#অন্ধকারে_এক_চিলতে_আলো
#লেখিকা-শারমিন আঁচল নিপা
#পর্ব-১৪/শেষ পর্ব
আলো বাসায় প্রবেশ করতেই খানিকটা বিচলিত হয়ে গেল। কারণ বাসাটা পুরো অন্ধকার হয়ে আছে। চারপাশে কিছু দেখতে পারছে না সে। আজকাল অন্ধকার দেখলে আলোর গা গুলায়। বুকের ভেতরটা শিউরে উঠে। ভয় ভয় গলায় আলো তানভীরকে উদ্দেশ্য করে বলল
– এত অন্ধকার কেন চারপাশ?
কথাটা আলো বলে উঠতেই চারপাশ আলোকিত হয়ে গেল। পার্টি স্প্রে গুলো সাদা ধোঁয়ার মতো চারদিকে উড়তে লাগল। আলো বুঝে উঠতে পারছে না কী হচ্ছে। এর আগেই লক্ষ্য করল একটি সুন্দরী মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মেয়েটাকে দেখে মনে হচ্ছে সে বাংলাদেশী না। কিন্তু মেয়েটি কে? আলো ভাবতে ভাবতেই মেয়েটি আলোর কাছে এসে ঠিক সামনে দাঁড়াল। অস্পষ্ট বাংলায় বলল
– কেমন লাগলো সারপ্রাইজটা?
আলো চুপ হয়ে রইল। তার বোধগম্য হচ্ছে না কী ঘটছে। তানভীরের দিকে সে তাকালো। তানভীর তখন মৃদু হাসছিল। কৌতুহল চোখে জাহানারা সুফিয়ার দিকে তাকিয়ে বলল
– আন্টি মেয়েটি কে? আর কিসের সারপ্রাইজ কিছুই তো বুঝতে পারছি না।
জাহানারা সুফিয়া হাসতে হাসতে বলল
– এ হলো আমার বড় ছেলে সানীর বউ। সে বাংলাদেশী না। তার নাম এলিজাবেথ। তবে আমি তাকে নাম দিয়েছি সিথুন। আর তিনমাস আগে সানী বিয়ে করে সব অভিমানের পালা শেষ করে বাসায় ফিরে। তুমি তো তখন জেলে ছিলে তাই জানো না কিছু। আর এত পথ পেরিয়ে অন্ধকারে এক চিলতে আলোর মুখ দেখেছো তাই তোমাকে সিথুন সারপ্রাইজ দিয়েছে। মজার ব্যপার হচ্ছে সে তোমার জন্য একটা কেকও বানিয়েছি। আজকে আমরা সে কেক কেটে সিলেব্রেট করব।
জাহানারা সুফিয়ার কথা শুনে আলো খুশিতে স্তব্ধ হয়ে গেল। এত ভালোবাসা সে পাবে কখনও বুঝতে পারে নি। তার মনটা খুশিতে নাচতে লাগল। খুশির তাড়নায় মুখ দিয়ে কোনো কথায় যেন তার বের হচ্ছে না। শুধু চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। এর মধ্যেই একজন বলে উঠল
– এটাই তাহলে সে আলো? যার কথা এ তিনমাসে মা আর তানভীরের মুখে এত শুনেছি।
আলো কন্ঠটা শুনে পাশে তাকিয়ে দেখল একজন সুদর্শন পুরুষ দাঁড়িয়ে আছে। আলোর বুঝতে বাকি রইল না উনিই হলেন তানভীরের বড় ভাই সানী। আলো সানীর দিকে তাকিয়ে নম্র গলায় বলল
– ভাইয়া কেমন আছেন?
– হ্যাঁ ভালো আছি। কিন্তু তুমি কী আমাকে চিনো?
– চিনি না তবে তানভীর ভাইয়া আর আন্টির মুখে এর আগে আপনার কথা শুনে আন্দাজ করেছি আপনি সানী ভাইয়া৷ আর সিথুন ভাবীকে আমার অনেক পছন্দ হয়েছে।
আলোর কথা শুনে সানী মুচকি হাসলো সে সাথে সিথুনও।
জাহানরা সুফিয়া তানভীরের দিকে তাকিয়ে বলল
– যাও কেকটা নিয়ে এসো। আলো আর তুমি এক সাথে কেক কাটবে কারণ তুমি আলোকে এ বাসায় নিয়ে এসেছিলে।
পরক্ষণেই সিথুন আর সানীর দিকে তাকিয়ে বলল
– তোমরাও আলোর পাশে বসো।
কথাটা বলেই জাহানারা সুফিয়া একজন মধ্য বয়স্ক লোককে ইশারা করে বলল
– আলো উনি হলেন তানভীরের চাচা।
আলো তানভীরের চাচাকে সালাম দিল।।তানভীরের চাচা সালামের জবাবা দিয়ে আলোর পাশে এসে দাঁড়াল। মাথায় হাত বুলিয়ে দোআ করে দিল। জাহনারা সুফিয়া তখন হালকা গলায় বলল
– বাসায় একটা বিশেষ অনুষ্ঠান আছে তো তাই তানভীরের চাচা এসেছে। আগে কেকটা কাটো তারপর বলব কিসের অনুষ্ঠান।
জাহানারা সুফিয়ার কথাটা শুনে আলোর তর সইছে না। আলো ভাবতে লাগল এ বাসায় বিশেষ অনুষ্ঠান তানভীরের বিয়ে ছাড়া আর কী হতে পারে। কথাটা ভাবতেই আলোর বুকে তানভীরকে হারানোর বিয়োগ ব্যথা অনুভব করল। আলো বুঝতে পারলো এ কয়দিনে তানভীরকে সে কতটা ভালোবেসে ফেলেছে। তাহলে কী তানভীরকে সে হারিয়ে ফেলবে? আলো নিজেকে আর সামলাতে পারল না। অস্থির গলায় বলল
– কী অনুষ্ঠান এখনি বলুন। তারপর নাহয় কেক কাটা যাবে।
জাহানারা সুফিয়া হাসতে হাসতে বলল
– তানভীরের বিয়ে।
কথাটা শুনেই আলোর মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে গেল। ভালোবাসা হারানোর যন্ত্রণা টা ইতোমধ্যে টের পেল। কাঁপা কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করল
– কার সাথে?
আলোর প্রশ্নটা যেন সবাই এড়িয়ে গেল। জাহানারা সুফিয়া তাড়াহুড়ো করে বলল
– কেকটা কাটো এবার। এ সময় রাবু আবার কোথায় গেল। রাবু…রাবু…রাবু..
– জ্বি খালাম্মা।
– কাজের সময় কোথায় থাকো তুমি? তাড়াতাড়ি এসো। আর আসার সময় একটা ছুরি নিয়ে এসো। কেক কাটতে হবে।
– খালাম্মা আনতেছি।
বলেই রাবু দৌঁড়ে ছুরি নিয়ে আসলো। তানভীরের বিয়ের ব্যপার নিয়ে আলোর কষ্টটা প্রখর হলেও সে কষ্টটাকে হাসির আড়ালে চাপা দিয়ে কেকটা কাটলো। কেক কাটা শেষে সবাই রাতের খাবার খেয়ে নিল। আলো আলোর রুমে গিয়ে খাটে হেলান দিল। তানভীরের বিয়ে কার সাথে সেটাই সে ভাবতে লাগল। আজকে আলো সব পেলেও তার কাছে মনে হচ্ছে সবচেয়ে প্রিয় জিনিসটা হারাতে যাচ্ছে। এমন সময় তানভীর কাশি দিয়ে আলোর রুমে প্রবেশ করলো। আলো কাশির আওয়াজ পেয়ে নড়েচড়ে বসে তানভীরের দিকে তাকাল। তানভীর হালকা গলায় আলোর দিকে তাকিয়ে বলল
– মুখটা এত ফ্যাকাশে কেন?, আর মন মরা হয়ে বসে আছো কেন? মন খারাপ নাকি?
আলো মাথা নেড়ে বলল
– না। আচ্ছা আপনার যে মেয়ের সাথে বিয়ে সে মেয়ের নাম কী?
তানভীর লাজুক গলায় বলল
– মিশকাত।
নামটা শুনতেই আলোর আশার আলো ধপাশ করে নিভে গেল। এতক্ষণ পর্যন্ত আলো আশা করছিল যে তানভীরকে নিয়ে হইতো একটা সারপ্রাইজ পাবে। তবে তানভীরের মুখে পাত্রীর নাম শুনার পর সে আশাটা থমকে গেল। কষ্টটা প্রখর হলো। তানভীরকে যে সে এত ভালোবেসে ফেলেছে বুঝতেই পারে নি। তবে নিয়তি মেনে নেওয়া ছাড়া তার কোনো উপায় নেই। মুখে যেন তার কষ্টের অন্ধকার নেমে আসলো। ভাঙ্গা গলায় বলল
– অভিনন্দন। আচ্ছা ভাবীর একটা ছবি কী দেখতে পারি?
– কেন দেখতে পারবে না। অবশ্যই দেখতে পারবে। দাঁড়াও দেখাচ্ছি তোমায়।
বলেই পকেটে হাত দিয়ে মোবাইলটা বের করে। মোবাইলটা চাপতে চাপতে বলল
– কোথায় যেন ছবিটা রেখেছিলাম। হ্যাঁ মনে পড়েছে। ওর জন্য মাই হার্ট লিখে একটা এলবাম বানিয়েছিলাম সেখানে রেখেছি। সত্যি বলতে কী মিশকাতকে আমি অনেক ভালোবেসে ফেলেছি। তাকে সবটা ভালোবাসা উজার করে দিলেও যেন মনে হবে ভালোবাসা দিতে পারে নি। বিশেষ ব্যপার হচ্ছে মিশকাতকে আমাদের পরিবারের সবাই খুব পছন্দ করেছে।
কথাগুলো তানভীর বলেই যেতে লাগল। আর আলোর চোখের কোণে কষ্টের পানি জমা হলো। তানভীরের প্রতি তার অনেক অভিমান জমেছে তবে সেটা প্রকাশ করার মতো অধিকার তার নেই। আলোর খুব কষ্ট হচ্ছে। তবুও নিজেকে সামলে নিল। এমন সময় তানভীর মোবাইলটা সামনে দিয়ে বলল
– এ হলো আমার হবু বউ।
আলো ছবিটা দেখে যেন আকাশ থেকে পড়ল।কারণ এটা তো আলোর ছবি। বিস্মিত গলায় তানভীরের দিকে তাকিয়ে বলল
– আপনি হয়তো কোথাও ভুল করছেন। এটা তো আমার ছবি। আমার নাম তো মিশকাত না।
তানভীর এবার অট্ট হাসি দিয়ে বলল
– ইচ্ছা করেই নামটা ভুল বলেছিলাম কারণ তোমার এক্সপ্রেশন দেখার জন্য। তুমি আমাকে ভালোবাসো কী না সেটা বুঝার জন্য। তোমার ফ্যাকশে মুখ দেখে আমি নিশ্চিত হলাম তুমিও আমাকে ভালোবাসো। আলো আমি তোমায় বড্ড ভালোবাসি। কালকে তোমার সাথে এনগেজমেন্টের ব্যবস্থা করব। বিয়ে নিয়ে হয়তো একটু ঝামেলা হতে পারে কারণ তুমি প্রাপ্ত বয়স্ক না। আচ্ছা তুমি রাজি তো আমাকে বিয়ে করতে?
তানভীরের কথা শুনে আলোর চোখ দিয়ে পানি পড়তে লাগল আর মুখে হাসির রেখা ফুটে উঠল। এ যেন আলো ছায়ার খেলা। মৃদু গলায় আলো বলে উঠল
– আমিও আপনাকে বড্ড বেশি ভালোবাসি।
আলোর কথাটা শুনে তানভীর আলোকে জড়িয়ে ধরে পরক্ষণেই ছেড়ে দিয়ে বলল
– আচ্ছা এখন গেলাম। অনেক কাজ বাকি। তুমি বিশ্রাম নাও কেমন।
আলো মাথা নাড়ল। তানভীর আলোর রুম থেকে বের হলো। আলোর শরীরটা ক্লান্ত। ঘুমে চোখটা এখন বুজে আসছে। তাই দরজা খোলা রেখেই ঘুমিয়ে গেল।
রাত ঠিক তিনটা একটা বিকট আওয়াজে সবার ঘুম ভাঙ্গলো। আওয়াজটা পেয়ে সবাই তাড়াহুড়ো করে উঠে ঘরের আলো জ্বালিয়ে ঘর থেকে বের হলো। লক্ষ্য করলো আওয়াজটা আলোর রুম থেকে আসছে। সবাই আলোর রুমে গিয়ে চমকে গেল। লক্ষ্য করল তানভীরের চাচা আলোর রুমের মেঝেতে রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। আর আলো ছুরি নিয়ে মাথা নীচু করে বসে আছে। আলো জোরে জোরে দম নিচ্ছে। আলোকে এ অবস্থায় জাহানারা সুফিয়া দেখে চেঁচিয়ে বলে উঠল
– তুমি কী ভাইজানকে খুন করেছো? তোমার জন্য আমরা সবাই এত কিছু করলাম আর তুমি ভাইজানকে মেরে দিলে? কীভাবে পারলে এমন করতে?
কথাটা শুনেই আলোও চেঁচিয়ে বলল
– হ্যাঁ আমি চাচাকে খুন করেছি। কারণ অমানুষগুলো মানুষের মুখোশ পরে থাকে।এদেরকে চেনা বড় কঠিন। রাত তখন আড়াইটা আমি ক্লান্ত থাকায় দরজা খুলেই ঘুমিয়ে পড়ি।।হুট করে মনে হলো কেউ একজন আমার হাত চেপে জড়িয়ে ধরেছে। আমি স্পর্শ পেয়েই উঠে দেখি চাচা।চাচাকে দেখে চেচাঁতে নিলে চাচা আমার মুখটা চেপে ধরে বলল
– আরে মা চেঁচিও না। একটু আদর করে চলে যাব। তোমাকে দেখে সামলাতে পারিনি নিজেকে। রুশির মতো একদম তুমি। রুশিকে যেভাবে আদর করেছি ঠিক সেভাবে করব। আর কাউকে কিছু বলো না।
বলেই আমাকে ঝাঁপটে ধরল। আমি ছুটাবার অনেক চেষ্টা করেও যখন পারছিলাম তখন কেক কাটার সে ছুরিটা হাত বাড়িয়ে টেবিল থেকে নিয়ে আঘাত করি উনাকে। সেদিন রুশি নিজের কাছে হেরে গেলেও আমাকে আমি হারতে দেইনি। তাই মানুষের মুখোশ পড়া অমানুষকে খুন করলাম। আমাকে পুলিশে দিতে চাইলে দেন। আমার কোনো আফসোস নাই। অন্তত বলতে তো পারব আমি এ অমানুষকে শেষ করতে পেরেছি।
আলোর কথা শুনে সবাই চুপ। তানভীরের চাচা এমন সেটা যেন কেউ বিশ্বাস করতে পারছে না। আবারও পুলিশকে খবর দেওয়া হলো। আলোকে ধরে নেওয়া হলো। পুলিশ রুশির বিষয়টা তদন্ত করে তানভীরের চাচার ডি এন এ টেস্ট করে নিশ্চিত করে যে রুশির পেটে তানভীরের চাচার সন্তানেই ছিল। অথচ সে সময়টায় তানভীরের চাচা সন্দেহের তালিকার বাইরে ছিল। তানভীরের পরিবার বড় একটা ধাক্কা খেল। সে সাথে রুশিকে নিয়ে হাজারও প্রশ্নের উত্তর মিললো। এদিকে আদালত আলোকে আইন হাতে তুলে নেওয়ার জন্য দু বছরের কারাদন্ড দিল।
তানভীর আজকে আলোকে দেখতে গেল। সেখানে আলোর দিকে তাকিয়ে বলল
– মারতে গেলে কেন? জোরে চিৎকার দিলে তো আমারা বাঁচাতে পারতাম তোমাকে। তোমারও সাজা হত না। তোমাকে ছাড়া থাকব কী করে?
আলো তানভীরের দিকে তাকিয়ে বলল
– এছাড়া উপায় ছিল না। তুমি ভালো থেকো। আর অন্য কাউকে বিয়ে করে সুখী থেকো। আমার মতো খুনীর জন্য আর আপেক্ষা করো না। রুশিকে নিয়ে যে প্রশ্ন জমেছিল অন্তত সে প্রশ্নের উত্তর তো পেয়ছো।
– আমি তোমার জন্য জনম জনম অপেক্ষা করতে রাজি। এ তো মাত্র দুই বছর। আমি এ খুনীটাকেই চাই আলো। ভালোবাসি তোমায়।
আলো মৃদু গলায় বলল
– বাসায় যাও। আমি আসব আবার ফিরে তোমার কাছে অন্ধকারে এক চিলতে আলো খুঁজতে।
সমাপ্ত।