#অন্তর্দহন_প্রণয়
#লিখনীতে_সুরাইয়া সাত্তার ঊর্মি
১০।
সন্ধ্যা ৭ টা বেজে কুঁড়ি মিনিট। লাল, নীল, হলুদ, সবুজ, আরো না রঙ্গে রাঙ্গানো হয়েছে কলেজ। কলেজের ভিতরেই অডিটোরিয়াম রুমে বিশাল আয়েজন করা হয়েছে। সারি সারি স্টুডেন্ট বসে আছে তাদের আসনে। সবারই গায়ে লাল-সাদা শাড়ি আর ছেলেদের গায়ে লাল-,সাদা পাঞ্জাবি। একের পর এক পারফরম্যান্স হচ্ছে।দূর থেকে দেখা যাচ্ছে ডা. আদর আর ডা. অভিনবকে। দুই রাজপুত্র সবার সামনে বসে আছেন। কি সুনরদর লাগচ্ছে তাদের। মনে হচ্ছে আধারের মাঝে, ঝিলিক মারা দুটি তারা পদর্পন করেছে অনুষ্ঠানে। তারা যদি পা না ফেলতো অনুষ্ঠান যেন ফিকে লাগতো। বোনের ডায়রি পরে ডা. অভিনবকে আরো বেশি পর্যবেক্ষন করছে ইদানীং জয়নব। এরই মাঝে উপস্থিত হয়েছে শহরের মেয়র জীবন তালুকদার। পরনে ফর্মাল ড্রেসস কোড। বয়সে ৪০/৪৫ এর কাছাকাছি। জীবন তালুকদারের বক্তৃতা শেষেই উপস্থিত হলেন কলেজের প্রিন্সিপাল সাহির আজওয়াদ। তিনি কিছু ঘন্টা আগেই আমেরিকা থেকে ফিরেছেন। জীবন তালুকদার সাহির আজওয়াদকে দেখেই এগিয়ে এসে কুশলাদি বিনয় পর্ব শেষ করে বসে পড়লেন তাদের নির্দিষ্ট আসনে। জয়নবের কাছে সাহির আজওয়াদকে বড্ড চেনা মনে হচ্ছে। বয়স পঞ্চাশের কোঠায়। অভিনব স্যারের মুখখানার মতোই মুখের গঠন। কিন্তু চোখ জোড়া ডা. আদরের মতো। কিন্তু লোকটিকে কোথায় দেখেছে কিছুতেই মনে পরছে না জয়নবের।
“ওই বুইড়া বেটাগো দিকে চাইয়া কি দেখোস?”
কুয়াশার কথা জয়নবের ভাবনা ছেদ পড়ে, সে অবাক হয়ে বলে,,
“উল্টা পাল্টা বকস কেন? আমি তো ওই লোকটারে দেখতাছি। চেনা চেনা লাগতাছে বইলা!”
কুয়াশা জহুরির মত দেখলো একবার জয়নবকে। পরমুহূর্তেই হাতে তালি বাজাবার মতো করে বলল,
“বাহ্ বইন বাহ্ তুই আমার থেকে ২০০ কদম এগিয়ে গেলি!”
জয়নব ভ্রু কুচকে বলল,
“কি কইতাছোস! ”
কুয়াশা মুখ ভঙ্গি গম্ভীর করে ফেললো। জয়নবের দিক ঝুঁকতেই জয়নবও হালকা পিছনের দিক হেলে পড়লো। কুয়াশা ফিসফিস করে বলল,
“পোলারে পছন্দ হয় না তোমার, খাইশটা ডাকো। এখন বাপের উপর নজর দাড়ি করো। মাইনশে কি কইবো দোস্ত?”
কথাটি প্রথমে ধরতে পাড়লো না জয়নব। পরে বুঝতে পেরে কুয়াশার মাথা গাট্টা মেরে বলল,
“গাধী! আমি কইছি ওই ব্যাটরে পছন্দ করি? এত দুই লাইন বুঝোস কেন?”
“আমি ভাবছি..”
কথার মাঝেই কথা থামিয়ে দিলো জয়নব। দু হাত তুলে মাফ চাওয়ার মতো ভঙ্গিমা করে বলল,
“মাফ কর আম্মা। তুই আর ভাবিস না কিছু!”
কুয়াশার মুখ চুপসে যাওয়া আমের মতো হয়ে গেল।
অনুষ্ঠান বক্তৃতার পর্ব শেষ করে আবার শুরু হলো। কুয়াশা নিজেও ভালো ডান্স পারে। সেও একক ভাবে নাচবে। তার পালা আসতেই এক ছুট। জয়নব হেসে দিলো।
জয়নব হঠাৎ করেই প্রকৃতিক ডাকে ওয়াশরুম যাওয়ার প্রয়োজন পড়তেই বেড়িয়ে পড়লো। ওয়াশরুম এসে তার কাজ সেরে, শাড়ি ঠিক করতে লাগলো। ঠিক সেই মুহূর্তে ভেসে এলো কারো আত্মচিৎকার। জয়নব হন্তদন্ত হয়ে বের হতেই দেখতে পায় আয়ান ভাইয়াকে সেই কালো কাপড় পরিহিত লোকটি ছুঁড়ি মারার চেষ্টা করছে। জয়নব দৌড়ে তাদের মাঝে এসে পড়লো। চিৎকার করে বলল,
“এই কি করছো? মারতে চাইছো কেন?”
আয়ান ভাইয়া ভয়ে আদমরা। কেঁদেই দিয়েছে। লোকটির সাথে পেরে উঠতে পারছে না। জয়নব নিজেই লোকটিকে ধাক্কা দিতে চাইলো। উল্টো কালো পোশাক পরিহিত লোকটি ওকেই ধাক্কা মেরে দিলো। জয়নব শরীরের ব্যালেন্স সামলাতে না পেয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়লো নিচে। তবুও সে থেমে নেই। আবার সামনে এসে দাঁড়িয়ে লোকের মুখের কাপড় খুলে নিতে চাইলো সে। ঠিক তখনি জয়নবের হাত পোঁচ মেরে লোকটি পালিয়ে যায়। জয়নবের মুখ দিয়ে বেড়িয়ে আসে আর্তনাদ।
————-
“আমার জান বাঁচানোর জন্য থ্যাঙ্ক ইউ ছোট আপু!”
আয়ান জয়নবের হাতে ব্যান্ডেজ করে দিতে দিতে বলল কথাটুকু। জয়নব তাচ্ছিল্যের স্বরে বলল,
“আমি আপনাকে আগেই বলেছিলাম ভাইয়া আপনি পাত্তা দেন নি আমার কথার!”
আয়ান গাল ফুলিয়ে শ্বাস ছেড়ে বলল,
“আমাকে কেন কেউ মারতে চাইবে বুঝতে পারছি না!”
“রুফাইদা আপু ও জানতো না তাকে মরতে হবে!”
এক প্রকার চমকে তাকালো আয়ান। রুফাইদা নামটি তার বুকে গিয়ে লাগলো। তোতলানো গলায় বলল,
“রু ফাই দা!”
“হ্যাঁ রুফাইদা, যাকে খুন করা হয়েছিলো নির্মম ভাবে!”
আয়ান বিস্মিত কন্ঠে বলল,
“তুমি তার..”
কথাটুকু কেড়ে নিয়ে জয়নব বলল,
“বোন!”
আয়ান আবেগে আপ্লূত হয়ে কেঁদে ফেললো। জয়নবকে জড়িয়ে ধরে বলল,
“তুমি রূপের বোন আগে বলবা না? জানো ওকে কত মিস করি। ওকে কত ভালোবাসাতাম আমি। কিন্তু ও আমার কথাই শুনলো না। কতবার না করেছি ওকে ওই পথে পা বাড়াতে কিন্তু সে…”
আবারো কথার মাঝে ফোঁড়ন কাঁটলো কারো গগনবিদারী চিৎকার। জয়নব আর আয়ন তাকালো সদর দরজার দিকে। ডা. আদর দাঁড়িয়ে আছে। রক্তিম চোখে ভস্ম করে দিচ্ছে যেন তাদের। বড় বড় পা ফেলে এগিয়ে এলেন উনি। জয়নব ভয়ে সিটিয়ে গেছে। বার বার মন বলছে, “এখন কি হবে?”
ডা. আদরের ভয়ংকর সুন্দর চোখ দুটি মেলে তাকিয়ে আছে জয়নবের দিক। অত্যান্ত ঠান্ডা গলায় বললেন,
“এই জন্যই বুঝি পালিয়ে বেড়াচ্ছো আমার থেকে?”
জয়নব কিছু মূহুর্ত কথা খুঁজে পেলো না। আয়ান তখনি বলে উঠলো,
“স্যার আপনি ভুল ভাবছেন। ও আমার বোনের মতো!”
ডা. আদর এই মুহূর্তে কিছুই যেনো শুন্তে রাজি না। আয়ানকে সেখানে থেকে যেতে বলে, জয়নবের বাহু চেপে ধরে হিসহিসিয়ে বলে,
” আমি কম কিসে মেয়ে? আমাকে কেন ফিরিয়ে দিচ্ছো? কেন ইগনোর করছো?”
জয়নব ব্যথায় রাগে হিতাহিতজ্ঞান শূণ্য হয়ে পড়লো। আদরের চোখে চোখ রেখে বলল,
“আমি আপনাকে পছন্দ করি না। প্লিজনদয়া করে আর বিরক্ত করবেন না।”
কথাটি আদরের বুকে গিয়ে লাগে। জয়নবের হাত ছেঁড়ে দিয়ে এলোমেলো দৃষ্টিতে তাকায়। ম্লান গলায় বলে,
“ঠিক আছে। আমি তোমাকে আর বিরক্ত করবো না!”
আর দাঁড়ায় না আদর যেভাবে এসেছিলো সেভাবেই ফিরে যায়। জয়নব সেখানেই বসে পরে ডুকরে কাঁদতে লাগে।
——–
বিষন্ন আরো একটি রাত কেঁটে যেতে লাগলো। নিশাচর নিশ্চুপ পাখিদের মতো চুপচাপ জয়নব নিজেও। বোনের ডায়রিটি আবারো খুলে বসলো সে।
~
আজ অনেক দিন পর ডা. অভিনব আমার দিকে তাকালেন। ভালোবাসা ছিলো না দৃষ্টিতে কিন্তু কিছু একটা ছিলো যেন আমার মনে ঘায়েল করার জন্য। আমি তার চাহনিতে স্থির হয়ে গেছিলাম। মনে হচ্ছিলো তিনি আমাকে কন্ট্রোল করতে চাইছেন। আমি হারিয়ে যেতে চাইছিলাম তার সেই চাহনিতে। কিন্তু তা বেশিক্ষণ রইলো না। পাশ থেকে একজন মেয়ের কথা শুনে সেদিন আমার স্বপ্ন চুরমার হয়ে গেলো। ডা. অভিনবের নাকি গার্ল ফ্রেন্ড আছে। তাউ তাদেরই ব্যাচমেট। কিন্তু কে? তা কেউ আজো জানতে পারেনি। এইটুকু কথা আমার মনে ঝড় তোলার মতো হয়েছিলো। সেদিন আমি কেঁদে কুঁটে বাসায় চলে যাই। ঠিক সাত দিন পর আবার ফিরে আসি মনের সাথে লড়াই করতে করতে। ঠিক সেই দিনেই ঘটলো ঠিক অদ্ভুত ঘটনা…
চলবে,