অনুভূতি
পর্ব ৮
মিশু মনি
.
১১.
শিকদার সাহেবের মেজো মেয়ে রৌদ্রময়ীর আজ বিয়ে।
পুরো বাড়িতে বিয়ের আনন্দের বন্যা বইছে। এত হাসাহাসি আর এত আনন্দের ফোয়ারা অনেক দিন দেখেননি শিকদার সাহেব। মেয়েটাকে ভালো ঘরে বিয়ে দিতে পেরে বুকটা অনেক শান্তি শান্তি লাগছে। স্ত্রীকে বারবার ডেকে ডেকে বলছেন, “ওগো নিধির মা, দেখবা আমাগো রোদ অনেক ভালা থাকবো।”
– “হ, আমার ও তাই মনেঅয়। আমাগো রোদ অনেক ভাগ্য কইরা জন্মাইছিলো তাইনা?”
– “তুমি তো ওর মা, তুমিই কইবার পারো সেইটা।”
– “ধুর, আমারে এইভাবে কইবেন না তো। আমার শরম করে।”
– “হ, করবো ই তো। নিজে যখন কইলা, তখন শরম লাগে নাই?”
শিকদার সাহেবের স্ত্রী লজ্জায় একেবারে লাল হয়ে গেলেন। এমন সময় শোনা গেলো অনেক আনন্দধ্বনি আর চেঁচামেচি, বর এসেছে, বর এসেছে।
শিকদার সাহেব ও ওনার স্ত্রী ব্যস্ত হয়ে পাত্রপক্ষ কে বরণ করতে ছুটলেন। রৌদ্রময়ী’র ঘরে বসে থাকা সবাই ছুটে গেলো বরকে দেখতে। পুরো বাড়িতে যেন শুধু হাসির কল্লোলধ্বনি ধ্বনিত হচ্ছে।
পাত্রকে দেখে রোদের ছোটবোন দুপুর খুশিতে গদগদ হয়ে ঘরের দিকে ছুটছে। আপুকে জলদি জলদি বলতে হবে আজ অরণ্য ভাইয়াকে কি দারুণ দেখাচ্ছে! উফফ এত্ত সুন্দর আর কিউট লাগছে আজ দুলাভাইকে! কিজানি বিয়ের সাজে বুঝি সবাইকেই দারুণ লাগে। আজ রোদ আপুকেও দারুণ দেখাচ্ছে।
ছুটতে ছুটতে ঘরে এসে দেখলো রৌদ্রময়ী নেই। বোধহয় ওয়াশরুমে গেছে। অনেক্ষণ বিছনায় বসে পা দুলাতে লাগলো দুপুর। বেশ খানিকটা সময় কেটে গেছে। এখনো আপুর দেখা নেই,কোথায় যে গেলো মেয়েটা। একটু পরেই বিয়ে পড়ানো হবে আর সে বাথরুমে গিয়ে বসে আছে। নিশ্চয় ই কাঁদছে। পাগলি একটা।
আপনমনে এসব ভাবছিলো দুপুর। সে সময়ে হঠাৎ ফোনের মেসেজ টোনটা বেজে উঠলো। ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে বুকটা ছলাৎ করে উঠলো। রোদ আপুর মেসেজ, “dupur, ami basa theke paliye jacchi. baba ma k bolis amk maf kore dite. ar kichu bolte parchi na. amr jonno kew tension koris na. babar dike kheyal rakhis.”
মেসেজ টা সিন করেই চোখ ফেটে কান্না বেড়িয়ে আসতে চাইলো দুপুরের। বুকটা ঢিপঢিপ করতে লাগলো। আপু এই কাজটা কেন করলো? কখনোই তো ওকে দেখে কিচ্ছু বোঝা যায়নি। আজ এই কাজের কারণ টা কি? আপু কেন এমন করলো? আপুরে, বাবার সম্মান ধূলায় মিশিয়ে দিলি তুই!
কয়েকবার কল ব্যাক করে দেখলো নাম্বার বন্ধ। কিছুতেই রোদের সাথে এখন যোগাযোগ করা সম্ভব না। এবার কি হবে! বাবাকে কিভাবে বলবে এ কথা! পুরো গ্রামের লোক জানে রৌদ্রময়ী কত ভালো একটা মেয়ে। আর আজ এভাবে বাবাকে অপদস্থ হতে হবে সবার সামনে!
চুপচাপ বসে কাঁদতে লাগলো দুপুর। ধীরেধীরে সবাই ঘরে এসে রোদকে খুঁজতে আরম্ভ করে দিলো। দুপুরকে কান্নার কারণ জিজ্ঞেস করলে ও চেপে গেলো। কিন্তু সময় পেরিয়ে যাচ্ছে। আর মুখ বন্ধ করে থাকা যায়না। ও মাকে জড়িয়ে ধরে বলেই দিলো কথাটা।
মা কথাটা শুনে কয়েকমুহুর্ত নিস্তব্ধ হয়ে রইলেন। কথাটা দুঃস্বপ্নের মত কানে বাজছে। কিভাবে স্বামীকে বোঝাবেন উনি!
দুই মা মেয়ে মিলে আড়ালে দাঁড়িয়ে চুপচাপ কথা বলছিলেন। আর কেউ যেন শুনতে না পায়। কিন্তু দু একজন সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকাচ্ছেন। গ্রামের লোকদের মুখ সামলানো দায়। এবার যে কি তুলকালাম কান্ড হবে কে জানে! বুকটা ধুকপুক করে উঠলো দুপুরের।
শিকদার সাহবকে ডেকে নিয়ে এসে দুপুর বললো, “আব্বা একটা বিপদ ঘইট্যা গ্যাছে।”
শিকদার সাহেবের মুখ শুকিয়ে গেল। আসন্ন বিপদের শংকা স্পষ্ট হয়ে উঠলো চেহারায়। দুপুর আস্তে আস্তে কথাটা বুঝিয়ে বললো বাবাকে। বাবা সব শুনে মূর্তির মতন দাঁড়িয়ে রইলেন। দুপুর কান্নায় ভেঙে পড়েছে। বাবার একটা সম্মান আছে এ এলাকায়। সব আপু নষ্ট করে দিলো। কেন করলো এরকম টা?
খুব বেশি সময় সবকিছু শান্ত রাখা গেলো না। বাধ্য হয়ে শিকদার সাহেব বেয়াইকে ডেকে কথাটা বললেন। সব শুনে বেয়াই নিশ্চুপ হয়ে মাটির দিকে চেয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। বড় কিছু বলে অপমান করার ইচ্ছে তার নেই। তার মেয়ে এই কাজটা করলে তিনি চুপ করেই থাকতেন, অযথা শিকদার সাহেবকে অপমান করার কোনো মানে হয়না।
ঘটনা বুঝতে পেরে অরণ্য এসে জিজ্ঞেস করলো, “কি হইছে আব্বু?”
অরণ্য’র বাবা কথাটা বলতেই কিছু না ভেবেই অরণ্য উত্তর দিলো, “আব্বু এখনো কথাটা কেউ জানেনা। শুধু আমরাই চার পাঁচজন জানি। এখন ই কিছু একটা উপায় বের করতে হবে।”
– “কিসের উপায়?”
অরণ্য এক মুহুর্ত চুপ থেকে বললো, “আব্বু,আমি দুপুরকে বিয়ে করে ফেলি। তাহলে আমাদের উভয়ের সম্মান ই বেচে যাবে। আর লোকজন কে বলবে, আমিই দুপুরকে বিয়ে করতে চেয়েছি। তাই রোদ কষ্ট পেয়ে ঘরের দরজা বন্ধ করে বসে আছে। আর দুপুরের সাথে বিয়ে দিয়ে দাও আমাকে। আর একটু দেরি হলেই লোকজন নানা কথা বলবে আব্বু।”
অরণ্য’র মুখে এমন প্রস্তাব শুনে চমকে উঠলেন শিকদার সাহেব। ছেলেটা সম্মানের কথা ভেবে এভাবে একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললো! সিদ্ধান্ত টা খারাপ নয়। এখন অরণ্য’র বাবা যদি রাজি হোন আরকি। উনি অসহায় ভাবে বেয়াইয়ের দিকে তাকালেন। অরণ্য নিজেও বাবার হাত ধরে বললো, “সবকিছু পরে ভেবো আব্বু। আমি জানি তুমি রোদকে অনেক পছন্দ করতে। এখন এতকিছু ভাবার সময় নেই। আমি নিজেও জানিনা রোদ এ কাজটা কেন করলো! কখনোই কিছু বুঝতে পারিনি ওকে দেখে।”
অরণ্য বাবাকে অনেক বোঝানোর পর বাবা রাজি হলেন। শিকদার সাহেব বেয়াইকে জড়িয়ে ধরে কেঁদেই ফেললেন প্রায়। ছুটে এসে দুপুরকে বললেন কথাটা। কিন্তু এখন নিজেকেই বিয়ে করতে হবে শুনে মাথায় বাজ পড়লো দুপুরের! বাবার সম্মানের প্রশ্ন। রোদ আপু পালিয়ে গিয়ে যে অসম্মানিতে ফেলে দিতে যাচ্ছে, সেটা সামলানোর জন্যই বিয়েটা করতে হবে ওকে। কিন্তু দুপুরের সবকিছু জুড়েই যে নিখিল। ছেলেটাকে মনপ্রাণ উজার করে ভালোবাসে ও। নিখিলকে কিভাবে কষ্ট দেবে ও? এদিকে এখান না বলে দিলে বাবার অপমান হবে, সেইসাথে অপমানিত হবেন অরণ্য ভাইয়া আর ওর বাবাও। কারণ ওনারা নিজে থেকে এই প্রস্তাব দিয়েছেন শিকদার সাহেবের সম্মান বাঁচানোর জন্য। এখন কি করবে দুপুর!
বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে, “আমি রাজি আব্বা” কথাটা বলেই ছুট লাগালো একটা। এক ছুটে ঘরে এসে দরজা বন্ধ করে দিলো। বিছানার উপর ধপ করে পড়ে গিয়ে বালিশে মুখ গুঁজে ডুকরে কেঁদে উঠলো।
অনেক্ষণ নিরবে কাঁদার পর ফোনটা নিয়ে নিখিলকে কল দিলো। নিখিল রিসিভ করেই বললো, “এতক্ষণে সময় হলো তাইনা? সেই কখন থেকে অপেক্ষা করছি মহারানীর কলের জন্য।”
ডুকরে কেঁদে উঠলো দুপুর। নিখিল স্তব হয়ে বলল, “কি হয়েছে দুপুর? আপু চলে যাচ্ছে বলে কাঁদছো?”
দুপুর আরো কিছুক্ষণ কেঁদে বলল, “হ্যা। কিন্তু শুধু চলে যায়নি, আমাকে তোমার থেকে কেড়ে নিয়ে চলে গেছে নিখিল।”
নিখিল একেবারেই স্তব্ধ! কিছুই বুঝতে পারলো না। অবাক হয়ে বললো, “মানে!”
কাঁদতে কাঁদতে সবকিছু খুলে বললো দুপুর। নিখিল বাকরুদ্ধ হয়ে শুনছে। সব শোনার পর মনেহচ্ছে ওর কথা বলার শক্তি হারিয়ে গেছে। চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে টপটপ করে।
দুপুর বলল,”আমি কি করবো নিখিল? বলো তুমি?”
– “আমি এসে তোমার বাবার পায়ে ধরে তোমাকে চাই?”
– “আমার খুশির জন্য হয়ত বাবা তোমার হাতে তুলে দিতে চাইবে। কিন্তু সবার সম্মানের কথা ভেবে আমার হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে নিখিল। আমি কি করবো এখন তুমিই বলো। প্লিজ নিখিল বলো। আমাকে খুন করে যাও তুমি। আমি পারছি না ভাবতে।”
নিখিল অনেক্ষণ চুপ থেকে বলল, “বিয়ে করে নাও।বাবার সম্মান রক্ষা করো।”
– “নিখিল! তুমি বাঁঁচবা কিভাবে?”
– “ভাগ্যে তুমি ছিলেনা। এটা ভেবেই বাঁচতে হবে আমাকে। ভালো থেকো দুপুর।”
কথাটা বলেই ফোন কেটে দিলো নিখিল। দুপুরের মরে যেতে ইচ্ছে করছে এখন। বাবাকে দুপুর এতটাই ভালোবাসে যে বাবার সম্মানের কথা ভেবে বিয়েটা করতেই হবে। আর নিখিলকে হারিয়ে ফেলতে হবে রোদের জন্য। আপু এত বড় সর্বনাশ টা কেন করলো? কি দোষ ছিলো দুপুরের?
মা এসে ডাকাডাকি করে দরজা খুলতে বাধ্য করলেন। পাত্রপক্ষ বসে আছে, কাজি বসে আছে এসব বলে দুপুরকে বউয়ের সাজে সাজালেন। দুপুরের গাল বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে। মায়ের চোখেও জল বাঁধ মানছে না। দুই মা মেয়ে কাঁদতে কাঁদতে দুপুরকে বিয়ের জন্য প্রস্তুত করালেন।
১২.
মেঘালয় একজন পুলিশ কে ডেকে নিয়ে এসে নিজের পরিচয় দিয়ে বলল, “দৌড়ে এসে গাড়িতে উঠেছি তাই টিকেট করার সময় পাইনি। আমাদের দুটো টিকেট দিলে ভালো হতো।”
পুলিশ জানালেন, “এই কম্পার্টমেন্টে সিট ফাঁকা নেই। সব টিকেট বিক্রি হয়ে গেছে। প্রথম শ্রেণির বগিতে অনেক সিট ফাঁকা আছে। সেখানে চাইলে বসতে পারেন।”
– “পরের স্টেশনে নেমে তাহলে ওখানে যাবো। আপনি একটু দেখিয়ে দেবেন প্লিজ।”
– “শিওর মিস্টার মেঘালয়। আপনাদের সেবার জন্যই আমরা নিয়োজিত।”
– “থ্যাংকস ভাইয়া।”
পুলিশ টি হেসে মেঘালয়কে আপাতত একটা সিটে বসতে বলে চলে গেলেন অন্যদিকে। মেঘালয় এসে মিশুর সামনে বসে পড়লো। মিশু অবাক হয়ে চেয়ে আছে। মেঘালয় জিজ্ঞেস করলো, “কি ভাবছো মিশু?”
– “সারপ্রাইজড আমি।”
– “আমি ধন্য।”
– “তাই নাকি! কেন?”
– “আপনি সারপ্রাইজড হয়েছেন বলে। কেন হয়েছেন?”
– “আমি সারপ্রাইজড হলে আপনি ধন্য হবেন সেজন্য।”
মেঘালয় হেসে উঠলো। মিশুও মুচকি হাসলো। এরপর অনেক্ষণ দুজনেই চুপচাপ। মিশু আশেপাশে তাকিয়ে ট্রেনের ভেতরের পরিবেশ উপভোগ করছে। মেঘালয় বারবার তাকাচ্ছে মিশুর মুগ্ধ চোখের দিকে। এই মেয়েটা যা দেখে, তাতেই মুগ্ধ হয়। মুগ্ধ হবার জন্যই বোধহয় জন্ম হয়েছে ওর!
রাত বেড়ে যাচ্ছে। ট্রেনের যাত্রীগণ ঘুমে ঢলে পড়ছেন একেকজন। দেখতে দেখতে পরের স্টেশনে এসে ট্রেন থামলো। এই বগি থেকে নেমে প্রথম শ্রেনীর একটা বগিতে এসে উঠলো মেঘালয়। মিশুকেও সাথে আসতে হয়েছে। পাশাপাশি দুটো সিট নিয়ে টিকেট কাটলো। তারপর বসে পড়ল নিজেদের সিটে।
মিশু জানালার পাশে বসতে পেরে খুশিতে লাফিয়ে উঠলো। কি যে আনন্দ হচ্ছে ওর। হঠাৎ সামনে তাকিয়ে দেখলো একটা সিটে একটা সুন্দর বেনারসি পড়া লাল টুকটুকে বউ বসে আছে! কি মিষ্টি দেখতে। মিশু মেঘলয়কে বললো, “আমার ওই বউটার সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করছে। একটু যাই?”
মেঘালয় হেসে বললো, “আচ্ছা যাও।”
মিশু উঠে গিয়ে মেয়েটির পাশে বসে বললো, “কিগো বিয়ের কনে, নাম কি গো তোমার?”
– “রৌদ্রময়ী।”
– “বাহ! নামটাও যেমন মিষ্টি, দেখতেও তেমন মিষ্টি। বাড়ি ছেড়ে পালাচ্ছো বুঝি?”
রোদ কিছু বললো না। মিশু ওর পাশে বসে হাত দুটো ধরে বলল, “সরি এমন প্রশ্ন করার জন্য। আমাকে বন্ধু ভাবতে পারো।”
রোদ মৃদু স্বরে বললো, “হুম পালাচ্ছি বাসা থেকে।”
– “প্রিয়জনের কাছে যাচ্ছো বুঝি?”
চমকে উঠলো রৌদ্রময়ী। কি করে যাবে সে? তার তো কোনো প্রিয়জন ই নেই!
মিশু বলল, “নাকি জোর করে বিয়ে দিচ্ছিলো?”
– “থাক না প্লিজ। আমি এসব নিয়ে এখন কথা বলতে আরাম পাচ্ছিনা।”
– “ওহ আচ্ছা। ঠিকাছে আপুটা। তাহলে একটু ঘুমিয়ে নাও, খুব টায়ার্ড মনেহচ্ছে তোমাকে।”
মিশু উঠে গিয়ে নিজের সিটে বসলো। মেঘালয় বললো, “কথা হলো?”
– “হ্যা, মেয়েটার বোধহয় অনেক কষ্ট।”
– “হুম। কষ্ট না হলে কি কেউ এভাবে পালায়?”
মিশু এক পলক মেঘালয়ের দিকে তাকিয়ে বাইরে তাকালো। জানালা দিয়ে সুন্দর বাতাস আসছে, মনটা ফুরফুরে হয়ে উঠছে, আহ! কি শান্তি!
চলবে…