অনুভূতি
পর্ব ৫
মিশু মনি
.
৮.
সকালবেলা ঘুম ভেঙে গেলো মেঘালয়ের। ঘুম থেকে উঠে বিছানার উপর বসলো। মনে পড়ে গেলো স্বপ্নের কথা। আজ রাতেও একটা স্বপ্ন দেখেছে ও। আগের দুদিনের মতই তবে আজকে একটু ভিন্নতা ছিলো। আজ দেখলো, মেয়েটি খুব কাঁদছে, তার চোখের জলে সমুদ্র হয়ে যাচ্ছে। জল দিয়েই সমুদ্র! এত কাঁদছিল কেন মেয়েটা! বারবার কাঁদছে আর মেঘালয়ের দিকে তাকাচ্ছে। যেন খুব করে চাইছে মেঘালয় ওর চোখ মুছে দিক। তারপর আবার উঠে সমুদ্রের তীর ধরে হাঁটা শুরু করেছে। একই স্বপ্ন পরপর তিনদিন দেখার মানেটা বুঝতে পারছে না ও।
মেঘালয় গালে হাত দিয়ে চিন্তা করতে লাগলো। যখন কিছুই ভেবে পাচ্ছিলো না, তখন উঠে দাঁড়ালো। বাইরে যাওয়া যাক। তাড়াতাড়ি হাত মুখ ধুয়ে পোশাক বদলে বাইরে বেড়িয়ে পড়লো।
ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো সকাল সারে দশটা। এখন ওর কোনো কাজ নেই। কি করা যায় তাহলে? কোথাও যেতেও ইচ্ছে করছে না। মনটা কেমন যেন হয়ে আছে। খুব বিক্ষিপ্ত লাগছে। হঠাৎ মনে পড়লো একবার সুপার শপে যাওয়া যায়। মিশুর বোনের শরীর কেমন হলো সেটাও জেনে নেয়া দরকার আর কিছু কেনাকাটা ও সেরে ফেলতে হবে। শপে ঢুকতেই মিশুর সাথে চোখাচোখি হয়ে গেলো। মিশু খুব মায়াবী গড়নের একটা হাসি দিলো।
মেঘালয় এগিয়ে গিয়ে বলল, “ছোটবোনের শরীর কেমন এখন?”
– “ওষুধ খেয়েই অনেক টা সুস্থ হয়ে গেছে। এখন বেশ ভালো আছে। আপনার কাছে কৃতজ্ঞ থাকবো আমি।”
মেঘালয় মাথা ঝাঁকিয়ে বললো, “বেশ। এখন কিছু কেনাকাটা করা দরকার। পিংক ল্যাকমি লিপস্টিক আর লাল ম্যাট লিপস্টিক দিন তো।”
মিশু ওর কথামত লিপস্টিক নিয়ে এসে রাখলো। মেঘালয় প্যানকেক ও দিতে বললো একটা।আর কোনো কিছুর নাম ওর মনে নেই। তাই রোদেলার নাম্বারে ফোন দিয়ে শুনে নিলো সানস্ক্রিন কোন ব্রান্ডের নিতে হবে? জিনিস গুলো প্যাকেটে নিয়ে বিল মিটিয়ে বাইরে চলে এলো মেঘালয়। আজ দশ মিনিটেই কেনাকাটা হয়ে গেলো! কিন্তু মিশুর সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে খুব যে ইচ্ছে হয়। ওর সাথে কথা বলতেও মন টানে। কিন্তু এভাবে তো আর কারণ ছাড়া কথাও বলা যায়না।
মেঘালয় আরেকবার ভিতরে ঢুকে মিশুকে গিয়ে বলল, “আপনার ছুটি কি বার থাকে?”
– “আমাদের কোনো ছুটি নেই। মাসে চারদিন ছুটি নিতে পারি কিন্তু আমি নেইনা।”
মেঘালয়ের মনটা খুব খারাপ হয়ে গেলো। মাত্র সাত হাজার টাকার জন্য ১২ ঘন্টা দাঁড়িয়ে থাকে মেয়েটা। তাও আবার সাপ্তাহিক কোনো ছুটিও নেই! সূর্যের আলো দেখার সুযোগ টাও বোধহয় পায়না সে। ওর জন্য একটা কাজের ব্যবস্থা করতেই হবে।
বাইরে এসে কয়েকজন কে কল দিয়ে খোজ খবর নিলো কোথাও সেরকম সুযোগ আছে কিনা। কিন্তু কেউই সেরকম বলতে পারলো না। ভার্সিটিতে না গিয়ে সোজা ওর বাবার অফিসে চলে আসলো মেঘালয়। ওর মুখ থেকে মিশুর অবস্থার কথা শুনে বাবা কি বলবেন বুঝতে পারলেন না। এখন কোনো লোক অফিসে নিয়োগ দেয়া হচ্ছেনা, তাছাড়া গ্রাজুয়েট ছাড়া কাউকে নেয়ার সুযোগ ও নেই। মিশু তো সবেমাত্র উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করলো, ওকে কি চাকরী দেবেন উনি! কিন্তু মেঘালয়ের অনুরোধ রাখলে ছেলেটা অনেক খুশি হবে। অনেক ভেবেচিন্তে বাবা বললেন, “আমার একজন অফিসের কাজে সহযোগিতা করার জন্য কাউকে দরকার। এসিস্ট্যান্ট এর চাকরী দিলে পারবে সে?”
– “পারবে আব্বু। শুধু কাজের চাপ একটু কম দিও। আর বাচ্চামেয়ে তো, একটু মানিয়ে নিও তুমি।”
বাবা হেসে বললেন, “আচ্ছা সে দেখা যাবে। বেতন কিন্তু বারো হাজার দিবো।”
– “ওর জন্য এটাই অনেক আব্বু। মাত্র সাত হাজার টাকায় ১২ ঘন্টা ডিউটি করে ও।”
– “আচ্ছা, এখানে ১০ টা থেকে বিকাল ৫ টা অব্দি থাকলেই হবে।”
মেঘালয় খুশিতে ওর আব্বুকে জড়িয়ে ধরলো। সবসময় আব্বু ওর ইচ্ছে গুলো পূরণ করে দেন। এখন মিশুকে এই খুশির কথাটা জানাতে হবে।
মেঘালয় শপিং ব্যাগটা আব্বুর কাছে দিয়ে আবারো সুপার শপে চলে গেলো। কিন্তু গিয়ে দেখল মিশু নেই। ঘন্টা খানেক আগেই তো এখানে ছিলো মেয়েটা! বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর ও মিশুকে পাওয়া গেলো না। মন খারাপ করে বেড়িয়ে এলো ও। মিশুর বোন বোধহয় অসুস্থ হয়ে পড়েছে তাই মিশু বাসায় চলে গেছে হয়ত। দোকানে কাউকে কিছু জিজ্ঞেস করলে কি যে ভাবে! কিছু জিজ্ঞেস করাও যায়না।
কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করার পর ওর ইচ্ছে করলো একবার মিশুর বাসায় চলে যেতে। এই ভালো খবর টা ওকে জানাতেই হবে তো। আর সে চাইলে কালই জয়েন করতে পারে এটাও ওকে বলা দরকার। কিন্তু মেয়েটা বাসায় গেছে কিনা সেটাও তো জানেনা মেঘালয়। আজ কোথাও যাওয়ার ইচ্ছে নেই। কিছুই ভালো লাগছে না।।এর কারণটাও ধরা যাচ্ছেনা। বোধহয় সেই স্বপ্নটা!
পায়ে হেঁটে অনেকদূর আসার পর মেঘালয় দেখতে পেলো রাস্তার পাশে মিশু দাঁড়িয়ে রাস্তার দিকে চেয়ে আছে। খুবই মলিন মুখ আর বিষন্ন দেখাচ্ছে। যেন কোনো কঠিন অসুখ বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে ও। মেঘালয়ের ডাক শুনে চকিতে ফিরে তাকালো মিশু।
মেঘালয় বলল, “এখানে কেন তুমি? ডিউটি ছেড়ে এখানে কি করছো? আমি গিয়ে তোমাকে পেলাম না।”
– “শরীর টা ভালো লাগছিলো না। তাই ছুটি নিলাম আজ। এর আগে কখনো ছুটি নেইনি। আপনার কথা শোনার পর নিতে ইচ্ছে করলো।”
– “কোথায় যাবে এখন?”
– “জানিনা, আমার খুব ঘুরতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু কোথায় যাবো একা একা,আর হাতও খালি একদম। তাই রোদে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে রাস্তার সৌন্দর্য উপভোগ করছি।”
– “আর আমি ছটফট করছি।”
– “কেন?”
– “তোমাকে দোকানে গিয়ে খুঁজলাম। একটা ভালো খবর দেয়ার আছে।”
– “বলুন।”
মেঘালয় বলল, “ভালো খবর এভাবে দেয়া যাবে না। এক জায়গায় যেতে হবে।”
মিশু অবাক হয়ে বলল, “ভালো খবর দিতে চাইলে এক জায়গায় গিয়ে দিতে হবে?”
– “হ্যা, ভালো খবর ভালো জায়গায় দিতে হয়।”
মিশু একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, “চলুন তাহলে।”
মেঘালয় ওকে নিয়ে লোকাল বাসে উঠে পড়লো। বাসায় গাড়ি থাকা সত্ত্বেও গাড়ি নিয়ে বের হয়না ও। সাধারণ মানুষ দের মত চলাফেরা করতেই ভালো লাগে। বাসে উঠতেই কিছুক্ষণ পর দুইটা সিট ফাঁকা হয়ে গেলো। জানালার পাশের সিটে বসলো মিশু। মেঘালয় ওর পাশেই বসলো। মিশু উৎসুক চোখে বাইরে তাকাচ্ছে আর অবাক হচ্ছে কিছু না কিছু দেখে। ওর মনটা ভালো হয়ে গেছে। ইস! হাসলে কত সুন্দর দেখায় মেয়েটাকে! ও বোধহয় জার্নি খুব ভালোবাসে। ইচ্ছে করছে ওকে নিয়ে দূরে কোথাও বেড়াতে যেতে। মেয়েটা যাই দেখবে শুধু অবাক হবে, ভালো লাগবে খুব।
চিন্তাটা মাথায় আসতেই মাথা চুলকে ভাবতে লাগলো মেঘালয়। বেশ কয়েকদিন ধরেই বন্ধুরা বলছিল কোথাও ট্যুরে যাওয়ার কথা। দশ বারো জন বন্ধু বান্ধবী গেলে মিশুকে বললে সেও যেতে পারে। ট্রাভেলিং করতে কে না ভালোবাসে?
মেঘালয় বলল, “আচ্ছা মিশু তুমি ট্রাভেলিং ভালোবাসো?”
– “হ্যা খুব ভালোবাসি। কেন?”
– “আমরা দশ জন বন্ধু বান্ধবী মিলে ট্যুরে যাচ্ছি।তুমি কি যাবা আমাদের সাথে? গেলে তোমার মনটা ভালো হয়ে যাবে।”
মিশু বেশ উৎফুল্ল হয়ে বলল, “হ্যা আমি যাবো। অবশ্যই যাবো। কবে যাবেন?”
ওর খুশি দেখে মন ভরে গেলো মেঘালয়ের। হেসে বলল, “খুব শীঘ্রই যাচ্ছি। প্রিপারেশন নাও।”
এবার মিশুর মুখে মেঘ নেমে এলো। মুখটা কালো করে বলল, “না থাক যাবো না।”
– “কেন?”
– “আমার টাকা নেই এখন হাতে।”
– “আমার কাছে ধার নিও,এসে ফেরত দিয়ে দিও।”
মিশু মুখ কাচুমাচু করে বলল, “এমনি তেই আপনি দুই হাজার টাকা পাবেন আমার কাছ থেকে।”
– “ধুর বাদ দাও তো। তুমি যাচ্ছো। আমি আমার বন্ধুদের কনফার্ম করে দিচ্ছি।”
মিশুর মনটা আনন্দে ভরে গেলো। কিন্তু চাকরী তে তো তিনদিন ছুটি নিতে হবে তাহলে। ছুটি নিলে মাস শেষে বোনাস টা আর পাওয়া যাবেনা। সেটাও চিন্তা হচ্ছে,ঘুরতে যেতেও ইচ্ছে করছে। কি করা যায় ভাবতে লাগলো ও। হঠাৎ ও খেয়াল করলো, মেঘালয় যে সিটে বসেছে তার সামনের সিটের পিছনে হাত রেখেছে। হাত ঘেমে গেছে বেশ। কিন্তু হাতে এত সুন্দর ঘনঘন লোম! ঘর্মাক্ত হাতটাকেই মনেহচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সৌন্দর্য!
মেঘালয়ের হাতের দিকে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলো কিছুক্ষণ। তারপর মিশুর চোখ চলে গেলো মেঘালয়ের কপালে। কপাল টাও ঘেমে গেছে। কপালের দিকের চুলগুলো দেখেও কেমন যেন ফিল কাজ করছে ভেতরে। মনেহচ্ছে মেঘালয়ের সমস্ত শরীরেই এমন সৌন্দর্য! এমন বাহ্যিক জিনিস গুলো দেখেও এত ভালো লাগছে কেন বুঝতে পারছে না মিশু।
মেঘালয় মিশুকে বাস থেকে নামতে বললে নেমে পড়লো ও। তারপর দেখল পিছনে স্টার কাবাব রেস্টুরেন্ট! এই রেস্টুরেন্টটা নাকি মোহম্মদপুরের সবচেয়ে বিখ্যাত গুলোর একটি। এখানে কেন নিয়ে এলো মেঘালয়!
মিশু মেঘালয়কে অনুসরণ করে ভিতরে গিয়ে বসলো। মেঘালয় ওর বন্ধুদের সাথে ফোনে কথা বলে এসে খাবার অর্ডার করলো। মিশু চুপচাপ বসে এদিক সেদিক তাকাচ্ছে।
মেঘালয় এসে বসতে বসতে বলল, “আমরা আগামী পরশু যাচ্ছি। দুদিনের ট্যুর।”
মিশু অবাক হয়ে বলল, “পরশু! একটা প্রস্তুতির ব্যাপার আছে না?”
– “দেরি করা যাবেনা। এসেই তোমাকে আবার চাকরী তে জয়েন করতে হবে।”
– “মানে!”
মেঘালয় খুব সুন্দর ভাবে মিশুকে বুঝিয়ে বলল চাকরীর ব্যাপার টা। সব শুনে মিশুর চোখে পানি এসে গেছে। অচেনা একটা মানুষ ওকে নিয়ে এত কিছু ভেবেছে! কত উপকার করলো মানুষ টা, আবার ট্যুরেও নিয়ে যেতে চাইছে। দেবদূত হয়ে এসেছেন উনি!
মিশুর মুগ্ধ চাহনি খুব ভালো লাগলো মেঘালয়ের। মেয়েটা খুশি হলেও সুন্দর লাগে, মুগ্ধ হলে আরো বেশি সুন্দর লাগে! এখন থেকে বেশী বেশী সারপ্রাইজ দিয়ে ওকে মুগ্ধ করে দিতে হবে! তাহলে অন্তত এই সুন্দর চাহনি টা উপভোগ করা যাবে।
খাবার চলে এলো কিন্তু মিশু কিছুই খেতে পারলো না। ওর সবকিছু স্বপ্নের মত লাগছে! কাল থেকে আর মার্কে টে ডিউটি তে যেতে হবেনা। বিকেলে একটা সিভি নিয়ে মেঘালয়ের বাবার অফিসে গিয়ে ওনার সাথে দেখা করতে হবে। ট্যুর থেকে ঘুরে এসে তারপর চাকরী তে জয়েন!
মিশুর গাল বেয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে। অন্য কোনো লোক হলে মিশুর এত ভালো লাগত না। ট্যুরে যেতে বললেও সে যেতো না। কিন্তু মেঘালয়ের মানবতা, বিবেকবোধ, সম্মানবোধ সবকিছু এত বেশী সুন্দর যে, ওকে সন্দেহ করলে অন্যায় হয়ে যাবে। ছেলেটা দেবতাসুলভ একদম!
মিশু কাঁদছে আর মেঘালয় মুখ টিপে হাসছে। এই মুগ্ধ কান্নাটাও অসম্ভব সুন্দর লাগছে ওর। এত সুন্দর করে কেউ কাঁদতে পারে! জানা ছিলোনা মেঘালয়ের। আজ মিশুর নতুন নতুন রূপ ধরা দিচ্ছে ওর কাছে।
চলবে..