#অন্ধ_তারার_অশ্রুজল
১৩.
রাতে খাওয়ার পর মায়ের কাছে গিয়ে বসল ইফতি। মা তার সাথে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছিলেন পুরোপুরি। কিন্তু গতরাতে হাসপাতালে গিয়ে প্রয়োজনে কথা বলতে হয়েছে। আবার আজ দিনের বেলা থেকে কথা বন্ধ৷ মা কথা না বললে দমবন্ধ লাগে ইফতির। তার ওপর আজ প্রিয়তীর ঠেলা খেয়ে মনে হলো নিজে গিয়ে সাধ্যসাধনা না করলে এই বরফ গলানো যাবে না৷ তার ওপর দিন দিন কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে একসময় যদি আর না গলে!
ছেলেবেলা থেকেই ইফতি মা অন্তপ্রাণ। মা না হলে তার কোনোকিছুই চলে না। এদিকে মায়ের জানের টুকরো আছে তার কাছে। তাকে ছাড়া মায়েরও চলে না। একদম বাচ্চাকালের কথাগুলো মাথায় খেলে যায় ইফতির৷
সে তখন খুব ছোটো। ওর বাবার বড় ব্যবসা ছিল। বিশাল কাপড়ের দোকান। রমরমা অবস্থা। নিজেদের বাড়ি, গাড়ি সব ছিল। হঠাৎ এক অগ্নিকান্ডে ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল সবকিছু। এক রাতের ব্যবধানে কোথা থেকে কোথায় নেমে গিয়েছিল তারা ভাবলে শিউরে উঠতে হয়!
ঋণের দায়ে তখন জর্জরিত বাবা। ওরা শহরতলীর একটা এক রুমের বাসা ভাড়া নিয়ে থাকে। গাদাগাদি, নোংরা পরিবেশে ইফতি প্রথম প্রথম একেবারেই মানিয়ে নিতে পারত না। চিৎকার করে বাড়ি মাথায় তুলে ফেলত। নিজেদের বাড়ি যাবে বলে কাঁদতে কাঁদতে মাকে পাগল করে দিত। মা সামলাতে পারতেন না।
গরুর মাংস ছাড়া সে খেতে পারত না। মা খুব কষ্ট করে অনেক গল্প শুনিয়ে মিথ্যে বলে তাকে খাওয়াতেন। প্রথম কিছুদিন খেলেও একদিন বেঁকে বসল ইফতি। সে কিছুতেই গরুর মাংস ছাড়া ভাত খাবে না। পুরো একদিন তাকে কিছুই খাওয়ানো গেল না। ঘরে তখন টাকাপয়সা কিছুই ছিল না। কোনোরকম বাজার করতেন বাবা। নিজের সবটা খুইয়ে পাওয়ানাদারদের চিন্তা মাথায় নিয়ে তার পাগল হবার দশা। এর মাঝে মা-ই বা কেমন করে ছেলের আবদার স্বামীর কাছে বলেন?
মা সহ্য করতে না পেরে সেদিন নিজের দাদীর দেয়া শেষ স্মৃতি কানের দুলজোড়া বিক্রি করে দিয়ে ইফতির জন্য মাংস কিনে এনেছিলেন। ওই দুলজোড়া নাকি হাজার সমস্যার মধ্যেও তিনি বিক্রি করে দিতে রাজি ছিলেন না।
ইফতি এসব শুনেছে বাবার মুখে।
ইফতির খুব ইচ্ছে ছোটোবেলা থেকেই যে মাকে সেরকম একজোড়া দুল সে গড়িয়ে দেবে। কিন্তু সেরকম আর্থিক সঙ্গতি বা সুযোগ তার হয়নি।
ইফতির জ্বালাতন আর বায়নাক্কার শেষ ছিল না ছোটোবেলায়। মিফতা তখন মায়ের পেটে। কীসব জটিলতায় মা বড় অসুস্থ। তবু পুরোদিন ইফতির পেছনে ছুটতে হলো। মা ক্লান্ত হতেন, কিন্তু বিরক্ত হতেন না। একরোখা একটা মানুষ ছেলের জন্য এতটা করতে পারে এটা দেখে বাবা অবাক হতেন। ইফতি সব শুনেছে বড় হয়ে। আর মায়ের জন্য তার মমতা বেড়েছে।
মিফতা সবসময়ই বাবার ছেলে। মাকে সে কমই পেয়েছে। মায়ের সব মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু ছিল ইফতি। মিফতা কষ্ট পেত, মা কেন তাকে কম আদর করে? বাবা মায়ের আদর পুষিয়ে দেয়ার চেষ্টা করত। ইফতির নিজেরও মাঝে মাঝে খারাপ লাগত, সব আদর একাই পায়, মিফতা বঞ্চিত। তবে মায়ের এই এক সন্তানকে বেশি ভালোবাসার নীতি সে কিছুতেই টলাতে পারেনি।
মায়ের ঘরে উঁকি দিল ইফতি। মা মাথায় তেল দিচ্ছিলেন৷ ইফতি ঘরে ঢুকে মায়ের মাথার কাছে বসে তেলের বাটিটা টেনে নিল।
ইফতির মা ইরাবতী বিরক্ত চোখে পেছনে ঘুরে বললেন, “যা এখান থেকে। কী চাই?”
আজকের ইফতিকে দেখে কেউ বলতে পারবে না সে একসময়ের একরোখা জেদি একটা ছেলে ছিল। খুব সামলে নিয়েছে সে নিজেকে। তবে মায়ের সামনে অতকিছু বাঁধা মানে না তার। সেও একটু ঝাঁঝলো গলায় বলল, “কিছু চাই না। চুপচাপ বসে থাকো।”
ইফতির কথাতেই কাজ হলো। ইরাবতী আর কোনো কথা বললেন না। চুপ করে রইলেন। ইফতি সুন্দর করে ঘষে ঘষে পুরো মাথায় তেল দিয়ে দিল। চুল টেনে টেনে বেণীও করে ফেলল। পুরো সময়ে তাদের কোনো কথা হলো না।
ইফতি সবসময়ই মায়ের মাথায় তেল দিয়ে দেয়। ইরাবতী তূণার বিয়ের পর খুব দুঃখ করতেন তার আর মেয়ে নেই বলে। এই এক কথা শুনতে শুনতে ইফতি একদিন বিরক্ত হয়ে বলেছিল, “আচ্ছা থাকলে তোমার এমন কী করত যা ছেলেরা করতে পারি না?”
মা বলেছিলেন, “অন্তত আমার মাথায় তেল দিয়ে দিতে পারত।”
তারপর থেকেই চলছে এরকম। ওদের অলিখিত নিয়ম হচ্ছে মায়ের মাথায় তেল দেবার পর মাও ইফতির মাথায় তেল দিয়ে মাথা বানিয়ে দেবেন।
ইফতি সেই নিয়মমতো সামনে গিয়ে মেঝেতে বসে পড়ল।
ইরাবতী কয়েক সেকেন্ড নড়লেন না নিজের জায়গা থেকে। তার জেদ প্রচন্ড। ইফতির প্রতি যে রাগ তার জমা হয়েছে সেরকম রাগ অন্য কারো প্রতি হলে তিনি হয়তো কোনোদিন কথাই বলতেন না তার সাথে। কিন্তু ইফতি কাছে আসলেই তার মন গলে যায়। ইচ্ছে করে ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে, ছেলের সাথে প্রাণ খুলে কথা বলতে।
আজ ছেলে নিজেই এসেছে। তিনি ফিরিয়ে দিতে চেয়েও পারছেন না। এদিকে ইফতি অপেক্ষা করছে মা কী করে দেখার জন্য। তার অস্থির লাগছে।
অবশেষে কয়েক মিনিট পার হয়ে গেলে ইফতির মাথায় হাত পড়ল। মা সবসময়ের মতোই চুলে তেল দিয়ে মাথা বানিয়ে দিলেন।
এ সময়ে মা ছেলে অনেক গল্প করে। ইফতি তার অফিসের প্রতিটা কথা মাকে বলত। তার স্কুল, কলেজ, ইউনিভার্সিটি থেকে শুরু করে অফিস পর্যন্ত সব বন্ধুবান্ধবদের মা চেনেন। দেখে না হলেও ইফতির মুখে গল্প শুনে।
ইফতি গল্প করতে শুরু করল। এমনভাবে, যেন কিছুই হয়নি। মা তেমন একটা কথা বললেন না।
সব শেষে ইফতি যখন উঠে পড়ল, তখন মা বললেন, “আমি ভাবতাম তুই আমাকে সব কথা বলিস। তোর ছেঁড়া মোজা থেকে শুরু করে অফিসের শেষ ফাইলের সমস্যা পর্যন্ত আমি জানি। কিন্তু তোর জীবনের একটা বড় অংশ যে আমি একেবারেই জানতাম না এটা কোনোদিন কল্পনাই করিনি। আজও তুই কত গল্প করলি! অথচ তোর বউকে নিয়ে ঘুরতে গিয়ে কী করেছিস সেসব গল্প তো করলি না।” বলে মা উত্তরের অপেক্ষা না করে ঘর থেকে বের হয়ে রান্নাঘরে চলে গেলেন। ইফতিও পেছন পেছন গিয়েছিল, কিন্তু ভেতরে তুবাকে দেখে আর এগুলো না।
______________________________
ইফতিকে মায়ের ঘরে গল্প করতে দেখে প্রিয়তীর ভীষণ কান্না পাচ্ছে। তার নিজের মায়ের সাথে কথা হয় না কতগুলো দিন হয়ে গেছে! মা কেমন আছে? মায়ের কি তার কথা মনে পড়ে না? মা আজ কী রান্না করেছে? মায়ের কোমরের ব্যথাটা কি কমেছে? সে চলে আসার পর সন্ধ্যায় নাস্তা কে বানায়? ঘরদোর কে গোছায়? মা কি তাকে ছেড়ে খেতে পারে?
সে নিজে তো গুছিয়ে সংসারের পায়তারা করছে। কিন্তু তার ফেলে আসা ঘর? ভাবতে ভাবতে কান্নায় ভেঙে পড়ে প্রিয়তী। বাড়িতে ফোন করে। কিন্তু কেউ ফোন তোলে না। বেশ কয়েকবার চেষ্টার পর একসময় ওপাশ থেকে আর কোনো সাড়া আসে না৷ তার নাম্বারটা ব্লক করে দেয়া হয়েছে!
(চলবে)
সুমাইয়া আমান নিতু
#অন্ধ_তারার_অশ্রুজল
১৪.
ইফতি ঘরে ঢুকল ভাঙা মন নিয়ে। মা তার সাথে এমন করবে ভাবেনি সে। এতদিন ইফতি মায়ের সাথে সব কথা শেয়ার করত এটা সত্যি৷ তবে কথাগুলো পুরোপুরি তার সম্পর্কিত ছিল। অন্য কারো ব্যক্তিগত ব্যাপার সে কখনো মায়ের কাছে বলেনি৷ প্রিয়তী আর তার ঘুরতে যাবার কথা মাকে বলা তার কাছে উচিত মনে হয়নি। স্বামী স্ত্রীর ব্যক্তিগত ব্যাপার মায়ের সাথে বলাটা শোভনও নয়। তার ওপর মা এখনো তাদের বিয়ে মেনে নেননি। কিন্তু মায়ের তো এটা বোঝা উচিত ছিল৷ এই বয়সে এসে এরকম ছেলেমানুষী বিষয়ে রাগ করার কোনো অর্থই হয় না। ভাবতে ভাবতে দীর্ঘশ্বাস ফেলল ইফতি।
হঠাৎ তার খেয়াল হলো প্রিয়তীর দিকে। চুপচাপ বিছানার কোণায় বসে আছে। চোখ দেখেই বোঝা যায় খুব কেঁদেছে। তাকে দেখে সামলে নেবার চেষ্টা করছে। ইফতি প্রিয়তীর কাছে গিয়ে বসে তার মাথায় হাত রেখে বলল, “কী হয়েছে?”
প্রিয়তী নিজেকে সামলাতে পারল না। ইফতিকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলল। তবে মুখে কিছুই বলল না।
ইফতি বুঝতে পারল ব্যাপারটা। বলল, “বাড়ির কথা মনে পড়ছে?”
“হুম।”
“চিন্তা করো না প্লিজ! আমি নিজে তোমাকে নিয়ে তোমাদের বাড়ি যাব। ওনারা ঠিকই নেবে নেবেন।”
প্রিয়তী চোখ মুছে বলল, “নেবে না। কিছুতেই মানবে না। আজকে আমার ফোন নাম্বার ব্ল্যাকলিস্টে ফেলে দিয়েছে। আমি জানি মা ঠিকই আমার কথা ভেবে কাঁদে। মা আমার সিদ্ধান্ত মেনেও নেবে। কিন্তু বাবা নেবে না। বাবা অনেক কঠিন হৃদয়ের মানুষ। সে একবার কোনোকিছু ঠিক করে ফেললে সেখান থেকে তাকে সরানো অসম্ভব। বাবা কোনোদিন আমার মুখ দেখবে না৷ মাকেও দেখতে দেবে না।” বলতে বলতে আবারও অঝোরে কেঁদে ফেলল প্রিয়তী।
ইফতি প্রিয়তীর মাথায়-পিঠে হাত বুলিয়ে তাকে শান্ত করার চেষ্টা করতে থাকল। একসময় বলল, “প্রিয়তী জানো, পৃথিবীতে যা হয় ভালোর জন্যই হয়। হতে পারে যা হচ্ছে সবটা কোনো সুন্দর ভবিষ্যতের জন্যই। আর মেঘের আড়ালে থাকলেও সূর্যটা ঠিকই আছে।”
প্রিয়তী মাথা তুলে ওড়না দিয়ে চোখ নাক মুছে নিল। তারপর ফিক করে হেসে বলল, “তুমি কি স্কুলে পড়ার সময় ভাবসম্প্রসারণ খুব ভালোমতো মুখস্থ করেছিলে? একদম সেরকম ডায়লগ!”
“ধ্যাৎ!”
প্রিয়তী নিজেকে সামলে নিয়েছে অনেকটা। ইফতি তার খুব কাছে বসে আছে। ইচ্ছে করলেই তাকে খুব শক্ত করে জড়িয়ে ধরা যায়৷ কিন্তু লজ্জা লাগছে। কান্না করার সময় কাজটা করা যত সহজ ছিল, স্বাভাবিক হওয়ার পর ততটা সহজ লাগছে না৷ তবুও সে মনের ইচ্ছেটাকে ঠেলে না দিয়ে ইফতির আরও কাছ ঘেঁষে এলো। ইফতিও এক হাতে জড়িয়ে ধরল তার কাঁধ।
প্রিয়তী ইফতির শার্টের বোতামটা ঘোরাতে ঘোরাতে বলল, “তোমার সেদিন একটা কথা বলার কথা ছিল, বলোনি।”
“কোনটা?”
“তুমি যেরকম স্ত্রী চেয়েছো আমি কতটা তেমন?”
ইফতি প্রিয়তীর কপালে চুমু খেয়ে বলল, “তোমাকে সত্যিটা বলি প্রিয়তী৷ তুমি আমার জীবনের একটা আশীর্বাদ। তোমার মতো এত ভালো মেয়ে আমি জীবনেও খুঁজে পেতাম না। ভাগ্যের জোরে কুড়িয়ে পেয়েছি।”
দু’জনেই হাসল। প্রিয়তী বলল, “তোমার কথাবার্তায় ফ্লার্টের গন্ধ পাচ্ছি!”
“নিজের বউয়ের সাথে ফ্লার্ট করতে যাব কেন?”
“তো কী করবে?”
ইফতি খুব অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, “বলব?”
প্রিয়তী লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করে ফেলে বলল, “নাহ।”
ইফতি উঠে গিয়ে দরজাটা লক করে দিল। জানালার পর্দা টেনে দিয়ে ঘরে এয়ার ফ্রেশনার স্প্রে করে দিল।
প্রিয়তী বলল, “এসব কী হচ্ছে?”
“পরিবেশটা সুন্দর করার চেষ্টা করছি।”
“মা বলেছেন এখন এত আদিখ্যেতা না করতে। বাড়িতে একটা অসুস্থ মানুষ আছে।”
“তো তাতে আমাদের কী?”
প্রিয়তীর বলতে ইচ্ছে হলো, আমাদের মাঝেই অসুস্থ মানুষটার অস্তিত্ব রয়ে গেছে। খুব প্রবলভাবে তার ঘ্রাণ পাওয়া যায় তোমার মাঝে। সামান্য এয়ার ফ্রেশনার সেই ঘ্রাণ দূর করতে পারবে না৷
তবে সে বলল না কিছুই। ইফতির ডাকে সাড়া দিয়ে এগিয়ে গেল। তাদের দুজনার মনেই দুঃখবোধ খুব গভীরভাবে শিকড় গেড়ে বসেছিল। কিছুক্ষণের জন্য সেই বিষন্ন সময়টুকু থেকে তারা বেরিয়ে একটা অন্য ভালোলাগার জগতে বিচারণ করে এলো। যেখানে এসব জগৎ সংসারের দুঃখ বিষাদের লেশমাত্র নেই। শুধু গভীর ভালোবাসাময় কিছু মুহূর্ত আছে।
রাত যখন প্রায় দুটো, তখনও ইফতি জেগে আছে। তার বাহুতে মাথা রেখে ক্লান্ত প্রিয়তী ঘুমে বিভোর। প্রিয়তীকে পুরোপুরি পাবার পর তার মনে হচ্ছে, প্রিয়তী তার সেই সত্যিকারের আপন মানুষ যাকে সে যুগের আদি থেকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। মাঝে যা ছিল, সব ভুল, সবটাই মিথ্যে!
_______________________________________
মিফতার ঘুম ভেঙে গেল ভোরে। তার শনিবারেও ছুটি থাকে। সাধারণত শুক্র শনি সে এগারোটার আগে বিছানা ছাড়ে না। আজ কেন চোখ খুলে গেল?
পাশে হাতড়ে সে তুবার অস্তিত্ব খুঁজে পেল না। ঘরটা অন্ধকার। ভোরের আলো ভালোভাবে ফোটেনি এখনো। মিফতা ভাবল তুবা বোধহয় বাথরুমে।
বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পরেও যখন তুবা এলো না, তখন সে উঠে পড়ল। লাইট জ্বালিয়ে দেখল তুবা ঘরেই বসে আছে। তাদের ঘরের কোণে রাখা ছোট্ট দুটো বেতের সোফার একটায় গুটিশুটি হয়ে পড়ে আছে। চোখদুটো খোলা, ভেজা। চোখে আলো পড়তেই হাত দিয়ে চোখ ঢেকেছে তুবা। তবুও সব বুঝতে পারল মিফতা।
সে কোনো কথাই বলল না। বাথরুমে ঢুকে পড়ল। রাগে গা জ্বলছে তার। বিয়ের পর থেকে এই নাটক দেখছে৷ দু’দিন পরপর কী হয় কে জানে! কার জন্য এত দুঃখ ওর? সে কি কম ভালোবাসে তাকে?
বিয়ের আগেই শুনেছিল মিফতা, তুবার প্রেমিক আছে। কিন্তু সে তখন ভালোবাসায় অন্ধ৷ কোনোকিছুর পরোয়া করেনি।
খুব বৃষ্টির দিন ছিল সেদিন। আকাশের ভয়াবহ গর্জন উপেক্ষা করে মিফতা তুবার তলব পেয়ে গিয়েছিল তাদের বাড়ির সামনে। তুবা তাকে বলেছিল, “তুমি তো আমাকে ভালোবাসো তাই না মিফতা? বিয়ে করবে আমাকে?”
মিফতা অবাক হয়ে বলেছিল, “তুমি তো বলেছিলে তোমার কারো সাথে কমিটমেন্ট আছে।”
তুবা তখন শক্ত গলায় বলেছিল, “নেই। সে আমাকে চিট করেছে।”
“তুমি আমাকে সত্যিই বিয়ে করতে চাও?” সন্দিগ্ধ গলায় জিজ্ঞেস করেছিল মিফতা।
তুবা মাথা দুলিয়ে বলেছিল, “হ্যাঁ।”
মিফতা আগে-পরের আর কোনো কথাই চিন্তা করেনি। তুবার হাত ধরে বলেছিল তাকে সে বিয়ে করবে। করেছিলও পরের দিন। মিফতা কখনোই খুব ভেবেচিন্তে কোনোকিছু করে না। সেজন্য পস্তাতে হয়েছে বহুবার। এবারও তাই হচ্ছে।
বিয়ের কিছুদিন পর থেকে তুবার এরকম হঠাৎ বৈরাগ্য পেয়ে বসে। রাতে তার পাশে শুয়ে থাকতে পারে না৷ সে ছুঁতে গেলে যেন জ্বলে ওঠে। তারপর উঠে গিয়ে সোফায় বসে রাত কাটিয়ে দেয়।
এই রোগ সারাবার বহু চেষ্টা করেছে মিফতা, কিন্তু ব্যর্থ হয়েছে।
এমনিতে তাদের সুখী কাপল বলেই মনে হয়। মিফতা তুবাকে পাগলের মতো ভালোবাসে। তুবাও তাকে ভালোবাসা দেখায়। কিন্তু এরকম দিনগুলো এলে মিফতা বুঝতে পারে, তুবা আসলে তাকে ভালোবাসে না। শুধুই নিজের ইচ্ছেয় বিয়ে করেছে বলে দাঁতে দাঁত চেপে সংসার করে যাচ্ছে। পুরো পৃথিবীটা তখন অসহ্য বোধ হয় মিফতার।
বিয়ের আগে তার সবচেয়ে ভালো বন্ধু লিখন বলেছিল, “এই মেয়েকে বিয়ে করা ঠিক হবে না। হয়তো বয়ফ্রেন্ডের সাথে ঝগড়া হয়েছে। ঠিক হয়ে গেলে তখন চলে যাবে। তুই তারপর কী করবি?”
মিফতা হেসে বলেছিল, “বিয়ের পর আমার সাথে বেঁধে ফেলব। যেতে দিলে তো!”
এতদিনে এসে মিফতা বুঝতে পারে, মানুষটাকে হয়তো বেঁধে ফেলা যায়, কিন্তু মন বাঁধা যায় না।
ওইযে গানটা আছে না, “আমার হাত বান্ধিবি, পা বান্ধিবি, মন বান্ধিবি কেমনে….”
মিফতা দীর্ঘশ্বাস ফেলে হাতমুখে পানি ছিটিয়ে নিল। বের হয়ে তুবার দিকে তাকাল পর্যন্ত না। টিশার্টটা বদলে দরজা খুলে ঘর থেকে বের হবার মুহূর্তে মনে পড়ল, তুবার গতরাতে জ্বর ছিল। এখনো কি আছে? মন বেরিয়ে যেতে আর সায় দিল না। পায়ে পায়ে সে তুবার কাছে চলে এলো। তার কপালে হাত দিয়ে জ্বর দেখল। জ্বর ভালোই আছে। ঔষধ খাওয়া প্রয়োজন।
সে নিচু স্বরে বলল, “ওঠো। কিছু খেয়ে ঔষধ খেতে হবে। নইলে সেদিনকার মতো হবে।”
তুবা ঘোলাটে দৃষ্টিতে মিফতার দিকে তাকাল। তারপর অস্ফুট স্বরে কী যেন বিড়বিড় করে বলল। তবে সবসময়ের মতো জেদ দেখাল না। উঠে পড়ল। মিফতার হাত ধরে বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ল।
(চলবে)
সুমাইয়া আমান নিতু