অনুভূতি পর্ব ৭

0
2519

অনুভূতি
পর্ব ৭
মিশু মনি
.
১০.
গভীর রাত।
রেলস্টেশনের ওভারব্রিজ দিয়ে হাঁটছে মেঘালয়। মাঝেমাঝেই এই কাজগুলো করে ও। হুটহাট করে বেড়িয়ে পড়ে বাড়ি থেকে, তারপর যেদিকে ইচ্ছে হয় হাঁটা শুরু করে। রাতের পরিবেশ বড্ড বেশি রোমাঞ্চিত করে মেঘালয়কে। রাতের মধ্যে অন্যরকম একটা ব্যাপার আছে। রাতে সবকিছুই কেমন যেন রহস্যময় হয়ে ধরা দেয়।
ওভারব্রিজ এর উপরে অনেক লোকজন শুয়ে আছে, কিছু বাচ্চা একেবারে খালি গায়ে শুয়ে ঘুমাচ্ছে। এদের দেখলেই মনটা কেমন যেন করে উঠে। কত অসহায় এরা! মেঘালয়ের ইচ্ছে করছে এগিয়ে গিয়ে একটা বাচ্চার গায়ে হাত বুলিয়ে ছুঁয়ে দিতে। একটু মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হয়,সে রাতে খেয়েছে কিনা? এরা দুবেলা ঠিকমত খেতেও পারেনা।
এসব ভাবতে ভাবতে মেঘালয় ওভারব্রিজের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে। চোখ ঘুরিয়ে আশপাশ টা দেখছে। হঠাৎ খেয়াল করে দেখলো সিঁড়ির নীচের ধাপগুলোর দিকে একটা মেয়ে বসে আছে। মাথায় ওড়না দেয়া। পিছন দিকটা দেখে কেমন চেনাচেনা লাগছে। এরকম ওড়না কারো দেখেছিলো ও। কিন্তু এই মাঝরাতে সে স্টেশনে বসে থাকবে কেন? ভেবেই পেলো না মেঘালয়।
কৌতুহলে ভরা চোখ নিয়ে ধীরেধীরে নেমে এলো নীচে। সিঁড়ির নীচের ধাপগুলোর কাছাকাছি এসেই বুঝতে পারলো এটা আর কেউ নয়, এটা সেই বাচ্চা স্বভাবের মিশু নামের মেয়েটা। মেঘালয় বেশ কিছুক্ষণ অবাক হয়ে চেয়ে রইলো মিশুর দিকে। পিছনে মেঘলয় এসে দাঁড়িয়েছে মিশু সেটা খেয়াল করেনি। মেয়েটা সামনে ই চেয়ে আছে আর গভীর ভাবে কিছু একটা ভাবছে।
মেঘালয় এগিয়ে এসে সিঁড়িতে মিশুর পাশে বসে পড়লো। মিশু এক পলক ওর দিকে তাকিয়েই বিস্ময়ে চোখ বড়বড় করে ফেললো। মেঘালয়ের চোখেও বিস্ময়! এত রাতে এই মেয়েটা রেলস্টেশনে গালে হাত দিয়ে বসে আছে, কত রকমের বিপদ ঘটতেও পারে। কিন্তু সে নির্বিকার চাহনিতে চেয়ে আছে সামনের দিকে। ভাবতেই অবাক লাগে!
মিশু বললো, “আপনি খুব সুন্দর করে গান গাইতে পারেন।”
– “সেটা আমিও জানি। এত রাতে তুমি এখানে কেন?”
– “এত রাত আর কোথায় হলো? সবেমাত্র রাত সাড়ে এগারো টা।”
– “এটা কি সন্ধ্যাবেলা মনেহচ্ছে? তুমি এখানে কেন?”
– “আম্মু অসুস্থ হয়ে পড়েছে তাই বাসায় পাঠিয়ে দিয়েছি। ওদেরকেই ট্রেনে তুলে দিতে এসেছিলাম।”
– “সেকি! তোমার আম্মুও অসুস্থ! কি হয়েছে ওনার?”
– “কিডনিতে সমস্যা দেখা দিয়েছে। আর আম্মুর জণ্ডিসের দিকেও যাচ্ছিলো। তাই গ্রামে যেতে চাচ্ছিলো।”
– “চলে গেছেন ওনারা?”
– “হ্যা, ওদেরকে বিদায় দিয়ে আমি এখানে বসে আছি। আমার আর বাসায় যেতে ইচ্ছে করছে না।”
– “তোমার মায়ের সাথে আর কে আছেন?”
– “ছোটবোন।”
– “আচ্ছা বেশ।”
মেঘলয়ের চেহারায় চিন্তার ছাপ পড়েছে। মিশুর দিকে তাকিয়ে দেখলো ওর মুখ দিব্যি হাসিহাসি। মেঘালয় জিজ্ঞাস করলো, “তোমার খারাপ লাগছে না?”
– “একটু লেগেছিলো। মানিয়ে নিয়েছি।”
– “কি বলে মানিয়ে নাও নিজেকে?”
– “এইযে স্টেশনে কত কত লোক এভাবে পড়ে পড়ে ঘুমাচ্ছে, বাচ্চাদের গায়ে জামাও নেই। কি করুণ চেহারা ওদের, ঠিকমত খেতেও পারেনা। আমি শুধু নিজের দিকে তাকাই আর ভাবি, ওদের চেয়ে আমিতো কত্ত ভালো আছি। তাহলে কেন সামান্য কিছু দুঃখে মন খারাপ করে বসে থাকবো”
মেঘালয় মিশুর এই উক্তিতে একেবারে অবাক হয়ে গেলো। মুগ্ধ দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো মিশুর দিকে। ছোট্ট একটা মেয়ে, অথচ কত গভীর চিন্তা ভাবনা! এরকম কেন এই মেয়েটা! সত্যিই অদ্ভুত!
মিশু জিজ্ঞেস করলো, “আপনি কোথাও যাচ্ছেন?”
– “না, আমি মাঝেমাঝে এরকম বাইরে বের হয়ে হাঁটি। রাত আমাকে মোহিত করে তার সৌন্দর্য দিয়ে।”
– “আমার ও রাত প্রিয় অনেক। রাত কত স্তব্ধ, কত নির্জন, কত রহস্যময় তাইনা?”
– “হুম। এ জন্যই রাতকে আমার ও এত বেশি ভালো লাগে। এনিওয়ে মিশু, মুখটা খুব শুকনা শুকনা লাগছে। বসো, চা নিয়ে আসি।”
মেঘালয় উঠে গিয়ে দুকাপ চা নিয়ে এসে আবারো মিশুর পাশে বসে পড়লো। মিশু মুগ্ধ হচ্ছে এটা ভেবেই যে, এরকম বড় একজন মানুষ এত অনায়াসে, এত নিঃসংকোচে কিভাবে মিশতে পারেন! বড্ড মুগ্ধ হতে ইচ্ছে করে।
মেঘালয় চায়ের কাপ এগিয়ে দিলো। মিশু চা নিয়ে ধন্যবাদ জানিয়ে চায়ে চুমুক দিলো। মেঘালয় বললো, “কি ভাবছো মিশু?”
মিশু রেললাইনের দিকে চেয়ে আছে। ট্রেন এসে দাঁড়িয়ে আছে স্টেশনে। যাত্রীরা ব্যস্ত হয়ে ছুটাছুটি করছে। কেউ কেউ নামছে, কেউ উঠছে। কত সুন্দর একটা দৃশ্য! মিশুর ও খুব ইচ্ছে করছে একবার ট্রেনে উঠে লম্বা একটা জার্নি দিতে। কিন্তু সকালেই অফিস আছে, আবারো সকাল দশটা থেকে রাত দশটা অব্দি ডিউটি। জীবন টাকে নিজের মত করে উপভোগ করার কোনো সুযোগ ই যে নেই।
মেঘালয় জানতে চাইলো কি হয়েছে? মিশু জবাব দিলো, “আমার খুব ট্রেন জার্নি করতে ইচ্ছে করছে।”
– “কোথাও ঘুরে আসো ট্রেনে করে।”
– “কিন্তু আমার লাইফটা তো ব্যস্ততায় ঢাকা। ঢাকা শহরের ব্যস্ততায় ঢাকা হলে কি অবস্থা হয় জানেন ই তো। সকালে ডিউটি আছে।”
– “আমি তো তোমাকে একটা অফিসের এড্রেস দিয়েছি। সেখানে চাকরী কনফার্ম। তুমি শুধু গিয়ে ইন্টার্ভিউ দিয়ে, এপোয়েন্টমেন্ট লেটার নিয়ে আসবে।”
মিশু একবার তাকালো মেঘালয়ের দিকে। এটার কথা ওর মনেই ছিলোনা। বেশ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো ওর চোখ। চোখের মণি ঝিকমিক করে উঠলো।
মিশু বলল, “আজ তো বাসায় যাওয়ার তাড়া নেই। আমি তাহলে আজই ট্রেনে করে কোথাও ঘুরে আসি।”
মেঘালয় হেসে বললো, “আচ্ছা যাও। হুটহাট করে কোথাও যাওয়ার মজাই আলাদা।”
মিশু এক চুমুকে সবটুকু চা শেষ করে দ্রুত উঠে পড়লো। তারপর এগিয়ে গেলো ট্রেনের দিকে। মেঘালয় উঠে দাঁড়িয়েছে। মিশু একবার ওর দিকে তাকিয়ে বললো, “যাই ঘুরে আসি। ট্রেন যেখানে যাবে, সেখানেই যাবো।”
মেঘালয় হেসে হাত নেড়ে বিদায় জানালো। মিশু ছুটে গিয়ে টেনে উঠে পড়লো। ব্যাপার টা চমকানোর মতই ছিলো। এত রাতে একা একটা মেয়ে স্টেশনে একা একা গালে হাত দিয়ে বসে আছে, আবার ইচ্ছে হতেই ছুটে গিয়ে ট্রেনে উঠলো। এমন মেয়েও এ পৃথিবীতে আছে! ভারী অদ্ভুত!
মিশু ট্রেনে উঠে দাঁড়িয়ে আছে। টিকেট কাটা হয়নি,কাজেই সিট পাওয়ার প্রশ্নও আসেনা। গাড়িতে প্রচণ্ড রকমের ভিড়। সকলেই গাদাগাদি করে দাঁড়িয়ে আছেন। অবশ্য যে যার সিটে বসে পড়লেই গাড়িটা ফাঁকাফাঁকা লাগবে। মিশু চুপচাপ একটা সিটের উপরে হাত রেখে দাঁড়িয়ে রইলো। জানালার ফাঁক দিয়ে দেখার চেষ্টা করলো মেঘালয়কে দেখতে পাওয়া যায় কিনা। কিন্তু ওকে দেখা যাচ্ছেনা।
গাড়ি হুইসেল বাজিয়ে চলতে আরম্ভ করে দিয়েছে। মিশু দরজার দিকে তাকাতেই অবাক হয়ে দেখলো মেঘালয় ও ছুটে এসে গাড়িতে লাফিয়ে উঠে পড়লো। মিশু এগিয়ে এসে বিস্ময়ের ঘোরেই বললো,”এভাবে ছুটে এলেন যে! আপনার ও বুঝি ট্রেনে চড়তে ইচ্ছে করছে?”
– “হুম, হঠাৎ ই ইচ্ছে করে বসলো। আর আমার কিছু ইচ্ছে হলে আমি সেটা করেই ফেলি।”
মিশু হেসে বললো, “আমিও খানিকটা এরকম পাগলী পাগলী। যখন যা ইচ্ছে হয়,কিছু না ভেবেই করে ফেলি। জানেন, একদিন রাস্তা দিয়ে হেঁটে হেঁটে প্রাইভেটে যাচ্ছিলাম। সাথে ছিলো আমার চারজন বন্ধু। রাস্তার পাশেই রেলওয়ে স্টেশন। কিন্তু আমরা যেখানে আছি,সেখান থেকে গিয়ে ট্রেনে উঠতে চাইলে কমপক্ষে পাঁচ মিনিট দৌড়াতে হবে। তবুও সম্ভব কিনা সন্দেহ। তো, আমার এক বন্ধু আমাকে বললো, “ট্রেন কিছুক্ষণের মধ্যেই ছেড়ে দিবে। এখন ছুটে গিয়ে উঠা সম্ভব?” আমি উত্তরে বললাম, “হ্যা সম্ভব।” এরপর দু একটা কথায় রীতিমত ওরা আমাকে চ্যালেঞ্জ জানালো। আমি আর কিছুই না ভেবে ছুটা আরম্ভ করে দিলাম। উসাইন বোল্টের মত গতিতে দৌড়েছি বোধহয় কারণ আমি দ্রুতই স্টেশনে পৌছে গেলাম।কিন্তু ট্রেন ছেড়ে দিয়েছে। আস্তে আস্তে সেটা চলতেও আরম্ভ করেছে। আমি অনেক দ্রুত দৌড়াচ্ছিলাম। লোকজন শুধু চেঁচাচ্ছিল আমাকে দেখে। কেউ কেউ বলছিল,এই মেয়ে ট্রেনে উঠতে পারবে না। পড়ে যাবে, ইত্যাদি ইত্যাদি সব কথাবার্তা। ট্রেনে খুব জোড়েই ছেড়ে দিয়েছে। আমি চলন্ত ট্রেনে গিয়ে উঠে পড়লাম। কি যে থ্রিলিং ছিলো ব্যাপার টা!”
কথা শেষ করতে করতেই মিশু রীতিমত হাঁফাচ্ছিলো। মেঘালয় মুগ্ধ হয়ে চেয়ে আছে। মনেমনে ভাবছে, “আমার মতই পাগলাটে স্বভাবের মেয়েটা। এমন রিস্কি কাজও কেউ করে!”
মিশু হাসছে আর বারবার মেঘালয়ের দিকে তাকাচ্ছে। মেঘালয় বললো, “কোথায় যাবে এখন?”
– “ট্রেন যতদূর নিয়ে যাবে।”
– “আচ্ছা বেশ। আজ বোধহয় খুব টাকা পয়সা নিয়ে বেড়িয়েছো?
মিশু মুখ বাঁকা করে হেসে বললো, “না। মানে আজ বেতন পেয়েছি তো।”
– “আচ্ছা। আজ তোমার অফিসে আমি যেতেও পারিনি, ক্লাস শেষে ফ্রেন্ডরা মিলে ঘুরতে গিয়েছিলাম। আজ কিছু কেনাকাটা করা হয়নি। সে যাই হোক, এখন চলো বসে পড়ি।”
– “টিকেট তো কাটিনি। কোথায় বসবো?”
মেঘালয় আশেপাশে তাকিয়ে একটা সিট দেখিয়ে দিয়ে বললো, “আপাতত এখানে বসো। এরপর দেখি কি করা যায়।”
মিশু একবার মেঘালয়ের দিকে তাকিয়ে সিটে গিয়ে বসলো। এই লোকটা সত্যিই একটু অন্যরকম! যাক, ট্রেন জার্নিটাও তবে বেশ অন্যরকম হবে!
চলবে..

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে