অন্ধকারে এক চিলতে আলো পর্ব-১৩

0
1594

#অন্ধকারে_এক_চিলতে_আলো
#লেখিকা- শারমিন আঁচল নিপা।
#পর্ব- ১৩

তাহলে কী আলো মারা গেল?? আলোকে ধরে হাসপতালে নেওয়া হলো।

এদিকে আজকে কেন জানি আলোর জন্য তানভীরের মনটা বেশি পুড়তে লাগল। চোখের কোণে কষ্টের লোনা জল জমতে লাগল। জমে থাকা কষ্টগুলো বাড়তে লাগল। ছুটে গিয়ে আলোকে দেখতে ইচ্ছা করল তার। তবে দেখার উপায় নেই। হাত পা যেন তার বাঁধা। নিজেকে বড্ড কাপুরুষ মনে হচ্ছে তার। মনে হচ্ছে সে কিছুই করতে পারছে না।

আর জাহানারা সুফিয়া আলোকে পুলিশে দিয়ে দমে যায়নি। তিনি ইতোঃমধ্যে সকল প্রমাণ জোগাড় করেছেন। একজন এডভোকেটের সাথে কথা বলেছেন। যদিও সব প্রমাণ নিয়ে যাওয়ার কথা ছিল আরও কিছুদিন পর কিন্তু আজকে আলোর অবস্থা শুনে তিনি তাড়াহুড়ো করে এডভোকেট সাহেরা খান কে নিয়ে চলে গেলেন সেখানে। সেখানে গিয়ে এডভোকেট সাহেরা খান প্রথমেই অভিযোগ করেন যে একটি ১৪ বছরের মেয়ে যদি কোনো অন্যায় করে সেটা কিশোরী আইনে পড়ে। তাহলে তাকে রিমান্ডে কেন দেওয়া হলো। সাহেরা খানের এমন অভিযোগে জানানো হয় যেহেতু আলো বিবাহিত ছিল সেহেতু তারা বয়স দিয়েছিল ১৮ বছরের বেশি। সে অনুযায়ী তাকে প্রাপ্ত বয়স্ক ধরা হয়। কিন্তু সাহেরা খান পাল্টা অভিযোগ দায়ের করল। একটি নিরাপরাদ মেয়েকে বিনা কারণে টর্চার করে মৃত্যুর মুখে ফেলে দেওয়ার জন্য।

আপাতত বিষয়টা পর্যবেক্ষণ চলছে। আর জাহানারা সুফিয়া অনুমতি নিয়ে আলোকে দেখতে গেল। হাসপাতালে আলোর নিথর দেহটা দেখে যেন তার মরে যাওয়া তিন বছরের মেয়েটার মুখটা চোখে ভেসে উঠল। জাহানারা সুফিয়ার প্রথম সন্তান ছেলে ছিল না। প্রথম সন্তান ছিল একটা মেয়ে। তবে রোড এক্সিডেন্টে মাত্র তিন বছর বয়সে মেয়েটা মরে যায়। আজকে আলোকে দেখে তার মেয়ে সায়রার কথা বেশ মনে পড়ছে । আলোর ঠিক পাশে গিয়ে বসলো। এর মধ্যে একজন ডাক্তার আসলো। জাহানারা সুফিয়া ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করল

– আলোর অবস্থা কেমন আছে? আর কী জন্য এমন হয়েছিল?

ডাক্তার হালকা গলায় জবাব দিল

– রোগীর অবস্থা ভালো। তবে রেগীর বিষয়ে পারমিশন ছাড়া কাউকে কিছু বলা যাবে না।

এর মধ্যেই জাহানারা সুফিয়ার ডাক পড়ল। মাত্র ৫ মিনিটের জন্য তাকে দেখতে দেওয়া হয়েছিল। জাহানার সুফিয়া শেষ বার আলোর মুখের দিকে তাকালো। আলোর অসহায় মুখটা তার মনটাকে চূর্ণ বিচূর্ণ করছে। নিজেকে সামলে নিয়ে শক্ত করে কেবিন থেকে উনি বের হলেন।

বাসায় ফিরলেন দুপুর ২ টায়। সাধারণত এ সময়টাতে উনাকে বাসায় পাওয়া যায় না। কয়েক বছর পর উনাকে বাসায় আসতে দেখে তানভীরও খানিকটা বিস্মিত হলো। সে বিস্মিত গলায় মাকে বলল

– মা তুমি এই সময় বাসায় কেন? শরীর খারাপ?

– তেমন কোনো কারণ নেই। আলো অসুস্থ আলোকে দেখতে গেছিলাম। আলোকে দেখা শেষে সরাসরি বাসায় চলে আসলাম।

আলোর কথা বলতেই তানভীরের বুকে কম্পন দিল। মায়ের চোখের দিকে নিজের অশ্রুসিক্ত চোখটা রেখে ভাঙ্গা গলায় বলল

– আলোর কী অবস্থা এখন? আর আলোকে কী দেখতে যেতে পারব এখন৷ মা সত্যিই বিশ্বাস করো আলোকে আমার কাছে মিথ্যাবাদী খুনী মনে হয়নি। শুধু শুধু আলো কষ্ট পাচ্ছে ঐ অন্ধকার রুমে। ওর জীবনের আলোটা নিভে যাবে মা কিছু উপায় না বের করলে।

– তোমরা বাচ্চারা সবসময় অস্থির হয়ে একেকটা কাজ করো বলেই জীবনে অনেক ভুল করে বসো। আবেগ দিয়ে সবসময় সব কাজ হয় না। একটু বিবেক একটু ধৈর্য রাখা প্রয়োজন। আবেগী হলে জীবনে কষ্ট পাওয়া ছাড়া আর কিছুই পাবে না। আলোর ব্যবস্থা করে এসেছি৷ সব কিছু প্রমাণ জোগার করা হয়েছে। এখন বাকিটা আদালত সিদ্ধান্ত নিবে। সেদিন যদি আলোকে পুলিশে না দিতাম তাহলে এ মিথ্যা জালে আলোও ফেঁসে যেত সে সাথে আমরাও। এখন যা হবে ভালো হবে। সময় দরকার।

মায়ের কথা শুনে তানভীরের মুখটা একটু প্রশস্ত হলো। আলোর জীবনে আবার সব ঠিক হতে চলল। শান্তি লাগছে তার। কেন জানি না আলো মেয়েটাকে সে চরম ভাবে এ কয়দিনে অনুভব করেছে। হয়তো একেই বলে ভালোবাসা।

“ভালোবাসতে যুগ যুগান্তের পরিচয়ের দরকার পড়ে না। মাঝে মাঝে খনিকের দেখাতেও ভালোবাসার মাত্রা প্রখর হয়ে যায়।”

তানভীর মৃদু গলায় বলল

– সবকিছু যেন ভালোভাবে শেষ হয়।

বলেই নিজের রুমের দিকে এগুতে লাগল। জাহানারা সুফিয়া তানভীরকে পেছন ডেকে বলল

– আরেকটা সুসংবাদ আছে।

তানভীর পেছন ফেরে মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল

– কী সুসংবাদ?

– তোমার বড় ভাই সানী কল দিয়েছিল।কিছুদিনের মধ্যে সে বাড়ি আসবে। হয়তো তার ভেতরে জমে থাকা সব কষ্ট দূর হয়ে গেছে৷ যেহেতু সে আসবে তাই তার পছন্দের সব বিষয়গুলো বাড়িতে এনে রাখো। ওর রুমটাও পরিপাটি করে রাখো। ঠিক আছে।

সানী আসছে শুনে তানভীরের মনটা আরও বেশি আনন্দিত হয়ে গেল। সানীর সাথে দেখা নেই সেই কত বছর যাবত।একসাথে দুটো ভালো খবর তার মনটাকে স্বস্তি দিল।

অপরদিকে আলোর অবস্থার উন্নতি ঘটল।রিমান্ড স্থগিত করা হলো। সে সাথে আলোর বিষয়টা আদালত সমস্ত প্রামাণ দেখার পর পুনরায় তদন্ত করতে বলা হয়েছে। একই সাথে নীলার মামাকে গ্রেফতার করে রিমান্ডে নেওয়ার রায় দেওয়া হয়েছে।

নীলার মামাকে গ্রেফতার করা হলো রিমান্ডেও নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করার পর সমস্ত কিছু স্বীকার করেছে।নীলার মা, বাবা বিষয়টা জানার পর ভেঙ্গে পড়েছে। নীলার জীবনের পরিণতি এমন হবে তারা যেন এটা মানতেই পারছে না। তবে পরবর্তীতে নীলাকে কারা ধর্ষণ করেছে সে বিষয়টা এখনও ধোঁয়াশা আর আলোর মাকে কারা খুন করেছে সেটাও এখনও জানা সম্ভব হয়নি। নীলা আর আলোর মায়ের খুনের সময় আলো তানভীরের বাসায় ছিল সেটার প্রমাণ পেশ করার পর আলোকে দুটো খুনের থেকে পরিত্রাণ দেওয়া হয়েছে।

অপরদিকে আলোর স্বামী আলোকে মাত্র বারো বছর বয়সে বিয়ে করেছে অর্থাৎ সেটা বাল্য বিবাহ গন্য হওয়ায় সে বিয়েকে বিয়ে বলে বিবেচনা করা হয়নি। দিনের পর দিন একটা কিশোরী মেয়েকে সে লোকটা ধর্ষণ করেছে। আর আলো নিজেকে বাঁচাতে হত্যার মতো জঘন্য কাজটা করতে বাধ্য হয়েছে।

মামলাটা আদালতে দীর্ঘ চারমাস চলার পর এসব প্রমাণিত হয়। আর সে সাথে আলোর মায়ের খুনী এবং নীলার খুনীকে বের করার নির্দেশ দেওয়া হয়। আর আলোকে সব পরিস্থিতি বিবেচনা করে মুক্তি দেওয়া হয়। দীর্ঘ চার মাস কঠোর লড়াইয়ের পর আজকে আলোর মুক্তি। আজকে আলো অন্ধকার জেল থেকে বের হয়ে আলোর মুখ দেখবে। জীবনের এক চিলতে আলোর খুঁজ হয়তো সে পেয়ে যাবে এবার।

আলোর জীবনের এ আলোর রেখাটা দেখা সম্ভব হয়েছে এডভোকেট সাহেরা খান,জাহানারা সুফিয়া আর তানভীরের জন্য। অন্ধকার কারাগার থেকে বের হয়ে আলো প্রথমেই জাহানারা সুফিয়ার কাছে এসে কেঁদে দিল। জাহানারা সুফিয়া আলোকে বুকে জড়িয়ে নিল। নিজের মৃত মেয়েকে যেন সে আবার ফিরে পেয়েছে। আর তানভীর পাশে দাঁড়িয়ে মায়ের আর আলোর ভালোবাসার মুহুর্ত গুলো অবলোকন করছিল। আলো এবার তানভীরের দিকে তাকিয়ে তার চোখে পুনরায় আটকে গেল। সত্যিই আলো সেদিন তানভীরের চোখ চিনতে ভুল করে নি। এ নিষ্পাপ চোখের চাহনিতে আলো ডুবে গেল। আর তানভীর সে তো আলোর চাহনিতে নিজেকে যেন বিলিয়ে দিল।জাহানারা সুফিয়া আলোকে হালকা ধাক্কা দিয়ে বলল

-কী ব্যপার চুপ কেন?

আলো তানভীরের চোখ থেকে চোখটা সরিয়ে নিয়ে বলল

– না কিছু না আন্টি।

জাহানারা সুফিয়া পাশে দাঁড়ানো সাহেরা খানকে ইশারা দিয়ে বলল

– তোমার জন্য দীর্ঘ চার মাস উনি পরিশ্রম করেছেন। উনাকে কিছু বলো।

আলো সাহেরা খানের পাশে গিয়ে মৃদু গলায় বলল

– এ ঋণ শোধ করার ক্ষমতা আমার নেই। আমাকে ভালোবেসে এটুকু সাহায্য করার জন্য ধন্যবাদ।

সাহেরা খান আলোর কথা শুনে হালকা হেসে বলল

– আমার এতে কোনো ক্রেডিট নেই। সব ক্রেডিট মিসেস জাহানারা সুফিয়া মেডাম আর তানভীরের। তারা তোমার পাশে ছিল। হয়তো তাদের সাথে রক্তের সম্পর্ক নেই তোমার তবে যে সম্পর্ক তৈরী হয়েছে সেটা আত্মার সম্পর্ক। তাদেরকে সম্মান করো কেমন। আবার দেখা হবে। ভালে থেকো।

বলেই এডভোকেট সাহেরা খান চলে গেলেন। তানভীর আর জাহানারা সুফিয়া আলোকে নিয়ে বাসায় আসলো।

আলো বাসায় প্রবেশ করতেই খানিকটা বিচলিত হলো। কারণ

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে