অনুভূতি পর্ব ৩২

0
1953

অনুভূতি
পর্ব ৩২
মিশু মনি
.
৫০.
বিছানাকান্দিতে পৌছে মিশুর আনন্দ যেন আর ধরেই না। মেঘালয়ের হাত ধরে ও ছপ করে পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়লো। পানিতে ছপ ছপ শব্দ তুলে বালিতে এসে এসে উঠলো। জুতোজোড়া নৌকাতেই খুলে রেখে এসেছে। মেঘালয়কে রেখেই মিশু ভো দৌড় শুরু করে দিলো। সব বন্ধুরা ওর কর্মকাণ্ড হা হয়ে দেখছে।
মিশু এদিক সেদিক দৌড়াচ্ছে আর মুগ্ধ হয়ে আশেপাশে তাকাচ্ছে। পিছনে বিশাল প্রশস্ত নদী, সামনে ডানেও মেঘালয় আর বামেও মেঘালয়। সামনে যত দূর চোখ যায়,মেঘালয়ের বিস্তৃত পাহাড় গুলোই চোখে পড়ে। গাঢ় সবুজে চোখ ধাধিয়ে যাওয়ার মত অবস্থা। দূরে একটা ঝরণাও দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। মিশু ছুটতে ছুটতে অনেক দূর চলে গিয়ে স্রোতের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। স্রোতে পা ডুবিয়ে দিয়ে কয়েকবার লাফালো। মেঘালয় ও ছুটতে শুরু করেছে,এভাবে লাফালে তো পাথরে পা কেটে যাবে।
মিশু লাফাতে লাফাতে ক্লান্ত হয়ে ধপ করে একটা পাথরের উপর বসে পড়লো। তারপর হাফাতে হাফাতে পানি ছিটাতে আরম্ভ করলো। শীতল পানির স্রোতে পা ডুবিয়ে কি যে শান্তি লাগছে! মেঘালয় ছুটে এসে ওর পাশেই পাথরে বসে পড়লো।
মিশু আনন্দের ঠেলায় কথাই বলতে পারছে না। সমানে পানিতে লাফাচ্ছে। পানির নিচে মৃদু লাল,নীল কত রঙের নুড়ি পাথর! পাথর গুলো তুলে তুলে খেয়ে ফেলতে ইচ্ছে করছে। বিছানাকান্দির পানি একদম স্বচ্ছ। দূরের ঝরনার দিকে তাকিয়ে মিশু মেঘলয়কে বললো, “ওইখানে যাওয়া যাবেনা?”
– “না রে পাগলী। ওটা অনেক বেশি দূরে। এখান থেকে ঝরনা কত্ত ছোট দেখাচ্ছে দেখছো না?”
– “মেঘমনি, আমার আনন্দে কান্না করতে ইচ্ছে করছে গো। আমি একটু কান্না করি?”
মেঘালয় হাসতে হাসতে বললো, “কাঁদবে? দুজনে একসাথে জলে নামার পর কান্না করিও।”
– “এখন কাঁদবো না?”
– “এখন কাঁদলে লোকজন হা করে তাকিয়ে থাকবে। দুজনে একসাথে পানিতে নেমে ডুবে বসে থাকবো, তখন আমার বুকে মাথা রেখে কান্না করো।”
– “ইস! আইডিয়াটা ভালো। তখন আমি অনেক গুলা কান্না করবো আচ্ছা?”
– “আচ্ছা অনেক গুলা কান্না করো। এখন কেঁদো না। এখন গা ভিজিও না, আসো আগে লাঞ্চ করে নেই।”
– “লাঞ্চ কই করবা? এখানে কে ভাত রেঁধে বসে আছে তোমার জন্য?”
মেঘালয় হেসে মিশুর একটা হাত তুলে নিয়ে পিছন দিকে দূরে কয়েকটা দোকান দেখিয়ে দিয়ে বললো, “ওই যে চালা গুলো দেখতে পাচ্ছো? ওইখানে আমার জন্য ভাত রেঁধে বসে আছে। চলো।”
– “এখনি তো খিদে পায়নি গো। আর এত তাড়াতাড়ি খাওয়ার কি আছে?”
– “পানিতে নেমে কান্না করবে না?”
– “আমি কি চার পাঁচ ছয় ঘন্টা ধরে কাঁদবো নাকি? অল্প একটু কাঁদবো।”
– “তুমি না বললা অনেক গুলা কান্না করবা?”
– “অনেক গুলা কান্না অল্প কয় মিনিটেই সেরে ফেলবো। বেশিক্ষণ কান্না করা যায়? এত সুন্দর জায়গায় বেশিক্ষণ কান্না করা যায়না।”
– “ও আচ্ছা, তবুও এখন আমাদের খেয়ে নেয়া উচিৎ। আমরা একটু পর পানিতে নামবো, ভেজা শরীরে তো আর খেতে ভালো লাগবে না।”
মিশু মাথা ঝাঁকিয়ে বললো, “তা ভালো বলেছো। আসো তাড়াতাড়ি খেয়ে আসি।”
মিশু পানি থেকে পা তুলে পাথরের উপর দিয়ে পা ফেলে ফেলে দ্রুত দোকানের দিকে যেতে লাগলো। ওর সাথে যে মেঘালয় আছে সেটা ভূলেই গিয়েছে বোধহয়। মেয়েটা বেশি সুখের মুহুর্ত গুলোতে একদম বাচ্চা স্বভাবের হয়ে যায়। এখনো তার ব্যতিক্রম হয়নি। এমনিতেই সবসময় শিশুসুলভ আচরণ ফুটে উঠে ওর আচরণে, আজকে আরো বেশি ফুটে উঠেছে। মেঘালয়ের বুকের ভেতরটা কেমন কেমন যেন করছে। চারিদিকে এত ভালো লাগা কেন!
মিশু দ্রুত হাঁটতে গিয়ে হঠাৎ একটা পা উপরে তুলে চেঁচিয়ে উঠলো। মেঘালয় কাছে গিয়ে বলল, “ব্যথা পেলে? এজন্যই তোমার আমার হাত ধরে সাথে সাথে চলা উচিৎ। এত ছুটোছুটি করলে তো হবেনা, পা ভেঙে বসে থাকবা তখন আর কোনো মজাই হবেনা।”
মিশু মুখটা কাচুমাচু করে বললো, “আচ্ছা আমার হাত ধরে ধরে আসো তাহলে।”
– “আমি তোমার হাত ধরে যাবো নাকি তুমি আমার হাত ধরে যাবা?”
মিশু হেসে ফেললো। ওর বন্ধুরা এসে উপরেই দাঁড়িয়ে আছে, কেউ আর জলের ধারে আসেনি। ওদের কাছে গিয়ে মেঘালয় বললো, “আগে খেয়ে নেই।”
সায়ান বললো, “এই বাচ্চাটাকে সামলাস কিভাবে তুই?”
মেঘালয় হাসলো। মিশুর কোনো মনোযোগই নেই ওদের প্রতি। ও অবাক হয়ে আশেপাশে তাকাচ্ছে। পায়ের নিচে গুড়িগুড়ি বালি আর পাথর। খালি পায়ে হাঁটলে পায়ের তলায় কেমন সুড়সুড়ি অনুভূত হয়। মাথার উপর স্বচ্ছ নীলাকাশ, তিনদিকেই মেঘালয় আর একদিকে প্রশস্ত নদী। সবকিছু এত সুন্দর কেন!
মেঘালয় মিশুর হাত ধরে ধরে ওকে নিয়ে চালা দেয়া রেস্টুরেন্টের কাছে চলে এলো। ওকে চেয়ারে বসিয়ে রেখে খাবার অর্ডার দিয়ে আসলো। মিশু আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেছে। ও বসে বসে টেবিলে ঢোল বাজাতে লাগলো। কোনোদিকে ওর হুশ নেই। সবাই হা করে চেয়ে আছে ওর ঢোল বাজানোর দিকে। দুই হাতে সমান তালে টেবিলে ঢোল বাজিয়ে চলেছে।
মেঘালয় এসে দেখলো এই কাণ্ড! সবাই হতবাক আর মিশু তবলা বাজায়! পাগল হয়ে গেছে নাকি মেয়েটা? ও এসে মিশু পাশের চেয়ারে বসে বললো, “কি করছো? ঢোল বাজাচ্ছো কেন?”
– “ঢোল কই পেলাম? আমিতো টেবিল বাজাচ্ছি।”
হতবাক হয়ে চেয়ে থাকা মুখ গুলো হেসে উঠলো। মেঘালয়ের ও হাসি পেলো। ও হাসি থামিয়ে বললো, “টেবিল বাজাচ্ছো কেন?”
– “হাত আছে, ইচ্ছে হয়েছে তাই বাজাই। তোমার ইচ্ছে হলে তুমিও বাজাও।”
– “যা ইচ্ছে হবে তাই করতে হবে?”
– “হ্যা, কয়দিন ই বা বাঁচবো। যা ইচ্ছে হবে তাই করতে হবে।”
মেঘালয় মিশুর কানের কাছে এগিয়ে এসে ফিসফিস করে বললো, “আমার ইচ্ছে করছে তোমার নিচের ঠোঁটে একটা ছোট্ট কামড় দিতে।”
মিশুর শরীর শিউরে উঠলো। মুখের হাসি মুহুর্তেই মিলিয়ে গেলো ওর। চোখ রাঙিয়ে মেঘালয়ের দিকে তাকিয়ে বললো, “তুমি এত খারাপ কেন? দেখছো আমি একটু অন্য জগতে চলে গেছি এখন আমাকে থামানোর জন্য এসব বলবা?”
সবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে মিশুর দিকে। মেঘালয় লজ্জা পেয়ে আর কথা বাড়ালো না। চুপচাপ খেতে শুরু করলো। মিশুও খাবার খাওয়া আরম্ভ করেছে। মেঘালয় মিশুর কানেকানে বললো, “তুমি রেগে গেলে আরো বেশি মিষ্টি দেখায়। তখন তোমার নাভীতে….”
কথা শেষ করতে পারলো না। মিশু দুটো ঘুষি দিতেই মেঘালয় চেয়ার সুদ্ধ পিছনে উলটে পড়ে গেলো। পাশের টেবিলের লোকজন তাকাচ্ছে ওদের দিকে। আর মেঘালয়ের বন্ধুরা একদম থ!
মেঘালয় ও মিশুর এমন আচরণে একদম অবাক। ও উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করলো। মিশু বললো,”আমার কোনো দোষ নেই। সব দোষ আরাফ ভাইয়ার। সে সারাক্ষণ ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিতে চায়। তার ইফেক্ট আমার উপর পড়েছে।”
সবাই হাসলো। মেঘালয় উঠে চেয়ার টেনে নিয়ে বসলো। আর কোনো কথাই বললো না। একদম চুপচাপ মাথা নিচু করে খেতে আরম্ভ করেছে। সবাই দেখছে ব্যাপারটা সংকোচ জনক। অন্যরাও খেতে লাগলো। এদিকে মেঘালয়ের মাথাটা খুব ঝিমঝিম করছে। পিছনে উলটে পড়ে একটা পাথরের উপর মাথাটা পড়ায় খুব আঘাত পেয়েছে মাথার পিছন দিকে। কিন্তু কাউকে বুঝতে দিলো না। যথাসাধ্য চেষ্টা করলো স্বাভাবিক থাকার জন্য। তবুও ব্যথায় মুখটা বিকৃত হয়ে যাচ্ছে। মেঘালয়ের চেহারা কেমন যেন ফ্যাকাসে হয়ে গেলো। ও দাঁতে দাঁত চেপে ব্যথা হজম করার চেষ্টা করছে।
সায়ান মেঘালয়ের দিকে তাকিয়ে কিছু একটা বুঝতে পেরে জিজ্ঞেস করলো, “মেঘ তুই ঠিক আছিস?”
মেঘালয় এতক্ষণ চোখ বন্ধ করে ছিলো। সায়ানের প্রশ্ন শুনে চোখ মেলে তাকালো। মিশুও প্রশ্ন শুনে চমকে তাকালো মেঘালয়ের দিকে। ওর চোখের দিকে তাকিয়ে ভেতরটা কেঁপে উঠলো মিশুর। এমন দেখাচ্ছে কেন মেঘালয়কে? সে কি মিশুর আচরণে কষ্ট পেলো?
মিশু খাওয়া বন্ধ করে মাথা নিচু করে ভাবছে। এরকম রিয়েক্ট করাটা উচিৎ হয়নি। নিজের কাছে নিজেকেই অপরাধী মনেহচ্ছে। এখন সবার সামনে কিছু বলাও যাবেনা। খাওয়া শেষ হলে কথা বলতে হবে। কিন্তু এখন তো আর খেতেই পারবে না ও।
আরাফ জিজ্ঞেস করলো, “তুই কি ব্যথা পেয়েছিস মেঘ?”
মেঘালয় মাথা ঝাঁকিয়ে বললো, “আরে না। তোরা অযথা ভাবছিস। আমি একদম ঠিক আছি।”
মিশু পিছন ফিরে তাকালো মাটির দিকে। ছোট্ট পাথরটা দেখেই ও বুঝে গেছে মেঘালয় সেটাতেই পড়ে আঘাত পেয়েছে। মনটা চরম খারাপ হয়ে গেলো। মেঘালয়ের চোখের দিকে চেয়ে জিজ্ঞেস করলো, “সত্যি করে বলোতো মেঘ তুমি ব্যথা পাওনি?”
মিশুর চোখের দিকে তাকালে মেঘালয় কিচ্ছু লুকাতে পারেনা। ও বলল, “এমন কিছু না। সামান্য একটু ব্যথা পেয়েছি।”
মিশুর কান্না এসে যাচ্ছে। কেন এরকম আচরণ করলো ও? এই ছেলেটা ওকে কত ভালোবাসে,কত্ত খেয়াল রাখে। আর ও শুধুশুধু কষ্ট দিয়ে ফেললো। নিজের উপর প্রচণ্ড রাগ হচ্ছে।
মেঘালয় বললো, “আমার অভ্যেস আছে এসবে। যখন হিমালয়ে যেতাম, কত বড় বড় বিপদে পড়েছি। তুষারঝড়ের মত অনেক বড় বড় বিপদ থেকে বেঁচে ফিরেছি। এ আর কি এমন। বাদ দে, খা তোরা সবাই।”
সবাই খেতে শুরু করেছে। মিশু খাচ্ছেনা দেখে মেঘালয় বললো, “তুমি খাচ্ছো না কেন? আরে পাগলী আমি রাগ করিনি। আমি কতবার বেস ক্যাম্পে গিয়েছি তুমি জানো? আমার এসব সামান্য আঘাতে কিছু হয়না।”
– “মাথায় না হয় সামান্য আঘাত পেয়েছ, আমার আচরণে ভেতরে যে আঘাতটা পেয়েছো সেটার কি অভ্যেস আছে?”
মিশুর প্রশ্নে টেবিলের সবাই মাথা তুলে তাকালো ওর দিকে। মিশুর চোখ ছলছল করছে। কেউ কিছু বললো না। মেঘালয় হেসে বললো, “তুমি আমার বুকের ভেতর হাত ঢুকিয়ে কলিজাটা টেনে বের করে নাও, তবুও আমার একটুও কষ্ট হবেনা। আমার লাইফটাই তো তোমার। খেয়ে নাও নয়ত আমিও খাবোনা।”
মেঘালয় মিশুর মুখে খাবার তুলে দিলো। মিশু এবার কেঁদেই ফেললো একেবারে। মেঘ বললো, “এখনি কান্না করছো কেন? তুমি না বললা পানিতে নেমে অনেক গুলা কান্না করবা? এখন সব কান্না শেষ হলে তখন কাঁদবা কি?”
বলেই হেসে ফেললো। মিশুও হাসলো। রৌদ্রময়ী মুগ্ধ হয়ে ওদের দুজনকে দেখছে। কিভাবে মেঘালয় এই বাচ্চা মেয়েটাকে এতটা ভালোবাসতে পারে? কাউকে পরোয়া করছে না, লোকজনের সামনেই ওকে তুলে খাওয়াচ্ছে। অন্য কোনো ছেলে হলে তো রেগে আর মিশুর সাথে কথাই বলতো না। মেঘালয় মিশুর সমস্ত কিছু সহ্য করে যায়। অদ্ভুত একটা মানুষ!
খাওয়া শেষ করে ওরা পাশের দোকানগুলোতে এলো। হরেক রকমের কসমেটিক্স বিক্রি হচ্ছে। মিশু অবাক হলেও আগের মত স্বাভাবিক হতে পারছে না। মন খারাপ লাগছে খুব। ওরা টুকটাক কেনাকাটা করতে লাগলো। মেঘালয় বারবার মিশুকে বলল, “যা মন চায় নাও।” তবুও মিশুর কোনো ভাবান্তর নেই। ও কেমন নিস্তব্ধ হয়ে গেছে। মনেহচ্ছে মেঘালয় ই বোধহয় ওকে ঘুষি মেরে ফেলে দিয়েছিলো। মেঘ দিব্যি হেসে হেসে জিনিসপত্র দেখছে আর ও বিষণ্ণ হয়ে আছে।
মিশু একা একা হাঁটতে হাঁটতে স্রোতের দিকে যেতে লাগলো। মেঘালয় এসে ওর পাশে হাঁটতে লাগলো। দুজনে এসে একসাথে পানিতে নামলো। মেঘালয় হাঁটুজলে পা ডুবিয়ে মিশুকে এসে ওর পাশে বসতে বলল। কিন্তু মিশু ওর কথা শুনলো না। ও একাই এগিয়ে যেতে লাগলো গভীর স্রোতের দিকে। মেঘালয় বলল, “ওদিকে যেওনা, ওখানে স্রোত বেশি।”
মিশুর কোনোই ভাবান্তর নেই। ও কেমন যেন স্থবির হয়ে গেছে। মেঘালয় ওর পিছুপিছু যেতে লাগলো। মিশু একটা পাথরে আঘাত পেয়ে পড়ে যাওয়ার উপক্রম হয়,তবুও থামলো না। একটা একটা করে পাথর ডিঙিয়ে দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে সামনের দিকে। ওদিকে স্রোতের গভীরতা বেশি। মেঘালয় এত করে ডাকছে তবুও শুনছে না। গিয়ে সামনে একটা গর্তে লাফিয়ে পড়লো। বুকের ভেতরটা ছ্যাত করে উঠলো মেঘালয়ের। আবার ব্যথা পেলো না তো? কি যে করে মেয়েটা। শুধুশুধু দুশ্চিন্তায় ফেলে দেয়।
দুপাশে বড় বড় পাথর আর মাঝখানে একটু গভীর, মিশু সেখানে ডুবে শুধু নাক আর চোখ বের করে চেয়ে আছে। চোখ পিটপিট করে তাকাচ্ছে মেঘালয়ের দিকে। পুরো শরীর টা পানির নিচে। স্রোত ওকে ঠেলে নিয়ে যেত চাইছে কিন্তু পাথরে পা ঠেলে বসে আছে ও। দুপাশেই বড় বড় পাথর থাকায় পাথরের সাথে আটকে আছে। ও যে খুব মজা পাচ্ছে সেটা দেখেই বোঝা যাচ্ছে। চোখে হাসির ঝিলিক। স্বচ্ছ পানিতে বসে আছে পা দুটো একসাথে জড়ো করে সেটাও বোঝা যাচ্ছে। মেঘালয় নেমে পাথরে হেলান দিয়ে বসে পড়লো। মেঘালয়ও ডুবে গেলো প্রায়, শুধু মাথাটা বের হয়ে থাকলো। মিশু শুধু নাক আর চোখ কান বের করে রেখেছে। পুরো শরীরটাই পানির নিচে। এদিকে কেউ নেই, শুধু ওরাই দুজন।
মেঘালয়কে পাথরে হেলান দিয়ে বসতে দেখে মিশু এসে ওর কোলের উপর বসে পড়লো। মেঘালয়ের বুকে হেলান দিয়ে ডুবে রইলো দুজনে। এদিকে বরফ শীতল জলের স্পর্শে শরীর শিউড়ে উঠছে দুজনের। মেঘালয় পানির নিচেই শক্ত করে মিশুকে জাপটে ধরে রইল। মিশু পাথরের আড়ালে মেঘালয়ের মাথাটা আচমকা ঠেস দিয়ে ধরে ওর ঠোঁটে ঠোঁট রাখলো। মিশুর এরকম কাজে একদম অবাক হয়ে গেলো মেঘালয়। সেজন্যই মেয়েটা এত দূরে এসে ডুবে বসে আছে, এতক্ষণে স্পষ্ট হলো ওর কাছে। মেঘালয় চোখ খুলে রেখেছে, মিশুর চোখ বন্ধ। ওর চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। মেঘালয় ওর ঠোঁটে একটা ছোট্ট কামড় দেয়ার পর মিশু ওকে ছেড়ে দিয়ে সোজা হয়ে বসল।
মেঘালয়ের চোখে চোখ রেখে করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো, “সরি মেঘালয়। আর কক্ষনো এভাবে তোমাকে আঘাত করবো না। সরি, আমাকে মাফ করে দাও প্লিজ।”
বলেই দুহাতে নিজের কান ধরে বসে রইলো। মেঘালয় হাসতে হাসতে বললো, “এত বড় একটা সারপ্রাইজের পরও কি আর রাগ করে থাকা যায়?”
মিশু এসে ওর বুকে মাথা রেখে ডুব দিয়ে রইলো অনেক্ষণ। তারপর মাথা তুলে জোরে জোরে শ্বাস নিতে নিতে বললো, “দম আটকে আসছিলো উফফ। পানি গুলো জলের মত ঠাণ্ডা।”
– “হা হা হা, পানি আবার জলের মত ঠাণ্ডা হয় কি করে?”
-“মেঘালয় যেভাবে মিশুর মত মিষ্টি, সেভাবে।”
মেঘালয় আবারো হেসে উঠলো। মিশু ওর বুকে পিঠ ঠেকিয়ে বুকে হেলান দিয়ে শুয়ে পড়লো। মেঘালয় পাথরে হেলান দিয়ে বসে আছে, আর মিশু ওর বুকে হেলান দিয়ে আকাশের দিকে চেয়ে আছে। দুজনেই একসাথে আকাশ দেখছে। আকাশ ঘন নীল, সাদা তুলোর মতন মেঘ উড়ছে। মিশু এক মেঘালয়ের বুকে হেলান দিয়ে আরেক মেঘালয় দেখছে। পিছনে মেঘালয়, ডানে মেঘালয়, বামেও মেঘালয়। যার বুকে হেলান দিয়ে কোলে বসে আছে, সেও মেঘালয়। আর মাথার উপর উড়ছে মেঘ আর মেঘ। আহ! কি অদ্ভুত সুখ!
অনেক্ষণ পানিতে এভাবে ভেসে ভেসে আকাশ দেখলো। আস্তে আস্তে এদিকে লোকজন আসতে শুরু করেছে। এতক্ষণ এখানে কেউ ছিলোনা। লোকজনের সামনে এভাবে শুয়ে থাকা যায় না। মেঘালয় মিশুকে নিয়ে সেখান থেকে উঠে আসলো। দুজনে একটা পাথরের উপরে বসে একে অপরের পিঠে হেলান দিয়ে বসে বসে বিছানাকান্দির মুগ্ধ করা সৌন্দর্য দেখতে লাগলো। যত বিকেল হচ্ছে, স্রোত তত বেড়ে যাচ্ছে।
রৌদ্রময়ীর একজন ভালো সঙ্গী জুটে গেছে, পূর্ব। বাকিরা যখন জলের ভেতর শুয়ে আকাশ দেখছিলো পূর্ব তখন রোদের সাথে বসে গল্প করছিলো। রোদ পাথরে বসে পানিতে পা ডুবিয়ে অনেক্ষণ গল্প করলো ওর সাথে। পূর্ব’র কিছু ছবি তুলে দিলো, পূর্ব ওর অনেক ছবি তুললো, বাকিদের ছবিও তুললো। মিশু আর মেঘালয় দূরে হারিয়ে গিয়ে পানিতে ডুবে প্রকৃতি আর প্রেমের নেশায় মেতেছে। আর ওরা সবাই মিলে হাসি ঠাট্টা, দুষ্টুমি, পানি ছুঁড়োছুড়ি করতে লাগলো। রোদের মন এখন একদম ভালো। রোদ নিজেও অনেক্ষণ পানিতে শুয়ে শুয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলো। আকাশ দেখতে খুবই ভালো লাগে ওর। দেখতে দেখতে বিকেল গড়িয়ে এলো।
মেঘালয় মিশুকে বলল, “চলো এবার ওদের কাছে যাই। অনেক্ষণ এখানে বসে আছি।”
-“আমার ইচ্ছে করছে আজীবন এখানে থেকে যাই।”
মেঘালয় হাসলো। হাত ধরে মিশুকে টেনে তুলে আস্তে আস্তে হেঁটে ওর বন্ধুদের দিকে আসতে লাগলো। অনেক্ষণ পাথরের উপর বসে গল্প করেছে ওরা, একে অপরকে পানি আর পাথর দিয়ে মারামারি করেছে। মিশুর মজার মজার কথা শুনে বিভোর হয়ে রইলো মেঘালয়।
সূর্য পশ্চিমাকাশে হেলে পড়ার পর সূর্যাস্ত দেখতে দেখতে ওরা নৌকায় করে আবারো ঘাটের দিকে ফিরছিলো। আজকের দিনটা অন্যরকম একটা দিন ছিলো। সন্ধ্যার আগ মুহুর্তে বিছানাকান্দির সৌন্দর্য একদম মোহনীয় হয়ে উঠে। মিশু বারবার বলতে লাগলো, “পাথর কেন খাওয়া যায় না? বালি কেন খাওয়া যায়না? মেঘালয় কেন খাওয়া যায়না?”
পূর্ব বলল, “মেঘালয় খাওয়া যায়।”
সবাই হেসে উঠলো ওর কথা শুনে। নৌকায় ফেরার সময় সন্ধ্যা নেমে এসেছে। নদীর শীতল হাওয়ায় শরীর হিম হয়ে যাচ্ছে। তার উপর ভেজা কাপড়ে সবাই বসে আছে। শিরশির করে ঠাণ্ডা বাতাস লাগছে গায়ে। শরীর ফুড়ে যেন বাতাস ঢুকে যাচ্ছে ভেতরে। মেঘালয় মিশুকে ধরে রইলো। ওর উষ্ণ স্পর্শে মিশুর একটুও শীত করছে না। কিন্তু বাকিদের অবস্থা করুণ। রোদ রীতিমত ঠাণ্ডায় কাঁপছে। মেঘালয় সবকিছুতে অভ্যস্ত। সে পর্বতারোহণে গেলে কত ঠাণ্ডা সইতে হয়। হিমালয়ের বরফে জমে যাওয়ার মত অবস্থা হয়ে যায় একেবারে।
চলবে..

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে