অনুরক্তি এসেছে তোমার শহরে পর্ব-০৫

0
569

#অনুরক্তি_এসেছে_তোমার_শহরে
#পর্বঃ৫
#বর্ষা
মৌচাক থেকেই ইলিয়ানা আর আহান স্যারের পথ আলাদা হয়েছে।আহান স্যার আজ একজনের সাথে এদিকটায় দেখা করতে এসেছেন বলেই জানিয়েছেন। অবশ্য বর্তমানে সে একজন ক্যান্টমেন্ট কলেজের ইংলিশ প্রফেসর। সুদর্শন,সিঙ্গেল প্রফেসর!তাই হয়তো সুন্দরী রমনীদের কাছে তার দামটাই আলাদা।

ইলিয়ানা গাজীপুর জেলায় আজ দুদিন যাবৎ।সফিপুর তানহায় তার যেতে হবে নিজ প্রফেশনের স্বার্থে

তানহা হসপিটালে যেতেই হসপিটাল স্টাফরা সংবর্ধনা জানায় তাকে।বয়স অনুযায়ী এতোটা প্রাপ্তি তার হওয়ার কথা নয়।তবে সে যেখানে পড়াশোনা করেছে সেখানে পাঁচ বছরের স্টাডি/কোর্স সে সাড়ে তিনবছরে কমপ্লিট করেছে।আবার দুই বছরের স্টাডি মাত্র দেড় বছরে। অবশ্য এতে সে সিনিয়রদের সাথে পড়তে বা নিজেকে কম্পেয়ার করে এগিয়েছে।তাইতো তেইশে ডাক্তার হিসেবে জয়েনিং আর পঁচিশের আগেই নামকরা কার্ডিওলজিস্ট জেহের চৌধুরী নামে পরিচিত হয়েছে সে।ডক্টর জোবেদা আউট অফ টাউন তাই আসতে পারেননি।তবে ভিডিও কলে সংবর্ধনা জানান। এবং বাকিদেরকে ইলিয়ানার সাথে সহায়ক ভূমিকা পালন করতে বলেন। বহু আগে একবার কিংবা দুইবার আসা হয়েছিলো তানহা তে তার।তবে তা প্রায় সব বছর চৌদ্দ আগের ঘটনা।

ইলিয়ানার ফাতেহ নামের ছেলেটাকে বেশ লেগেছে।বয়স অল্প।ইন্টার্নে শেষে সদ্য ডাক্তার পদবী পেয়েছে সে এই হসপিটালে। অবশ্য এই হসপিটালের ওনার তথা ডক্টর জোবেদার দূরসম্পর্কের আত্মীয় ফাতেহ রেহমান।সেও কার্ডিওলজি নিয়ে পড়াশোনা করায় তাকেই নিজের সহায়ক হিসেবে কাজে থাকতে বলেছে ইলিয়ানা। অবশ্য উক্ত কথাটা ডক্টর জোবেদাকে জানাতে সে খুশি হয়েছেন।

রাত দুইটা/তিনটার দিকে ইলিয়ানা হসপিটাল থেকে বের হওয়ার কথা বলে। ফাইলগুলো চেকিং করা।তারপর রোগী সজাগ থাকায় তাকে পরিদর্শন করা এবং টাইমলি না ঘুমানোর কারণে একটু রাগ দেখানো। অবশ্য পেশেন্টদের সন্তানের মতো শাসন না করলে যে পেশেন্টদেরই ক্ষতি।তারপর বই আনিয়ে তা ঘাঁটাঘাঁটি।সবশেষ একটু গবেষণা করে বের হতে চাওয়া।

—মিষ্টার ফাতেহ আমি চলছি। আপনার সিফটও তো শেষ তাই নয় কি?(ইলিয়ানা)

—আমার সিফট তো এগারোটার সময়ই শেষ।আপনি যেহেতু এসেছিলেন তাই ছিলাম।(ফাতেহ)

—তাহলে আমার জন্য তো আপনার অনেক লেইট হয়ে গেলো(ইলিয়ানা)

—পেশেন্টদের সুস্থতার জন্য এই দেরী কোনো দেরী নয়!(ফাতেহ)

ফাতেহ-র কথায় ইলিয়ানা অত্যন্ত খুশি হয়।ইলিয়ানা ভান্নারার দিকে যাবে শুনে ফাতেহ বলে সেও সেই দিকেই যাবে। এক্ষেত্রে তারা একত্রেই যেতে পারে।আর যেহেতু ফাতেহ-র বাইক আছে সেহেতু যেতে মাত্র মিনিট দশেক লাগবে।

ইলিয়ানা একবার রিক্সায় করে যেতে চাইলেও পরে ভাবে এতো রাতে তার জন্য অন্তত পক্ষে বাংলাদেশে কেউ রিক্সা নিয়ে দাঁড়িয়ে নেই।তাইতো রাজি হয় ফাতেহ-র প্রস্তাবে।ভান্নারাতে স্কুলের কাছাকাছি নামতেই দেখতে পায় রাস্তাটা বেশ অন্ধকার আচ্ছন্ন।তবে মাঠের দিকটা আলোয় আলোকিত। কেননা সেদিকটায় যে নারী, পুরুষ সদস্য সকলেরাই আছে।

—ম্যাম,আপনি কি রিইউনিয়নে এসেছেন?(ফাতেহ)

—হুম.. কেন?(ইলিয়ানা)

—তেমন‌ কিছু না।আমি তো জানতাম আপনি ফরেন থেকে এসেছেন। তাই অবাক হলাম এখানের স্কুলে আপনি স্টাডি করেছেন শুনে।(ফাতেহ)

—স্কুল বড় বিষয় না তবে আমরা শিক্ষকদের থেকে কি নিতে সক্ষম হলাম এবং তারা আমাদের কি দিলো এটাই হচ্ছে বড় বিষয়!হ্যা এসএসসি অব্দি আমি এই স্কুলেই ছিলাম (ইলিয়ানা)

—আচ্ছা ম্যাম চলি।কাল দেখা হচ্ছে তো?(ফাতেহ)

—যেহেতু তিন/চারদিনের মাঝে অপারেশন করাতে হবে, সেহেতু কালকেও যেতে হবে। আল্লাহ হাফেজ (ইলিয়ানা)

ইলিয়ানা আর দাঁড়ায় না।অন্ধকারের মাঝে ঢুকে পড়ে।বড় বড় বিল্ডিং হয়েছে এদিকটায়। অবশ্য ঝাপসা আলো আছে।কেউ ইলিয়ানার হাত টান দিয়ে গলির দেয়ালে আটকায় তাকে।ইলিয়ানা ভয় পেয়ে যায়।তাইতো চেহারা না দেখেই আত্মরক্ষা কৌশলে কুপোকাত করে সামনের ব্যক্তিকে।নিচে ফেলে তারপর মোবাইলের ফ্লাশে নিজের প্রিয় ব্যক্তিটিকে দেখে।সরি সরি বলে ধরে তুলে।

নিজের ব্যাগ থেকে চুপচাপ ফাস্ট এইড বক্স‌‌‌ এনে একদম মাঠের বাইরের দিকটায় বসে আহান স্যারকে নিয়ে।মাথায় অনেকটা চোট পেয়েছে।ইলিয়ানা আলতো হাতে মলম লাগিয়ে দিতে দিতে বলে,

—এভাবে অন্ধকারের মাঝে আমার পথ রোধ করেছিলেন কেন?(ইলিয়ানা)

—কে ছিলো ছেলেটা?(আহান স্যার)

—আমি একটা প্রশ্ন করেছিলাম।

—আমিও করেছি।

—আগে আমার প্রশ্নের জবাব দিন।

আহান স্যার ইলিয়ানার কথা গ্রাহ্য না করেই বলে,
—শোনো মেয়ে ওই ছেলে যেই হোক তাকে ভুলে যাও।আর আমাকে ফ্রি হয়েই ম্যাসেজ দিবা।রেস্ট্রেকশন সরিয়ে নিয়েছি।কালকে তোমায় একস্থানে নিয়ে যাবো।যাবা?

—কোথায়?(ইলিয়ানা)

—আমি যেখানে নিয়ে যাবো সেখানে।

—জায়গাটা কোথায় সেটা তো বলবেন নাকি!

—কালকে গেলেই দেখতে পাবা।এখন গিয়ে শুয়ে পড়ো। রাতদুপুরে বাইরে ঘুরঘুর করো না পেত্নি ভেবে কেউ ভয় না পেলেই হয়!যাও

আহান স্যার হাসতে হাসতে কথাটা বলেন। ইলিয়ানা কপট রাগ দেখিয়ে বলে,

—পেত্নি আপনার বউ।

—তাইতো বললাম।এখন আর ঝগড়া না করে গিয়ে শুয়ে পড়ো।আমিও যাচ্ছি।বাই।

—আল্লাহ হাফেজ।

ইলিয়ানা বিরবির করে সরে আসে সেখান থেকে। তাঁবুতে এসে দেখে মেহের বসে আছে বড় বড় চোখ করে।ইলিয়ানার দিকে তাকিয়ে ইশারায় ফোন দেখায়।ইলিয়ানা ফোনের দিকে তাকাতেই মেহের ম্যাসেজ পাঠায় যে,”তুই কি এখনো মরীচিকার পেছনে ছুটছিস?”

ইলিয়ানা ম্যাসেজের জবাবে শুধু এতোটুকুই বলে যে,”মরীচিকার পেছনে ছুটছি কিনা জানি না।তবে এখন অনেক রাত হয়েছে।ঘুমা আর ভাবছি দুলা ভাইয়ের সাথে কথা বলমু।সেই কত বছর আগে তোদের গুপ্ত চরের কাজ করতাম ভাবা যায়!”

সকালবেলা ইলিয়ানার উঠতে উঠতে আটটা বেজে যায়। কাছাকাছি অনন্যাদের বাড়ি। সেখানে থাকার ব্যবস্থা চাইলেই করা যেতো।তবে এতে সব বন্ধুরা এবং শিক্ষকরা থাকবে না বলেই আর যাওয়া হয়নি।আজ ঘুরতে সেদিকটায় নিয়ে যাবে অনন্যা।

ইলিয়ানা ফ্রেশ হয়ে একটু এদিক ওদিক হাঁটা হাঁটি করছিলো।সকালে খিচুড়ির আয়োজন হয়েছে।পূর্বে প্রিয় খাবারের তালিকায় থাকলেও এখন আর তা প্রিয় নেই।বেশি খাওয়াও হয় না আর।তাইতো এদিক থেকে বেরিয়ে দোকান থেকে কলা আর ব্রেড কেনার উদ্দেশ্যে যেতেই ইলিয়ানার মুখশ্রী ঝলঝল করে ওঠে কাছের বান্ধুবীদের আরেকজনকে দেখে।মেয়েটাকে মিস করছিলো সে।

ইলিয়ানা ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরে বলে,

—বেবি ভালো আছিস?

ওমা,ওই মেয়ে অর্থাৎ সাঈদা ইলিয়ানাকে ছাড়িয়ে আগে থেকে মাথা ইলিয়ানাকে পর্যবেক্ষণ করে বলে,

—বেবি তুই এতো চিকন হইছোস কেন?হাড্ডি লাগে।আমারে দেখে তো শিখতে পারোস কত গুলুমুলু হইছি।

সাঈদার কথায় ইলিয়ানা গাট্টা মেরে বলে,

—হ,যে গুলুমুলু হইছোস যে হাড্ডি গুড্ডি সব বোঝাই যায়।

সাঈদা আর ইলিয়ানা খুনসুটি করতে করতেই স্কুল মাঠের দিকে যায়।খাবার কেনার কথা ভুলেই বসে সে।আর কোনো ফ্রেন্ডের সাথে যোগাযোগ না থাকলেও সাঈদা মাঝেমাঝে কমেন্ট করতো আর তখনই হঠাৎ হঠাৎ ইলিয়ানা রিপ্লাই দিতো।আর তখনই একটু আকটু ম্যাসেঞ্জারেও কথা হতো।এই যা যোগাযোগ।

প্রিন্সিপাল স্যারকে পেয়ে যেন সাঈদার খুশি ধরে না।প্রিয় স্যারটা যখন চলে যাবেন বলে জানালেন তখন কি কান্নাই না জুড়ে ছিলো সাঈদা,অনন্যা, অন্তরা আর তাসনিম।তবে এবার পাগলিগুলো অত্যন্ত আনন্দিত।

অধিকাংশ পুরনো স্যাররা চলে গিয়েছেন অন্য জায়গায়।তাইতো হঠাৎ আবারো সবাইকে পেয়ে খুব খুশি তারা।ইলিয়ানার ফোনে টুং করে ম্যাসেজ আসে। সবগুলো সাঈদাকে নিয়ে ব্যস্ত থাকায় একটু সরে আসে সে।জ্যাকের ম্যাসেজ।

”ম্যাম প্লিজ কাম ব্যাক উইথ মি।দিস প্লেস ইজ নট সুইটেবল ফর আস।”

ইলিয়ানা হাসে।বিদেশী হিসেবে জ্যাকের জন্য একটু নয় বরং অনেকটাই কষ্টসাধ্য এই পরিস্থিতিতে বসবাস। তাইতো একদিনেই বিরক্ত হয়ে ম্যাসেজ দিয়ে দিয়েছে। কেননা সে জানে তার ম্যাম অলরেডি তার অবস্থান সম্পর্কে জ্ঞাত।

”কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন আমায়?এখন তো বলুন।”

ইলিয়ানা আহান স্যারের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন করে। দু’জনে রিক্সায় বসা।আজকে সবাই আলাদা আলাদা ঘুরতে গিয়েছে। তবে কয়েকজন আবার কোথাও না গিয়ে ছুটির কাজগুলো অনলাইনে বসেই করে নিচ্ছে।যাতে মাস শেষে বেতনটা আসে। ছোটবেলায় পরিবারের দায়িত্ব অধিকাংশের ওপর না থাকায় বড়বড় অনেক স্বপ্নই দেখেছিলো এরা যে বড় হয়ে একমাসের লম্বা একটা রিইউনিয়ন কাটাবে।তবে সম্ভব হলো না।তবে শেষমেশ বহু কষ্টে সবাইকে ম্যানেজ করে আয়োজিত হলো রিইউনিয়ন।

”স্যার এটা কোথায় আসলাম আমরা?”

পুরো ফাঁকা একটা মাঠের কাছাকাছি রিক্সা থেকে নামলো ওরা।ইলিয়ানা অবাক এবং জানতে আগ্রহী। সামনের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ইলিয়ানা হঠাৎ লক্ষ্য করে আহান স্যার নেই।

”স্যার,স্যার?”

ইলিয়ানা চারপাশটা ভালো মতো দেখতে থাকে।ওর মনে ভয় জেঁকে বসে। একেতো অচেনা জায়গা, তারওপর নির্জন।ইলিয়ানা আর ভাবে না।ভয় পেলে মস্তিষ্ক একদম শূন্য হয়ে যায়।এতে বিপদে বাঁচার সম্ভাবনা থাকলেও তা হ্রাস পেতে লাগে। তাইতো নিজে কাম ডাইন করে ইলিয়ানা আশপাশ তাকায়। হঠাৎ আহান স্যার ইলিয়ানার সামনে এসে দাঁড়ায়। অবশ্য সে দৌড়ে এসেছে তা তার দম ফেলা দেখেই ইলিয়ানা বোঝে।

আহান স্যার ইলিয়ানাকে বলে,

” তোমার না সূর্যাস্ত দেখার শখ।এর থেকে আরেকটু দূরেই হেঁটে গেলে ছোটখাটো নদী আছে।চল,আজ দুজনে একসাথে সূর্যাস্ত দেখবো।আর এটা তোমার জন্য…

ইলিয়ানার দিকে গোলাপের থোকা এগিয়ে দেয়। চুলগুলো যেহেতু ঝুঁটি বাঁধা তাই তার মাঝে ইলিয়ানা ফুলটাকে গাঁথার চেষ্টা চালায় তবে ব্যর্থ হয়। ফুলের দুটো পাপড়ি ছিড়ে যায়।তা দেখে আহান স্যার ইলিয়ানার হাত থেকে ফুল নিয়ে চুলের মাঝে গেঁথে দেয়।ইলিয়ানা অন্যরকম শিহরণ অনুভব করে।

চলবে?

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে