অনুভূতি পর্ব ৩০

0
1910

অনুভূতি
পর্ব ৩০
মিশু মনি
.
৪৬.
রোদ বলতে আরম্ভ করলো,
“আমার বিয়ে ঠিক করা হয়েছিলো বাড়ি থেকে। অরণ্য’র বাবা আমার বাবার ভালো বন্ধু, উনি চেয়েছিলেন আমাদের পরিবারের সাথে সম্বন্ধ করতে। সেজন্যই বিয়ে পর্যন্ত আসা। আমি আগেই অরণ্যকে দেখেছিলাম কিন্তু অরণ্য আমাকে দেখেনি। ও দেখেছিলো দুপুরকে। আর ভেবেছিলো দুপুরের সাথেই ওর বিয়ে। তাই ওর বাবার প্রস্তাবে সম্মতি দিয়েছিলো। আমাদের প্রায় এক সপ্তাহের মত শুধুমাত্র ফোনেই কথা হয়েছে। তারপর বিয়ের দুদিন আগে আমরা আলাদাভাবে বাইরে দেখা করি। আমাকে অরণ্য’র পছন্দ হয়নি। কিন্তু সে ব্যাপারে কিছুই ও আমাকে বলেনি। ঠিকমত ফোন ধরত না আর। আমি ভাবতাম বিয়ের ঝামেলায় হয়ত ব্যস্ত আছে। কিন্তু বিয়ের আগের দিন রাতে ও আমাকে ফোন দিয়ে অনুরোধ করে বলে, ‘যেভাবে পারো বিয়েটা আটকাও। তোমাকে নিয়ে সারাজীবন কাটানো আমার পক্ষে সম্ভব না। আমি জানতাম না তুমি এমন দেখতে। আমি চাই, আমার বউ অন্তত আমার চেয়ে ফর্সা হোক। তোমাকে বিয়ে করলে সম্পর্ক বেশিদিন টিকবে না। অযথা দুজনের লাইফে তিক্ততা বাড়ানোর কোনো মানে হয়না। যেভাবে পারো বিয়েটা আটকাও।’ সেদিন অরণ্য’র কথা শুনে আমার ইচ্ছে করছিলো মাটির ভেতর ঢুকে যাই। আমিও ওকে ভালোবাসতে শুরু করেছিলাম আর এক সপ্তাহে অনেক স্বপ্নও দেখে ফেলেছিলাম। সব কষ্ট মেনে নিয়েও ওকে বলেছিলাম যেন নিজেই ওর বাবাকে বলে বিয়েটা ভেঙে দিতে। ও বলেছিলো, ‘আমার বাবাকে বললে আমাকে মেরে ফেলবে নয়ত ত্যাজ্য করবে।আব্বু খুব রাগী।’ আমি ওকে অনেক কিছুই বলে বোঝানোর চেষ্টা করেছি। কিন্তু ও মাত্র একটা কথা বলে আমাকে চিরতরে থামিয়ে দিয়েছে। ওর কথাটা ছিলো, ‘তুমি কি চাও তোমার স্বামী ঘরে তোমাকে রেখে অন্য মেয়ের কাছে যাক? যদি চাও তাহলে বিয়ে করো।”
নিখিল হতবাক হয়ে তাকালো রোদের দিকে। রোদ চোখ মুছে বললো, “একটা মেয়ের জন্য এরচেয়ে বড় অপমান আর হয়না রে নিখিল। যার সাথে রাত পোহালেই আমার বিয়ে,সে আমাকে বিয়ের আগের রাতে বলছে তুমি কি চাও তোমার স্বামী অন্য মেয়ের কাছে যাক? এটা কতটা অপমানের ভাবতে পারিস নিখিল?”
নিখিল রোদের হাত ধরে বললো, “কাঁদিস না প্লিজ। শক্ত হ রোদ। তুই এসব বাবাকে বলিস নি কেন?”
রোদ বললো, “আংকেলের সাথে আব্বুর খুব ভালো সম্পর্ক। আব্বু সারাক্ষণ বলতো ওনার কাছে সে সারাজীবন কৃতজ্ঞ থাকবে। আমি যদি এসব আব্বুকে বলতাম, আব্বু জনসম্মুক্ষে অরণ্য আর ওর বাবাকে অপমান করতো। আমিতো একটু হলেও অরণ্যকে ভালোবাসতে শুরু করেছিলাম। আমি চাইনি আমার জন্য ও অপমানিত হোক। কি করবো কিচ্ছু বুঝে উঠতে পারছিলাম না। বিয়ে হলেও আমি দাম্পত্য জীবনে কখনোই সুখী হতাম না। আর বিয়ে ভাঙতে চাইলে আব্বুকে বলতেই হবে, সেটাও পারছিলাম না। আমার ইচ্ছে করছিলো সুইসাইড করতে তাও পারিনি। অতটা সাহস আমার নেই। আমি সারারাত আর বিয়ের দিন সারাটা দিন কেঁদেছি, সন্ধ্যায় এমন অবস্থা হলো যে আর কিছু চিন্তাই করতে পারছিলাম না। চিন্তাশক্তি নষ্ট হয়ে গিয়েছিলো হয়ত। কিছুতেই কি করবো মাথায় কাজ করছিলো না আমার। অরণ্য সন্ধ্যার পর কল দিয়ে বলেছিল, ‘দোহাই লাগে তুমি বাড়ি থেকে চলে যাও। সেটাই আমাদের দুজনের জন্য ভালো হবে। আমার তখন মানসিক অবস্থা খুবই খারাপ, আমি সত্যি সত্যিই বাড়ি থেকে বেড়িয়ে পাগলের মত ছুটতে থাকি। আমি তখন বুঝিনি সে দুপুরকে বিয়ে করার জন্যই আমাকে পালাতে বলেছিল। জানলে আমি বাড়ি থেকে চলে যেতাম না নিখিল। বিশ্বাস কর আমাকে।”
রোদ আর কথা বলতে পারছে না। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে ও। অরণ্য রোদের হাত ধরে বললো, “একটু বোকামি করে ফেলেছিস। তোর উচিৎ ছিলো বাবাকে সবকিছু খুলে বলা। তাহলে একটা সমাধান হয়েই যেতো।”
রোদ বললো,”আমি ওর আর ওর বাবার সম্মানের কথা ভেবেছি, আমার বাবার সম্মান নিয়ে ভাবিনি। আমার চিন্তা করার মত অবস্থা ছিলোনা। তুই তো জানিস আমি লাইফে কখনো রিলেশনে জড়াইনি, জীবনে প্রথম অরণ্যকেই ভালোবাসতে চেয়েছিলাম। আমার সমস্ত স্বপ্ন নিমেষেই চুরমার হয়ে গেছে। আর এভাবে কেউ কখনো আমাকে অপমান করবে আমি সেটা ভাবিনি।”
রোদ কাঁদতে কাঁদতে ঢলে পড়লো নিখিলের কাঁধে। নিখিল ওকে ধরে বললো, “এখন তো আমার মাথা কাজ করছে না। দুপুর কখনোই আমাকে ছেড়ে অরণ্যকে নিয়ে সুখী হতে পারবে না। আর এখন সবচেয়ে বড় কথা, অরণ্য ছেলে হিসেবে ভালো হলে কি হবে ওর তো চাহিদা দুপুরের শরীরের প্রতি। বাহ্যিক সৌন্দর্য দেখেই ও দুপুরকে এত কেয়ার করছে। তার হাতে কিভাবে দুপুরকে ছেড়ে দেই আমি? আমি যে ওকে আমার চেয়েও বেশি ভালোবাসি। ওরকম একটা লোকের হাতে ওকে ছেড়ে দিতে আমার ঘৃণা হচ্ছে।”
রোদ কান্না থামিয়ে মাথা তুলে বললো, “তোদের ভালোবাসা একদম পবিত্র ছিলো। আমার মতে তুই গিয়ে ওকে নিয়ে আয় সেটাই ভালো হবে। আমার ভূলের জন্য তোরা প্লিজ লাইফটা নষ্ট করিস না। তুইও আজীবন পুড়বি,দুপুর ও কখনো সুখী হতে পারবে না। সবকিছু জেনেও কি তুই ওকে অরণ্য’র সাথে থাকতে দিবি?”
নিখিল একটু চুপ থেকে বললো, “আমি দুপুরকে নিয়ে আসবো। কিন্তু ভাবছি, হঠাৎ কথাটা শুনলে তোর বাবা নিজেকে সামলে নিতে পারবেন তো?”
রোদ নিশ্চুপ হয়ে গেলো। রাগ হচ্ছে ওর নিজের প্রতি। অরণ্য’র ভালোর কথা ভাবতে গিয়ে নিজের বাবাকে অনেক কষ্ট দিয়ে ফেলেছে ও। ভালোবাসা এমন ই হয়,বিবেক বোধ লোপ পেয়ে যায় ধীরেধীরে। এখন অনুশোচনা করেও লাভ হবেনা। দুপুরকে ছাড়িয়ে আনতে হবে।
নিখিল বললো, “আমি যতদূর জানি, আংকেল দুপুরকে খুবই আদর করেন। দুপুরকে অনেক বিশ্বাস করেন উনি। দুপুর যদি গিয়ে সবটা ওনাকে বুঝিয়ে বলেন তাহলে নিশ্চয়ই উনি বুঝবেন। তখন আর কষ্ট নিয়ে থাকবেন না, আর তোকেও ঠিকই বুঝবেন উনি।”
রোদ মাথা ঝাঁকিয়ে বললো, “ঠিক বলেছিস। আমার ভূলের জন্য এতকিছু হচ্ছে। আমার ভূলটা তুই শুধরে দিবি প্লিজ? তুই দুপুরকে নিয়ে গিয়ে বাবার কাছে সবকিছু বুঝিয়ে বলবি।”
– “চিন্তা করিস না। সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। আমি তোকে কথা দিচ্ছি,আংকেল নিজে থেকে তোকে ডেকে বাসায় নিয়ে যাবে দেখিস।”
– “তাই যেন হয় রে। মান সম্মান যা যাবার তা তো গেছেই, দুপুরের লাইফটা নষ্ট করিস না। খুব ভালো মেয়ে ও।”
নিখিল রোদের হাত ধরে ওকে অনেক কিছু বুঝিয়ে বললো। ওর কথাগুলো শুনতে শুনতে অনেকটা চিন্তা দূর হলো রোদের। নিখিল ওর বন্ধু শিহাবকে কল দিয়ে বলল ওর গাড়িটা নিয়ে নিখিলকে সিলেট রেখে আসতে পারবে কিনা।
শিহাব বললো, “হুট করেই সিলেট কি জন্য?”
– “তোকে আমি যেতে যেতে সব বলবো। বাসে গেলে অনেক সময় লাগবে, কিন্তু আর একটা সেকেন্ড ও দেরি করার ইচ্ছে আমার নেই। প্লিজ দোস্ত চলনা যাই।”
– “আমিতো মনিহারে,মুভি দেখছি। গার্ল ফ্রেন্ড নিয়ে আসছি।”
– “শো শেষ হবে কখন? অনেক রাত তো হয়েই গেলো, এত রাতে হলে তুই? আমার দম বন্ধ হয়ে আসতাছে দোস্ত। আমাকে যেতেই হবে।”
– “আচ্ছা হাফ এন হাওয়ার টাইম দে। তুই রেডি হয়ে মোড়ে আয়, আমি ওকে বাসায় রেখে আসছি।”
নিখিল ফোন রেখে রোদের দিকে তাকিয়ে বললো, “আমি বের হচ্ছি। এখানকার এক ফ্রেন্ড আসবে গাড়ি নিয়ে।”
নিখিল রুমে এসে দ্রুত রেডি হয়ে নিলো। রোদ ওর রুমে এসে বিছানার উপর বসে আছে। ওর চোখ এখনো ভেজা। নিখিল রেডি হতে হতেও ওকে অনেক কিছু বোঝালো। বড় বোনকে ডেকে সিলেট যাওয়ার কথা বুঝিয়ে বললো নিখিল। তারপর যখন বের হতে যাবে রোদ এসে ওর পিছনে দাঁড়িয়ে বললো, “আমাকে নিয়ে যাবি নিখিল?”
নিখিল রোদের দিকে তাকালো। রোদ বললো, “আমার বাসায় দম বন্ধ হয়ে আসবে। টেনশন হবে খুব। তোরা তো গাড়ি নিয়ে যাচ্ছিস, আমাকে সাথে নিয়ে যা। আবার তোর ফ্রেন্ডের সাথে না হয় ফিরে আসবো। তোরও এতটা পথ ভালো লাগবে না। আমরা দুজন কথা বলতে বলতে যেতে পারবো।”
নিখিল একটু ভেবে বললো, “আচ্ছা শাড়িটা বদলে আপুর একটা ভালো শাড়ি পড়ে আয়। আপুর তো জামাও নেই,সব শাড়ি।”
রৌদ্রময়ী শাড়ি বদলে একটা ভালো শাড়ি পড়ে আসলো। বোনের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে দুজনে বেড়িয়ে পড়লো সিলেটের উদ্দেশ্যে।
ওরা পুরোটা রাস্তা বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলতে লাগলো। নিখিল রোদ আর শিহাব মিলে প্লান করে ফেললো দুপুরকে নিয়ে ও সোজা ঢাকায় চলে যাবে। বিয়ে করে তারপর রোদের বাবার সামনে গিয়ে হাজির হবে। এই কটা দিন রোদকে নিখিলের বোনের বাসায় থাকতে হবে। সবকিছু গুছিয়ে নিয়ে বাবা নিজে থেকে ডেকে নেয়ার পর রোদ বাসায় ফিরবে, তার আগে নয়। দুপুরকে হারানোর পরও আবার ফিরে পাওয়ার উত্তেজনায় উত্তেজিত হয়ে রইলো নিখিল। রোদ শুধু প্রার্থনা করছে সবকিছু যেন ঠিক হয়ে যায়।
৪৭.
হোটেল থেকে বের হওয়ার জন্য রেডি হয়ে নিলো দুপুর ও অরণ্য। লবিতে এসে মেঘালয়দের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলো। অরণ্য গিয়ে একটা সোফায় বসে পড়েছে। দুপুরের বসতে ইচ্ছে করছে না। ও চুপচাপ দাঁড়িয়ে ফ্লোরের দিকে চেয়ে আছে।
আজকে মেঘলয়রা হোটেল ছেড়ে দেবে। সেজন্য ওদের একটু সময় লাগছে বের হতে। হঠাৎ চোখ ঘুরাতেই একটা সোফায় নিখিলকে দেখে চমকে উঠলো দুপুর। ওর সমস্ত শরীরে যেন বিদ্যুৎ খেলে গেলো। নিখিল এখানে বসে আছে এটা কিভাবে সম্ভব! রাতেই তো ওর সাথে কথা হলো। সত্যি সত্যি চলে এসেছে ও! ভাবতেও পারছে না দুপুর। এখন কি করবে? হাত পা কাঁপতে লাগলো ওর।
নিখিল ইশারায় ফোনে কথা বলার ইংগিত দিলো। দুপুর ব্যাগ থেকে ফোন বের করে অন করলো। একটা মেসেজ এলো নিখিলের নাম্বার থেকে, “tomar sathe onek kotha ache. any how hotel theke ber hoba. amake ektu somoy dao please.khub important.”
দুপুর গিয়ে অরণ্য’কে বললো, “আমার সানস্ক্রিন টা একটু নিয়ে আসবেন রুম থেকে? আজ বাইরে খুব রোদ উঠবে মনেহচ্ছে।”
অরণ্য হেসে উঠে দাঁড়াল। দুপুর সোফায় বসে বললো, “আমি এখানে বসছি। নিয়ে আসুন একটু কষ্ট করে। বউয়ের সেবা যত্ন করতে হয় একটু।”
বলেই হাসার চেষ্টা করলো। ব্রান্ডের নাম শুনে নিয়ে অরণ্য দ্রুত লবি থেকে বেড়িয়ে রুমের দিকে যেতে লাগলো। দুপুর ইশারায় নিখিলকে বাইরে বের হতে বলে লবি থেকে বের হলো। ওর পিছনে নিখিল ও উঠে বেড়িয়ে আসলো। এক ছুটে এসে লিফটের সামনে দাঁড়ালো। নিখিল এসে ওকে নিয়ে লিফটে ঢুকেই বোতাম টিপে দিলো। দুপুরের দিকে এক পলক চেয়েই ওর হাত টেনে ধরে বুকে জাপটে ধরলো। এত কষ্টের পর নিখিলকে দেখতে পেয়ে দুপুর ও নিজেকে সামলাতে পারলো না। শক্ত করে জড়িয়ে ধরে কান্না করে দিলো।
হোটেল থেকে বেড়িয়ে এসে গাড়িতে উঠতে বললো দুপুরকে। দুপুর সংকোচ করছিলো উঠতে। নিখিল বলল, “অনেক কথা আছে। ওঠো।”
দুপুর গাড়িতে উঠে বসামাত্রই ডানপাশে রৌদ্রময়ীকে দেখে অবাক হয়ে গেলো। নিখিল গাড়িতে ওঠামাত্র শিহাব গাড়ি স্টার্ট দিলো। দুপুর একবার নিখিলের দিকে তাকাচ্ছে, আরেকবার রোদের দিকে তাকাচ্ছে। ওর চোখ কপালে উঠে গেলো একেবারে। কি হতে চলেছে কিছুই বুঝতে পারছে না ও। কিছুক্ষণ গাড়ি চলার পর কোথায় এসে দাঁড়ালো দুপুর বুঝতে পারলো না। গাড়ি থেকে নেমে একটা পার্কের মতন জায়গায় চলে এলো ওরা। বেঞ্চিতে দুপুরকে বসিয়ে নিখিল একদম শুরু থেকে এখন পর্যন্ত যা কিছু ঘটেছে সবটাই বুঝিয়ে বললো দুপুরকে। সব শুনে কান্নাভেজা চোখে রোদের দিকে তাকালো দুপুর। নিজেকে সামলাতে পারলো না কিছুতেই। বোনকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলো।
কান্নাকাটি থামলে নিখিল দুপুরকে জিজ্ঞেস করলো, “তুমি কি আমার হাত ধরতে চাচ্ছো দুপুর?”
প্রশ্নটা সরাসরি হৃদপিন্ডে গিয়ে আঘাত করলো দুপুরের। এই ছেলেটাকে ছাড়া বাঁচার কথা চিন্তাও করতে পারতো না ও। কিন্তু এখন যে ও অন্য কারো স্ত্রী। একটা বাঁধনে জড়িয়ে গিয়েছে সে, হাজার চাইলেও অরণ্য এখন ওর স্বামী। তাকে ফেলে চলে যাওয়াটা কি ঠিক হবে? করুণ চোখে নিখিলের দিকে তাকালো দুপুর।
নিখিল জিজ্ঞেস করলো, “কি ভাবছো? তুমি না চাইলে জোড় করবো না। তবে আমি এসেছি তোমাকে নিয়ে যাওয়ার জন্যই। কিন্তু তোমাকে একবার জিজ্ঞেস করা উচিৎ। তুমি কি আমাকে ভালোবাসো?”
ভালোবাসা শব্দটা শুনে সমস্ত প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গেলো দুপুর। ভালোবাসার জন্য চরম স্বার্থপরতাও করা যায়। নিখিলের মত করে অরণ্য এ জীবনেও ওকে ভালোবাসতে পারবে না। তাছাড়া সবকিছু শোনার পর অরণ্য’র সাথে সংসার করার বিন্দুমাত্র ইচ্ছেও ওর নেই। বরং ঘৃণা হচ্ছে অরণ্য’র প্রতি। রোদের মত একটা মেয়েকে যে এভাবে অপমান করতে পারে, সে আর যাই হোক কখনো কাউকে ভালোবাসতে পারবে না।
দুপুর এগিয়ে এসে নিখিলের চোখের দিকে তাকিয়ে বললো, “হারানোর যন্ত্রণা কতটুকু জানো না? এই কয়টা দিনে আমি হারে হারে বুঝেছি। হারিয়েও আবার ফিরে পেয়ে কি করে ফেরাই তোমায়?”
সবকিছুর সমাধান তো হয়েই গেলো। রোদ ভয় পেয়েছিলো দুপুর আসতে আপত্তি জানায় কিনা সেটা ভেবে। এখন আর চিন্তা নেই। বাবার সাথে দুপুর মুখোমুখি হলে সবই ঠিক হয়ে যাবে আশা করা যায়। রোদ দুপুরের হাত ধরে বললো, “তোরা খুব সুখী হবি দেখিস।”
দুপুর বললো, “সবই ঠিক আছে। কিন্তু এখনি বাসায় যাওয়া যাবে না। অন্তত কটা দিন আমাদের গা ঢাকা দিয়ে থাকতে হবে। এখনি অরণ্য আমাদের দেখা পেলে একটা ঝামেলা বাঁধবে।”
কথাটা একেবারে খারাপ বলেনি। কোথাও উঠতে পারলে বেশ হতো। তারপর বাবাকে সেখানেই ডেকে নিয়ে সবটা বুঝিয়ে বলতে হবে। কিন্তু নিখিলকে গ্রামের লোকজনের সামনে নিয়ে যাওয়া যাবেনা। এলাকাবাসী নানান কথা বলবে। কিন্তু থাকার মত কোনো জায়গা তো দরকার। ভাবতেই দুপুরের মিশুর কথা মনে পড়ে গেলো। মিশু বলেছিলো মেঘালয় একটা বাড়ি দিয়ে দিয়েছে ওকে। ওর বাড়িতে গিয়ে কিছুদিন নিরাপদে থাকা যাবে। মিশু আর মেঘালয়ের মত কাউকে জীবকে দেখেনি দুপুর। ওরা খুবই অন্যরকম একটা জুটি, ওদেরকে বুঝিয়ে বললে একটা ভালো উপায় বের হবে।
দুপুর নিখিলকে কথাটা বলতেই নিখিল রাজি হয়ে গেলো। দুপুরের সিদ্ধান্তের উপর নির্ভর করা যায়। রাতে যখন মিশুর ফোনটার সাথে ফোন বদল হয়ে গিয়েছিলো, তখন মিশুর ফোন থেকে দুপুর নিজের নাম্বারে কল দিয়েছিলো একবার। তারমানে মিশুর নাম্বার ওর ফোনে আছে।
দুপুর ফোন বের করে দেখল অরণ্য অসংখ্যবার কল দিয়েছে। ও মিশুর নাম্বার টা নিখিলের ফোনে তুলে নিয়ে নিজের ফোন একেবারে বন্ধ করে ব্যাগে রেখে দিলো। তারপর মিশুর নাম্বারে একটা টেক্সট পাঠালো, “আমি দুপুর। তোমার সাথে জরুরি কথা আছে, কিন্তু অরণ্যকে বুঝতে দিওনা আমি মেসেজ পাঠিয়েছি। মেসেজ দেখে থাকলে সাইডে এসে কল ব্যাক করো।”
কিছুক্ষণ পরেই মিশুর নাম্বার থেকে কল এলো। দুপুর মেঘালয়কে ফোন দিতে বললে মিশু মেঘালয়ের হাতে ফোন দিলো। মেঘালয় বললো, “হ্যালো।”
– “ভাইয়া আমি দুপুর। আপনারা এখন কোথায়?”
– “আমরা এখনো রুমে। এখন বের হবো। তোমরা কি লবিতেই আছো?”
– “আপনার সাথে আমার কিছু জরুরি কথা আছে। আপনি কি একটু কষ্ট করে আসতে পারবেন? আসলে সবকিছু খুলে বলবো। কিন্তু দয়া করে কাউকে বুঝতে দিবেন না আমি ফোন দিয়েছিলাম।”
কথা শেষ করে মিশুকে রুমে রেখে দুপুরের নাম্বার টা নিজের ফোনের ডায়ালে নিয়ে মেঘালয় হোটেল থেকে বেড়িয়ে এলো। নানান প্রশ্ন ওর মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিলো। গাড়ি নিয়ে দ্রুত এসে হাজির হলো ওদের কাছে। কিন্তু রৌদ্রময়ীকে দেখে আরো একটু অবাক হলো মেঘালয়। তারমানে একটা জট এই মেয়ের সাথেই আছে। রৌদ্রময়ীও বিস্মিত হলো মেঘালয়কে দেখে। ওদেরকে ট্রেনে দেখেছিলো ও। ওর সাথে থাকা মেয়েটা খুব করে এসে আলাপ জমাতে চাইছিল। সেই মেয়েটাই তাহলে মিশু! চমকালো রৌদ্রময়ী।
সবকিছু শোনার পর মেঘালয় একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বললো, “একদম ভালো একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। আপনারা আমার বাসায় গিয়ে উঠতে পারেন। বাড়ি একদম ফাঁকা। যেকোনো হেল্প লাগলে শুধু একবার স্মরণ করবেন আমাদের।”
দুপুর মেঘালয়ের হাত ধরে বললো, “আমার কোনো ভাই নেই। আজ থেকে তুমি আমার ভাই। তোমাকে দেখেই আমার হিংসে হচ্ছিল, আর নিখিলকে কল দিয়ে কাল কান্নাকাটি করেছিলাম। নয়ত ওকে সারাজীবনের মত হারিয়ে ফেলতাম।”
মেঘালয় হাসলো। রৌদ্রময়ী দুপুরের বোন সেটা কালকেই ও নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিলো। আর রোদের সাথে অরণ্য’র বিয়ের কথা ছিলো, কিন্তু রোদ বাড়ি থেকে পালিয়ে যাওয়ার কারণে দুপুরের সাথে বিয়ে হয়েছে সেটা আগেই আন্দাজ করেছিলো মেঘালয়। আজকে সমস্ত জট খুলে গেলো।
মেঘালয় বললো, “নিশ্চিন্তে চলে যাও বোন। মিশুর মুখে আমার গল্প শুনে বিশ্বাস করে আমাকে ডেকে এনে এসব শেয়ার করলে তাতেই আমি অনেক বেশি সন্তুষ্ট। এরকম বিশ্বাস আজকাল কে কাকে করে? হাজার হলেও আমি অরণ্য’র বন্ধু।”
– “আপনার মত মানুষ হয়না মেঘালয় ভাইয়া। পৃথিবীর সব মানুষ যদি আপনার মত হতো!”
– “তোমরা তাহলে এখনি বেড়িয়ে পড়ো। আমি আম্মুকে জানিয়ে দিবো, চাবি পাঠিয়ে দিবে। আর বিয়ে পড়ানো সংক্রান্ত যেকোনো জটিলতায় আমাকে কল দিও। আর হ্যা, টাকার দরকার হলে লজ্জা না পেয়ে জাস্ট একটা ছোট্ট মেসেজ দিবা ওকে?”
নিখিল এগিয়ে এসে জড়িয়ে ধরলো মেঘালয়কে। এরকম ছেলেও পৃথিবীতে আছে! শিহাব ও জড়িয়ে ধরলো মেঘালয়কে।
মেঘালয় রৌদ্রময়ীকে বলল, “আপনার মানসিক অবস্থা ভালো নেই এখন। একা একা ওনার বোনের বাসায় গিয়ে কি করবেন? তারচেয়ে বরং আমাদের সাথে এখানে তিনটা দিন থেকে যান। আমরা আজকে হোটেল ছেড়ে দিচ্ছি। চা বাগানে পুরো বাংলোটাই আমাদের জন্য। থাকার কোনো সমস্যাই হবেনা।”
দুপুর উচ্ছ্বসিত হয়ে রোদকে বললো, “আপু, মিশুর মত একটা চমৎকার মেয়ে কোথাও পাবিনা। আর ওনার সব বন্ধুরাই এত ভালো আর মজার। তোর খুব ভালো লাগবে, মনটা ভালো হয়ে যাবে দেখিস।”
রোদ বললো, “আচ্ছা ঠিকাছে। আমি তাহলে থেকে যাই। তোরা নিজেরা সাবধানে থাকবি।”
এতক্ষণে হাসি ফুটে উঠলো রোদের মুখে। নিখিল ও দুপুর বিদায় নিয়ে চলে গেলো শিহাবের গাড়িতেই। অন্য কোথাও থেকে ঢাকার গাড়িতে উঠবে ওরা। আর মেঘালয় রৌদ্রময়ীকে নিয়ে একটা রেস্টুরেন্টে এসে ওকে বসিয়ে রেখে নাস্তা দিতে বললো। তারপর নিজের ফোনটা ওর হাতে দিয়ে বললো, “এটা আপাতত আপনার কাছে রাখুন। ফোন খুব দরকারি। আমি এক্ষুনি হোটেলে যাবো আর ওদেরকে নিয়ে চলে আসবো।”
রোদ খুব অবাক হলো মেঘালয়ের উদারতা দেখে। এতকিছুর পর আবার নিজের দামী মোবাইল টাও ওর হাতে দিয়ে যাচ্ছে। এতটাও বিশ্বাসী কেউ হয়? সত্যিই দুপুর ঠিকই বলেছে। মিশু অনেক ভাগ্য করে এমন একজন মানুষ পেয়েছে। দুপুরের হিংসে হওয়ার কারণ যথার্থ। এমন একজনকে পেলে সুখী না হয়ে উপায় আছে?
চলবে..

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে