#অন্ধ_তারার_অশ্রুজল
৪.
ইফতির মা ফর্সা, মোটাসোটা, গোলগাল সুন্দর দেখতে। চেহারায় দেখলেই মা ডাকতে ইচ্ছে করে। তিনি ইফতি আর প্রিয়তীর দিকে অনেকক্ষণ গোল গোল চোখে তাকিয়ে রইলেন বাকরুদ্ধ হয়ে।
ইফতি কাচুমাচু মুখে বলল, “মা, আসলে…”
মা হতাশ ভঙ্গিতে সোফায় বসে পড়লেন। তার দৃষ্টি ঘুরছে প্রিয়তী আর ইফতিকে ঘিরে। একটা সময় বললেন, “তাহলে করেই ফেললি তোর পছন্দের মেয়েকে বিয়ে?”
ইফতি বলতে যাচ্ছিল আসলে এটা সেই মেয়ে না। হাতে প্রিয়তীর রাম চিমটি খেয়ে মাঝপথে আটকে গিয়ে বলল, “হু…হ্যাঁ।”
পেছনে কাচ ভাঙার শব্দে ফিরে তাকাল তারা। সেই মেয়েটা এসে দাঁড়িয়েছে। ওর হাত থেকে পানির গ্লাস পড়ে গেছে।
“তোমার আবার কী হলো?” মায়ের কন্ঠে বিরক্তি।
মেয়েটা ইফতির দিকে একবার বিষদৃষ্টিতে তাকিয়ে ভাঙা কাচ তুলতে শুরু করল। বোধহয় ভাবছে, ইফতি তাকে এতদিন ঠকিয়েছে৷ ওর সাথে সাথে এই মেয়ের সাথেও তাহলে সম্পর্ক ছিল!
ইফতি এগিয়ে গিয়ে মায়ের হাত ধরে বলল, “মা, তুমি রাগ করো না প্লিজ…”
মা ঝটকা দিয়ে হাত সরিয়ে নিয়ে বললেন, “আমি কিচ্ছু জানি না। যা করার তোর বাবা এসে করবে।”
তিনি উঠে দাঁড়িয়ে প্রিয়তীর হাত ধরে টেনে নিয়ে গেলেন নিজের ঘরে। গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলেন৷ কী মুসিবত!
এদিকে ইফতির প্রাক্তন প্রেমিকা এবং বর্তমান ছোটো ভাইয়ের বউ তুবা এসে দাঁড়াল সামনে। “বলুন তো ঘটনা কী?”
“কিসের ঘটনা?”
“এই মেয়েকে আমদানি করেছেন কোথা থেকে?”
“তা জেনে তোমার কী কাজ?”
“আমার কী কাজ মানে? আপনি এত দুশ্চরিত্র তা তো জানা ছিল না।”
ইফতি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “ব্রেকআপের দুই মাস পর তুমি আরেকজনকে বিয়ে করে ফেললে তখন চরিত্রের চিন্তা কোথায় ছিল?”
“দেখুন! আপনার ভাইয়ের সাথে বিয়ে অনেকটা ঝোঁকের মাথায় করেছি। আপনার সাথে রাগ থেকে করেছি। কিন্তু আপনি নিশ্চয়ই তা করেননি! আমাকে কেন ঠকিয়েছেন? এই মেয়েকে বিয়ে করার জন্য?”
“তুমি মিফতাকে বিয়ে করেছ আমার সাথে রাগ থেকে?”
“হ্যাঁ!”
“তুমি যে ওকে ঠকাচ্ছ তার কী হবে?”
“কে কাকে ঠকাচ্ছে? আপনার ভাইকে জিজ্ঞেস করে দেখুন, সে আমার সাথে সুখী কি না!”
“মানলাম সুখী, কিন্তু তুমি তো তাকে ভালোবাসো না।”
“বাসি।”
“এইমাত্র বললে আমার সাথে রাগ থেকে বিয়ে করেছ।”
“তো? তারপর ভালোবাসা হতে পারে না?”
“কে জানে! তা হলেই ভালো।”
তুবা রাগে কাঁপতে কাঁপতে বলল, “এতদিন পর্যন্ত আপনাকে কাপুরষ ভাবতাম, এখন দেখলাম দুশ্চরিত্রও৷ যতটুকু সম্মান ছিল আপনার জন্য, সেটুকুও শেষ। ভালোই হলো।”
ইফতি কিছু বলার খুঁজে পেল না৷ তুবা চলে গেল নিজের ঘরে। ইফতি কী করবে ভেবে পেল না৷ মায়ের বন্ধ দরজার ওপাশে কী হচ্ছে কে জানে! নিজেকে সত্যি সত্যিই দুশ্চরিত্র মনে হচ্ছে!
★★★
পুরো একঘন্টার ইন্টারভিউ দিয়ে ফেলল প্রিয়তী। তার অতীত, বর্তমান সব একেবারে পেট চেপে বের করে নিলেন ইফতির মা। প্রথমে মহিলাকে যতটা সরল আর মিষ্টি মনে হচ্ছিল আদতে তিনি তা নন। প্রয়োজনে খুব শক্ত কথাও বলে ফেলতে পারেন সহজে।
প্রিয়তী চেষ্টা করেছে স্মার্টলি সব প্রশ্নের উত্তর দেবার। সব অবশ্য সে সত্যি বলেনি, কেন বাড়ি থেকে পালিয়েছে সেটা বললেও ইফতির সাথে কী করে দেখা হলো সেটা বলেনি। উনি এখনো জানেন ইফতি আর প্রিয়তী তিন বছর ধরে প্রেম করছিল।
সন্ধ্যায় আরেক দফা মিটিং হলো৷ ইফতির বাবা হলেন মিটিংয়ের হেড৷ তিনি অবশেষে ঘোষণা দিলেন, বিয়ে যেহেতু হয়েই গেছে, মেনে না নিয়ে উপায় নেই। তবে যত দ্রুত সম্ভব প্রিয়তীর বাবা মায়ের সাথে যোগাযোগ করতে হবে। বাবা মাকে কষ্ট দিয়ে প্রিয়তী বড় অন্যায় কাজ করেছে।
বাবা যতই ভালো করে কথা বলুক না কেন, মা কিন্তু এখনো মুখ কঠোর রেখেছেন। তার চেহারার দিকে তাকানো যাচ্ছে না। মনে হচ্ছে কেউ তাকে জোর করে তেঁতো ঔষধ খাইয়ে দিয়েছে। সেটাই মুখে নিয়ে বসে আছে, না পারছে ফেলতে, না পারছে গিলতে!
প্রিয়তী তাদের বলেছে দুটো দিন পর নিজের বাবা মায়ের সাথে কথা বলিয়ে দেবে। সে আসলে মনে মনে চাইছে তার বাবা মাকে একটা শিক্ষা দিতে। হয়তো শিক্ষাটা বেশি হয়ে যাচ্ছে, হয়তো তারা এতক্ষণে মেয়ে আর মানসম্মান একসঙ্গে খুইয়ে সত্যিই কষ্টে আছেন, তবুও প্রিয়তীর অভিমান কমছে না। পাহাড়সমান অভিমান জমিয়ে রেখেছে সে মনের মধ্যে। বাবার শেষদিনের ব্যবহার সে কিছুতেই ভুলতে পারছে না৷
রাত বাড়তেই প্রিয়তীর কেমন অস্থিরতা শুরু হলো। এই লোকটার সাথে থাকতে হবে! এক ঘরে! মাত্র একদিনের পরিচয়ে ঝোঁকের মাথায় বিয়ে করে ফেলার সময়েও মনে হয়নি লোকটার সাথে এক ঘরে থাকতে হবে। ইফতি লোক ভালো সন্দেহ নেই, কিন্তু বিয়ে করা বউয়ের সাথে সে আর কতটাই বা ভালো থাকতে পারবে? প্রিয়তী টেনশনে ঘেমে নেয়ে একাকার!
প্রিয়তী কি তাকে বলবে, তার কিছুটা সময় প্রয়োজন?
রাতে ইফতির বোন তূণা এসে হাজির হলো। সে বেশ দূরেই থাকে, তবে খবর পেয়ে ছুটে চলে এসেছে বড় ভাইয়ের বউ দেখতে। তূণা খুব মিষ্টি। প্রিয়তীকে দেখেই বলল, “ভাইয়া তোর পছন্দ তো মাশাআল্লাহ। কী সুন্দর বউ রে!”
প্রিয়তী লজ্জা পেয়ে গেল। তূণাই এসে বাসর ঘরের ব্যবস্থা করল। স্বামীকে দিয়ে ফুল আনিয়ে নিজেই ঘর সাজাল। সাথে তুবাকেও টেনে এনে কাজ করিয়ে নিল। তূণা বয়সে মিফতার চেয়ে বড়৷ তাই তুবা বয়সে আর সম্পর্কে দুটোতেই তার চেয়ে ছোটে। এজন্য তূণা হুকুমও চালায় দেদারসে।
প্রিয়তীর খারাপই লাগল তুবার জন্য। বেচারি কি ভেবেছিল এতদিনের প্রেমিকের বাসর ঘর নিজের হাতে সাজিয়ে দিতে হবে?
রাত বারোটায় প্রিয়তী আর ইফতিকে বাসর ঘরে ঢুকিয়ে দেয়া হলো।
চারদিকে ফুলের সুবাস। ভীষণ সুন্দর করে সাজানো হয়েছে ঘরটা। ছিমছাম ঘর প্রিয়তীর এমনিতেই বেশ পছন্দ হলো। ঘরে একটা ডাবল বেডের খাট, একটা আলমারি, ছোট্ট ড্রেসিং টেবিল, একটা বুকশেলফে বেশকিছু বই, দেয়ালে টানানো বড় একখানা পেইন্টিং। তার ওপর এখন ফুল আর নানা রকমের মোমবাতি দিয়ে সাজানো পুরো ঘর।
ইফতি আগেই বিছানায় গিয়ে ধুপ করে বসে পড়ল। প্রিয়তীর কাছে জামাকাপড় কিছু নেই। সে নিজেও মনে করেনি বলে কেনা হয়নি আজ। এবার বিপদে পড়ল সে। এই শাড়ি গতকাল সকাল থেকে পরে আছে। শরীর আঠা আঠা হয়ে আছে। বিচ্ছিরি লাগছে তার।
ইফতিকে বলল, “আচ্ছা, আমি তো এই শাড়ি পরে ঘুমাতে পারব না। কেন আজকে জামাকাপড় কিনতে মনে ছিল না বলুন তো! কারো কাছে জামাকাপড় চাওয়া কি ঠিক হবে? উফ! আমি এত বোকা কেন!”
মা যে শাড়িটা দিল সেটা পরে ফেলুন।
“ওইটা তো কাল পরার জন্য৷ আপনার কিছু আত্মীয়স্বজন নাকি আসবে। আর ওই জামদানি পরে কেউ ঘুমাতে পারে? পাগল নাকি?”
ইফতি বলল, “কিন্তু চাইব কার কাছে? তূণা তো বেড়াতে এসেছে, জামাকাপড় তেমন এনেছে বলে মনে হয় না। এক বাকি রইল তুবা।”
প্রিয়তী কী ভেবে বলল, “থাক বাবা, তুবার কাছে চেয়ে কাজ নেই। আমি এই শাড়ি পরেই ঘুমাই। কিন্তু এটা দুদিন ধরে পরে আছি আমি!”
অগত্যা ইফতি উঠে বেরিয়ে গিয়ে মায়ের ঘরে টোকা দিল। মা দরজা খুলে ওকে দেখে বিরক্ত মুখে সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে চেয়ে রইলেন। আগ বাড়িতে কিছু জিজ্ঞেস করলেন না। ইফতি আমতা আমতা করে বলল, “ও জামাকাপড় কিছু আনেনি…”
“তো?”
“নরম কোনো জামা থাকলে..রাতে ঘুমানোর জন্য…”
ইফতির মায়ের একবার ইচ্ছে হলো মুখের ওপর আবার দরজাটা বন্ধ করে দিতে। কিন্তু অনেক কষ্টে নিজেকে সামলালেন তিনি। ওয়্যারড্রোবের ড্রয়ের থেকে একসেট জামা বের করে দিলেন। তিনি নিজে শাড়ি পরতেন আগে, কয়েক বছর হলো সালোয়ার কামিজও পরেন। এই সেটটা তার একটু টাইট হয়। তবুও প্রিয়তীর অনেক ঢিলে হবে। তা হোক! আর কোথা থেকে এই রাতে জামা আমদানি করা যাবে!
জামা হাতে নিয়ে প্রিয়তীর চোখ খানিকটা বিষ্ফারিত হলো, এটাতে তার মতো দু’জন ঢুকতে পারবে মনে হচ্ছ! কিন্তু যেহেতু তার কাছে আর কোনো অপশন নেই, তখন সেগুলোই নিয়ে নিল। বাথরুমে ঢুকে শান্তিমতো গোসল করল ঘন্টাখানেক সময় নিয়ে।
ইফতি এদিকে চিন্তায় পড়ে গেল। মেয়েটা যে বাথরুমে ঢুকেছে, আর বের হবার নাম নেই। অজ্ঞান হয়ে গেল না তো? একটানা শাওয়ার থেকে পানি পড়ার শব্দ আসছে। কিছু হলো না তো?
সে কয়েকবার বাথরুমের সামনে ঘুরঘুর করল। একবার ভাবল ডাক দেয়, কিন্তু সমস্যা হলো সে তার বউয়ের নাম ভুলে গেছে। যতদূর মনে পড়ে কাবিননামায় সই করেছে ইসরাত জাহান নামে। সেটা তো ভালো নাম। ডাকনামটাও একবার বলেছিল, কিন্তু ইফতি এতকিছুর মধ্যে ভুলে বসে আছে।
সময় যখন ঘন্টার কাটা অতিক্রম করে গেল, তখন ইফতি আর থাকতে পারল না। দরজা নক করে বলল, “ইসরাত, আপনি ঠিক আছেন?”
প্রিয়তী দ্রুত জামাকাপড় পরে বের হলো। ওর চুল অনেক বড়। প্রায় হাটু পর্যন্ত। ভেজা চুল ছড়িয়ে রেখেছে সামনে। পরনের জামা ভিজে যাচ্ছে চুলের পানিতে। প্রিয়তী সামলাতে পারছে না৷ বাড়িতে সে সুতি কাপড়ের গামছা ব্যবহার করে। ইফতির মোটা কাপড়ের তোয়ালে দিয়ে কিছুতেই চুল বশে আনতে পারছে না। চুল মুছতে মুছতে কাহিল হয়ে যাচ্ছে সে। এদিকে ঢিলে জামা মনে হচ্ছে কখন যেন গা থেকে খুলে পরে যাবে। ক’দিন আগে নাক ফুড়িয়েছে সে৷ নাকের ছোট্ট সাদা পাথরটা ঝিকমিক করছে।
ইফতিকে হা করে তাকিয়ে থাকতে দেখে প্রিয়তী বিরক্ত গলায় বলল, “কাকে ডাকছিলেন তখন? আপনার এক্সের নাম তো জানতাম তুবা, ইসরাত না।”
ইফতি ইতস্তত করে বলল, “আপনাকেই তো ডাকছিলাম।”
“আমার নাম ইসরাত না, নূসরাত। নূসরাত জাহান প্রিয়তী।”
“ওহ আচ্ছা।”
প্রিয়তী বিড়বিড় করতে করতে ব্যালকনিতে চলে গেল। “মানুষ কত উজবুক হলে বিয়ে করা বউয়ের নাম ভুলতে পারে!”
(চলবে)
সুমাইয়া আমান নিতু