অনূসুয়া পর্ব-১১

0
729

#অনূসুয়া
#পর্ব১১
#রাউফুন

রোজ রোজ আলিফের যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ সুসমা ঠিক করলো এই জব টা সে সত্যিই ছেড়ে দেবে৷ ভেবে নিলো নতুন জব এপ্লাই করে তারপর ছাড়বে জবটা।
সুসমা অফিস গিয়ে নিজের কাজ করছিলো। হঠাৎই তার জানালার বাইরে রাস্তায় চোখ গেলো। কালো শার্ট পরিহিত আবছা আবছা একজনকে দেখা যাচ্ছে। চমকপ্রদ হয়ে সুসমা নিজের ডেস্ক থেকে বেরিয়ে জানালা দিয়ে ভালো ভাবে লক্ষ্য করে দেখলো সত্যিই মেরাজ দাঁড়িয়ে আছে। সুসমার ঠোঁটের কোণে হাসি ফুঁটে উঠলো অজান্তেই। সে গিয়ে জানালার কাচ উপরে উঠিয়ে দেখে নিশ্চিত হলো ঐটা আসলেই মেরাজ। মানুষটা কি এই ক-দিনে অনেক শুকিয়ে গেছে? কেমন জীর্ণ শীর্ণ শরীর। এলোমেলো চুল। অসুখ করেছিলো কি? তার কি উচিত ছিলো একবার খোঁজ নেওয়ার? সেদিনের পর মেরাজের ম্যাসেজ আসেনি।

‘মিস সুসমা কাজ বাদে আপনি জানালার বাইরে কি দেখছেন?’

সুসমা ভুলেই গেছিলো তার কড়া বসের কথা। সে পেছনে ফিরে বললো, ‘ আমার জামাই দেখি, দেখবেন?’

আলিফ ভ্রু কুচকে বললো,’হোয়াট? মশকারা করেন আমার সঙ্গে? ডোন্ট ফরগেট হাহ্ আ’ম ইউর বস!’

‘তো আমি কি জানালার কাছে যেতে পারি না?’

‘কাজ রেখে যেখানে সেখানে যাওয়া রুলসের বাহিরে! জানালার কাছে দাঁড়িয়ে জামাই দেখা নয়৷’

‘আমি তো অপ্রয়োজনে যায়নি স্যার।’ জবাব দিলো সুসমা।

‘কাজ ফেলে জানালার কাছে কি প্রয়োজন আপনার?’

‘কফ্-থু থু ফেলছিলাম স্যার।’ যদিও বিন্দু মাত্র সত্যি নয় এই কথাটা। তবুও বললো সুসমা। তাছাড়া এই ঘাড় ত্যাড়া গম্ভীর বসের সঙ্গে এভাবেই কথা বলবে সুসমা এতে যা হবার হবে।

‘ছেহ্! মানে টা কি? এতোটা অপরিষ্কার কেন আপনি?’

‘স্যার, কফ্-থু থু কি আমি অফিস রুমেই ফেলতাম? তাহলে কি সেটা খুব পরিষ্কার এর মতো কাজ হতো?’

‘ইয়াক, কি কথা! আপনি এমন পঁচা? ছিঃ!’

‘এমন ভাবে বলছেন যেনো জীবনে আপনার নাক দিয়ে কফ্, স্বর্দি পড়েনি, স্বর্দি-জ্বর হয়নি। আশ্চর্য! নাকি আপনার নাকের ডগায় রাগে ভরা জন্য জ্বর স্বর্দি ভয়ে পালিয়ে যেতো লেজ গুটিয়ে?’

‘আমি আপনার মতো অপরিষ্কার না!’

আলিফ সুসমার দিকে তাকিয়ে থেকে ইয়াক ইয়াক করে নিজের ক্যাবিনে চলে গেলো। একটা মেয়ে এতোটা আন-হাইজেনিক কি করে হতে পারে?

অফিস শেষে ক্লান্ত শরীর খানা টেনে নিয়ে যাচ্ছিলো সুসমা। আজ রিক্তার ছুটি ছিলো। রিক্তার বাড়িতে অশান্তি চলছে। এমতা অবস্থায় অফিসে এসে খিটখিটে বসের পীড়া সহ্য হবে না। তাই সুসমাই বলেছিলো রিক্তাকে ছুটি নিতে। রিক্তা ডিভোর্স পেপারে সই করে পাঠিয়ে দিয়েছে তার হাসবেন্ডের বাসায়। ভীষণ ঝুট ঝামেলা পোহাতে হচ্ছে রিক্তাকে। সুসমা রুমালে ঘাম মুছে তাকিয়ে দেখলো মেরাজ তখনো দাঁড়িয়ে আছে। সে ত্রস্থ পায়ে এগিয়ে গিয়ে সরাসরি বললো, ‘আমি তো ভাবলাম আপনি আমার পিছু ছেড়ে দিয়েছেন। তা এতো দিন পর কোথা থেকে উদয় হলেন?’

সুসমা হাঁটছে, সাথে মেরাজও তার সঙ্গে পা মেলাচ্ছে। অতঃপর সঙ্গে সঙ্গে লিখলো, ‘আপনি কতটা নিষ্ঠুর মানবী জানেন?’

সুসমা ম্যাসেজ পড়ে বললো,’নিষ্ঠুরই আমি,আগে বুঝেন নি?’

‘নিষ্ঠুর হলে না বুঝবো। উপরে উপরে মিথ্যা নিষ্ঠুরতার পরিচয় দিয়ে থাকেন শুধু। নিষ্ঠুর শব্দটা আপনার জন্য আংশিক সত্যি, না না আংসিক নয় ক্ষনিকের জন্য সত্যি।’

‘হঠাৎ আপনি সম্বোধন?’

‘পরনারীকে তো আপনিই বলতে হবে। আগে মনে হতো আপনি আমার খুব কাছের একজন তাই তুমি বলতাম। এখন মনে হয় না। এখন মনে হয় আপনি আমার থেকে আলোকবর্ষ দূরে। ক্রমশ দূরে সরেই যাচ্ছেন।’

‘বাব্বাহ, অনেক কথা শিখেছেন দেখছি। অসুখ করেছিলো?’

‘হ্যাঁ, সেদিন রোদে ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থেকে বেজায় জ্বর চেপে বসলো শরীরে। জ্বরে কাহিল আমি বিছানা ছাড়তে পারিনি। আপনি আমায় মিস করছিলেন?’

সুসমা হাঁটা থামিয়ে, কাষ্ঠ হেসে বললো, ‘নাহ! আপনাকে মিস করার মতো তো কিছু নেই।’

মেরাজ শুকনো হেসে মাথা নাড়লো। যার অর্থ ‘হ্যাঁ তাই তো কে আমি? কেন মিস করবে?’ সুসমাও বলতে চাইছিলো, ‘যাকে ভুলতেই পারলাম না এক মুহুর্তের জন্য তাকে কি মিস করতে হয়?’
দুজনেই নিরবে হাঁটছিলো। পাশা পাশি হেঁটে যেতে যেতে বললো,

‘জানেন মেরাজ, আমার প্রাক্তন আমাকে কি বলেছিলো? বলেছিলো, আমি যদি তাকে ডিভোর্স দিয়ে আমার প্রেমিককে বিয়ে করি তবে নাকি আমি এক বাপের প**দা না। খুব বাজে ভাবে বলছিলো, কলিজা ছিদ্র করা কথা খানা। আর রাশেদ প্রেমিক বলতে আপনাকেই বুঝিয়েছিলো।’

‘ওহ তার মানে এই কারণে তুমি আমায় রিজেক্ট করছো?’ লিখলো মেরাজ।

‘নাহ, আপনি কি আমার প্রেমিক? এই কলঙ্কিত জীবনে আপনার মতো শুদ্ধ পুরুষকে জড়াতে চাই না। আপনার উচিত এবার নিজেকে নিয়ে ভাবা। অনেক হয়েছে আর নয়। বাবা মায়ের পছন্দ মতো মেয়ে দেখে বিয়ে করে নিন! আমার সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে নিজের গায়ে দাগ লাগাবেন না।’

‘তা সম্ভব না, আমি যদি তোমার কাছে শুদ্ধ পুরুষ হয়ে থাকি তবে জেনে নাও তোমার সঙ্গে নিজেকে জড়ালে যদি হাজারটা দাগ নিজের চরিত্রে লাগে তবে তাই সই।’

ম্যাসেজ পড়ে সুসমা বললো, ‘আপনি বৃথা জেদ করছেন।’

‘জেদ নয় ভালোবাসা বলো। এই ভালোবাসা মৃত্যুর আগ অব্দি থাকবে।’

‘আপনার এই কথাটি অভ্রান্ত সত্য, কিন্তু তবু কেন আপনার চৈতন্য হয় না?’

‘আমার চৈতন্যে শুধুই তুমি! তাই অন্য কোনো কথায় কিছু হয় না।’

‘তাহলে আপনি কি করবেন? বিয়ে করবেন না, এভাবে ভবঘুরে হয়ে ঘুরে বেড়াবেন?’

‘অপেক্ষা করবো তোমার। আর বিয়ে করেই বা লাভ কি? যাকে বিয়ে করবো আমি তো সেই মেয়েটাকে ভালোবাসতে পারবো না। তাহলে মেয়েটার জীবন নষ্ট করে কি লাভ বলো তো?’

‘আপনার অপেক্ষা যদি কোনো দিনই না শেষ হয় তখন কি করবেন?’

‘তোমায় ভালোবাসবো আমৃত্যু, আজীবন। আর এটাই হবে আমার স্বার্থকতা!’

সুসমার ভীষণ কান্না পাচ্ছে। মেরাজকে সে কিভাবে বুঝাবে সে নিরূপায়। তার কোনো উপায় নেই। তাকে কোনো ভাবেই গ্রহণ করতে পারবে না। হাঁটতে হাঁটতে ওরা ওঁদের বাড়ির কাছে চলে এলো। ভেতরে যাওয়ার আগে সুসমা এক পলক মেরাজকে দেখে বললো, ‘ওষুধ খাচ্ছেন?’

‘হ্যাঁ, খেতে চাইনি, মা বোন, বৃদ্ধ বাবার দিকে তাকিয়ে হলেও আমাকে সুস্থ থাকতে হয়। এই মানুষ গুলোর যে আমি ছাড়া আর কেউ নেই। আমার যেমন তুমি ছাড়া কেউই নেই তেমনই আমি ছাড়া ওঁরা নিঃস্ব, কেউ নেই। আমার কিছু হলে যে ওঁরা বাঁঁচবে না।’ শেষ ম্যাসেজ টা মেরাজ নিজের বাড়িতে ঢুকতে ঢুকতে লিখেছিলো। সুসমা ভেবেছিলো এই প্রশ্নের সে উত্তর পাবে না। ম্যাসেজ পড়ে হতাশার শ্বাস ফেলে ঘরে গিয়ে ধাম করে শুয়ে চোখ বন্ধ করে রইলো।

‘মেরাজ বাবা, আমাদের দিকে তাকিয়ে হলেও বিয়েটা করে নাও। আমরা তো তোমার বাবা মা, তোমাকে এভাবে দেখতে কি ভালো লাগে বলো? তাই আমরা ভাবছি তোমার জন্য অন্যত্র মেয়ে দেখবো!’

‘আব্বা, তোমরা ভাইয়াকে প্লিজ এই বিষয়ে কিছু বলিও না। ভাইয়া সুসমা আপুকে ছাড়া আর কাউকে মানতে পারবে না।’

‘সুসমা, সুসমা, সুসমা! ঐ মেয়েটা তো ওঁর ভালোবাসার দাম দিচ্ছে না। তবে ওঁর পেছনে কেনো পরে আছে? আমাদের কি ইচ্ছে নেই নাতী নাতনীর মুখ দেখার? আমরা মরে যাবো, তবুও কি নাতী নাতনীর মুখ দেখে যেতে পারবো না?’

বাবা মায়ের কথা শুনে নির্বিকার স্বভাবে পা চালিয়ে নিজের রুমে চলে গেলো মেরাজ। সর্বক্ষণ একটা বিষয়ে কথা বলতে ভালো লাগে না।

‘এই জন্যই তো আমি আপনার ছেলের থেকে দূরে আছি আন্টি। উনি যদি আমাকে বিয়ে করেন তবে কখনোই আপনারা নাতি নাতনীর মুখ দেখতে পারবেন না। আমি কখনোই মা হতে পারবো না।’

‘সুসমা আপু তুমি এখানে?’ মেরাজের বোন এগিয়ে এসে শুধালো।

‘হ্যাঁ সেদিন বোধহয় তোমরা এই স্বর্ণের চেইন টা ফেলে এসেছিলে। এটাই দিতে এলাম।’

‘আমরা চেইন টা ফেলে আসিনি। তোমার সঙ্গে মেরাজের বিয়েটা পাকাপোক্ত করতেই নিয়ে গেছিলাম কিন্তু সেটা না হলেও আমার ছেলে ওটা তোমার জন্য রেখে এসেছিলো।’ মেরাজের মা বললেন।

‘উনি কি পা’গ’লা’মি করছেন উনি বলুন তো। এই নিন চেইন টা রাখুন। এতো দামী জিনিস কেউ রেখে আসে! আজ হঠাৎই মা বললো আপনারা এটা দিয়ে এসেছেন আমার জন্য। যেহেতু আমাদের বিয়েটা হওয়া সম্ভব নয় সেহেতু এটা ফিরিয়ে দিতে এলাম। আপনারা বরং নতুন বউকে দিয়ে দেবেন।’

সুসমার ফোনের ম্যাসেজ টোন বেজে উঠলো। মেরাজের ম্যাসেজ।

‘এই বাড়িতে অন্য কোনো মেয়ে বউ হয়ে আসবে না সুসমা। তুমি ছাড়া আমার বৌ অন্য কেউ-ই হতে পারে না৷ আর চেইনটা আমিই রেখে এসেছি, তুমি আমার না হও, কিন্তু আমার দেওয়া জিনিস টা তো নিতেই পারো।’

সুসমা তাকিয়ে দেখলো মেরাজ দাঁড়িয়ে আছে তার ঘরের দরজার সঙ্গে হেলান দিয়ে৷ তাকে দেখে হাত নেড়ে হাসলো। তার ঠোঁটে বিদ্যমান সুন্দর হাসিটি সুসমারে হৃদয়ে কিসের যেনো একটা দোলা দিলো। হঠাৎই মনে হলো তার হৃদয়ে নতুন কিছুর সঞ্চার হচ্ছে, নতুন কিছু অনুভূতির আবির্ভাব হচ্ছে। সেটা যে মেরাজকে ঘিরে তা বুঝতে সময় লাগলো না সুসমার। মনে হলো এই হাসি দেখার অধিকার একমাত্র তার। শুধুই তার, অন্য কারোর না। অন্য কোনো মেয়ের জন্য মেরাজ এভাবে হাসুক সে চাই না। তার খুব হিংসে হবে তাহলে। কেন হিংসে হবে? কোনো উত্তর পায় না সুসমা।

#চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে