#অপেক্ষার_প্রিয়_প্রহর
#পর্বঃ৩
#সাদিয়া_ইসলাম
‘এই তো ভাইয়া, আমার অপেক্ষা করছে হয়তো।’
ওয়াজিহা এবং ইরাদের কথার মাঝেই অন্য একটি নারী কণ্ঠস্বরের উপস্থিতি বুঝতে পেরে সেদিকে দৃষ্টি ঘুরালো ইরাদ। ওয়াজিহা ঘুরে দাড়ালো। দুজনের সামনে হাস্যজ্বল মুখশ্রী নিয়ে দাড়িয়ে আছে একটি মেয়ে, রাবিয়া। ওয়াজিহার বেস্টফ্রেন্ড। ভার্সিটিতে এসে ভেতরে যাওয়ার আগেই ওয়াজিহাকে বাইরে নজরে পরায় সে রিকশা থেকে নেমে সোজা ওয়াজিহার কাছেই আসে। এসে ইরাদের প্রশ্ন কানে পরায় সে উত্তর দেয়। ইরাদকে রাবিয়া চিনে। ওয়াজিহার বড় বোনের চাচা শ্বশুরের ছেলে। ওয়াজিহার সূত্রে অলির আকিকার সময় ওয়াজিহার বোনের শ্বশুর বাড়িতে গেলে পরিচয় হয়েছিলো। রাফাও ওয়াজিহার মতোই রাবিয়াকে বোনের থেকে কিছু কম দেখে না। এজন্য রাবিয়ার কাছে রাফার শ্বশুর বাড়ির মানুষদের পরিচিতি অজানা নয়। ওয়াজিহা রাবিয়াকে দেখে ওর দিকে এগিয়ে এসে ওর পাশে দাড়িয়ে বাহুতে হালকা চাপড় মেরে বললো,
‘তোর আসতে এত দেরি হলো কেন?’
‘বলিস না, বাসায় তো জানিসই ক্যাসেট বাজে বাবা মায়ের। মেয়ে বড় হয়েছে, বিয়ে দিতে হবে। পাত্রপক্ষ নাকি আসবে! এজন্য আমায় ভার্সিটিতে আসতে দিবেনা। ওসব নিয়ে ক্যাঁচাল করে বাসা থেকে বেরোতে বেরোতে দেরি হয়ে গেলো। যাই হোক তুই এত ফার্স্ট চলে আসছিস! এমনিতে তো আমারই এসে তোর জন্য অপেক্ষা করতে হয়!’
‘ এমনি, আজ ঘুমটা চট করেই ভেঙে যাওয়ায় এসেছি।’
দু-বান্ধবী নিজেদের মাঝে কথাবার্তা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পরায় ইরাদের কথা বেমালুম ভুলে বসেছে নাকি! কেউ তার সাথে কথাই বলছে না! সে যে জলজ্যান্ত একটা মানুষ এখানে দাড়ানো! একদমই খেয়াল নেই দুজনের! এমন টাই মনে হলো ইরাদের কাছে। ইরাদ ভ্রুকুটি করে দুজনকেই দেখে নিয়ে ইতস্ততভাবে বললো,
‘ওকে, আপনারা নিজেদের দিনটি উপভোগ করুন। আমি বরং যাই, আমারও অফিসে কাজ জমা পরে আছে।’
ইরাদের কথা ওয়াজিহা এবং রাবিয়ার কর্ণগোচর হতেই দুজনে ইরাদের দিকে তাকালো। ওয়াজিহা জিভে কামড় দিয়ে চাহনী ছোটো করে ইরাদকে বললো,
‘এই রে দেখুন না, বান্ধবীকে পেয়ে আপনার সাথে কথা বলতেই ভুলে গেলাম। এখনই যাবেন! আমাদের দুজনের পক্ষ হতে এক কাপ কফি-ই না হয় খেয়ে যান। ক্যাফে আছে সামনেই। আপনি বেশি ব্যস্ত না হলে চলুন বসা যাক!’
ইরাদ সংকোচে পরলো ওয়াজিহার কথায়। মাত্রই কাজের কথা বললো। এখনই যদি আবার বলে, কাজের প্রেশার নেই, চলুন বসা যাক! মেয়েটা কি ভাববে তাকে? ইরাদ নিজ মনেই নিজেকে প্রশ্ন করলো। না বিষয়টা শোভনীয় হবেনা। একবার কাজের কথা বলে চলে যেতে চেয়ে, আবার প্রেয়সীর নজরে দেখা মানুষ-টির সাথে সময় কাটানোর লোভে কাজ নেই বললে! এক মুখে দু রকম কথা হয়ে যাবে বিষয়টা। ইরাদকে চুপ থাকতে দেখে রাবিয়া প্রশ্ন করলো,
‘কি হলো ইরাদ ভাই? এনিথিং রং! আপনার সমস্যা হবে? কাজের জন্য কি সময় মিলছেনা?’
‘আরে বিষয়টা তেমন নয় রাবিয়া। আপনারা ক্লাসে যান। আসলেই একটু কাজের তাড়া আছে। আপনাদের দিনটি সুন্দর কাটুক। আমি আসি, পরে কোনো একদিন একসাথে বসে কফি পান করা যাবে, সাথে আড্ডাও দেওয়া যাবে। আল্লাহ হাফেজ।’
ঠোঁটে হাসির রেখা টেনে দুজনকেই কথাগুলো বলে বিদায় জানিয়ে ইরাদ নিজের গন্তব্যের উদ্দেশ্যে হাঁটা ধরে। ওয়াজিহা এবং রাবিয়া-ও ইরাদ চলে যেতেই দুজনে হাঁটতে হাঁটতে ভার্সিটি চত্বরে প্রবেশ করে। নিজেদের ডিপার্টমেন্টের দিকে অগ্রসর হতে হতে ওয়াজিহা জিগাসা করে,
‘আংকেল আন্টি-র আবহাওয়া আজ কেমন? গরম কি বেশিই?’
‘তাতানো তাওয়ায় ঘি ঢেলে আসছি। ঠান্ডা হবার কথা নয়।’
‘এমনটা না করলেও তো পারিস!’
‘আর কয়েকটা মাস, এরপর মাস্টার্স কমপ্লিট হয়ে যাবে। তখন কি বিয়ে দেওয়া যাবে না? কয়েক মাসেই একদম আমার বয়স আশি বছর বেশি হয়ে যাবে তাইনা? এতগুলো বছর ধৈর্য নিয়ে পড়াশোনা করাতে পারলে! তোর আংকেল আন্টি কয়েকমাস কেন আমার বিয়ে না দিয়ে থাকতে পারছেনা? এখন বিয়ে-টা করি! পরীক্ষা দিতে দেয় কি না দেয়! ঠিক নেই। দিতে দিলেও ফেল করলে? আমার অবস্থা কোথায় গিয়ে দাড়াবে? একটু ভেবেছিস কখনও?’
‘মানুষ আজকাল নিজের কথা ব্যতিত অন্যের কথা কমই ভাবে রাবু। তোর মতো বোকা সবাই না। তুই আমার কথা ভাবিস বলেই যে আমি তোর কথা ভাবিয় বিষয়-টা এমন নয়।’
‘তুই না বললেও আমি জানি, বিষয়টা কেমন! চল ক্লাসের টাইম হয়ে আসছে। ক্লাস শেষে এসব আলোচনা করা যাবে।’
‘এমনিও আজ তোর বাসায় থাকবো, ক্লাস শেষে বা রাতে অনেক আড্ডাই দেওয়া যাবে।’
‘আমার বাসায়!’
রাবিয়া অবাক হয়ে ওয়াজিহার দিকে তাকালো। ওয়াজিহা স্বভাব সুলভ শান্ত ভঙ্গিতেই হেটে চলেছে। রাবিয়া ওয়াজিহার তার বাসায় থাকার কারণ টা বুঝে আসতেই বিস্মিত কণ্ঠে জিগাসা করে,
‘আবার উনারা আসছেন? উনারা না আসলে তো তোকে ধরেবেধেও আমার কাছে রাখা যায়না৷’
‘হু উনারা আসবেন, আমি চাই না আমার জন্য উনাদের আবার পরশ ভাইয়ার সাথে তর্কাতর্কি হোক৷ কয়েকটা দিন-ই তো এসে থাকেন উনারা। একটু শান্তিতেই ছেলের কাছে থাকুন। এমন মানুষ আমি দেখ! আমার জন্য মা সন্তানের মাঝেও দূরত্ব। পরশ ভাইকে এতো অনুরোধ করেও মানানো যায়নি। বুক ফেটে শুধু দীর্ঘশ্বাসই আসে রে রাবু।’
‘বাদ দে, এসব কথা না উঠানোই ভালো।’
দুজনই ক্লাসের কাছে এসে পরায়, নিজেদের মাঝে আলোচনা বন্ধ করে ক্লাসে ঢুকে পরে।
……..
অফিসে ঢুকেই নিজের কাজ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পরেছে ইরাদ৷ বেশিদিন হয়নি সে চাকরি টায় যুক্ত হয়েছে, পাঁচ মাস হলো সবে। এজন্য কাজ বেশি চাপের না হলেও কাজগুলো করতে বেশ বেগ পোহাতে হয় ইরাদের। ভাগ্যিস পরশ ছিলো, নয়তো কাজগুলো ঠিকঠাক ভাবে করে চাকরি বাঁচানো-ই দায় হয়ে যেতো। আজকাল যা কঠিন সময় যাচ্ছে সবার। পড়াশোনা শেষ করে চাকরির অভাবে যুবকরা রাস্তায় রিকশা নিয়ে নামে, নানান পন্থা অবলম্বন করে জীবিকা নির্বাহ করে। সে তুলনায় পরশের সহায়তায় চাকরি-টা যোগার করতে পেরেছে ইরাদ। পরশ তার সিনিয়র হলেও এমন পাওয়ার নেই যে! তার রেফারেন্সেই চাকরি হবে। শুধু তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করেছিলো পরশ। নিজের ডেস্কে বসে কলম হাতে নিয়ে ঘুরাঘুরি করাতে করাতেই আনমনে এসব ভাবছিলো ইরাদ। তখনই তার ডাক পরে পরশের কেবিনে। সে পরশের কেবিনে প্রবেশ করতেই পরশ ইরাদের দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে বললো,
‘বসে পর এখানেই। কিছু দরকারই কথা ছিলো।’
ইরাদ বসতে বসতেই ঘাড় নাড়িয়ে উত্তর দিলো,
‘হুম বলো, কি দরকারি কথা?’
‘অফিশিয়াল কাজকর্মের কথা, পারিবারিক নয়। কিন্তু অফিসের কাজের কথা সেরে পারিবারিক কিছু কথা বলাও জরুরী।’
‘হুম বলো, আমি শুনছি।’
ইরাদ জবাব দিতেই ওরশ সব কাজ বুঝিয়ে দেয় অফিসের। এরপর সামনের টেবিলের উপর কনুইয়ের উপর দুহাত ভর করে বলে,
‘আজ আম্মা আব্বা গ্রাম থেকে আসবেন। চাচীকে নিয়ে সময় করে আমার বাসায় গিয়ে একবার ঘুরে আসিস। এমনিতে কাজের প্যারা, দুই পরিবারে অনেকদিন নিজেদের মতো সময় কাটানো হয়না।’
ইরাদ সব কথা শান্ত ভাবে শুনে চেয়ারে গা এলিয়ে ঘাড়ে একহাত দিয়ে চিপে ধরে আয়েশী ভঙ্গিতে বলে,
‘কাপুরুষ-টাও আসবে নাকি ভাইয়া? আসলে অন্তত আমার রাগ টা ঝাড়তে পারতাম।’
‘কাপুরুষ হোক বা সুপুরুষ, ও আমাদের ভাই ইরাদ। রাগ দেখানো বিষয়-টা কেমন দেখায়?’
‘তোমার ভাই অপমানিত বোধ করবে বলে ভয় করছো? এই ভয়টা সত্যি করে ফেস করেছে তোমার শালীকা নামক মেয়েটি। কই তাকে তো সবার কথা থেকে বাঁচাতে বিষয়টা কেমন দেখায়! এটা তো ভাবোনি ভাইয়া?’
‘সব ঝামেলার পর্ব মিটিয়ে বউ-সন্তান, শালীকা সবাইকে নিয়ে নতুন করে সংসার সাজিয়েছি ইরাদ। আর কি করতে বলিস আমায়?’
‘আচ্ছা বাদ দাও সেসব কথা। উনাকে বিয়ে দিবে না? পাত্র দেখছো?’
‘বিয়ে দেওয়ার কথা রাফা ভাবছে। কিন্তু ওয়াজিহা যে জেদি! ওর সম্মান এমনি দু দুবার আমাদের পরিবারের মাধ্যমে হারিয়ে বসেছে। নিজের চিরচেনা গ্রাম ছেড়েছে আমাদের ভুলে। সেই মেয়ের অমতে গিয়ে বিয়ে কি করে দেই?’
‘উনি তো বাচ্চা খুকি নন, মতামত নিয়েই বিয়ের জন্য পাত্রের সন্ধ্যান করতে পারো।’
‘মতামত নিয়েও বিয়ের কথা বললে পাত্রপক্ষ ওর সম্পর্কে সব শুনে পিছিয়ে যায়। কারণ ও চায় ওর সত্যিটা যে পরিবার এক্সেপ্ট করতে পারবে! সেই পরিবারেই বিয়ে করবে। আড়াল করে কিছু করবেনা।’
পরশের কথা শুনে ইরাদ ক্ষান্ত হয়। একদিকে তার মা এক জেদি, অন্যদিকে আড়ালে যাকে ভালোবেসে চলেছে! সে এক জেদি। দুই জেদি মানুষকে কি করে মানাবে বুঝতে পারছেনা ইরাদ। মায়ের কাছে তবুও ওয়াজিহার কথা বলতে পেরেছে ইরাদ। কিন্তু ওয়াজিহার সামনে গিয়ে কি করে বলবে যে, সে তাকে ভালোবাসে, বিয়ে করতে চায়। যদি ওয়াজিহা না মানে! তাকে রিফিউজ করে? এখন তবু একতরফা ভালোবাসা আছে, তখন শুধু ফিরিয়ে দেওয়ার কষ্টই রয়ে যাবে। ইরাদকে চুপচাপ বসে থাকতে দেখে পরশ বললো,
‘যা ঝটপট কাজগুলো সেরে ফেলে। দুই ভাই একসাথেই ছুটির পর বেরুবো আজ। এরপর তোদের বাসায় গিয়ে চাচীকে সাথে নিয়ে আমার বাসায় ফিরবো।’
‘কিন্তু তোমার সাথে আমার কিছু জরুরী কথা ছিলো ভাইয়া।’
‘কি কথা?’
‘অফিস থেকে বাসায় ফেরার পথেই বলবো।’
‘ওকে।’
ইরাদ পরশের কেবিন ছাড়ে৷ পরশ চেয়ারে মাথা এলিয়ে ভাবে, ইরাদের কথাগুলো ফেলে দেওয়ার মতো নয়। সত্যিই এবার ওয়াজিহার জীবনটা গুছিয়ে দেওয়া জরুরী। মেয়েটা কেমন পাল্টে যাচ্ছে, হাসে না, নিজের যত্ন নেয়না। দিনদিন যেনো পাথরে পরিণত হচ্ছে। এরকম হওয়ার পেছনে যেহেতু তার পরিবারের দায় আছে অনেক টা, সেহেতু তাকেই পদক্ষেপ নিতে হবে। বড় ভাই হিসেবে দায়িত্ব যখন নিয়েছে, এবার পূরণ করতেই হবে। পরশ চিন্তাভাবনা ছেড়ে কাজে মনোযোগ দিলো। এদিকে ইরাদ পরশের কেবিন থেকে বেরিয়ে নিজের ডেস্কে বসতে বসতে চিন্তা করছে, “পরশকে কথাগুলো বলা ঠিক হবে তো! যদি উল্টো প্রতিক্রিয়া আসে। উফ কি একটা যন্ত্রণা ভালোবাসায়। ভালোবাসা যেমন বাঁচতে শেখায়, দিনশেষে মরতেও না বাধ্য করে বসে!” যা হবার হবে, অনেক লুকোচুরি হয়েছে। এবার হয় ভালোবাসার মানুষটিকে জীবনে আঁটকে নেবে! নয়তো তার ইচ্ছেই দূরে যেতে দিবে। এভাবে আর দোটানায় ভোগার মানে হয় না। ইরাদ লম্বা করে কয়েক বার নিঃশ্বাস নিয়ে নিজের চিন্তাভাবনা রেখে কাজে মনোযোগ দেয়।
চলবে?