#অন্ধ_তারার_অশ্রুজল
৬.
প্রিয়তীর মোবাইলের চার্জ ফুরিয়ে বন্ধ হয়ে ছিল। চার্জ করে মোবাইল অন করতেই অজস্র নোটিফিকেশনে ভেসে গেল মোবাইল। সবই বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজনের মেসেজ। আত্মীয়রা গালাগালি করেছে আর বন্ধুরা উদ্বিগ্ন হয়ে খবর পেতে চাইছে তার।
প্রিয়তী আরিফের চ্যাটবক্স ওপেন করল। আরিফের ভরসায়ই সে বাড়ি থেকে বের হয়ে এসেছিল। এখন কী বলতে চাইছে দেখা দরকার। প্রিয়তী এই এক ছেলের জন্য সারাটাদিন অপেক্ষা করেছে। এতটা আর কারও জন্য কোনোদিন করেনি।
আরিফ বড় বড় অনেকগুলো মেসেজ পাঠিয়েছে। তার না আসার অজস্র কারন। তবে সেগুলো যে অজুহাত এটা বুঝতে খুব বড় বিজ্ঞ হতে হয় না। প্রিয়তীর নিশ্চিত আরিফ ইচ্ছে করে এই কাজ করেছে। দুবছর পাত্তা না পাওয়ার প্রতিশোধ নিয়েছে। এরপর হয়তো খুব হেসেছে মনে মনে। প্রিয়তীর মনে হলো খারাপের মধ্যে আসলে ভালো হয়েছে৷ আরিফের মতো ফালতু একটা ছেলের সাথে সত্যিই বিয়ে হলে তার জীবনটা হয়তো নরক হয়ে যেত।
আরিফ অলাইনেই ছিল। প্রিয়তীকে অনলাইনে দেখে মেসেজে খুব চিন্তিত সুরে লিখেছে, “কোথায় তুমি প্রিয়? প্লিজ কাম ব্যাক! তোমার চিন্তায় দু’দিন মাথা খারাপ হয়ে গেছে আমার! আমার ভুলের জন্য এসব হলো। তুমি কোথায় আছ? কেমন আছ?”
প্রিয়তী একটা হাসির ইমোজি পাঠাল। সেটা দেখে ওপাশে কয়েক সেকেন্ডের নিরবতা। বোধহয় স্তব্ধ হয়ে ভাবছে হচ্ছেটা কী!
“প্রিয়, তুমি বাড়ি ফেরোনি জানি। বন্ধুদের কারো বাড়িতেও যাওনি৷ তাহলে কোথায় আছ?”
“বললে কী করবে? আমাকে এখান থেকে নিয়ে যাবে? সেদিন যেটা করতে পারোনি তাই করবে?”
আবারও মিনিটখানেক নিরবতা। বোধহয় ভেবেছিল এর মাঝে ওর কোনো একটা হেস্তনেস্ত হয়ে গেছে। তাকে আর ঝামেলায় পড়তে হবে না। কিন্তু প্রিয়তী যে তাকে আবারও একটা পেরেশানিতে ফেলার চেষ্টা করছে!
আরিফ আস্তেধীরে লিখল, “দেখো, এত কুইক ডিসিশন নেয়া কোনো ক্ষেত্রেই ঠিক না৷ তুমি এই দু’দিন কোথায় আছ সেটা আগে বলো।”
প্রিয়তী ঠান্ডা মাথায় লিখল, “আমি সেখানেই আছি যেখানে নিয়তি আমাকে টেনে নিয়ে এসেছে। সেদিন সারাদিন অসহায়ের মতো একটা কাপুরুষের জন্য আমি অপেক্ষা করেছিলাম, যে কিনা কিছু ফালতু অযুহাত দিয়ে আমার সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে ফেলেছিল। সে বলত সে আমাকে ভালোবাসে। একটা কথা আছে না, তোমার তাকে বেছে নেয়া উচিত যে তোমাকে ভালোবাসে। আমিও সেটাই করতে চেয়েছিলাম। আমি তোমাকে পাত্তা দিতাম না, কারন তোমার প্রতি আমি ইন্টারেস্টেড ছিলাম না৷ কিন্তু আমি পালিয়ে আসার আগের দিন পর্যন্ত তুমি আমার প্রতি দুর্বল ছিলে। তোমার আকর্ষণটাকে ভালোবাসা ভেবে তার ভরসায় ছিলাম আমি। তবে সৃষ্টিকর্তাকে ধন্যবাদ, যে আমাকে একটা নোংরা মানুষের হাত থেকে বাঁচিয়ে দিয়েছে।”
আরিফ মেসেজটা সীন করে চুপচাপ বসে রইল। প্রিয়তী পরের মেসেজে লিখল, “আমি বিয়ে করেছি আরিফ। খুব ভালো একটা মানুষকে বিয়ে করেছি। সে একটা অপরিচিত মেয়েকে পথে অসহায় অবস্থায় পেয়ে একা ছেড়ে আসেনি। বিয়ে করে নিজের বাড়িতে নিয়ে এসেছে।”
গতদিন বিয়ের পর ইফতির বন্ধুরা কিছু ছবি তুলেছিল। সেগুলোর ইফতির কাছ থেকে নিল প্রিয়তী। তারপর পাঠিয়ে দিল বন্ধুদের চ্যাটগ্রুপে।
আরিফ সবার আগে মেসেজগুলো দেখল। কিন্তু কোনো রিয়েক্ট বা মন্তব্য করল না।
প্রিয়তী অনেকক্ষণ অপেক্ষা করল বাড়ি থেকে কোনো কল আসে কি না সেজন্য। কিন্তু কেউ একবারও ফোন করল না। শেষ পর্যন্ত রাগ করে সে মোবাইল আবার অফ করে দিল। কিছু ভালো লাগছে না তার। যে লোকটার গলায় ঝুলে তার বাড়িতে চলে এসেছে, তার যন্ত্রণার কারনও সে হচ্ছে। ইফতির মা ইফতির সাথে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছে৷ সে বেচারা মাকে বড় বেশি ভালোবাসে৷ অফিসে যাবার আগে মায়ের মুখের দিকে কিছুক্ষণ অসহায়ের মতো তাকিয়ে থেকে গেছে। প্রিয়তীর তখন খুব খারাপ লাগছিল। নিজের মায়ের কথাও মনে পড়ে যাচ্ছিল।
প্রিয়তীর সারাদিন কাটল শাশুড়ীর সাথে এটা সেটা করে। আশ্চর্য ব্যাপার হচ্ছে তুবা তার সাথে কোনোরকম কথা বলে না৷ সে বলতে চাইলেও মুখ ফিরিয়ে চলে যায়। যেন সে বড় কোনো অপরাধে অপরাধী। ওর কি এখনো প্রাক্তনের জন্য ভালোবাসা বা অধিকারবোধ আছে? ইফতি তাকে কতটা ছাড় দেয়? মেয়েটার বয়সও বেশি না। এই বয়সে জটিল সম্পর্কে জড়িয়ে গেছে। তাকে সেভাবে দোষও দেয়া যায় না৷ তবে প্রিয়তীর এসব ভাবসাব মোটেও ভালো লাগল না। তাকে অপছন্দ করার কারন আছে ঠিকই, তাই বলে চক্ষুলজ্জাও থাকবে না?
প্রিয়তী রান্না ভালোই পারে। দুপুরে সে একটা আইটেম রান্না করে ফেলল। বুটের ডাল দিয়ে গরুর মাংস। সবাই খেয়ে খুব প্রশংসাও করল। তুবা অবশ্য প্লেটেই তুলল না। তার নাকি ডালের সাথে মাংস দেখেই অরুচি ধরে গেছে।
প্রিয়তীর খেতে ইচ্ছে করল না। বরং মনে হলো ইফতি থাকলে ভালো হতো। তাকে খাওয়াতে পারলে ভালো লাগত। প্রথমবার একটা কিছু রান্না করল, সেটা আসল মানুষটাকেই খাওয়াতে পারল না! প্রিয়তী একটা বাটিতে ইফতির জন্য বেশ খানিকটা তরকারি তুলে রাখল। শাশুড়ী মা সেটা দেখলেন, তবে কিছুই বললেন না৷ মুখের ভাব দেখেও বোঝা গেল না ব্যাপারটা কিভাবে গ্রহণ করলেন।
বিকেলে তূণা প্রিয়তীর কাছে এলো আচারের বয়াম নিয়ে। প্রিয়তীর আচার খুব প্রিয়। মা খুব একটা বানাত না। এখন শাশুড়ীর আচারের ভান্ডার দেখে চোখ কপালে উঠেছে তার৷ টক-ঝাল-মিষ্টি আমের আচার মুখে দিয়ে চোখ বুজে এলো প্রিয়তীর। আহা!
তূণা অনেক গল্প করল। গল্প করতেও জানে মেয়েটা! সন্ধ্যার মুখে ইফতির ছোটো ভাই মিফতা চলে এলো। মিফতা হাসিখুশি প্রাণখোলা মানুষ। ভালো লাগল প্রিয়তীর। সন্ধ্যার চা-টা সেই বানাল। চায়ের সাথে আড্ডা জমল ভালো। প্রিয়তীর আপন লাগতে শুরু করেছে ওদের। এরকম একটা পরিবার থাকতে ইফতি এত হীনমন্যতায় কেন ভুগছিল এটা একটা বড় প্রশ্ন।
প্রিয়তীর শ্বশুর তার সাথে কথাবার্তা তেমন কিছু বলেনি তখন পর্যন্ত। তিনি চা খেলেন নিজের ঘরে। একটু পরে ডাক পড়ল প্রিয়তীর।
“জি বাবা বলুন।” প্রিয়তী শুরু থেকেই শ্বশুর শাশুড়ীকে মা বাবা ডাকতে শুরু করেছে। তাদের পটানোর জন্য না, আপনাআপনিই ডাকগুলো আসছে তার ভেতর থেকে।
গম্ভীর মানুষটা একটু হাসলেন। চোখ ছুঁয়ে যাওয়া হাসি। এই প্রথম খুব স্নেহভরে তিনি প্রিয়তীর দিকে চেয়ে বললেন, “মনের দরজা পাকস্থলী থেকে যায়, কী বলো? চা-টা দারুণ হয়েছে। এত ভালো চা এই বাসায় কেউ বানাতে পারে না। তোমাকে বিয়ে করে ছেলেটা ভালোই করেছে৷ এখন প্রতিদিন এমন চা খেতে পারব৷ কী বলো? হা হা হা।”
প্রিয়তীর মনটা ভীষণ ভালোলাগায় ছেয়ে গেল। মিষ্টি করে হেসে সে বলল, “অবশ্যই বাবা৷ এখন থেকে আমিই চা বানাব।”
(চলবে)
সুমাইয়া আমান নিতু