#অন্তর্দহন_প্রণয়
#দ্বিতীয়_খন্ড
২।
সুরাইয়া সাত্তার ঊর্মি
❌(কপি করা নিষেধ) ❌
দিন থমথমে… গুমাটে ভাব। যেন যে কোনো সময়.. ঝাপিয়ে নামবে আকাশের বুক চিঁড়ে বেদনা অশ্রু। ঠিক যেন কিশোরী মেয়ের মুখ। আকাশ পানে চেয়ে মেহজাব ভাবলো…
“অম্বর টা আজ সত্যি হয়তো অভিমান করে আছে! কার উপর হতে পারে? নিশ্চয় কোনো মনের কেউ..!”
মেহজাবে ভাবনার ফোঁড়ন পড়লো। আবির গাড়ি ব্রেক কসলো একটি দো তালা বাড়ির সামনে। বলল,
” স্যার মাহাদ খানের বাসায় এসে পড়েছি আমরা!”
মেহজাব মাথা নাড়লো। দাম্ভিক মুখখানায় ভেসে উঠলো গম্ভীরতা৷ তারা বেড়িয়ে এলো গাড়ি থেকে। এবং ভিতরে চলল।
” মাহাদকে আমি নিজের প্রাণের চেয়ে বেশি ঘৃণা করি!”
নড়েচড়ে বসলো আবির,
” কেনো ম্যাম?”
নুড়ির চোখ জোড়া জল টলমল,
” একটা পশু লোকটা!”
” কি বলছেন?”
“স্যতি বলছি। ভালোবেসে বিয়ে করেছিলাম আমরা.. আর -ও? ভালো হয়েছে ও মরে গেছে!”
আবির বিস্ময়ে বুঁদ হয়ে তাকালো মেহজাবের দিকে। মেহজাব শীতল দৃষ্টি মেলে আছে। যেন কিছু একটা বোঝার চেষ্টা করছে। এবার ঠোঁট নড়লো তার..
” এমন ধারণার কারণটা কি মিসেস?”
নুড়ি এবার দীর্ঘ শ্বাস ছাড়লো,
” ওর অনেক মেয়ের সাথে সম্পর্ক ছিলো। কতটা নিকৃষ্ট ছিলো সে আমি জানি। আমাকে যখন ইচ্ছে তখন ফিজিক্যাল টর্চার করতো নরপশুটা!”
বলেই ফুপিয়ে উঠলো নুড়ি। আবির স্তম্ভীত। মেহজাব ভাবলেশহীন। বলল,
” আপনি বলতে চাইছেন? আপনার বর আপনাকে মারধর করতো!”
নুড়ি চুপ করে গেলো। মাথা নত করে বসে রইলো। লক্ষ করলো দুজনেই চোখে মুখে ফুটে উঠেছে লজ্জার ভাব।
” মেম সরি ফোর দ্যাট ইনভেস্টিগেশনের জন্য আমাদের জানা প্রয়োজন।”
নুড়ি থেমে থেমে বলল,
“সেক্সচুয়াল ব্যাপারে স্যাডিস্ট গোছের ছিলে মাহাদ!”
নিস্তব্ধতা ছড়িয়ে পড়লো আবার। মুখে দু হাত চাঁপা দিয়ে হু হু করে কাঁদতে লাগলো। আবির আর মেহজাব চুপ করে রইলো। কোনো কিছুই বলল না আর।
আধঘন্টা পর…
অফিস রুমের রোলিং চেয়ারে বসে পেপার ওয়েট ঘুড়িয়ে চলছে মেহজাব। আরেক হাতে দামি ব্রেন্ডের সিগারেট। তার সামনেই বসে আছে আবির। অনেকক্ষণ চুপ থেকে আবির এবার ঠোঁট নাড়লো।
” বিগতো খুন হওয়া মানুষ গুলোর স্বভাব চরিত্রের সাথে অনেকটা মিল স্যার।লোকগুলো স্যাডিস্ট। অন্যকে কষ্ট দিয়ে আনন্দ পায়।”
সিগারেটটা আবারো ঠোঁটে ছুয়ে ধোঁয়া ছাড়লো,
” দুটো লিংক আছে এদের, এক হসপিটাল… দুই
স্যাডিজম। তার মানে এই দুটো কানেকশনের জন্যই এদের কোনো মরতে হয়েছে না তো?”
” কিন্তু স্যার কথা হচ্ছে, এদের খুনটা হচ্ছে কিভাবে তাই তো ধরতে পারা যাচ্ছে না!”
“ফরেনসিক রিপোর্ট কি বলে?”
” এইটাই যে নরমাল মৃত্যু। ”
” নরমাল হলে এমন বেঁধে টেধে কেন ফেলবে জঙ্গলে?”
” কথা তো সেটাই!”
মেহজাব জোরালো শ্বাস ছাড়লো। তারপর আবার বলল,
” মেডিকেল স্টুডেন্টদের লিষ্ট রেডি হয়েছে? ”
” জি স্যার। জয়নব আর রুফাইদার বান্ধবী বলতে তেমন কাউকে পাওয়া যায় নি। তবে চিনে অনেকেই। তার মাঝে আনিকা নামের একটি মেয়ে আছে জয়নবের ব্যাচের। ”
” তার কি বক্তব্য? ”
” বিশেষ কিছু না। তবে একটা কথা মনে হচ্ছে কাজে লাগতে পারে!”
“কি?”
” ডা. দেবাশীষ নামের একজন ছিলেন, তার মৃত্যু হয় খুব রহস্য ময় ভাবে। উনি আবার ছিলেন ওই কলেজের মেইন কালপ্রিট। অবৈধ ব্যবসার সাথে জড়িত। জয়নব মেয়েটি সে সময় রূপক নামের একজন সি আই ডিকে হেল্প করে ছিলো। ধরা পরার কদিন পরেই সে রহস্য ময় ভাবে মারা যায়। মানে হোটেল রুমে সুইসাইড করে।”
” স্ট্রেইঞ্জ।”
“শুধু তাই নয় একজন স্টুডেন্ট ও ভুত ভুত বলে ঝাপিয়ে পড়েছিলো শপিং মল থেকে!”
” এদের মাঝে কানেকশন আছে কি?”
” জ্বি স্যার দুটোর মাঝেই জয়নবের উপস্থিত ছিলো। তবে দুটোই আত্মহত্য বলা হয় রিপোর্টে!”
দু আঙুল কঁপালে ছুঁয়ে কিছু ভাবলো এবার মেহজাব। তারপর বলল,
” কেইস টা সত্যি কমপ্লিকেইটেড। আর ডা. সাহির, ডা. অভিনব, আর ডা. আদরের কোনো খবর?”
” এখন পর্যন্ত না স্যার। তবে ডা. আদর মেডিক্যাল কলেজ বন্ধ হবার বছর খানেক আগেই হারিয়ে গেছিলেন। কারো কারো মতে উনি হয়তো পৃথিবীতেই নেই। আবার কেউ কেউ ডা. আদর নামে কাউকে চিনেই না। ইনফেক্ট আমি তলিয়ে দেখেছি ব্যাপারটা, বাংলাদেশের কোথাও এই নামের কেউ যেন জম্মই নেয় নি!”
” ডা. আদর এভাবে উদাও হবার কি কারণ থাকতে পারে? ”
বিড় বিড় করে বলল মেহজাব। তখনি আবিরের যেন কিছু মনে পড়লো এমন ভঙ্গিমা করে বলল,
” আর একটি কথা স্যার। আনিকার কথা অনুযায়ী, যেদিন ডা. আদর গায়েব হয়, সেদিনের পর থেকে জয়নবকেও কোথাও পাওয়া যায় নি।”
মেহজাবের চোখে মুখে একটা চাপা রাগ আর হতাশা দেখা দিলো। মনে মনে বলল,
” কেন আমি সময় মতো সব জানতে পেলাম না? ডা. আদর কি তাহলে জয়নবকে গুম করে দিয়েছিলো?”
————-
আন্ধকার ঘরের মধ্য আলিশান বিছানার উপর বসে হাটুতে মুখ গুঁজে কেঁদে যাচ্ছে জয়নব। ঘরময় কান্নার শব্দ গুঞ্জন হচ্ছে। ঠিক সেই সময় ক্লিক করে ঘরের দরজা খুলে গেলো। আওয়াজটা শুনেই কেঁপে উঠলো জয়নবের আত্মা। জয়নব ভয়ে ভয় মাথা তুললো। চোখের সামনে ভেসে উঠলো ছায়া মুর্তি কারো। লোকটির মাদকাসক্তের মতো শরীরের ঘ্রাণ ঘরের চারিদিকে ফুলের মতো সুভাষ ছাড়াচ্ছে। জয়নবের কাছে এই ঘ্রাণ, এই সুভাষ পরিচিত। ছায়া মুর্তিটি এবার ঘরে লাইট ওন করলো। সূর্যের আলোর মতো প্রতিফলিত হলো ঘরের আলো। ছায়া মুর্তির মুখটি এবার সুস্পষ্ট। জয়নব ভয়ে চাদর খামচে ধরলো। সুদর্শন যুবক তার সামনে দাম্ভিকপূর্ণ মুখখানায় দাঁড়িয়ে আছে। গ্রীবাদেশে আজো তিল দুটি ঝলমলে করছে। জয়নব এবার ব্যক্তিটির চোখের দিকে তাকালো। চোখের মনি এবার ফ্যাকাসে নয় বরং কুচকুচে কালো। হয়তো আবারো লেন্স পরেছে লোকটি। এবার লোকটি ঠান্ডা কন্ঠ বলল,
” জান…! আর কত পালাবার চেষ্টা করবে?”
জয়নব চুপটি মেরে বসে চোখের জল ফেলতে লাগলো। আদর এবার এগিয়ে এলো। বাম হাতে শক্ত করে মুখটি তুলে ধরলো তার মুখ বরাবর। জয়নব ভয়ে ব্যথায় কুঁকড়ে যাচ্ছে। আদর আবার বলল,
“, এই খান থেকে আর পালাতে পারবে না তুমি জান। এইটা বাংলাদেশ নয়। যে যখন ইচ্ছে পালিয়ে গেলে আর খুন করে চলে এলে!”
জয়নবের চোখ ভয়ের সাথে এবার ঘৃণা দেখা গেলো। আবারো সে বন্দিনী হয়ে গেলো। তীর্যক হেসে বলল,
” আমাকে কোনো খাঁচার মাঝে বন্দি করেও লাভ হবে না আপনার। আমি বের হবোই!”
কথাটুকু শেষ হবার আগেই সাপটে এক থাপর পড়লো জয়নবের গালে৷ জয়নব বিছানার মাঝেই ছিটকে পড়লো। আর তখনি আদর গলা চেপে ধরলো জয়নবের বিছনার উপর। জয়নবের মনে হল, আজ সে এখানেই মরে যাবে। সে জানে ডা. আদরের রাগ কতটুকু খারাপ। সে জয়নবকে অনেক ভালোবাসে। এতটাই যে… বছর তিনেক আগেই তার রাজ্যে বন্দিনী করে রেখে দিয়েছিলো তাকে। কিন্তু গত ছ ‘ মাস আগেই আদরের বিশ্বাস অর্জন করে ফিরে এসেছিলো বাংলাদেশ। পর পর চারটে খুন করে লুকিয়ে দেশ ছাড়তে চেয়ে ছিলো জয়নব। কিন্তু… আদর… আদর নামের ভয়ঙ্কর লোকটির হাত থেকে রেহাই সে পায়নি। আদর জানতো, তার নেক্সট টার্গেট তার পিতা ডা,. সাহির। তাই হয়তো এত টাইট সিকিউরিটির মাঝে আছে লোকটি। নয় তো এবার তার পালাই ছিলো। জয়নবের শ্বা নিতে এবার অনেক কষ্ট হচ্ছে। ধীরে ধীরে হাত- পা ছোড়াছুড়ি বন্ধ করে দিচ্ছে। ঠিক সেই সময় আদর ছেড়ে দিলো তাকে। দাঁতে দাঁত চেপে, আঙ্গুল তুলে শাসিয়ে বলল,
” আমার থেকে পালাতে পারবে না জান। আমি তোমাকে ছাড়বো না কখনো। তুমি পাতালে লুকিয়ে থাকলেও। আমার খুঁজে বের করতে সময় লাগবে না। আমাকে আর ধোঁকা দেয়ার চেষ্টা করো না। এত বছর ধরে আমি যা করিনি তা করতে অতন্ত্য বাঁধ্য করো না!”
জয়নব এবার ভয় পেয়ে গেলো৷ আবার হাত পা গুটিয়ে ফুপিয়ে উঠলো। বিড়বিড় করে বলল,
” আমি একদিন তোমাকেও মেরে ফেলবো!”
আদর হাসলো এবার। যেন ছোট বাচ্চা কোনো মজার কথা বলছে। জয়নবের মাথা পরম যত্নে হাত বুলিয়ে বেড়িয়ে গেলো আদর। সাথে সাথে দরজাটা বন্ধ হয়ে গেলো ক্লিক শব্দ করে। জয়নব রাগে দুঃখ দরজার উপর ফুলদানি ছুঁড়ে মারলো। কাঁচের দরজাটি ভাঙ্গার বদলে ঝনঝন শব্দ করে ফুলদানিটা টুকরো টুকরো হয়ে গেলো। জয়নব আবারো ফঁপাতে লাগলো। এই নরক থেকে সে কবে রক্ষা পাবে? কবে? কবে?..
চলবে,