অনুভূতি পর্ব ৪৫

0
1900

অনুভূতি
পর্ব ৪৫
মিশু মনি
.
৭১.
রৌদ্রময়ী দুহাত দুদিকে মেলে দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মেঘ উড়ে এসে ওর শরীর স্পর্শ করে চলে গেলো। কি সুখ সুখ অনুভূতি!
পূর্ব বললো, “তোমাকে আজ আকাশের মতই লাগছে রোদ।”
পূর্ব’র কথা শুনে রোদ ওর দিকে ফিরে তাকালো। মুচকি হাসি ফুটে উঠলো ওর মুখে। ধীরেধীরে সকালের শুভ্রতা ছড়িয়ে পড়েছে। চারদিকে কুয়াশার মতন মেঘ ছড়িয়ে আছে। অন্যরকম একটা পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে এখানে। মিশু ও মেঘালয় এখনো একে অপরকে জড়িয়ে ধরেই আছে। এদিকে নিখিল ও দুপুর একসাথে দাঁড়িয়ে মুগ্ধ হয়ে আকাশের দিকে চেয়ে আছে। আকাশটা খুব বিশাল লাগছে এখান থেকে। মনেহচ্ছে পুরো পৃথিবীটাকেই দেখতে পাচ্ছে ওরা।
একটু আগেও এখানে ছিলো শুধুই মেঘের ছড়াছড়ি। সবকিছু ঝাপসা হয়ে গিয়েছিলো। অথচ খানিক বাদেই সমস্তটা একদম পরিষ্কার হয়ে গেলো।একদিকে মিজোরাম রাজ্য,একদিকে দীঘিনালা, আর পাহাড়ের চূড়া সবটাই স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। পাহাড়ের ভাঁজে ভাঁজে মেঘ জমে আছে। আস্তে আস্তে সূর্য উদিত হচ্ছে। মুগ্ধ হয়ে সবাই সূর্যাস্ত উপভোগ করলো। এরপর একসাথে বসে সকালের নাস্তা সেরে নিলো। ছেলেরা ওদের পিঠের ব্যাগে করে নাস্তা আর পানি বয়ে নিয়ে এসেছে। কারণ নাস্তা করতে দেরি হয়ে গেলে আর সূর্যোদয় দেখা হতোনা। আর এখান থেকে নেমে যেতেও অনেক দেরি হবে। কাজেই নাস্তা ব্যাগে করেই নিয়ে আসতে হয়েছে। নাস্তার পর একসাথে বসে কিছুক্ষণ আড্ডা চললো। সকালের স্নিগ্ধতা ছড়িয়ে পড়েছে। সূর্যের রঙিন আলোকরশ্মি এসে পড়েছে গায়ের উপর,পাহাড়ের চূড়ায় চূড়ায়।এক অন্যরকম ভালোলাগা ছেয়ে যাচ্ছে।
সায়ান ও আরাফ বললো, “তোমরা সবাই এখানে এনজয় করো। আমরা কংলাক ঝরনা দেখে আসি। ঝরনায় কিছুক্ষণ সময় কাটিয়ে স্নান সেরে আসবো।”
মিশু মেঘালয়ের দিকে তাকিয়ে বললো, “এই আমরা ঝরনায় যাবোনা?”
মেঘালয় বললো, “ঝরনায় যেতে হলে পাহাড়ের ঢালে নামতে হবে মিশু সোনা। অনেক দূর্গম পথ। এখানে উপরে যেমন দেখছো,তার একদম ভিন্ন। পুরো পথটাই বন্য জংগলে ঢাকা। তুমি ওই ঘন জংগল পেড়িয়ে যেতে পারবা?”
মিশু আত্মবিশ্বাসী স্বরে বললো, “আমি পারবো। চলোনা প্লিজ যাই।”
মেঘালয় হেসে বললো, “একদম পাহাড়ি লতা আর প্রাচীন বৃক্ষে ঢাকা পুরো পথটা। অনেক কষ্ট হবে তোমার। সায়ান আর আরাফ যাক,আমরা বরং লুসাই দের সাথে কথা বলে আসি।”
মিশু মুখটা করুণ করে বললো, “লুসাইদের সাথে কথা বলে ঝরনায় যাওয়া যাবেনা?”
– “আজকে থাক না, ঝিরিপথ দিয়ে যেতে হবে। আমি চাইনা অত কঠিন ট্রেইল করে খুব বেশি টায়ার্ড হয়ে পড়ো। তারপর আমাদের মধুচন্দ্রিমা…”
সবাই মুখ টিপে হাসলো মেঘালয়ের কথা শুনে। মিশু মুখটা ছোট্ট একটু করে তাকিয়ে আছে। মেঘালয় বললো, “ঝিরিপথটা অনেক দূর্গম। পাহাড়ি জংগল আর অনেক প্রাচীন বৃক্ষ দিয়ে ঢাকা রাস্তাটা। এই ট্রেইলে ট্রেকিং করে আসার পর রাতে নাক ডেকে ঘুমোবে তুমি। তখন আর একদম ই মজা হবেনা। আজকে রাতে আমরা সারারাত পার্টি করবো, বারবিকিউ হবে। কত মজা হবে ভাবতে পারো?”
মিশু তবুও মুখটা ছোট্ট একটু করেই আছে। ওর এখন খুব করে ঝরনায় যেতে ইচ্ছে করছে। মেঘালয় বললো, “পাগলি, এত মন খারাপ করোনা। আরেকবার এসে নিয়ে যাবো তোমায়। আজকে তোমাকে নতুন নতুন কিছু জিনিস দেখিয়ে আনি চলো।”
মিশু কিছু বললো না। মেঘালয় ওর মুখ দেখে বুঝতে পারছে ও ঝরনা দেখতে যাবেই। তার উপর প্রাচীন বৃক্ষ আর লতাপাতার কথা শুনেছে। ওর এখন ঝরনায় যাওয়ার ইচ্ছেটা আরো বেড়ে গেছে। মুখটা করুণ করে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। মেঘালয় হেসে ফেললো ওর মুখ দেখে।
সায়ান বললো, “তুই আর মিশুও চল আমাদের সাথে।”
মেঘালয় একটু কি যেন ভেবে বললো, “আচ্ছা ঠিক আছে। ওঠো মিশু,”
মিশু আনন্দে লাফিয়ে উঠে মেঘালয়ের গলা জড়িয়ে ধরলো। ছোট্ট বাচ্চারা আনন্দে যেমন লাফায়,সেরকম লাফাতে লাগলো। ওরা আর কিছুক্ষণ এখানে থাকার পর কংলাক ঝরনায় যাওয়ার উদ্দেশ্যে বিদায় নিলো সবার কাছ থেকে। নিখিল, দুপুর আর রোদ ও পূর্ব এখানেই থেকে গেলো। ওরা নেমে যাওয়ার পর নিখিল ও দুপুরও নিজেদের মত রোদের কাছ থেকে সরে আসলো। রোদ ও পূর্ব দুজনে বসে রইলো একে অপরের পিঠে হেলান দিয়ে। আরো একবার মেঘ এসে ওদের ছুঁয়ে দিয়ে গেলো।
নিখিল ও দুপুর হাত ধরাধরি করে আস্তে আস্তে পাহাড় থেকে নিচে নেমে এলো। ওরা আশেপাশের পরিবেশ দেখতে দেখতে কটেজের দিকে যেতে লাগলো।
৭২.
একরাতের জন্য কটেজ ভাড়া নেয়া হয়েছিলো। আজকে ওরা ক্লাব হাউজে থাকার অনুমতি নিয়েছে। ক্লাব হাউজের সামনে ফাঁকা জায়গাটায় তিনটা তাবুও টাঙিয়ে ফেলেছে। রাতে এই ফাঁকা জায়গায় একটু গান বাজনা আর আড্ডা হবে। ক্লাব হাউজের কেয়ারটেকার মইয়া লুসাই দাদা রান্নার ব্যবস্থা করে দিবেন। মেঘালয় ও সায়ান নিজ হাতে বারবিকিউ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। রাতে তাহলে বেশ মজাই হবে মনেহচ্ছে।
বুনো পরিবেশ আর পাথুরে পথে ট্রেকিং করে এসেও মিশুকে একটুও ক্লান্ত দেখাচ্ছে না। বরং দিব্যি ছুটোছুটি করে তাবু টাঙাতে সাহায্য করলো। বিকেলটা যে যার মত করে কাটিয়ে এসেছে। মেঘালয় মিশুকে নিয়ে লুসাইদের গ্রামে গিয়েছিলো। ওদের ঘরবাড়ি দেখতে দেখতে উৎফুল্ল হয়ে উঠেছিলো মিশু। লুসাইরা পাহাড়ে জুম চাষ করে,কি কি চাষ করে,কিভাবে করে সবই শুনে নিয়েছে। ওর খুব মজা লাগছিলো ওদের গ্রামে ঘুরতে। মানুষ গুলো খুবই ভালো আর মিশুক মনে হয়েছে। বাচ্চাগুলো চেয়ে চেয়ে দেখছিলো ওদের দিকে। মিশু দুটো বাচ্চাকে কোলে নিয়ে আদর ও করে দিয়েছে।
একটা বাড়িতে বসে হুকা টেনেছে আর গল্পও করেছে। মেঘালয়কে হুকা টানতে দেখে মিশুও টেনেছে। কিন্তু একবার টেনেই ওর সেকি কাশি! ওর কাণ্ড দেখে লুসাইরা হাসছিলো। পুরোটা বিকেল সেখানে কাটিয়ে দিয়ে কংলাক পাহাড়েই সূর্যাস্ত দেখে তারপর রুইলুই পাড়ায় ফিরে এসেছে ওরা। এসে তাবু টাঙানো, খড়ি জোগাড় করে রাখা, রান্নার ব্যবস্থা সব করে ফেললো।
রাত্রিবেলা
কাঠখড়িতে আগুন জ্বালিয়ে ওরা চারপাশে বসে আগুন পোহাচ্ছে আর আড্ডা দিচ্ছে। বারবিকিউ টা দারুণ টেস্টি হয়েছিলো, সেটার প্রশংসা চললো অনেক্ষণভর। এরপর শুরু হলো গান বাজনা। মেঘালয়ের সাথে ওর বন্ধুরাও শুরু করে দিলো। আজকে নিখিলও যোগ দিয়েছে সাথে।
“বয়স আমার বেশিনা,ওরে টুকটুকির মা
খালি চুল কয়ডা পাইক্কা গ্যাছে বাতাসে…
তোমার মাইয়াডারে দেবানা,এই কথা মোরে কবানা
তাইলে কিন্তু মরে যাবানি উপোসে…
বয়স আমার বেশিনা,ওরে টুকটুকির মা
খালি চুল কয়ডা পাইক্কা গ্যাছে বাতাসে…”
গান শুনে মিশু হেসেই খুন। ও মেঘালয়ের এক হাতে শক্ত করে চেপে ধরে বসে আছে। চারিদিক মেঘে জড়ো হয়ে গেছে। যেখানে বসে আছে সেখানেই মেঘ উড়ে উড়ে আসছে। কুয়াশার মতন মেঘ এসে গা ভিজিয়ে দিচ্ছে। আগুনের পাশে বসে থাকতে বেশ লাগছে।
গান শেষ করে সবাই শুয়ে পড়লো। একইসাথে সবাই সোজা হয়ে শুয়ে আকাশ দেখতে লাগলো। মাথার উপর রাশি রাশি নক্ষত্র। তারাগুলো দেখে মনেহচ্ছে সবগুলা মাথার উপর ঝুলে আছে,মনেহয় একটা ঢিল ছুড়লেই সব তারা টুপ করে গায়ের উপর পড়বে। এত কাছ থেকে কক্ষনো নক্ষত্র দেখেনি মিশু। ওর এতটা পরিমাণে সুখ সুখ লাগছে! মাঝেমাঝে মেঘ উড়ে এসে গায়ের উপর দিয়ে চলে যাচ্ছে। এত সুন্দর কেন সবকিছু!
শুয়ে থেকেও গান হলো কয়েকটা। রাত দুটোর দিকে একটা তাবুতে মিশু ও মেঘালয় শুতে চলে গেলো। নিখিল ও দুপুর একটায় চলে গেলো। এখন বাকি রইলো একটা তাবু। ক্লাব হাউজে রোদ শুতে গেলে পূর্ব,আরাফ ও সায়ান তাবুতে শুতে পারবে। কিন্তু রোদকে রুমে যেতে বলাটা কেমন যেন হয়ে যায়। এদিকে রোদকে তাবুতে শুতে বললে ওদের তিনজনকে রুমে গিয়ে শুতে হবে। সেটাও ইচ্ছে করছে না। তিনজনের ই ইচ্ছে করছে তাবুতে থাকতে। আরেকটা তাবুর ব্যবস্থা করতে পারেনি বলে তিনটাই করতে হয়েছে। এখন কি করা যায় তবে?
পূর্ব বললো, “আমি আর রোদ আজকে সারারাত বাইরে বসে থাকবো আর গল্প করবো”
রোদ চমকে উঠলো ওর কথায়। প্রস্তাবটা লোভনীয়। কিন্তু লজ্জা লাগছে ওর। সায়ান রোদকে জিজ্ঞেস করলো, “তাহলে তাই করবে?”
রোদ বললো, “আচ্ছা। আমার তো বাইরে বসে তারা গুনতেই ভালো লাগছে।”
আরাফ একবার দুষ্টুমি করে বললো, “আমরা দুজন বরং বাইরে বসে থাকি আর পূর্ব ও রোদ একসাথে তাবুতে ঘুমাক।”
কথাটা শুনে লজ্জায় লাল হয়ে উঠলো রোদ। মাথাই তুলতে পারছিলো না। সায়ান ও আরাফ হাসতে হাসতে তাবুতে শুতে গেলো। রোদ ও পূর্ব একসাথে শুয়ে রইলো ঘাসের উপর। আজকের জন্য পুরো ক্লাব হাউজই ওদের। কিন্তু মজার ব্যাপার হচ্ছে,ভেতরে কেউই থাকতে গেলো না। সবাই বাইরে তাবুতেই শুয়ে পড়েছে।
রোদ বললো, “আজকের রাতটা এতটা সুন্দর, সত্যি আমার জীবনে এত সুন্দর রাত বোধহয় কক্ষনো আসেনি।”
পূর্ব হেসে বললো, ” কখনো কি ভেবেছিলে আমার সাথে গভীর রাতে এভাবে পাহাড়ের উপর শুয়ে থাকবা?”
রোদ লজ্জা পেয়ে কাছে সরে আসলো পূর্ব’র। দুজনে একদম কাছাকাছি শুয়ে আছে। অন্ধকার রাতে এভাবে ঘাসের উপর শুয়ে আকাশ দেখার মাঝে অন্যরকম সুখ বিরাজ করে। পূর্ব বললো, “স্কাই কালার শাড়িতে তোমাকে পাক্কা আসমানি আসমানি লাগছিলো।”
– “ইস! হয়েছে। আর বলতে হবেনা।”
– “এখন মেঘ আর মিশু কি করছে বলোতো?”
রোদ লজ্জায় কুকড়ে যাওয়ার মত অবস্থা হলো। ওরা দুজন কি করছে এরকম লজ্জাজনক প্রশ্ন করতে পূর্ব’র কি একটুও লজ্জা করলো না? ছেলেটা খুবই পাজি। নিশ্চয়ই এখন দুষ্টমি ভরা হাসি হাসছে।
রোদ বললো, “মিশু নিশ্চয়ই মেঘালয়ের বুকে মাথা রেখে শুয়ে আছে।”
– “আহ! আমার ও ইচ্ছে করে ওরকম ভাবে কাউকে বুকে জড়িয়ে শুয়ে থাকতে।”
– “কাউ মানে তো গরু। গরুকে বুকে নিয়ে শুয়ে থাকবেন?”
পূর্ব হো হো করে হেসে বললো, “হুম। একরাতের জন্য তুমি কি গরু হবে রোদ?”
রোদের হাসি পেলো। ও আচমকা পূর্ব’র বুকে মাথা রেখে জাপটে ধরলো ওকে। পূর্ব দুহাতে রোদকে বুকে চেপে ধরে বললো, “এরকম মুহুর্ত আমার লাইফে এত তাড়াতাড়ি আসবে ভাবিনি।”
– “কিরকম?”
– “এইযে মাথার উপর আকাশ। তারাগুলো মিটিমিটি জ্বলছে। মনেহচ্ছে ঢিল ছুড়লেই টুপ করে একটা তারা ঝরে পড়বে গায়ের উপর। আমার চারিদিকে মেঘ ভাসছে। কুয়াশা ভিজিয়ে দিচ্ছে শরীর। ঘাসের উপর শুয়ে একজন রোদকে বুকে চেপে ধরে আছি।”
– “রোদ না, গরুকে বুকে চেপে ধরে আছেন”
-“হা হা হা।”
দুজনেই শব্দ করে হাসছে। তাবুর ভেতর থেকে ওদের হাসির শব্দ শুনে বড্ড আনন্দ হচ্ছে দুপুরের। অবশেষে পোড়া কপালীর মুখের হাসি ফিরিয়ে দিলো কেউ। এত সুন্দর হাসির শব্দ কতদিন শোনেনি দুপুর। প্রিয় বোনের প্রিয় হাসির শব্দ শুনতে শুনতে দুপুর ও নিখিলের বুকে মাথা রেখে সুখে ভেসে যেতে লাগলো। মনেহচ্ছে আজ রাতে পৃথিবীতে স্বর্গ নেমে এসেছে।
চলবে..

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে