কিন্তু আর্ভিন তাকে অবাক করে দিয়ে নিঃশব্দে খেয়ে চলছে। কোথাও তাকাচ্ছেও না। বলছেও না কিছু। পূণমের খচখচানি বেড়ে যায়। ক্ষিধে পেলেও চরম অনিচ্ছায় খাবার মুখে তুলে সে। এবং আরো একবার আশ্চর্য হয়। এখনকার খাবারটা একদমই পার্ফেক্ট হয়েছে। বরং অন্যান্য বারের তুলনায় আরো বেশী সুস্বাদু।
খাবার শেষেও আর্ভিন কোনো কথা বলেনি। নিঃশব্দে চলে যেতে চায়। পূণমই তাকে পেছন ডেকে বলে,
– আপনার ফোনের পাসওয়ার্ড হৃদমের সাথে মিলে গেল কি করে? মানে, আপনার আর ওর পাসওয়ার্ড সেম। এটা কিভাবে পসিবল?’
আর্ভিন তার কথায় পেছন ফিরে। আগের সেই তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকায়। মন বলছে, কথাটা জিজ্ঞেস করে একটা মস্ত ভুল করে ফেলেছে পূণম। শুকনো ঢোঁক গিলে সে। আমতা আমতা করে বলে,
– আসলে আমি বাগানে ছিলাম। ঘরে ফিরে দেখি আপনার ফোন, ল্যাপটপ পড়ে আছে। তাই!’
কথাটা বলার আগে পূণম একবারের জন্যও বুঝতে পারেনি সে আরো একটা ভুল করছে। বুঝতে পেরেছে আর্ভিনের বাঁকা হাসির প্রস্থানে। সাথে অবাকও হয়েছে খুউব। আর্ভিন নিশ্চয়ই কিছু বুঝতে পেরেছে। এই জন্যই সে এমন অদ্ভুত ভঙ্গিতে হেসেছে। কিন্তু সে তাকে এমনি এমনি ছেড়ে দিল কেন? কেন বললো না কিছু?
এই কেন-র উত্তর সে পায়, খানিক বাদেই। একদম ভিন্ন একটা উত্তর। সম্পূর্ণ ভিন্ন এবং ভয়ানক।
.
.
(চলবে)
#অপ্রত্যাশিত_বাসর
® নবনীতা নূর