অপেক্ষার প্রিয় প্রহর পর্ব-০১

0
1905

#অপেক্ষার_প্রিয়_প্রহর
#সূচনাপর্ব
#সাদিয়া_ইসলাম

‘শেষ অব্দি ২বার বিয়ে ভেঙে গেছে এমন মেয়েকে তোমার পছন্দ হলো ইরাদ!’

মায়ের প্রশ্নে ইরাদের মাঝে কোনো পরিবর্তন লক্ষ্য করা গেলো না। সে শান্ত ভঙ্গিতে চেয়ারে বসে খাচ্ছিলো, তার খাওয়া অব্যাহত আছে। ছেলের পড়াশোনা শেষ, ভালো একটা কোম্পানিতে বেশ ভালো পজিশনে চাকরি করে ইরাদ। একটু আগে মিসেস সালেহা ছেলেকে বিয়ের বিষয়ে কথা বললে, ইরাদ তার পছন্দের কথা জানায়। ছেলের পছন্দের মেয়েটিকে চিনেন মিসেস সালেহা। যাকে একদম পছন্দ না উনার। এজন্য কিছুটা বিক্ষিপ্ত বিক্ষুদ্ধ স্বরেই ছেলেকে প্রশ্নটা করেন। তাতে ছেলের মাঝে কোনো ভাবভঙ্গি দেখতে না পেয়ে মিসেস সালেহা একটু রেগে উঠলেন। চেয়ার ছেড়ে উঠে দাড়িয়ে ইরাদের সামনে একহাতে বেশ জোড়ে কয়েকবার বারি মেরে শুধালেন,

‘আমি তোমায় কিছু প্রশ্ন করেছি ইরাদ।’

‘ দু’বার বিয়ে ভাঙার পিছনে মেয়েটার কোনো দোষ ছিলো না মা। অযথা রাগারাগি করছেন আপনি।’

ইরাদ শান্ত গলায় জবাব দিয়ে টেবিল ছেড়ে বেসিনে গিয়ে হাত ধুয়ে নিজের রুমের দিকে পা বাড়ালো। মিসেস সালেহা ছেলের বেপরোয়া কথাবার্তায় হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলেন। যে ছেলে উনার রাগ দেখলে, পাগলের মতো কমানোর চেষ্টায় মত্ত হয়। সেখানে ইরাদ এতটা শান্ত! মানতে কষ্ট হচ্ছে সালেহা বেগমের। খাবার টেবিল ছেড়ে তিনিও ছেলের রুমে আসলেন। ইরাদ সোফায় ল্যাপটপ খুলে বসেছে এসেই। মা-কে দেখে একবার তাকিয়ে আবারও মনোনিবেশ করলো ল্যাপটপে। মিসেস সালেহার মুখাবয়ব রাগে থমথমে হয়ে গেলো। ছেলের পাশে ধপ করে বসে ছেলের উদ্দেশ্যে বললেন,

‘ঐ মেয়েকে বাদ দিয়ে যেকোনো মেয়ের কথা বলো! আমি অনাথ আশ্রম থেকে উঠে আসা মেয়েকেও মেনে নিবো। কিন্তু ঐ মেয়েকে নয়।’

ইরাদ শান্ত-শীতল চাহনীতে মায়ের দিকে দৃষ্টি ঘুরালো। নিজের স্বভাবসুলভ গম্ভীর ভঙ্গিতে মা-কে প্রশ্ন করলো,

‘সে বাদ দিয়ে যেকোনো মেয়েকেই আপনি মানতে পারবেন! অথচ তাকে নয়? কেনো মা? সে কি মেয়ের কাতারে পরে না নাকি?’

‘কি করে তুমি ঐ মেয়েকে বউ করার চিন্তা করো? তোমার চিন্তাভাবনা, পছন্দ করার ধরণ দেখে আমি হতবাক। আমাদের সোসাইটির সাথে ঐ মেয়ে যায়? নিজেকে প্রশ্ন করে দেখো তো বিষয়টা! একে তো পরপর দুবার বিয়ে ঠিকঠাক হয়ে বিয়ে হতে হতে ভেঙে গেছে। মা নেই, বাবা অন্য জায়গায় বিয়ে করে সংসার পেতেছে। মেয়েটা নিজেই বোনের শ্বশুর বাড়িতে পরে থাকে, না আছে কোনো ঠিক ঠিকানা!না আছে কোনো ব্যক্তিত্ব। ছ্যাচড়ার মতো বোনের সংসারে পরে থাকে। বয়স টাও খেয়াল করেছো! তোমার থেকে ৩বছরের ছোটোও তো হবেনা বোধ হয়! তাকে বউ করে এনে সবার সামনে কোন পরিবার থেকে উঠে এসেছে! কি পরিচয় দিবো?’

‘মা, আপনি নিজেও একজন নারী। কিছু বলার আগে এই কথা-টা মাথায় রাখুন। আমায় একা ছেড়ে দিন। রুমে যান, রাত হয়েছে ঘুমিয়ে পরুন।’

মিসেস সালেহা ছেলের সাথে কথা বলায় পেরে না উঠে উচ্চশব্দে উঠে দাড়ালেন। জোড় কদমে হেঁটে ইরাদের রুম ছাড়লেন। ইরাদ মায়ের গমন পথে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। সোফা ছেড়ে উঠে দাড়িয়ে ব্যালকনির দিকে অগ্রসর হলো। রাতের প্রায় ১০ টা বাজে এখন। ব্যস্ত ঢাকা শহরে এই রাত টুকু কিছুই না। আলো ঝকমকে শহরের বুক ছেড়ে ইরাদের দৃষ্টি আকাশ পানে স্থির হলো। টাউজারের পকেটে দু’হাত গুঁজে অন্ধকার আকাশে শান্তি হাতরাতে ব্যস্ত হলো ইরাদ। আনমনে ভাবলো,

‘মা, আপনি যদি বুঝতেন, পুরুষ মানুষ তার মা’য়ের মতোই একজনকে জীবনে চায়! আর তার সন্ধান পেলেই দিকবিদিকশুন্য হয়ে পরে নিজের করে পাওয়ার জন্য। তাকে এসব কথা বলে আপনি অসম্মান করে কি সুখ পাচ্ছেন আমি জানিনা৷ কিন্তু তাকে না পেলে আমার সুখের-ও অসুখ করবে।’

🌸🌸
অপরদিকে অন্ধকার আকাশে শূণ্য দৃষ্টি মেলে বারান্দার গ্রিল ধরে দাড়িয়ে আছে আরও একটি মানবী পরনের ওরনা টা এক কাঁধে পরে আছে, ফ্লোরে এক মাথা গড়াগড়ি খাচ্ছে। হাঁটু ছুইছুই চুলগুলো মৃদুমন্দ উড়ছে হালকা বাতাসে। মনে সব এলেমেলো চিন্তা ভাবনা। এই যে অন্ধকারে দাড়িয়ে আছে! হঠাৎ যদি ভুত এসে তাকে ভয় দেখায়! বিষয়টা কেমন হবে? সে কি ভয় পাবে! ধুর কি সব ভাবছে সে! নিজের চিন্তাভাবনার উপরই বিরক্ত হলো মেয়েটি। আচমকা কাধে কারোর স্পর্শ পেয়ে পিছন ফিরে তাকালো। অন্ধকারে স্পর্শ করা মানুষটি কে বুঝতে অসুবিধা হলো না মেয়েটির। সে মৃদু স্বরে বললো,

‘আপু তুমি? ঘুমাওনি যে! এতোরাতে আমার রুমে আসলে যে?’

‘না ঘুমিয়ে কি রাত্রীবিলাস করছিস?’

‘না আপু, উদ্ভট চিন্তাবিলাস করছি। যেমন ধর, এখন তোর বদলে যদি কোনো ভুত এসে আমায় ভয় দেখাতো? কেমন হতো বিষয়-টা! আমি কি করতাম? ভয় পেয়ে তোকে ডেকে চিৎকার চেচামেচি করতাম? নাকি ভুতকেও চমকে দিতে উল্টো ভয় দেখানোর চেষ্টা করতাম?’

মেয়েটির বড়ো বোন হাসলো বোনের কথায়। সুইচ টিপে বারান্দায় লাগানো লাইট টা জ্বা”লিয়ে দিতেই চোখের সামনে স্পষ্ট হলো ছোটো বোনের হাস্যোজ্জ্বল মুখশ্রী। বড়ো বোন নামক মমতার ছায়া সে তার মমতা মাখা হাতটি ছোটো বোনের গালে রাখলো। ছলছল দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,

‘এসব উদ্ভট চিন্তা করে, হেঁসে, আমায় হাসিয়ে কি বোঝাতে চাস তুই ভালো আছিস! খুশি আছিস নিজের দুনিয়ায়? আমায় কি তোর বোকা মনে হয় ?’

ওয়াজিহা নামক মেয়েটির মুখশ্রী মুহুর্তে বোনের কথায় চুপসে গেলো। দুঃখ-রা মনের আঙিনায় এক্কাদোক্কা করে হাতছানি দিতে শুরু করলো। তার মনের মাঝে কেমন একটা হাহাকার অনুভব হলো। ফাঁকা ঢোক গিলে নিজেকে সামলানোর চেষ্টায় উল্টোদিকে ফিরে বেশ কয়েকবার লম্বা শ্বাস নিলো। এরপর ঠোঁটে হাসির রেখা টেনে বোনের দিকে ফিরে বললো,

‘আপু বাদ দাও ওসব কথাবার্তা। আমি আসলেই ভালো আছি। তুমি রুমে যাও ঘুমাও। বাচ্চাটা কাঁদবে উঠে তোমায় না পেলে। আমারও ঘুম পাচ্ছে। সকালে ভার্সিটি আছে। চলো দুজনই ঘুমাই।’

‘ঘুমালে আমার সমস্যা ছিলো না। আমি জানি আমায় রুম থেকে তাড়িয়ে রাত জেগে বসে বসে কফির জার ফাঁকা করবি আর চোখের নিচের ডার্ক সার্কেল টা গাড় করবি। এই তো এটাই তো নিত্যকার রুটিন তোর।’

ওয়াজিহা মলিন হাসলো। বোনের দুগালে হাত রেখে আলতো স্বরে বললো,

‘আমার মিষ্টি আপু, সে থাকতে আমার আবার ডার্ক সার্কেলের চিন্তা! হোক না সে নিজের মতো গাড় হতে থাকুক। তুমি যাও তো যাও।’

ওয়াজিহার জেদে তার বড়ো বোন রাফা ওয়াজিহার রুম ছাড়লো। দরজার কাছে গিয়ে একবার ফিরে তাকালো বোনের দিকে। ওয়াজিহা বোন যেতেই মাত্রই সুইচ টিপে লাইট বন্ধ করে বারান্দার দেওয়াল ঘেষে বসে পরেছে। অন্ধকার আর বারান্দার ফাঁকফোকড় গলিয়ে আসা আবছা আলোয় ওয়াজিহাকে স্পষ্ট না দেখা গেলেও আবছা তো দেখা যাচ্ছেই। ওয়াজিহাকে বসতে দেখে রাফার প্রশ্নে প্রশ্ন আসলো, তার বোন কি কাঁদছে! হয়তো কাঁদছে। রাফা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। ধীর পায়ে নিজের রুমে ফিরে আসলো। রুমে এসেই ড্রিম লাইটের আবছা আলোয় বিছানায় ঘুমন্ত স্বামী সন্তানকে দেখে আনমনে বিরবির করে বলে,

‘আমার বোনটার আমার মতো সুন্দর ভরা সংসার হলে খুব বেশিই কি ক্ষতি হয়ে যেতো! সব কষ্ট উপরওয়ালা ওর উপরেই ফিক্সড করে পাঠিয়েছে! আর তো মেনে নেওয়া যায় না ওর এলেমেলো জীবন টা। আল্লাহ পথ দেখাও।’

রাফা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ছেলের পাশে শুয়ে পরে। তখনই শুনতে পায়,

‘ওয়াজিহা ঘুমায়নি?’

স্বামী পরশের প্রশ্নে রাফা একটু চমকে উঠলো। এই তো পরশ বেশ সুন্দর ঘুমাচ্ছিলো, জেগে উঠলো কখন! বেডের সাথে লাগানো ড্রেসিং টেবিলের তাক থেকে ফোন টা হাতে নিয়ে সময় দেখলো। সময় রাত বারোটা ছুঁইছুঁই করছে। সে হাফ ছেড়ে পরশের উদ্দেশ্যে বললো,

‘ঘুমাওনি?’

‘চেষ্টা করছিলাম ঘুমানোর। ভেঙে গেলো আচমকা। তুমি তো ওয়াজিহার ঘরেই গিয়েছিলে তাইনা?’

‘হু, ও ঘুমায়নি। রুমের দরজা খোলা দেখে কি করে দেখতে গিয়েছিলাম।’

পরশ সটান হয়ে শুয়ে কপালের উপর কনুই সহ হাত রেখে ক্লান্ত ভঙ্গিতে বললো,

‘মেয়েটা দিনদিন বড্ড শান্ত হয়ে যাচ্ছে রাফা। আমার একটু ভয়-ই করছে। একটু বললে ভুল হবে, বেশিই ভয় করছে। ঝড়ের পূর্বাভাস কিন্তু শান্ত প্রকৃতি।’

রাফা পরশের কথার মানে বুঝতে পারলো না। দ্বিধান্বিত মনে জিগাসা করলো,

‘কি বোঝাতে চাচ্ছো?’

চলবে?

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে