অপ্রত্যাশিত বাসর পর্ব-০১

0
6558

অপ্রত্যাশিত বাসর
পর্ব-০১
®নবনীতা নূর

০১.
শ্বশুরবাড়ি আসার ঘন্টা কয়েকের মধ্যেই সংসারের ইতি ঘটে পূণমের। বহু আকাঙ্খিত বাসর ঘরটিতে প্রিয় মানুষের জায়গায় এলো তার মৃত্যু সংবাদ। সংসার শুরুর আগেই বিধবার খাতায় নাম পড়ে উঁনপাজুরে মেয়েটির।

প্রেমের বিয়ে ছিল হৃদমের সাথে তার। দীর্ঘ সম্পর্ক না হলেও অসম্ভব গভীর ছিল সে সম্পর্ক। আট মাসের মান-অভিমান, ঝগড়া, বিরহ, প্রেম সবের সুন্দর দিনগুলো ফেলে বিয়ের পিঁড়িতে বসে দুজনে!

পূণমের সবে এইচএসসি পরীক্ষা শেষ হয়েছে। কোনো এক অনিবার্য কারণে সম্পর্ক শুরুর পর থেকেই হৃদম বিয়ের জন্য প্রেশার ক্রিয়েট করতে থাকে। এবং শেষমেশ তার পিড়াপিড়ি তেই এত দ্রুত অল্প আয়োজনে বিয়ের কাজ সেরে ফেলতে হয় তাদের।

বিয়ের নিয়ম-কানুন এবং সামাজিকতা শেষে পূণমকে সাজিয়ে গুছিয়ে তথাকথিত বাসর ঘরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। সে যখন কাঙ্ক্ষিত মানুষটার অপেক্ষায় ঝিমাচ্ছিল তখনই তার ফোনে অপরিচিত নম্বর থেকে ফোন আসে। বার বার রিঙিং হওয়ার পর এক প্রকার বাধ্য হয়েই ফোন রিসিভ করে পূণম। অতঃপর অপ্রত্যাশিত সে-ই খবরটি শুনেই জ্ঞান হারায় সে।

পূণমের হুঁশ ফেরে পরদিন বিকেলে। ততক্ষণে হৃদমের দাফনও হয়ে গেছে। শেষ বারের জন্য প্রিয় মুখটি দেখার সুযোগ অবধি সে পায়নি। বরং তাকে শুনতে হয় অপয়া, অলক্ষ্মী শব্দগুলো।

অলক্ষ্মী শব্দটার থেকে বাঁচানোর জন্য তৎক্ষনাৎ পূণমের শ্বশুর ভয়ংকর এক সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন। বলা বাহুল্য হৃদমের বাবা রেদওয়ান রায়হান অজানা কোনো এক কারণে পূণমকে অত্যন্ত স্নেহ করেন। উনার এই স্নেহের পরিমাণ অসীম। এর ছোট একটা উদাহরণ হলো, পূণমের বিয়ের শপিং তিনি নিজে করেছেন। পূণমের বিয়ের শাড়িটা অবধি উনারই পছন্দ করে দেওয়া।

বিয়ে বাড়ির রেশ কেটে গেলেও শোকের ছায়া কাটেনি পূণমের শ্বশুর বাড়ি থেকে। চার দিনেও সেখানে নিস্তব্ধ পরিবেশ বিরাজমান। এই চারদিনে পূণমের বাবা, মেহফুজ আহমেদ অত্যধিক বার এসেছেন পূণমকে নিয়ে যাওয়ার জন্য। কিন্তু পূণম কাঠ হয়ে বসেছিল, দরজা-জানালা বন্ধ করে। কথাও বলে নি কারো সাথে। আত্মীয়-স্বজন, প্রতিবেশীদের টিপ্পনী কাটা কথার জবাবেও সে বলেনি কিচ্ছু টি।

কেবল তার শ্বশুরের সাথে বেশ কয়েকবার কথা হয়েছে তার। সেটাও ক্যাজুয়াল কিছু কথা-বার্তা। কিন্তু পূণম বুঝতে পেরেছে তিনি তাকে অন্য কিছু বলতে চাইছেন। আর সেটা বলতেই তিনি সহজ হওয়ার জন্য তাদের কথোপকথন চালিয়েছেন। কোনো এক অজানা আশঙ্কায় পূণম নিজেও কিছু জিজ্ঞেস করতে পারছে না উনাকে।

কিন্তু পূণম জানে, তিনি তাকে চলে যাওয়ার কথাটাই বলবেন। আর সে-ও সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে। মরে গেলেও সে এ বাড়ি ছেড়ে যাবে না, কোত্থাও না। কিন্তু তার নিয়তি বোধ হয় চাইছিল অন্য কিছু।

এক রকম ভাবে মাস খানেক কেটে যায়। পূণমও আগের থেকে কিছুটা স্বাভাবিক হয়। যদিও এটা তার জন্য খুব সহজ ছিল না। সহজ করে দিয়েছেন তার শ্বশুর রেদওয়ান রায়হান। নিজের ছেলের শোক ভুলতে পূণমকে নিজের মেয়ের মতোই আগলে রেখেছেন। তাকে স্বাভাবিক করার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করে যান।

কিন্তু আশ্চর্য জনক সত্যি তার শ্বাশুড়ি বিদেশ থেকে ডিগ্রিধারী হয়েও কুসংস্কারে বিশ্বাসী। হৃদমের মৃত্যুর জন্য তিনি ইনিয়েবিনিয়ে পূণমকেই দায়ী করেন। জাতিতে বাঙালী হলেও ক্যানবেরায় জন্ম হয়েছে উনার। সেখানকার এক ভার্সিটির প্রফেসর ছিলেন রেদওয়ান সাহেব। সেখানেই তাদের প্রথম দেখা অতঃপর প্রণয় এবং পরিণতি বিয়ে। যদিও তার শ্বাশুড়ি মিসেস রায়হানের আগেও বিয়ে হয়েছিল অ্যান্ডি ফ্রাঙ্কলীন নামের এক ভদ্রলোকের সাথে। এমনকি আগের সংসারের ছেলেও আছে উনার।

কিন্তু ভালোবাসার টানে উনি সব ছেড়ে ছুটে আসেন বাংলাদেশে। মাতৃস্নেহের সবটা দিয়ে হৃদমকে মানুষ করে তুলেন। সেজন্যই তার মৃত্যু টা মেনে নেওয়া উনার জন্য অত্যধিক কঠিন হয়ে পড়ে। প্রচণ্ড ভাবে ভেঙে পড়েন মানসিক যন্ত্রণায়। সেজন্যই পূণমকে সহ্য করতে পারছেন না তিনি।

যাই হোক, ঠেলেঠুলে মাস পেরুতেই পূণমের জীবনে নতুন এক ঝড়ের আবির্ভাব ঘটে। আর এই ঝড়ের সূচক তার শ্বশুর রেদওয়ান রায়হান। কাউকে কিছু না জানিয়ে তিনি পূণমের বিয়ে ঠিক করে ফেলেন, আর্ভিন নামের কারো সাথে। বিয়ের কথা তাকে জানানো হয় রেজিস্ট্রি পেপার হাতে দিয়ে।

কিন্তু পূণম তার সিদ্ধান্তে অটল। সে বাকি জীবন হেসেখেলে দিব্যি কাটিয়ে দিবে হৃদমের স্মৃতি আঁকড়ে। জান গেলেও সে অন্য কাউকে বিয়ে করবে না। না, না, না। কিন্তু তার শ্বশুর তাকে অবাক করে দিয়ে তিনি নিজের জান দিয়ে দেন তার বিয়ের জন্য। আত্মহত্যার চেষ্টা করেন রেদওয়ান রায়হান।

অবস্থা খারাপ থাকার কারণে তিন দিন আইসিইউতে রাখা হয় উনাকে। বারো দিনের মাথায় বাড়ি নিয়ে আসা হয়। এবং এক ভয়ানক পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে বিয়ে হয়ে যায় পূণমের, আর্ভিন নামের সেই ছেলেটার সাথে। শুধু বিয়েই নয়, পূণমের জন্য আরো একটা চমৎকৃত বিষয় ছিল তার দ্বিতীয় বাসর রাত। নাম মাত্র সেই তথাকথিত বাসর রাতটা তার জীবন পুরোপুরি বদলে দেয়।
.
.
(চলবে)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে