অনুভূতি
পর্ব ৩৭
মিশু মনি
.
৫৭.
বেলা বাড়তে বাড়তে মিশুর জ্বর কমে এলো। মেঘালয় যেভাবে সেবা যত্ন করছে তাতে জ্বর ভালো না হয়ে উপায় আছে?
নাস্তা করার পর সবাই বেড়িয়ে পড়লো লালাখালের উদ্দেশ্যে । মিশু একটা চাদর গায়ে দিয়ে বসে আছে। আজকে ওদের মধ্যে বিদ্যাই সবচেয়ে বেশি বকবক করছে। ওর বকবকানি দেখে আরাফের বিরক্ত লাগছে ভীষণ। যে মানুষ টা সারাক্ষণ অনবরত বেয়াদব, মূর্খ এসব বলতে থাকে তার উপর বিরক্ত হওয়াটাই স্বাভাবিক। ওর চোখেমুখে বিরক্তির ছাপ স্পষ্ট।
আজ রাতেই ঢাকায় ফিরবে ওরা। সবাই মিলে একসাথে গাড়িতে যাওয়া কষ্টকর হয়ে যায় সেজন্য মেঘালয় বাসার ড্রাইভারকে ফোন দিয়ে সিলেটে চলে আসতে বললো। মিশু আজকে বাসে যেতে চাচ্ছে। ড্রাইভার এসে গাড়ি নিয়ে যাবে আর ওরা বাসেই যাবে ঠিক করে ফেললো। আরো একটা দিন থেকে যেতো কিন্তু মিশুর শরীর ভালো নয় আর মেঘালয়ের কনসার্ট থাকায় আজকেই যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হল।
লালাখালে গিয়ে নৌকায় করে পুরোটা ঘুরে এলো ওরা। এক জায়গায় নেমে চা বাগানে যাওয়া হলো। মিশু বাদে বাকিরা সবাই ঝাপাঝাপি করে গোসল করলো আর ও নৌকায় বসে থেকে দেখলো। লালাখাল থেকে বিকেলের দিকেই রওনা দিলো ওরা।
সিলেটে পৌছে খাবার খেয়ে নিয়ে বাংলোয় ফিরলো। মিশুর আবার জ্বর এসে গেছে তাই ওকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গিয়ে কিছু ওষুধ নিলো মেঘালয়। বেড়িয়ে এসে মার্কেটে ঘোরাঘুরি করে মিশুকে অনেক কিছু কিনে দিলো। মিশু একদম চুপসে গেছে, জ্বর আর মাথা ব্যথার জন্য ও চুপচাপ হয়ে গেছে অনেক। মিশু’র বারবার মনে পড়ছে মেঘালয়ের সাথে দেখা হওয়ার পর যেদিন নেভারল্যান্ডে যাওয়া হয়েছিলো সেদিন টার কথা। সেদিন ও ওর শরীরে জ্বর ছিলো।
বাংলোয় ফিরে বসে বসে চা আড্ডার সাথে সূর্যাস্ত উপভোগ করলো ওরা। সন্ধ্যার পর আজকেও কাঠখড়িতে আগুন লাগিয়ে দিয়ে বসে গল্প করা হল। কিন্তু আজকের আড্ডা বেশি জমলো না। মিশুকে ছাড়া সবকিছু কেমন যেন নিরামিষ লাগে। কোথাও যেন এতটুকু আনন্দ ও নেই। আগের দিনগুলোতে যেমন আনন্দ হয়েছিলো আজকে সেরকম হচ্ছেনা। মিশুর অসুস্থতার প্রভাব সবার মাঝেই পড়েছে। ঢাকায় ফিরেই একজন ভালো ডাক্তার দেখাতে হবে ওকে। নিশ্চয় ই অন্য রোগের উপসর্গ এটা।
রাতে খাওয়াদাওয়ার পর মিশুর মাথায় তেল মালিশ করে চুল বেঁধে দিলো মেঘালয়। ওকে এখন খুব আনমনা দেখাচ্ছে। মেঘালয় যত্ন করে ওর গা মুছে দিলো, গায়ে লোশন মেখে জামাকাপড় পড়িয়ে দিলো। হালকা সাজগোজ ও করিয়ে দিলো। মিশু শুধু মুগ্ধ হয়ে দেখছে একটা মানুষের ভালোবাসার ধরণ আরো কত রকমের হতে পারে!
বাসে মিশু ও মেঘালয় একসাথে বসলো। পূর্ব ও রোদ একসাথে বসেছে। বিদ্যার সাথে সায়ান ছাড়া আর কারোর ই ভাব হয়নি,তাই বিদ্যাকে সায়ানের পাশেই বসিয়ে দেয়া হয়েছে। আরাফ একাই বসে হেডফোনে গান শুনতে লাগলো।
পুরোটা রাস্তা মিশু মেঘালয়ের কাঁধে মাথা রেখে ঘুমালো। মেঘালয় ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো। মিশু যতক্ষণ ঘুমিয়েছে,মেঘালয় ওর মাথাটা নিজের কাঁধে নিয়ে মাথা টিপে দিয়েছে ওর। মাঝপথে গাড়ি থামলে মেঘালয় মিশুকে রীতিমত কোলে নেয়ার মত দুহাতে তুলে ধরে বাস থেকে নামালো। হাত ধরে বাথরুমে নিয়ে যাওয়ার সময় লোকজন হা করে দেখছিলো। রেস্টুরেন্টে পুরুষ ও মহিলাদের জন্য আলাদা বাথরুম। মহিলাদের ওদিকে ছেলেদের ঢোকার নিয়ম নেই। মেঘালয় মিশুকে রোদের হাতে তুলে দিয়ে নিজে বাইরে দাঁড়িয়ে রইলো। ওর বন্ধুরা অবাক হয়ে দেখছিলো এই মেঘালয়কে। এরকম করেও কেউ কাউকে ভালোবাসতে পারে! মিশু ছাড়া মেঘালয় যেন একদম বাঁচতেই পারবে না। মিশু বাথরুম থেকে বেড়িয়ে এলে মেঘালয় আবারো ওর হাত ধরে নিয়ে এসে মিশুর মুখ ধুইয়ে দিলো। পুরো রেস্টুরেন্টের লোকজনের দৃষ্টি এখন মেঘালয়ের উপর। সবাই মুগ্ধ হয়ে দেখছে সেদিকে ওর কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। মিশুর শরীর দূর্বল, ও একা একা এসব করতে পারবে না এটাই মেঘালয়ের কাছে সবচেয়ে বড়।
মিশু মুখ ধুয়ে এসে টেবিলে বসলো। খাবার এসে গেলে সবাই নিচু হয়ে খেতে লাগলো আর মেঘালয় নিজে খাওয়া বাদ দিয়ে মিশুকে তুলে খাওয়াতে লাগলো। পূর্ব বললো, “মিশু অসুস্থ না হলে আমরা বোধহয় বুঝতেই পারতাম না মেঘালয় ওর এত কেয়ার করে!”
মেঘালয় কারো কথাই মনোযোগ দিয়ে শুনলো না। ও মিশুকে তুলে খাওয়াতে লাগলো। মিশু জ্বরের প্রকোপে খেতেই পারছে না। খাবার গিলছে একটু একটু করে। মেঘালয়কে খেতে বললে ও দুবার মুখে দিলো শুধু। পাশেই শো কেসে মিষ্টি সাজিয়ে রাখা দেখে মিশু বললো, “আমি মিষ্টি খাবো।”
মেঘালয় গিয়ে এক কেজি মিষ্টি এনে দিলো ওকে। মিশু এক বসাতেই হাফ কেজি তুলে তুলে খেলো। কাউকে একটা দিলো ও না। মেঘালয় অনেক খুশি হয়েছে। যাক, তবুও তো পেট ভরা থাকবে। মিশুর যে মিষ্টি এত পছন্দ সেটা ওর জানা ছিলোনা। মিষ্টি পেলে মিশু সবকিছু ভূলে যায়।
খাওয়া শেষ হলে মেঘালয় ওকে হাত ধরে নিয়ে আবারো গাড়ির দিকে পা বাড়ালো। একজন লোক বলে উঠলো, “দুনিয়াতে আর কারো বোধহয় বউ নাই, হায়রে প্রেম।”
কথাটা সবার কানে এসে লাগলো। দুজন লোক হাসাহাসি করছে। মেঘালয় সেদিকে ভ্রুক্ষেপ করলো না। কারো কথায় ওর কিছু যায় আসেনা। কিন্তু আরাফ গিয়ে রীতিমত লোকটার কলার টেনে ধরার মত অবস্থা। পূর্ব ও সায়ান ওকে টেনে ধরে বাসে নিয়ে গিয়ে তুললো। নয়ত লোকটা নির্ঘাত আরাফের হাতে মাইর খেত।
বাসে উঠে মিশু বললো, “তুমি সবসময় আমার এত কেয়ার করো, এরকম পাগলামি কেন করো বলোতো? লোকজন তাকিয়ে থাকে।”
– “তুমি অসুস্থ আর আমি তোমাকে ছেড়ে দিয়ে চুপচাপ ভাত গিলবো? সেটা আমাকে দিয়ে হবেনা। কে কি বললো দেখার বিষয় না আমার।”
– “আমাদের সমাজে এরকম দেখলে লোকজন হাসাহাসি করবে বোঝোনা?”
– “করুক। আমি প্রেমের নতুন ইতিহাস রচনা করে যাবো। দেশের লোকরা হাসলে যে দেশে লোকজন কেউ কারো দিকে তাকায় না সেই দেশে গিয়ে তোমাকে নিয়ে থাকবো।”
মিশু হাসিতে ঢলে পড়বো। মেঘালয়কে জড়িয়ে ধরে বললো, “আমি তোমার সাথে মিশতে মিশতে বড় হয়ে যাচ্ছি আর তুমি আমার সাথে থেকে থেকে মিশুর মত বাচ্চা হয়ে যাচ্ছো।”
মেঘালয় মিশুর হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বললো, “জানিনা রে। আমার কেবলই মনেহচ্ছে পুরো দুনিয়া চলে যাক। শুধু তুমি থাকো, আর কাউকে লাগবে না আমার।”
– “তুমি সত্যিই পাগল হয়ে গেছো মেঘমনি।”
মিশু ওর বুকে মাথা রেখে হেসেই কুটিকুটি। বাসের লাইট নিভিয়ে দেয়া হয়েছে। অন্ধকার বাসে কিছুক্ষণের মধ্যেই নিরবতা নেমে এলো। সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে। বাস নিস্তব্ধ। দু একটা জানালা খোলা, সেগুলো দিয়ে শিরশিরে বাতাস আসছে। মিশু চাদর গায়ে দিয়ে মেঘালয়ের বুকে মাথা রেখে বসে আছে। অন্ধকারে মেঘালয়ের মুখটাও দেখা যাচ্ছে না। মিশু ওর মুখটা ধরে বললো, “এত ভালোবাসলে আমি তো হুট করেই হারিয়ে যাবো ”
মেঘালয় ওর মুখের উপর হাত দিয়ে বললো, “এইসব ফালতু কথা আর একবার বললে আমিই তোমাকে খুন করে ফেলবো। ”
মিশু আবারো হেসে উঠলো। মেঘালয় সত্যি সত্যিই পাগল হয়ে গেছে। কেমন ছেলেমানুষি করছে। প্রেমে পড়লে সবাই বুঝি এরকম পাগল হয়। মিশু অন্ধকারে নিচু হয়ে ঠোঁট দিয়ে মেঘালয়ের ঠোঁট স্পর্শ করলো।
৫৮.
দুদিন পর
আজ মেঘালয়ের কনসার্ট। কনসার্টে সবাই মিলে চলে এসেছে। এক সাড়িতে মিশু, পূর্ব,সায়ান, আরাফ, দুপুর, নিখিল আর রোদ সবাই বসেছে। সবাই মিলে এমন একটা সম্পর্ক তৈরী হয়ে গেছে যেন ছোটবেলা থেকেই একসাথে আছে ওরা সবাই। মিশুর সাথে সবার বেশ ভালো বন্ধুত্ব হয়ে গেছে। এই দুদিন তো দুপুর আর রোদ মিশুর মাথায় পানি ঢেলে দেয়া থেকে শুরু করে,রান্না করা, খাওয়ানো সব কাজে মেঘালয়কে সাহায্য করেছে। যদিও মিশুর জন্য মেঘালয় একাই যথেষ্ট।
ঢাকায় ফিরে ডাক্তার দেখিয়ে ভালো ওষুধ খেয়ে মিশু একদম সুস্থ হয়ে গেছে। এই দুদিন মেঘালয় সবসময় ওর সাথেই বাসায় ছিলো। নিজে তুলে খাইয়েছে, সবসময় খেয়াল রেখেছে মিশুর দিকে। রিহার্সেলে মাত্র একবার গিয়েছিলো। একবার রিহার্সাল করে কিভাবে গান গাইবে এটা নিয়েই সবাই টেনশনে ছিলো। গ্যালারি ভর্তি দর্শক দেখে মিশুর মুখ হা হয়ে গেলো। মেঘালয়কে অনেকেই চেনে। সবাই ওর সাথে কথা বলছিলো। মিশু শুধু দূর হতে খেয়াল করছিলো ওকে। আজকে মেঘালয়কে অন্যরকম সুন্দর দেখাচ্ছে। ইচ্ছে করে গিয়ে একটু ছুঁয়ে দেখি!
প্রোগ্রাম শুরু হয়ে গেলো। মেঘালয় স্টেজে উঠেই সর্বপ্রথম মিশুর দিকে তাকালো। মিশু ক্রমাগত উত্তেজিত হয়ে উঠছে। বারবার সায়ানের হাত চেপে ধরছে ও। সায়ান মিশুর মুগ্ধ মুখের দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে যাচ্ছে। ছলছল করছে ওর চোখ।
মেঘালয় গান গাইতে আরম্ভ করলো,
“কতবার তোর আয়না ভেঙেচূরে ঘুরে তাকাই,
আমার মতে তোর মতন কেউ নেই,
কতবার তোর কাঁচা আলোয় ভিজে গান শোনাই,
আমার মতে তোর মতন কেউ নেই…”
মিশু মুগ্ধ হয়ে শুনছিলো ওর গান আর গানের লিরিক। কেবলই মনেহচ্ছিলো কথাগুলো ওকে ই উদ্দেশ্যে করে বলা হচ্ছে। মেঘালয় গভীর আবেগ নিয়ে গানটা গাইছে। মিশুর চোখ দিয়ে টপটপ করে জল গড়িয়ে পড়ছিলো। সায়ান বুঝতে পেরে একবার মুছে দিলো ওর চোখ। মিশুর দিকে তাকিয়ে বললো, “মিশু..”
– “মেঘালয়ের মাঝে এত মায়া কেন সায়ান ভাইয়া?”
– “সেটা আমিও ভাবি।”
মেঘালয় এই মুহুর্তে গাইছে,
“তোর উঠোন জুড়ে বিশাল অংক,
কষতে বারণ ছিলো তাই..
কিছুই বোঝা গেলো না প্রায়…”
মিশু কেঁদে ফেললো এবার। সায়ানের হাত চেপে ধরে চোখ বন্ধ করে রইলো। সায়ান মিশুকে বাঁধা দিলো না। ও চুপ করে রইলো। মেঘালয়ের কণ্ঠে রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙে যাচ্ছে। প্রথমে টিএসসিতে হওয়ার কথা ছিলো, এখন প্রোগ্রাম হচ্ছে মিউজিয়ামের অডিটোরিয়ামে। পুরো গ্যালারি ভর্তি দর্শক। সবাই স্তব্ধ হয়ে গান শুনছে। গান যেন নয়,মেঘালয়ের কণ্ঠে আবেগের স্রোত নেমেছে। এই গানটা শেষ করে মেঘালয় অন্য আরেকটা গান ধরলো।
এবার উকিল মুন্সির ‘আমার গায়ে যত দুঃখ সয়’ গানটা আরম্ভ করলো। কিন্তু ওর গানের রাগ রাগিণীর টান শুনে ভেতরটা কেঁপে যাওয়ার মত অবস্থা হলো। বারি সিদ্দিকী যেভাবে রাগিণীতে সুর দিয়েছেন, মেঘালয় ও ঠিক সেভাবে দম বন্ধ করে টান দিলো। শুনে কেমন যেন বিষণ্ণতা ছেঁয়ে যায় ভেতরে।
গানটা শেষ করার পর মিশু চোখ মেলে খেয়াল করে দেখলো মেঘালয়ের চোখে জল। মিশুর ইচ্ছে করছিলো ছুটে গিয়ে মেঘালয়ের পাশে বসে ওর চোখ মুছে দিতে। শান্ত হয়ে ও বসে থাকার চেষ্টা করেও পারলো না। সায়ানের বাহু চেপে ধরে রইলো শক্ত করে।
এরপর আরো দুটো গান গাইলো মেঘালয়। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় প্রত্যেকটা গানই আলাদা রকমের। একই কণ্ঠে চার রকমের গানে সুর দিয়ে গ্যালারি মাতিয়ে তুললো। শেষের গানে, “তোর চাঁদে যাওয়া হলোনা, তোর ফর্সা হওয়া হলোনা” গানটা বেশ জমে উঠলো। মেঘালয় নেমে আসার পর ছেলে মেয়েরা ওর সাথে গিয়ে ছবি তুলতে লাগলো। মেঘালয় দু মিনিট ছবিতে পোজ দিয়েই হাফিয়ে উঠলো। এসব সেলিব্রেটি টাইপের কাজকর্ম ওকে দিয়ে হবেনা, ওকে দিয়ে শুধু ভালোবাসা বাসিই হবে। দ্রুত হল থেকে বেড়িয়ে সায়ানকে ফোন দিয়ে বললো মিশুকে নিয়ে বাইরে বের হতে।
চলবে..