অন্ধ তারার অশ্রুজল পর্ব-০৫

0
433

#অন্ধ_তারার_অশ্রুজল

৫.

“প্রিয়তী, কী করছেন?” বারান্দায় উঁকি দিয়ে বলল ইফতি।

“দেখুন, আকাশে কত মেঘ জমেছে!”

“দেখেছি। এবার ভেতরে চলুন৷ অনেক রাত হয়েছে৷ এভাবে রাতের বেলা খোলা চুলে কেউ বাইরে দাঁড়িয়ে থাকে?”

“থাকলে কী হয়?”

“ভূতে ধরে।”

“আমি নিজেই তো একটা পেত্নী। আমাকে কোন ভূতে ধরবে বলুন!”

ইফতি দেখল প্রিয়তীর চুলগুলো এখনো এলোমেলো হয়ে আছে। চুলের পানি পড়ে জামাকাপড় একেবারে ভিজে গেছে। ভেজা ঢিলেঢালা জামাটা রাতের ঠান্ডা বাতাসে ফুলে উঠছে বারে বারে। ইফতির একটু অস্বস্তি হলো কেন যেন৷ পেটের ভেতর অদ্ভুতুড়ে রকমের শিরশিরে অনুভূতি খেলে গেল। জীবনে এত অপ্রত্যাশিত ঘটনা কী করে ঘটতে পারে! তার ঘরের বারান্দায় অপরিচিত এটা মেয়ে দাঁড়িয়ে, তাও আবার তারই বউ। অ্যারেঞ্জ ম্যারেজেও ন্যুনতম পরিচয় হয়ে যায় বিয়ের আগে।

প্রিয়তীকে তার রহস্যময় একটা মেয়ে মনে হতে থাকে। দুদিনে এই প্রথমবার তার মাথায় কথাটা আসে, আচ্ছা প্রিয়তী তাকে কিরকম মানুষ ভাবে? নিশ্চয়ই ভালো মানুষই ভাবে, নয়তো বিয়ে করে ফেলত না৷ মেয়েটা কি তাকে ভালোবাসবে? সে নিজে কি এই মেয়েটাকে ভালোবাসতে পারবে? তুবার প্রতি যে ভালোবাসা ছিল তার পুরোটাই এখন লজ্জা আর বিতৃষ্ণায় ছেয়ে গেছে। ভালোবাসা শব্দটার অস্তিত্ব ওর সাথে জড়াতেও ইফতির নোংরা লাগে৷ হাজার হোক ছোটো ভাইয়ের বউ!

সে যাক, এখন কি সে প্রিয়তীকে খুব আপন করে নিতে পারবে? নিজের কাছেই বড় একটা প্রশ্ন এটা৷ ঠিক এই মুহূর্তের কথা ভাবলে মেয়েটার প্রতি তার আকর্ষণ অনুভব হচ্ছে প্রচন্ড, তবে সেটাকে মনের টান বললে ভুল হবে।

প্রিয়তী জিজ্ঞেস করল, “কী ভাবছেন এতক্ষণ ধরে?”

ইফতি কাছে গিয়ে বলল, “কিছু না৷ চুলের পানি দিয়ে ভেসে যাবেন তো! ঠান্ডা লেগে যাবে।”

“কী করবো তাহলে? সামলাতে পারছি না৷ আপনার তোয়ালেটা বিচ্ছিরি! কোথা থেকে কিনেছেন শুনি?”

ইফতি হেসে ফেলল, “নাচতে না জানলে উঠোন বাঁকা!”

সে এগিয়ে গিয়ে চুলগুলো মুছে দিতে থাকল, কিন্তু বুঝতে পারল কাজটা অতটা সহজ নয়। তোয়ালেটা প্রিয়তীর চুলের তুলনায় নেহায়েতই ছোটো। আসলেই বিচ্ছিরি!

ইফতির বৃথা চেষ্টা দেখে প্রিয়তী খিলখিল করে হেসে ফেলল। ইফতি ওর চুলগুলোকে কোনোমতে তোয়ালেতে মুড়ে পেঁচিয়ে ফেলে বলল, “পানি না ঝরে যাওয়া পর্যন্ত এরকমই থাকুক।”

“ওকে! থ্যা…ংস!” বলতে বলতে হাঁচি দিল প্রিয়তী। পরপর তিনটে।

দু’জন খুব কাছাকাছি চলে এসেছিল। ইফতির ভীষণ ইচ্ছে করছিল প্রিয়তীকে জড়িয়ে ধরতে, হয়তো কয়েক সেকেন্ড পর ধরেও ফেলত, কিন্তু তার মাঝে সর্বনেশে হাঁচি চলে এলো!

ইফতি একটু রাগ দেখিয়ে বলল, “এভাবে মাঝরাতে কেউ এক ঘন্টা গোসল করে?”

প্রিয়তী বলল, “কী করতাম? নিজেকে এত অপরিষ্কার লাগছিল!”

ইফতি হতাশ গলায় বলল, “আচ্ছা, কফি খাবেন?”

“এত রাতে কফি বানাবে কে?”

“কেন আমি।”

“না, এখন কষ্ট করতে হবে না প্লিজ।”

ইফতি হেসে বলল, “কষ্ট না তো, আমার ঘরেই কফি মেকার আছে। যখন খেতে ইচ্ছে করে বানিয়ে খেয়ে ফেলি।”

“বাহ! দারুণ তো!”

ইফতি কফি মেকারে দুই কাপ চমৎকার কফি বানিয়ে ফেলল। প্রিয়তীর খিদেও পেয়ে গিয়েছিল। সেটা বলতেই ইফতির স্টক থেকে কিছু বিস্কুট বের হয়ে এলো।

খেতে খেতে দু’জন অনেক গল্প করল। একসময় ক্লান্তিতে হাই তুলতে শুরু করল প্রিয়তী৷ সে গত তিন চার রাত ধরেই ঘুমায় না। ইফতির বিছানাটা খুব আরামের মনে হচ্ছে।

শুয়ে পড়ল তারা। প্রিয়তীর চোখ লেগে এলো শোওয়ার সাথে সাথে। নিঃশ্বাস গভীর হয়ে এলো। ইফতি কিছুক্ষণ ছটফট করল। প্রিয়তীর গায়ের মিষ্টি ঘ্রাণে তার মাথা ধরে যাবার অবস্থা। সাথে বাসরের ফুলটুল মিলে আরও অস্বস্তিকর অবস্থা তৈরি করেছে। দুটো মোম জ্বলছিল, নিভিয়ে দিয়ে এলো সে। শুয়ে পড়ল একপাশে গুটিশুটি হয়ে৷ তার বিছানাটা দখল হয়ে গেছে অর্ধেক। ঘরও বলা চলে দখল হয়ে গেছে। আগের মতো স্বাধীনতা আর থাকছে না। আর প্রাইভেসি! সে তো বোধহয় বানের জলে ভেসেই গেল! বিয়ে জিনিসটা সহজ নয় মোটেও। তবে প্রেয়সী এভাবে মড়ার মতো না ঘুমিয়ে তাকে একটু এটেনশন দিলে হয়তো এসব দখলদারিত্বের চিন্তাই ভেসে যেন জলে। উল্টে নিজেকেও বিলিয়ে দেয়া যেত তার কাছে। রাত বাড়ল, একসময় ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামল। শীত শীত করাতে ইফতি উঠে একটা কাঁথা গায়ে জড়িয়ে নিল, সাথে প্রিয়তীর গায়ের ওপরেও দিয়ে দিল। সে নিজেও ক্লান্ত ছিল, গতরাত ঘুমায়নি। কখন ঘুমিয়ে পড়ল বুঝতেও পারল না।

প্রিয়তীর ঘুম ভেঙে গেল শেষরাতের দিকে। এরপর চেষ্টা করেও আর ঘুম আনা গেল না। খুব কষ্ট হতে লাগল তার৷ মনে হলো পুরো পৃথিবীতে তার আপন বলতে কেউ নেই। সে প্রচন্ড একা। নিঃশব্দ কান্নাগুলো চোখ বেয়ে নামতে শুরু করল প্রিয়তীর৷ শব্দ করে কাঁদার ইচ্ছেটা দমন করল অতিকষ্টে।

ইফতির ভারী নিঃশ্বাসের শব্দ আসছে। আজই প্রিয়তী ভাবছিল, লোকটার কাছে কিছু সময় চাইবে। কিন্তু এখন তার নিজেরই ইচ্ছে করছে ইফতিকে ডেকে তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে ঘুমাতে। কাঁথার নিচে খুব কাছাকাছি শুয়েও তারা যেন অনেক দূরে বাস করছে৷ এই দূরত্ব কি কখনো কমবে?

(চলবে)

সুমাইয়া আমান নিতু

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে