#অন্তর্দহন_প্রণয়
#সুরাইয়া_সাত্তার_ঊর্মি
#পর্ব-৯
জয়নব চোখ খুলে নিজেকে আবারো আগের ঘরটিতে আবিস্কার করলো। বিড়বিড় করে বলল,
” এইটা সেই প্রিন্সের বাড়ি না?হ্যাঁ তাইতো।”
জয়নব বিছানা থেকে নেমে পড়লো। ঘাবড়ে যাওয়া কন্ঠে হাত দিয়ে দরজার কড়া নাড়তে লাগলো,
” দরজা খুলুন কে আছেন? হেল্প?”
বাহির থেকে কারো পায়ের শব্দ হতেই জয়নব থেমে গেলো কিছুক্ষণের জন্য। তারপর আবারো আওয়াজ করতে শুরু করলো। দরজার কড়া ঘাত বৃদ্ধি হতে দেখে দরজার বাহিরে দাঁড়িয়ে থাকা কুয়াশা দরজা খুলে দিলো,
” জয়নব এভাবে চেঁচাচ্ছিস কেন?”
কুয়াশাকে দেখে তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলো জয়নব। চোখে মুখে ঘৃণা স্পষ্ট। মুখ কুচকে অন্য দিকে তাকিয়ে রূঢ় কন্ঠে বলল,
” আমরা কাছে কি চাই তোদের? কেন এভাবে খেলছিস তোরা? আমার বাবা-মা, বোন-ভাই… এরা কেন সাফার করছে এসব কিছুতে?”
জয়নবের চোখে মুখে এবার প্রবল কৌতুহল। হয়তো সত্য জানার আশায়? কুয়াশা জয়নবের চোখে মুখে তাকিয়ে তাচ্ছিল্য মার্কা হাসি দিয়ে বলল,
” তুই সাফার করছিস? তুই?? না হেসে পারলাম না। ”
জয়নব অভিব্যক্তিহীন ভাবে তাকিয়ে রইলো। কুয়াশা জয়নবকে উদ্দেশ্য করে বলল,
” তুই যেটাকে সাফার বলছিস না? ওটা আমাদের বেলা কিছুই না… আমরা যা ভোগ করছি.. আমরা যতটুকু সহ্য করেছি? তার বিন্দু মাত্র তুই করিসনি!”
জয়নব অবাক দৃষ্টিতে চাইলো। শক্ত গলায় বলল,
” বলতে কি চাইছিস তুই?”
কুয়াশা হাসলো। বলল,
” যাকে তুই গুলি মেরে জমের বাড়ি পাঠালি না? সে আদর উরফ প্রিন্স… না থাকলে তোকেও মেরে কেঁটে কবে ভাসিয়ে দিতাম আমরা জানিস?”
জয়নব চমকে উঠলো। নিজের বান্ধবীর মুখে জয়নবকে মেরে ফেলার কথা শোনে দুই কানকে বিশ্বাস করাতে পারছে না। এই কি সেই তার বান্ধবী। যে নাকি মরতে পর্যন্ত রাজি ছিলো জয়নবের জন্য! জয়নবকে চোখে মুখে বিস্ময়কর ভাব দেখে কুয়াশা আবারো হেসে ফেললো। তারপর আবার বলতে শুরু করলো,
” জানিস? আমাদের একটা বড় পরিবার ছিলো। যেখানে দাদু-দিদা, চাচা-চাচী, ভাই-বোন সবাই ছিলো। ভালোবাসায় ভরপুর ছিল আমাদের পরিবার। আমার বাবা আর আদর ভাইয়ার বাবা ছিলেন আর্মি। বছর ঘুরতেই যখন তারা বাড়ি ফিরতো? হৈ-হুল্লোড়েে মেতে উঠতো সবাই। কিন্তু একদিন আমাদের এই খুশিতে গ্রহন লাগাতে চলে এলো তোর বাবা।”
জয়নব অবাকের উর্ধে। সঙ্গে সঙ্গে বলল,
” আমার বাবা…!”
” হ্যাঁ তোর বাবা। তোর পালক বাবা নয়.. অরিজিনাল বাবা… রাহুল খন্দকার। ”
জয়নবের বুকের ভিতর কেমন যেন একটা করে উঠলো। বিড়বিড় করে বলল,
” আমার বাবা… রাহুল খন্দকার! ”
কুয়াশা জয়নবের দিকে তাকিয়ে আবার বলল,
” হ্যাঁ তোর বাবা… একজন দেশদ্রোহী। অথচ দেখ আজ তিনি এই ভিনদেশের মাটিতে উনাকে পূজা করা হয়… নোবেল মানুষদের মাঝে একজন মানা হয়। অথচ এই লোকটার জন্য আজ আমার বাবা- মা, আদর ভাইয়ের বাবা-মা, কেউ নেই পৃথিবীতে…!”
এ পর্যায় ধরে এলো কুয়াশার কন্ঠ। জয়নব নিজের বাবা… নিজের পরিবার সম্পর্কে এত দিন অবগত ছিলো না। যেই নিজের পরিবার আর তার বাবার কথা শুনলো? মনের কোনে এক চিলতে আশা জেগে উঠলো। তার বাবা… তারো বাবা আছে?? জয়নব নিজের ভাবনা চিন্তার মাঝেই আনমনে নিজের মনের ইচ্ছে প্রকাশ করে বসলো,
” আমি… আমি কি আমার বাবাকে দেখতে পারবো?”
কুয়াশা এবার চেঁচিয়ে বলল,
” বাহ্… বাহ্ ভাই বাহ্…! যে পিতার বছরের পর বছর খবর ছিলো না.. তাকে দেখার জন্য মরিয়া হয়ে উঠছিস তুই? আর যে তোকে এতটা বছর আগলে রাখলো? ভালোবাসলো? অথচ একটা বার তার কথা জিজ্ঞেস করলি না পর্যন্ত? ”
জয়নব কিছুই বুঝতে পারলো না যেন। তাকিয়ে রইলো শুধু। কিছুক্ষণ পর রা বের হলো,
” কি বলতে চাইছিস তুই!”
” আদর ভাইয়া..! কাল থেকে হুঁশ ফিরেনি তার। ২৪ ঘন্টার মাঝে জ্ঞান না ফিরলে… আমরা তাকে হয়তো হারিয়ে ফেলবো!”
জয়নবের চোখ জোড়াতে হঠাৎ ভর করলো নোনা জল। গড়িয়ে পড়লো মাটিতে,
” উনি… উনি কোথায়!”
কুয়াশা ছোট শ্বাস ছাড়লো। বলল,
” আয় আমার সাথে!”
জয়নবের নিজেকে অপরাধী মনে করতে লাগলো। সত্যি তো। ও কতটা স্বার্থপর হয়ে গেছে। এ সব ভাবতে ভাবতে চলতে লাগলো কুয়াশার পিছনে। কুয়াশা একটা বড় রুমের সামনে এসে দাঁড়ালো। দরজা ঠেলে ভিতরে চলে এলো। জয়নব গুটি গুটি পায়ে পিছনে ঢুকতেই বুকের ভিতর ধক করে উঠলো। আদরের নিথর দেহো পড়ে আছে বিছানায়। ফ্যাকাসে মুখ, শুকিয়ে যাওয়া ঠোঁট আর চলছে ড্রীপ দেখে জয়নবের বুক হু হু করে উঠলো।ইশ কি হাল করেছে মানুষটার জয়নব। তখনি কুয়াশার ভেজা গলা শোনা গেলো,
” জানিস জান… আদর ভাইয়া আমাদের পরিবারের জান ছিলো। উনি না থাকলে আজ আমি, সাজিয়াপি, ইউয়ান এখনো কোনো রাস্তার ধারে বাস করতে হতো। খেতে হতো ডাস্টবিনে ফেলা যাওয়া খাবার গুলো। জানিস ভাইয়া কখনো কারো কাছ হাত পাততে শিখেনি। আমাদেরও শিখান নি…এর থেকে ভালো মনে হতো তার কাছে ডাস্টবিনে ফেলে যাওয়া আধা খাওয়া খাবার গুলো। আমরা রোজ অপেক্ষা করতাম জানিস? কখন কোনো ভালো খাবার যদি ফেলে যেতো? একদিন এসব সইতে না পেরে আদর ভাইয়া আমাদের জন্য কাজ করতে শুরু করে দিলেন। দিন রাত খেটে আমাদের জন্য খাবার আনতো, কাপড় আনতো। ভাইয়ার কত সেক্রিফাইস করেছে আমাদের জন্য জানিস? যে ছেলে বাড়িতে এক বেলা মাংস রান্না না হলে মুখে খাবার তুলতো না… মাছ হলে সেদিন খাবার বন্ধ ছিলো… সে ছেলে কি না খেয়েছে। ”
হু হু করে কেঁদে উঠলো কুয়াশা। শব্দহীন কান্নার শ্রোত জয়নবের চোখেও। জয়নব আদরের পাশে গিয়ে বসলো। হাতে হাত ছুঁলো। আহ্ কত দিন পর এই লোকটির স্পর্শ পেয়েছে। জয়নব আদরের কঁপালে হাত বুলালো। এই ছেলেটি নাকি এত কষ্ট করেছে জীবন? কই এই ছেলের নিস্প্রভ চাহনি দেখে কেউ কখনো বুঝবে না, তার অতীত টা কেমন ছিলো।সত্যি তো।আদরের ব্যক্তিত্বটাই বুঝি ছিলো অন্য রকম? আদরের সাথে থাকা কালীন কখনো জয়নবকে এঁকা ছাড়েনি আদর। উল্টো ওকে সাহায্য করেছে প্রতিটা প্রতিশোধ নিবার জন্য।জয়নব আদরের হাত শক্ত করে চেপে ধরে বসে রইলো। কুয়াশা কাঁদতে কাঁদতে বড্ড ক্ষিপ্ত হয়ে বলল,
” এসব কিছু তোর বাবার জন্য জান। এক মাত্র তোর বাবার জন্য!”
জয়নব আর এসব সহ্য হলো না। কখন থেকে তার বাবা এঁটা করেছে, তার বাবা ওটা করেছে শুনতে শুনতে জয়নব ক্লান্ত। সে তো তার বাবাকে চেনে না, জানে না। ছোট থেকে তো সাইফকেই বাবা বলে জানতো। হঠাৎ করেই উদয় হওয়া বাবা আর তার নামে শোনা কথা গুলো হজম করতে না পেরে খানিকটা জোরেই বলল,
” কি করেছে আমার বাবা?”
কুয়াশা বলল,
” কি করেনি সেটা বল? তোর বাবার জন্য আমাদের পরিবারকে সমাজ ছাড়া হতে হয়েছিলো। এক মাত্র তোর বাবার জন্য আমাদের বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়। এক মাত্র তোর বাবার জন্য আমার বাবা আর চাচ্চুকে শহীদের দরজা দেয়ার বদলে জঙ্গিবাদ বলা হয়।”
জয়নব এবার বিস্ময়ে আকাশ চুড়ায়। এসব কি শুনছে সে। কুয়াশা বলতে থাকলো,
” দিনটি ছিল রমজান মাসের শেষ রোজা। বাহিরে প্রবল ঝড়। পরিবারের সবাই তখন বাসায়। আজান দিবে ঠিক সেই সময়…. হঠাৎ আমাদের পুরো বাড়ি পুলিশে ঘিরে ফেলে। আজানের মুহূর্তে মুখে পানি টুকু নিতে দেয়নি তারা। আমাদের সবাইকে জেলে নিয়ে যাওয়া হয়। তখন আইন ছিলো খুব কঠিন.. তারউপর দেশদ্রোহীর তমকা। পরে আমরা জানতে পারি… এক মিশনে বাবা আর চাচ্চু তোর বাবার অনৈতিক কাজের খবর পেয়েছে তারা। আমেরিকার মতো জায়গায় ১১ টা ব্ল্যাক হোলের মাঝে লুকিয়ে আছে তার রহস্য। এসব কিছু বাবা আর চাচ্চু প্রুফ সহ জোগাড় করেছিলো। লাস্ট পর্যন্ত আইনের কাছে জাবার আগেই তাদের দেশদ্রোহীর তকমাটা লাগিয়ে দিলেন। তবে সেদিন কোনো প্রুভ না থাকায় ছেড়ে দিলেন আমাদের। তবে সেই কাল রাত্রী যেন আরো কালো হতে চলছিলো। কে বা কারা আগুন ধরিয়ে দিলে আমাদের বাসায়…. সেই আগুলো আমরা চারজন বের হয়ে তো এলাম! আর সবাই সেখানেই জ্বলে পুরে ছাই হয়ে গেলো!”
কুয়াশার চোখে এবার যেন ভেষে উঠলো সেই রাতটি। আগুন জ্বলছে, তাদের ঘর জ্বলছে, তার বাবা-মা ছোট ভাইটি জ্বলছে। চিৎকার ভেসে আসচ্ছে। কুয়াশা হাটু গেড়ে মাটিতে বসে পড়লো। দু চোখে মুখে হাত চেঁপে ধরলো। বাবা-মা ছোট ভাই আকাশের কথা এখনো মনে পরে কুয়াশার। জয়নব কুয়াশার পাশে এসে বসলো। ওর কাঁধে হাত দিতেই এক ঝাটকায় সরিয়ে দিলো কুয়াশা। আঙ্গুল তুলে বলল,
” দরদ দেখাতে আসবি না। বাপে আমাদের কষ্ট দেয় আর মেয়ে দয়া দেখাতে আসে।”
জয়নব চুপ করে রইলো। ওর কি দোষ এসবে?তখনি কুয়াশা বলল,
” তুই কি ভাবছিস আমি জানি… এ-টাইতো? তুই কেন? কেন তোকেই এসবে টানা হলো?”
জয়নব সত্যি জানতে চায়। সে বড় বড় চোখ করে চেয়ে বলল,
” হ্যাঁ আমি জানতে চাই সব… সব কিছু!”
কুয়াশা কান্নার মাঝেই রহস্যদায়ক হাসলো,
” সব রাক্ষসের আত্মা থাকে কোনো এক পাখির ভিতর।”
জয়নব হা হয়ে গেলো। রাক্ষস, আত্মা, পাখি? এসবের মানে টা কি? কুয়াশা চট করে উঠে দাঁড়ালো। পিছনে ফিরে বড় বড় পা ফেলে ছুটে চলে গেলো সে। জয়নব তার মাথার মাঝে চলা হাজার টা প্রশ্ন নিয়ে আবারো চলে এলো আদরের কাছে। আদরের বুকে হালকা করে মাথা রেখে ফোপাঁতে ফোঁপাতে কখন যে ঘুমিয়ে গেলো… জয়নব জানেই না….
এদিকে আদর চোখ খুললো। বুকের মাঝে জয়নবকে দেখে থম মেরে রইলো। পরক্ষণেই জয়নব তাকে গুলি করেছে ভাবতেই চোখ মুখ শক্ত হয়ে গেলো। কি করবে এবার আদর? ভুলে যাবে সব? নাকি বদলা নিবে জয়নবের কাছ থেকে? কি হবে জয়নবের? কি হবে তার বাবা রাহুলের? আর কিভাবে করবে জয়নবকে ব্যবহার তার বাবার বিরুদ্ধে???
চলবে….