অনুভূতি
পর্ব ২৯
মিশু মনি
.
৪৪.
মেঘালয় ও মিশু দুষ্টুমিতে মেতে উঠেছে। মিশুর পাগলামি দেখে হেসেই খুন হয়ে যাচ্ছে মেঘালয়। মিশু রাক্ষসের মত তেড়ে এসে আলতো করে ছুঁয়ে দেয় মেঘালয়কে, মেঘালয় ভাবে বোধহয় খুব জোরে ঘুষি বসাবে ওর নাকে। কিন্তু না, মিশু ঘুষি দিতে এসে হাতটা মেলে আলতো করে মেঘালয়ের থুঁতনিটা টিপে ধরে বললো, “ভাত দে নয়ত মানচিত্র খাবো থুক্কু হাত দে নয়ত ঘাড় মটকাবো।”
মেঘালয় হাত বাড়িয়ে দেয়, মিশু ওর হাত ধরে মটকানোর চেষ্টা করে হাতটা তুলে হাতের পিঠে চুমু দেয়। মেঘালয় হো হো করে হেসে উঠে। বাচ্চাদের মত খেলা শুরু করেছে মেয়েটা। হাস্যকর থ্রেড দেয়, “সেচ্ছায় হৃদসমর্পণ করো নয়ত চুমু ছুড়তে বাধ্য হবো।”
মেঘালয় বললো, “হৃদয় সমর্পণ করবো না। আপনি হুমকি কার্যকর করুন।”
এরপর মিশু সত্যি সত্যি যা ছুড়তে চেয়েছে, সেটা ছুড়তে আরম্ভ করে। মেঘালয় ওর অত্যাচারে রীতিমত সুখের সমুদ্রে ভাসছিলো। এমন সময় দরজায় কে যেন নক করলো। মিশু বিরক্ত হয়ে বললো, “এই সময়ে কে এলো বলোতো? ভাল্লাগেনা।”
মেঘালয় দরজার কাছে এসে জিজ্ঞেস করলো, “কে?”
ওপাশ থেকে দুপুরের গলা শোনা গেলো, “আমি দুপুর। একটু দরজা টা খোলা যাবে?”
মেঘালয় লাফিয়ে বিছানার উপর উঠে শুয়ে পড়ল। মিশুকে বললো, “তুমি যাও।”
মিশু মুখ কাচুমাচু করে দরজা খুলতে চলে গেলো। সামান্য একটু খুলে মাথা বাড়িয়ে বললো, “ভাবি কি হইছে?”
দুপুর ওর হাতের ফোনটা এগিয়ে দিয়ে বললো, “আমাদের দুজনের একই ফোন আর একই কভার। ভূলেই ফোনটা বদল হয়ে গেছে। তোমার টা আমার ব্যাগে চলে গিয়েছিল।”
– “ওহ আচ্ছা। থ্যাংকস ভাবি।”
– “আমার ফোনটা মনেহয় তোমার ব্যাগে, ওটা একটু দাও। বাসায় কথা বলবো তো।”
– “একটু কষ্ট করে দাঁড়ান নিয়ে আসছি।”
মিশু ওর ফোনটা নিয়ে দ্রুত গিয়ে ব্যাগ খুলে দুপুরের ফোনটা বের করলো। দরজার একটু ফাঁক দিয়েই বিছানায় শুয়ে থাকা মেঘালয়ের শরীর চোখ এড়ালো না দুপুরের। মেঘালয় উপুর হয়ে শুয়ে আছে, খালি গায়ে। ওর ফর্সা পিঠে অজস্র ঠোঁটের চিহ্ন। অমন প্রশস্ত আর আকর্ষণীয় পিঠ টায় লাল লিপস্টিকের দাগ দেখেই ভেতরে কাঁপন ধরে গেলো। দুপুরের ভেতর টা দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছিলো। ও চোখ ফিরিয়ে নিলো।
মিশু ফোন নিয়ে এসে যখন হাত বাড়িয়ে এগিয়ে দিলো ওর দিকে, দুপুর একবার মিশুর আপাদমস্তক তাকালো। গেঞ্জি ও কোয়ার্টার প্যান্ট পড়া মিশুকে সন্ধ্যায় দেখা শাড়ি পড়ার মিশুর থেকে একদম আলাদা লাগছে। তখন দেখে একজন পরিপূর্ণ স্ত্রী মনে হয়েছিলো, আর এখন মনেহচ্ছে উচ্ছল কিশোরী। ঝর্ণার মত উচ্ছল মেয়েটিকে প্রকৃতি নিজ হাতে গড়েছে। রূপ যেন উপচে পড়ছে পুরো শরীরে। আর চোখে মুখে একটা অপার্থিব সুখের নেশা লেগে আছে। অসম্ভব ঘোর ওই চোখে। মিশুকে দেখে এখন যে কেউ বলবে, এই মেয়েটা নিঃসন্দেহে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মেয়ে। এত সুখী বোধহয় কেউ কক্ষনো হয়না। মুখে প্রসন্ন হাসি, চুলগুলো এলোমেলো,আকর্ষণী
য় চেহারাটা টি শার্টে আরো বেশি আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে। লাজ রাঙা চিবুক গোলাপি আভা ধারণ করেছে। এত সুখী কেন এই মেয়েটা?
ফোন নিয়েই দুপুর আর এক মুহুর্ত দাঁড়ালো না। ওর কেমন যেন কষ্ট হচ্ছে মেঘালয় ও মিশুকে এরকম অবস্থায় দেখে। আত্মা ফেটে কান্না আসতে চাইছে। মনেহচ্ছে গায়ে কেউ আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। হিংসা, ক্ষোভ,হারানোর কষ্ট, মানসিক যন্ত্রণা, অরণ্য’কে মেনে নেয়ার চাপ, নিখিলকে জোর করে সরানো সবকিছু মিলে এত বেশি কষ্ট হচ্ছে যা কাউকে বলে বোঝানো সম্ভব না।
দুপুর ছুটতে ছুটতে এসে সিঁড়ির কাছে এসে থামলো। ধপ করে সিঁড়িতে বসে পড়ে হাফাতে লাগলো। তীব্র যন্ত্রণা হচ্ছে ওর ভেতরে। অন্যরকম একটা যন্ত্রণা মাথায় যেন পিন ফুটাচ্ছে। দুপুর নিখিলকে কল দিয়ে ফেললো।
নিখিল রিসিভ করামাত্রই দুপুরের কান্নার শব্দ শুনতে পেলো। হাউমাউ করে কাঁদছে মেয়েটা। নিখিল হতবাক হয়ে গেলো ওর কান্নার শব্দ শুনে। বললো, “দুপুর কাঁদছ কেন? কি হয়েছে?
দুপুর কান্নার জন্য কথাই বলতে পারছে না। কোনমতে একটু সামলে নিয়ে বললো, “নিখিল,আই লাভ ইউ।”
নিখিল নির্বাক! হঠাৎ দুপুরের মুখে এই কথাটা তাও আবার এমন সিচুয়েশনে, অকল্পনীয় লাগছে ওর কাছে। নিশ্চুপ হয়ে রইলো ও।
দুপুর বললো, “নিখিল, আমি তোমার। আমি শুধুই তোমার। আমার শরীরের প্রত্যেকটা লোমকূপ তোমার। নিখিল আমাকে নিয়ে যাও তোমার কাছে প্লিজ।”
আচমকা এমন কথা শুনে বাকরুদ্ধ হয়ে গেলো নিখিল। ওর ভেতরের চাপা কষ্টগুলো মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে লাগলো। জিজ্ঞেস করলো, “কি হইছে দুপুর?”
দুপুর বললো, “আমি তোমাকে অজস্র কামড় দিতে চাই। তোমার গলা, ঘাড়, কাঁধ, পিঠ, বুক সবখানে। দাগ বসিয়ে দিবো আমি। নিখিল প্লিজ আমাকে নিয়ে যাও। প্লিজ নিয়ে যাও আমাকে।”
নিখিল দুপুরের এমন পাগলামি কথাবার্তা শুনে কথা বলার শক্তি হারিয়ে ফেলেছে প্রায়। দুপুর কখনোই এ ধরণের কথাবার্তা বলেনা। আজকে তার কি হলো হঠাৎ করে? নিখিলের মুখে কথা ফুটছে না।
দুপুর বললো, “আমিও মিশুর মত সুখী হতে চাই। আমার কষ্ট হচ্ছে। খুব কষ্ট হচ্ছে।”
– “মিশু কে?”
দুপুর বললো, “মিশু মেঘালয়ের স্ত্রী। জানো মেঘালয় ওকে কত ভালোবাসে? আজকে পাক্কা দুই ঘন্টা মিশুর মুখে ওর আর মেঘালয়ের ভালোবাসার গল্প শুনেছি আমি। মিশুর কি পরিমাণ কেয়ার করে জানো না। ওদেরকে দেখলে মনেহয় পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ ওরা। আমার সহ্য হচ্ছেনা নিখিল। এমনিতে সবদিক থেকে মানসিক চাপ, আর এখন এমন যন্ত্রণা হচ্ছে যে আমার নিজের শরীরটা ব্লেড দিয়ে কুচি কুচি করে কেটে ফেলতে ইচ্ছে করছে। আমার ও খুব ইচ্ছে করছে মেঘালয়ের মত তোমার গলায় অজস্র দাগ করে দেই।”
নিখিল বললো, “এসব পাগলামি কেন করছো? তুমি কোথায় এখন?”
দুপুর বললো, “আমি হোটেলের সিঁড়িতে। আমি রুমে যাবো না। ওই লোকটাকে আমি কিছুতেই মানতে পারছি না। আমি গাড়িতে উঠে ফাঁকি দিয়ে স্লিপিং পিল খেয়েছিলাম। পুরোটা রাস্তা ঘুমিয়েছি আমি। আর হোটেলে ফিরেই মিশুদের সাথে বাইরে বেড়িয়ে গেছি। আমার একদম ই ওই লোকটার সাথে একটা সেকেন্ড কাটাতে ইচ্ছে করছে না।”
নিখিল বললো, “সেদিন তো এসব ভাবোনি। আমি এখন কি করবো তুমি বলো? তুমি তো আমাকে ফোন দিয়ে কাঁদছ, আমি কার কাছে বলবো আমার কষ্টের কথা?”
– “আমার ইচ্ছে করছে রৌদ্রময়ীকে খুন করে ফেলতে। ওর মত বড় বোন দুনিয়াতে থাকার চেয়ে না থাকাই ভালো। কোনোদিনো সামনে পেলে ওকে খুন করে ফেলবো।”
দুপুর খুব অস্বাভাবিক ভঙ্গিতে কথা বলছে। শুনতে খারাপ লাগছে নিখিলের। ভেতরটা ভেঙে চুরমার হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু কিছুই যে করার নেই আর। দুপুরকে সান্ত্বনা দেয়ার মত কোনো শব্দও খুঁজে পাচ্ছেনা ও।
দুপুর বললো, “মিশুকে দেখলেই আমার গা জ্বলে যাচ্ছে। মিশুকে একটু আগে দেখে ইচ্ছে করছিলো ওর চুল টেনে ধরে গলা টিপে মেরে ফেলি ওকে।”
নিখিল একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, “এভাবে বলছো কেন? মিশুর কি দোষ? অন্যকে দেখে এভাবে হিংসে করতে হয়না দুপুর। তুমি তো এমন ছিলে না।”
দুপুর বললো, “আমার পুরো শরীরে কষ্ট হচ্ছে নিখিল। তোমাকে না পাওয়ার কষ্ট, সারাজীবনের মত হারানোর কষ্ট, অরণ্যকে মেনে নেয়া,রোদের এই কাজ সবকিছু আমাকে প্রতিনিয়ত দগ্ধ করে যাচ্ছে। আমি এই কটা দিন পাথর হয়ে ছিলাম। আজ মিশু আর মেঘালয়কে দেখে আমার প্রচণ্ড কষ্ট হচ্ছে নিখিল। সহ্য করতে পারছি না আমি। প্লিজ আমাকে খুন করে রেখে যাও।”
-“পাগলামি করোনা দুপুর,রুমে যাও। তুমি এখন হোটেলে, মাথায় রাখো সেটা। কন্ট্রোল হারিয়ে ফেলো না। অরণ্য’র একটা প্রেস্টিজ আছে।”
দুপুর চুপ করে গেলো। কথাটা সত্যি কিন্তু প্রচণ্ড তিক্ত লাগছে শুনতে। ও বলল, “আমার কথা শুনে রাগ হচ্ছে তাইনা? আমাকে এখন ঘৃণা করো তুমি?”
– “কি উলটা পালটা বলছো এসব? তোমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে, যাও রুমে যাও।”
– “হ্যা আমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে। আমি তোমাকে ছাড়া বাঁচার কথা ভাবতেও পারতাম না। সেই আমি কিভাবে আছি ভাবতে পারো?”
– “বুঝতে পারছি। এখন রুমে যাও, সিঁড়িতে বসে এসব কথাবার্তা বলছো? কেউ দেখলে কি ভাব্বে?”
– “আমাকে এখন আর সহ্য হয়না বললেই পারো। ফোন রেখে দাও ”
– “অযথা ভূল বুঝছো দুপুর। তোমাকে ভালোর জন্য বলছি রুমে যাও।”
– “আমার মরে যেতে ইচ্ছে করছে। কষ্ট হচ্ছে বলে তোমাকে ফোন দিলাম আর তুমিও এমন করছো?”
নিখিল কিছু বলতে চাচ্ছিলো তার আগেই কল কেটে গেলো। এরপর কল ব্যাক দিয়ে দেখলো নাম্বার বন্ধ। নিখিলের পায়ের নিচ থেকে যেন মাটি সরে যাচ্ছিলো। দুপুর এমন একটা মেয়ে, যে নিখিলকে ছাড়া কিচ্ছু বুঝতে চাইতো না। পাগলের মত ভালোবাসতো ও নিখিলকে। এইতো সেদিন, নিখিলের মেসে রান্না হয়নি, ও দুপুরবেলা অব্দি না খেয়ে ছিলো। দুপুর কল দিয়ে জিজ্ঞেস করলে ও বললো, “রান্না হয়নি আজকে। আমি ঘুমাচ্ছি। ঘুম থেকে উঠে বাইরে গিয়ে খাবো।”
– “এখনি যাও প্লিজ।”
– “আমার এখন একদম ই ভালো লাগছে না। মেজাজ খারাপ লাগছে, আজকে রুম থেকে মানিব্যাগ হারিয়ে গেছে। রুমমেটরা সবাই বাসায় চলে গেছে, আমি মানিব্যাগ রেখে গোসলে গিয়েছিলাম। এসে আর পাইনি।”
– “ফোন নিয়ে যায়নি শুধু মানিব্যাগ নিয়ে গেছে?”
– “তার হয়ত শুধু টাকাই দরকার ছিলো। সেজন্য মানিব্যাগ নিয়ে গেছে। এখন হাতে একটা পয়সাও নাই, আব্বু টাকা পাঠাবে তারপর নীচে নামবো।”
কথাটা শুনে দুপুরের প্রচণ্ড মন খারাপ হয়ে গিয়েছিলো।
সেদিন বিকেলে আবারো নিখিলকে কল দেয় ও। নিখিল রিসিভ করলে বলে, “তুমি একটু গুলিস্তান আসতে পারবা?”
– “কেন?”
– “আমি গুলিস্তানে অপেক্ষা করছি তোমার জন্য। একটু রিক্সা নিয়ে চলে আসবা প্লিজ? রিক্সাভাড়া আমি দিয়ে দিবো।”
হতবাক হয়ে কিছুক্ষণ চুপ থেকে নিখিল বলল, “তুমি দাড়াও আমি আসছি।”
দ্রুত পাগলের মত ছুটে চলে এসেছে নিখিল। এসে দেখে ফ্লাইওভারের নিচে টিফিন ক্যারিয়ার হাতে দুপুর দাঁড়িয়ে। তিন বাটির টিফিন ক্যারিয়ারে করে খাবার রান্না করে এনেছে। নিখিল দৌড়ে এসে ওর সামনে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলো, “তুমি কেন আসছো এত কষ্ট করে?”
– “তুমি সকাল থেকে না খেয়ে আছো আর আমি বুঝি খেতে পারি? তোমার বাবা কখন টাকা দেবে সেই আশায় বসে থাকবো?”
– “আল্লাহ! সেজন্য তুমি মুন্সিগঞ্জ থেকে খাবার রান্না করে নিয়ে গুলিস্তান আসবা? তুমি কি পাগল দুপুর?”
দুপুর হেসে টিফিন বাটিটা ওর হাতে দিয়ে বলেছিলো, “বেশি কিছু রাঁধি নাই। পোলাও আর দেশী মুরগি রানছি। খুব তাড়াতাড়ি রান্না করছি তো, হয়ত ভালো হয় নাই।”
– “তুমি খাইছো?”
– “না, আমি বাসায় গিয়ে খাবো। আগে তুমি খেয়ে নিও পেট ভরে। রাতেও খাবা, আর বেশি হইলে ফ্রিজে রাইখো। কালকে সকালে খাইতে পারবা। অনেক গুলা পোলাও দিয়া দিছি।”
বলেই দাঁত বের করে হাসলো দুপুর। নিখিল হা করে চেয়ে রইলো ওর দিকে। টিফিন ক্যারিয়ার হাতে নিয়ে নিখিল মুগ্ধ হয়ে ওর পানে চেয়ে আছে, চোখে পানি এসে যাচ্ছিলো নিখিলের। দুপুর একটা ৫০০ টাকার নোট নিখিলের বাম হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল, “আর যাই করো, খাওয়াদাওয়া ঠিকমত কইরো। এইটা রাখো। আমি যাই, বাড়ি যাইতে রাত হবে এম্নেতেই।”
কথাটা বলেই দুপুর নিখিলের সামনেই মাওয়ার বাসে গিয়ে উঠলো। নিখিলের কথা বলা কিংবা হাত পা নাড়ানোর শক্তিটাও ছিলোনা। মাঝেমাঝে এরকম হুট করেই একদম বাকরুদ্ধ করে দেয়ার মত কাজ করে দুপুর। সারপ্রাইজের চেয়ে বেশি কিছু থাকলে সেটাই হতে হয়। দুপুর দিব্যি হাসতে হাসতে চলে যাচ্ছিলো, আর জানালা দিয়ে মাথা বের করে হাত নাড়ছিলো। সেই মায়াবী মুখখানার দিকে তাকিয়ে নিখিলের নিজেকে খুব ভাগ্যবান মনে হচ্ছিলো। কত যত্ন করে দুপুর রান্না করে আবার কষ্ট করে দিয়েও গেলো, নিজে কিচ্ছু খায়নি সকাল থেকে। নিখিল না খেলে কখনোই ও খায়না। আবার ৫০০ টা টাকাও হাতে ধরিয়ে দিয়ে গেলো। এমন কেন মেয়েটা? এত ভালোবাসতে হয় বুঝি!
নিখিলের সেদিন পায়ের নিচে শিকড় গজানোর মত অবস্থা হয়েছিল। অনেক্ষণ নড়াচড়া করতে পারেনি ও। টিফিন ক্যারিয়ার হাতে স্তব্ধ হয়ে চেয়ে ছিলো হাইওয়ের দিকে। দুপুর মাত্র তিন/চার মিনিটের জন্য এসেছিলো, অথচ আকাশ সমান কিছু অনুভূতি দিয়ে গিয়েছিলো সেদিন। যে মেয়েটা এভাবে ওকে ভালোবাসতো, নিখিলকে ছাড়া একটা মুহুর্ত ওর চলতো না। সে কিভাবে নিখিলকে ছাড়া থাকবে?
দুপুর কক্ষনো বাবার অবাধ্য হয়নি। বড় বোন রৌদ্রময়ী জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে থাকতো। বাসায় আসতো অনেক দিন পরপর। দুপুর ই নিজে রান্না করে ওর বাবাকে খাওয়াতো, খুব ভালোবাসে ও বাবাকে। বাবা বিয়ে করতে বলার পর আর কোনোকিছুই মাথায় আসেনি ওর, অন্তত বাবার সম্মান তো রক্ষা হবে। বাবার জন্য নিজের জীবনটাও দ্বিধা করবে না দুপুর। সেখানে একটা বিয়েই তো, নাহয় বাকি জীবনটা কষ্ট করেই কাটলো। তবুও বাবার মুখে একটু হাসি থাকুক। এই ভেবেই দুপুর বিয়েতে রাজি হয়ে গিয়েছিলো। কিন্তু যত সময় যাচ্ছে, আস্তে আস্তে বুঝতে পারছে নিখিলের শূন্যতাটুকু। যদিও নিখিলের জন্য দুপুরই বেশি পাগল ছিলো, তবুও দুপুর খুব করে অনুভব করতে লাগলো নিখিলের শূন্যতা। ওকে ছাড়া কিভাবে বাঁঁচবে দুপুর?
৪৫.
ছাদে বসে বসে সিগারেট টানতে টানতে এসব ই ভাবছে নিখিল। রৌদ্রময়ী হঠাৎ এসে পিছনে দাঁড়ালো। ছাদে সুন্দর চাঁদের আলো ছড়িয়েছে। নিখিল সিগারেটের ধোয়া উড়িয়ে দিচ্ছে ভুসভুস করে। কাকে যেন কল দিয়ে কথা বলতে লাগলো। রোদ একটা কথা শুনতে পেলো,
– “একটা বোতল হলেই চলবে। চাঁচড়া মোড়ে আয়,আমি যাচ্ছি।”
রোদ কাছে এসে জিজ্ঞেস করলো, “কই যাবি তুই? কিসের বোতল?”
নিখিল জবাব দিলো না। সিগারেট টানটেই লাগলো। এমন ভাব করতে লাগলো যেন রোদকে ও চেনেনা। রোদ বলল, “তুই নেশা করবি নিখিল? ছি,আমি ভাবতেও পারছি না তুই নিখিল এভাবে চেঞ্জ হয়ে গেছিস।”
নিখিল হাতের সিগারেট সহ ই এসে দুহাতে গলা টিপে ধরলো রৌদ্রময়ীর। সিগারেটের আগুন রৌদ্রময়ীর বাম গালের নিচে কানের দিকে লেগে পুড়ে যাচ্ছিলো, যন্ত্রণায় মুখটা কুঁচকে গেলো রোদের। ও তবুও টু শব্দটিও করলো না। অনুশোচনায় দগ্ধ হতে হতে মরে যাওয়ার ই ইচ্ছে হচ্ছে ওর। নিখিল গলা টিপে মেরে ফেলুক তো।
নিখিল ওর গলা ছেড়ে দিয়ে সিগারেট ছুড়ে ফেলে দিলো। তারপর ধপ করে বসে পড়লো ছাদের উপরেই। দুহাতে নিজের চুলগুলো টানতে টানতে বলল, “আমি পাগল হয়ে যাবো। এত স্ট্রেস আর নিতে পারছি না। আমার লাইফটা দুপুরকে ছাড়া অচল। ও ছাড়া কে আমার একটু কেয়ার করবে? সারা দুনিয়া খুঁজলেও ওরকম একটা দুপুর আমি কোথাও পাবো না।”
রোদের গালটা জ্বালা করছে ভীষণ। সিগারেটের আগুন খুবই তীব্র। জ্বলছে আর খুব খারাপ লাগচে রোদের। তবুও ও চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো। নিখিল আপনমনেই বলে যেতে লাগলো, “ওরে আমি যা কিছু দিতাম, ও বলতো তুমি নিজের কাজে লাগাও।আমার জন্য কক্ষনো কিচ্ছু কিনবা না। অথচ নিজে টাকা জমিয়ে আমারে পাঞ্জাবি, শার্ট গিফট করতো।আমারে বলতো, তুমি ভার্সিটিতে পড়ো। কত মানুষের সাথে মেলামেশা করতে হয়। তোমার অনেক গুলা জামাকাপড় দরকার।আমি বলতাম আমি নিজেই কিনতে পারি। তুমি পছন্দ করে দাও। দুপুর বলত,পাঞ্জাবীতে আমার কষ্টের আবেশ মিশে থাকবে। এটা গায়ে থাকলে আমারে কখনোই ভূলতে পারবা না।”
নিখিলের কথা শুনতে শুনতে গাল বেয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে রোদের। দুপুর খুব ভালো একটা মেয়ে সেটা ও জানে। কিন্তু নিখিলকে এতটা ভালোবাসতো সেটা জানা ছিলোনা ওর। দুপুরকে জিজ্ঞেস করলে কখনোই বলতো না ওর কারো সাথে সম্পর্ক আছে।
রোদ এসে নিখিলের পাশে বসলো।
নিখিল বললো, “জানিস রোদ ও আমারে একদিন ও কাপড় কাঁচতে দিতো না। আমি কাপড় কাঁচতে পারতাম না ভালোমতো। সেজন্য ও জেদ করতো, কয়দিন পরপর আমার সব জমানো ময়লা কাপড় ব্যাগে ভরে ওরে দিয়ে আসতাম, আর ও সব সুন্দর করে ধুয়ে লণ্ড্রী করে আমারে দিতো। এত ভালোবাসত মেয়েটা আমারে। কখনো কখনো আমারে বলতো হলের সামনে বাইর হও। আমি বাইরে গিয়া দেখতাম দুপুর আসছে। বলতো, তোমার জন্য সরষে ইলিশ রান্না কইরা আনছি। তোমার খুব পছন্দের না? ওর কথা শুনে আমি কান্না কইরা ফেলতাম রে রোদ। মেয়েটা আমারে ছাড়া বাঁচলেও আমি পারবো না। মুন্সিগঞ্জ থেকে এক পলক দেখার জন্য ও আমার হলের সামনে এসে দাঁড়াই থাকতো।”
নিখিল হাউমাউ করে কেঁদে ফেললো এসব বলতে বলতে। ভালোবাসা রা হয়ত এমনই হয়। দুপুরের সমস্ত পাগলামি গুলোকে শুধু পাগলামি ই মনে হতো নিখিলের। আজকে ওর অনুপস্থিতিতে বুঝতে পারছে ওকে হারানোটা জীবনের সবচেয়ে বড় অপূর্ণতা হয়ে গেলো।
রোদ আর চুপ করে থাকতে পারলো না। কাঁদতে কাঁদতে হুট করেই নিখিলের পা ধরে বললো, “আমাকে মাফ করে দে নিখিল। আমার জন্য তোদের এই অবস্থা হলো।”
নিখিল পা থেকে দুপুরের হাত সরিয়ে দিয়ে বলল, “তোর প্রতি আমার অভিযোগ নেই। ভাগ্যে যা ছিলো তাই তো হয়েছে।”
– “আমি যদি জানতাম দুপুরের সাথে অরণ্য’র বিয়ে হবে তাহলে কখনোই আমি বাড়ি ছেড়ে চলে আসতাম না।”
অরণ্য’র নাম মুখে নিতেই নিখিল আবারো ভেঙে পড়লো। একটু আগে দুপুর ফোন দিয়ে যা যা বলেছে সবই বলে ফেললো রোদকে। সব শুনে রোদ বললো, “তুই তাহলে ওর কাছে যা। ওকে নিয়ে আয় ”
নিখিল রেগে বললো, “পাগলের মত কথা বলবি না। তোর বাবার সম্মানের জন্যই দুপুর বিয়েটা করছে। এখন আমি ওরে নিয়ে এলে যেটুকু বাকি আছে তাও যাবে।”
রোদ কাঁদতে কাঁদতে বললো, “আমার অপরাধের জন্য তোদের পবিত্র ভালোবাসা আর দুটো লাইফ এভাবে নরক হয়ে যাবে আমি সেটা মানতে পারবো না। আমার ভূলের জন্য আমাকে অনুতপ্ত হতেই হবে। যা হবার হবে, তুই গিয়ে ওকে নিয়ে আয় প্লিজ। পায়ে পড়ি তোর।”
নিখিল নির্বাক হয়ে গেলো রৌদ্রময়ীর কথায়। সে নিজে বাড়ি থেকে পালিয়ে এসেছে,আর কোথাও যাওয়ার জায়গা নাকি নেই? তাহলে পালালো কার কাছে যাওয়ার জন্য? দুপুরের বিয়ে হয়ে গেছে সেটা শুনে তখন থেকে গম্ভীর হয়ে গেছে,এখন আবার বলছে দুপুরকে নিয়ে আসতে। রোদের সমস্যাটা কোথায়?
নিখিল রোদের হাত ধরে বললো, “দয়া করে কি বলবি কেন তুই বাড়ি থেকে পালালি?”
রৌদ্রময়ী একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো, “হুম। আজকে আর না বলে থাকতে পারবো না রে। সবটা তোকে জানাতেই হবে। আর তুই ওকে গিয়ে নিয়ে আসবি প্লিজ?”
নিখিল কৌতুহলী হয়ে তাকালো রোদের দিকে। চাঁদের আলোয় রোদের কান্নাভেজা কন্ঠ শুনে মায়া লাগছে ওর। রোদের গাল পুড়ে গিয়ে জ্বালা করছে তবুও ও সেদিকে ভ্রুক্ষেপ করছে না। তিনটা মানুষের ভেতরে যে দহন চলছে, বাহ্যিক আগুনের চেয়েও সেটার যন্ত্রণা কয়েক গুন বেশি।
রোদ বলতে আরম্ভ করলো-
চলবে..