অনুভূতি
পর্ব ৯
মিশু মনি
.
১৩.
বাসর ঘরে ফুলের উপর পা তুলে বসে আছে দুপুর।
আজ এই বিছানায় রোদের বসে থাকার কথা ছিলো। মাত্র কয়েক মুহুর্তের ব্যবধানে এখন এখানে দুপুর বসে আছে। রোদ কোথায় কি অবস্থায় আছে কে জানে, কিন্তু দুপুর ও নিখিল দুজনের ভিতরে একটু আগেই সর্বোচ্চ মাত্রার ঝড় বয়ে গেছে। যার রেশটা এখনো রয়ে গেছে। আনমনা হয়ে বসে বসে এই আকস্মিক ঝড়ের কথা ভাবছে দুপুর। কি থেকে কি হয়ে গেলো কিছুই বোঝা গেলো না।
দরজা ঠেলে ভিতরে প্রবেশ করলো অরণ্য। ওকে বেশ উজ্জ্বল আর হাসিখুশি দেখাচ্ছে যেন বিয়েটা দুপুরের সাথেই হবার কথা ছিলো। এগিয়ে এসে দুপুরকে বললো, “ওভাবে চেয়ে আছো যে?”
দুপুর চোখ নামিয়ে নিলো। অরণ্য মাথা থেকে পাগড়ি খুলে রেখে আস্তে আস্তে বিছানার কাছে এসে দুপুরের পাশে বসলো। দুপুর খুব অপ্রস্তুত বোধ করছে। আজকে দিনেও অরণ্য কে দুলাভাই বলে ডেকেছিলো ও। এখন তারই সাথে বাসর হচ্ছে! আর নিখিল? ডুকরে কান্না পেয়ে গেলো দুপুরের।
অরণ্য জিজ্ঞেস করলো, “কি ভাবছো দুপুর? রোদের জন্য মন কেমন করছে?”
দুপুর দুদিকে মাথা নাড়িয়ে না বললো। অরণ্য বললো, “যা হবার তা তো হয়েই গেছে। সে নিজের লাইফ নিজেই বেছে নিয়েছে। আমাদের কারো কথা সে ভাবেনি। আমরা কেন তাকে ভেবে অযথা কষ্ট পাবো বলোতো? আমাদের এখন একটা নতুন লাইফ শুরু হতে যাচ্ছে। আমাদের উচিৎ নিজেদের জীবনটাকে গুছিয়ে নেয়া।”
দুপুর মাথা নিচু করে রইলো। যদি ওর জীবনে নিখিল বলতে কেউ না থাকতো, তাহলে হয়ত এটা মেনে নিয়ে খুব সুখী হতে পারতো। অরণ্য নিঃসন্দেহে একজন ভালো ছেলে, স্বামী হিসেবেও অনেক ভালো। এরকম একজনের সাথে অনায়াসে সুখী হওয়া যায়। কিন্তু দুপুরের সবটুকু ভালোবাসা যে নিখিলের জন্যই ছিলো। এখন নিখিলকে ভূলে গিয়ে আবার নতুন করে অরণ্যকে ভালোবাসতে অনেক কষ্ট হবে। সবকিছু মেনে নেয়া সহজ হলেও, সুখী হওয়া সহজ নয়। কিছুতেই সুখী হতে পারবে না দুপুর।
অরণ্য আস্তে করে ঘোমটা টা সরিয়ে বেশ কিছুক্ষণ মুগ্ধ হয়ে চেয়ে রইলো দুপুরের দিকে। দুপুর কে আজ একটু বেশিই অপূর্ব লাগছে! ও যে এতটা সুন্দর সেটা আগে বোঝা যায়নি। আলতো করে দুপুরের ডান গালটা হাত দিয়ে স্পর্শ করলো অরণ্য। দুপুর চোখ বন্ধ করে ফেললো। ওর এখন খুব বেশি কষ্ট হচ্ছে। নিখিল নিশ্চয়ই এখন কেঁদে পাগল হয়ে যাচ্ছে। নিখিলকে ওরকম দুঃখ দিয়ে কিভাবে ভালো থাকবে দুপুর? নিখিল তো আসতে চেয়েছিলো দুপুরের বাবার কাছে, কিন্তু দুপুর ই নিষেধ করে দিয়েছে। কেন করলো এটা? দুপুরের নিজের প্রতি ভীষণ রাগ হচ্ছে। ইচ্ছে করছে এই বাসর ঘরে আগুন লাগিয়ে দিতে। কিন্তু কিইবা করার আছে। নিজের ইচ্ছায় সে এ বিয়েতে মত দিয়েছে। একবার না বললে বাবা কখনোই বিয়ে দিতো না। কিন্তু বাবার সম্মানের কথা ভেবে এটা করতে হয়েছে ওকে। কি করবে এখন ও?
দুপুরের চোখ বেয়ে টপ করে এক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়লো।
অরণ্য বললো, “দুপুর… কাঁদছো কেন? বাসার কথা মনে করে?”
দুপুর কিছু না বলে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। অরণ্য বললো, “তোমার কি টায়ার্ড লাগছে? ঘুমাতে চাও?”
প্রশ্নটা শুনে অনেক অবাক হয়ে গেলো দুপুর। মাথা নেড়ে হ্যা জানালো।
অরণ্য বললো, “আচ্ছা তুমি তাহলে ঘুমাও।”
চমকে ওর দিকে তাকালো দুপুর। বাসর ঘরে ছেলেরা সাধারণত খুব চেষ্টা করে বউকে ঘুমাতে না দেয়ার জন্য। আর অরণ্য ঘুমাতে বলছে! সত্যিই একবার মুগ্ধ হতেই হলো। দুপুর কোনো কথা না বলে আস্তে করে শুয়ে পড়লো। অরণ্য এসে বরের সাজ পোশাক বদলে টিশার্ট পড়ে ঘুমাতে গেলো।
দুপুরের কিছুতেই ঘুম আসছে না।একবার নিখিলের কণ্ঠটা না শুনলে ওর ঘুম আসবে না। কিন্তু এখন কিভাবে ওকে ফোন দেবে ও? সেটা যে আর হয়না। ওই অধিকার টা আর নেই।
অনেক চেষ্টা করেও আর পারলো না দুপুর। একবার নিখিলের কণ্ঠটা ওকে শুনতে ই হবে। বালিশের পাশ থেকে মোবাইল টা নিয়ে নিখিলকে কল দিলো। প্রথম বার রিং হতেই রিসিভ করলো নিখিল। কিন্তু রিসিভ করে কয়েকবার হ্যালো হ্যালো বললো। কিন্তু দুপুর চুপ করে ওর ভয়েস টা শুনে যেতে লাগলো। ভেতরে ভেতরে পুড়ে শেষ হয়ে যাচ্ছে। তবুও শান্ত হয়ে শুনতে লাগলো ওর কণ্ঠ।
নিখিল বারবার প্রশ্ন করে যাচ্ছে। ও ভেবেছে দুপুরের হয়ত বিয়েটা হয়নি। একটু আশার আলো দেখতে যাচ্ছিলো। এভাবে ওকে কষ্ট দেয়া যায়না। দুপুর আস্তে করে উঠে বাথরুমে চলে এলো। এসে টেক্সট পাঠালো নিখিলের নাম্বারে, “ami bashor ghore shuye achi Nikhil. tomar kontho ta shunte icche korchilo tai phone dilam. amk maf kore dio.”
মেসেজ টা দেখে যতটা কষ্ট পাওয়া সম্ভব তারচেয়ে বেশি পেলো নিখিল। সে বাসর ঘরে শুয়ে আছে অন্য একটা ছেলের সাথে আর সেটা মেসেজ করে পাঠিয়েছে? এরচেয়ে কষ্টের আর কি হতে পারে?
দুপুর মুখ ধুয়ে আবারো রুমে চলে আসলো। মনে মনে থ্যাংকস জানাচ্ছে অরণ্যকে। সে ঘুমাতে না দিলে আরো বেশি কষ্ট হতো দুপুরের। ও বিছানায় শুয়ে বালিশে মুখ গুঁজে শুধু কেঁদেই যেতে লাগলো। কাঁদতে কাঁদতে চোখ ফুলিয়ে ফেললো একদম।
১৪.
মেঘালয় জিজ্ঞেস করলো, “তোমার এখন কি ইচ্ছে করছে?”
– “আপনার গান শুনতে।” নিঃসংকোচে উত্তর দিলো মিশু।
মেঘালয় হেসে বললো, “এই ট্রেনে গান শুনবা? লোকজন কি বলবে?”
– “ফিসফিস করে শোনান। খুব আস্তে আস্তে।”
– “এসএমএস করে পাঠাই তাহলে।”
বলেই হাসলো। মিশুও হাসতে যাচ্ছিলো কিন্তু হাসতে পারলো না। তার আগেই মেঘালয়ের আচরণে অবাক হয়ে গেলো। মেঘালয় একদম মিশুর কানের কাছে এসে গাইতে আরম্ভ করলো,
“এ জীবনে যারে চেয়েছি…
আজ আমি তারে পেয়েছি…
তুমি আমার সেই তুমি আমার…
মিশুর কানের উপর মেঘালয়ের গরম নিঃশ্বাস পড়ছে। সেইসাথে ওর মায়াবী কণ্ঠে এই গান শুনে মিশুর শরীর ঝাঁকুনি দিয়ে উঠলো।
– “তুমি ছিলেনা, ছিলোনা আশা…
তোমায় পেয়ে আশা বেঁধেছে বাসা….”
মিশু একটু মাথাটা ঘোরাতেই মেঘালয়ের সাথে চোখাচোখি হলো। একদম কাছ থেকে দেখলো মেঘালয়ের চোখ দুটো। চোখাচোখি হতেই কেমন যেন লাগলো বুঝে উঠতে পারলো না ও।
মেঘালয় হেসে হেসে গান গেয়ে শুনাচ্ছে। গান থামাতেই মিশু বললো, “আরো শুনবো।”
মেঘালয় আবারো আরেকটা গান শুনাতে আরম্ভ করলো। শুনতে শুনতে ঘুম এসে যাচ্ছিলো মিশুর। আস্তে করে সিটে হেলান দিয়ে চোখ বুজলো। মেঘালয় গান থামালো না। মিশু ওর গান শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়লো। মাথাটা ঘুমে ঢলে পড়ে যাচ্ছিলো। মেঘালয় আস্তে করে ওর মাথাটা নিজের কাঁধের উপর নিয়ে নিলো। মেঘালয়ের কাঁধে মাথা রেখে আরামে ঘুম দিলো মিশু।
বারবার মিশুর ঘুমন্ত মুখটার দিকে তাকাচ্ছে মেঘালয়। বড্ড মায়াবী লাগছে দেখতে। আসলে সেই প্রথম দিনেই তো মিশু এক নামহীন মায়ায় জড়িয়ে ফেলেছে ওকে। সেই মায়ার কোনো নাম হয়ত নেই। যে মায়ার টানে প্রতিদিন বারবার ছুটে যেতো ওর দোকানে। শুধুমাত্র একটা বার দেখার জন্য,কথা বলার জন্য। আর মিশুর জন্য কিছু করার ইচ্ছেটাও খুব পেয়ে বসেছিলো মেঘালয় কে। আস্তে আস্তে ওর প্রতি দূর্বলতা তৈরী হচ্ছে। কিন্তু সেটা বুঝতে পারছে না মেঘালয়।
জানালা দিয়ে মিষ্টি বাতাস আসছে। কোথায় যাচ্ছে কেউই জানেনা। খুলনার টিকেট কাটা হয়েছে। এখন যেখানে খুশি নেমে যাওয়া যায়। নয়ত খুলনা অব্দিও যাওয়া যেতে পারে। মেঘালয় আবারো তাকালো মিশুর ঘুমন্ত মুখের দিকে।
চলবে…