অনুভূতি
পর্ব ১১
মিশু মনি
.
১৭.
– “সকাল নয়টা অব্দি বাসর রাত থাকে?”
ভাবির এমন রসিকতা শুনে মুখ টিপে হাসলো অরণ্য। হেসে হেসে বললো, “তাও তো কম হয়ে গেলো, আমি ভেবেছিলাম টানা দুদিন দরজা খুলবো না।”
বলেই শব্দ করে হাসল। ভাবিও হাসলো। কিন্তু এরকম কথা শুনে বুকটা চিনচিন করে উঠলো দুপুরের। ভালো লাগছে না এরকম কিছু শুনতে। নিতান্তই বাধ্য হয়ে বিয়েটা করতে হয়েছে ওকে। তারমানে এই নয় যে, আর সবার মত করে তাকেও এরকম রসিকতা শুনতে হবে। কিন্তু কিছুই করার নেই। শুনতেই হবে তাকে। কেউ তো আর জানেনা তার ভেতরে কি ঝড় বয়ে যাচ্ছে।
ভাবি রুমে ঢুকে কিছুক্ষণ হাসাহাসি করার চেষ্টা করল দুপুরের সাথে। কিন্তু দুপুরের মুখে কিছুতেই হাসি আসেনা। উনি তাড়াতাড়ি খাবার টেবিলে যেতে বলে চলে গেলেন রুম থেকে। অরণ্য এসে দুপুরের পাশে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলো, “কোনো সমস্যা?”
– “না।”
– “একটু সহজ হও আমার সাথে। বলো কি হইছে তোমার?”
দুপুর চোখ তুলে তাকালো। চোখাচোখি হতেই বুকটা কেমন যেন করে উঠলো ওর। অরণ্য’র চোখে কি যেন একটা আছে। সেই চোখের দিকে তাকালে খুন হয়ে যাবে যেকোনো মেয়েই। দুপুর তাকাতে পারলো না আর। চোখ নামিয়ে নিলো।
কিন্তু অরণ্য এগিয়ে এসে দুপুরের মুখটা আলতো করে ধরে একদম কাছে চলে এলো। দুপুর কি হচ্ছে কিছুই বুঝতে না পেরে চোখ বন্ধ করে ফেললো। বুকের ধুকপুকুনি টা বেড়েই যাচ্ছে ওর। অরণ্য আলতো করে একটা চুমু একে দিলো দুপুরের কপালে। দুপুরের বুক ফেটে কান্না আসতে চাইছে। অনেক কষ্টেও চেপে রাখতে পারলো না। চোখে একটু পানি চলে এলো। অরণ্য দুপুরের মুখটা তুলে বলল, “তোমাকে আমার করে নিলাম। এখন থেকে তুমি শুধুই আমার। আর আমিও শুধুই তোমার। কাজেই নিজেকে আমার থেকে আলাদা ভেবোনা। যা কিছু ভেতরে চেপে রেখেছো, আমাকে বলে হালকা হতে পারো। ”
দুপুর চোখ বন্ধ করেই রইলো। খুলতে পারলো না কিছুতেই। অরণ্য বলল, “তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে নাস্তার টেবিলে আসো, সবাই ওয়েট করছে আমাদের জন্য।”
কথাটা বলেই অরণ্য বেড়িয়ে গেলো ঘর থেকে। কপালের যে জায়গাটায় অরণ্য চুমু একে দিয়েছে, সেখানে একবার হাত রাখলো দুপুর। কষ্ট হচ্ছে ভীষণ। এখন তো এই অধিকার শুধুই অরণ্য’র, সে দোষের কিছুই করেনি। কিন্তু কষ্ট হচ্ছে অন্যকারো জন্য। অরণ্য কে পেয়ে নিজেকে খুব ভাগ্যবতী ভাবলে ভূল হবেনা, তবে কষ্টটা যে অন্য কোথাও। নিখিলকে কিছুতেই ভূলতে পারছে না দুপুর। বারবার ওর কথা ভেবে কান্না আসতে চাইছে, কষ্টে মরে যেতে ইচ্ছে করছে ওর।
তাড়াতাড়ি নাস্তার টেবিলে চলে এলো ও। নাস্তা খেতে খেতে অরণ্য ওর বাবাকে বললো, “আব্বু আমি কালই দুপুরকে নিয়ে একবার সিলেট থেকে ঘুরে আসতে চাই। বাংলোয় কথা বলে দাও।”
বাবা একবার চোখ তুলে তাকালেন। কিন্তু কিছুই বললেন না। মাথা নেড়ে খাবার খেতে লাগলেন। অরণ্য বলল, “আব্বু আমি কিছু বলেছি। আমার অফিসের ছুটি মাত্র কয়েকদিন। এর ফাঁকেই একবার ঘুরে আসতে চাই। বাসায় দুপুরের কোনো কাজ নেই। আজ বৌভাত হয়ে গেলে কালই চলে যাবো।”
সবাই খাওয়ার মাঝে একবার তাকালেন অরণ্য ও দুপুরের দিকে। দুপুর লজ্জায় মাথা নিচু করে আছে। ওর গলা দিয়ে খাবার নামছে না। তবুও নাড়াচাড়া করতে হচ্ছে। অরণ্য বউকে নিয়ে বিয়ের পরদিন ই ঘুরতে যেতে চাইছে! একটুও কি লজ্জা লাগছে না বলতে?
অরণ্য আবারো বললো, “আব্বু, কিছু বলছো না কেন?”
– “যাবি ঘুরতে। বারণ তো আর করবো না। কয়দিনের জন্য যেতে চাস?”
– “দুদিন তিনরাত।”
– “চা বাগানের ভিতরে থেকে কি করবি? বউ নিয়ে যাচ্ছিস হোটেলে ওঠ। নূরজাহান গ্রান্ডে কথা বলে দেখ।”
অরণ্য উচ্ছ্বসিত হয়ে বললো, “থ্যাংকস আব্বু। আমি এক্ষুণি কথা বলে দেখছি রুম বুক করা যায় কিনা। আর তোমরা খেয়ে নাও, আমি খুশির ঠেলায় আর খেতেই পারবো না।”
অরণ্য উঠে রুমের দিকে চলে গেলো। দুপুর একবার তাকালো ওর চলে যাওয়ার দিকে। ছেলেটা প্রচণ্ড রকমের খুশি হয়েছে। উত্তেজনায় চোখে পানি চলে এসেছে ওর। কিন্তু এরকম আচরণ সাধারণত কেউ করেনা, খাওয়ার মাঝখানে উঠে যাওয়াটা তো ঠিক না। খাবার শেষ করে যেতে পারতো।
দুপুরের শ্বাশুরি মা বললেন, “তুমি কিছু মনে করোনা মা। ও একটু এমন ই। পাগলাটে ছেলে আমার।”
দুপুর এমনিতেই খেতে পারছিলো না, এখন আরো পারছে না। মনটা কেমন কেমন যেন করছে। বেড়াতে গেলে প্রত্যেকটা মুহুর্ত অরণ্য ওর সাথে সাথেই থাকবে, অনেক কষ্ট হচ্ছে ভাবলে। একজনকে মন থেকে সরিয়ে আরেকজনকে জায়গা করে দেয়াটা সত্যিই খুব কষ্টের।
কোনোমতে খাওয়া শেষ করে রুমে আসতেই অরণ্য বললো, “রাগ করছো দুপুর?”
– “না, রাগ করবো কেন?”
– “ভাবছো কেমন নির্লজ্জের মতন বললাম কালকেই বেড়াতে যেতে চাই? আসলে আমি তোমার জন্যই ওটা বলেছি। আমি জানি তোমার অনেক কষ্ট হচ্ছে, কিছুতেই সহজ হতে পারছো না। তোমাকে নিয়ে একটু ঘুরে এলে ভালো লাগবে তোমার।”
দুপুর কিছুই বললো না। কিন্তু অবাক হলো বেশ। আস্তে করে এগিয়ে এসে দাঁড়িয়ে রইলো জানালার পাশে। অরণ্য এসে দুপুরের পিছনে দাঁড়িয়ে রইলো বেশ কিছুক্ষণ। কিন্তু কেউই কোনো কথা বললো না। এভাবে সময় পেড়িয়ে যেতে লাগলো। অরণ্য ভাবছে কিভাবে মেয়েটার মনটাকে একটু ভালো করা যায়? আর দুপুর ভাবছে, জীবন এত অদ্ভুত কেন!
১৮.
মিশু রৌদ্রময়ীর সাথে গল্প করার অনেক চেষ্টা করেও পারলো না। মেয়েটা কিছুতেই মুখ খুলতে চায়না। শুধু সিটে হেলান দিয়ে চোখ বুজে আছে, গাল বেয়ে টপটপ করে জল গড়িয়ে পড়ছে। মিশু একবার রোদের হাত ধরে আলতো করে চেপে ধরলো। বললো, “আমাকে তোমার বোন ভাবতে পারো। মনে যা আছে বলে ফেলতে পারতে, হালকা লাগতো অনেক।”
দুপুর একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। কিছুই বললো না। এমনকি চোখ ও খুললো না। মিশু উঠে গিয়ে নিজের জায়গায় বসে পড়লো। একটু পরেই মেঘালয় চলে এলো। এসে হাসতে হাসতে বললো, “ম্যাম সরি, হাঁসের গোশত পাওয়া গেলো না।”
মিশু হেসে ফেললো ওর সরি বলার ধরণ দেখে। বললো, “থাক, হাসের গোশত এখন খেতেও চাইনা। আপাতত ওই নতুন বউয়ের মুখ থেকে দুটো শব্দ বের করতে চাই। অনেক চেষ্টা করেও পারলাম না। কি করি বলুন তো?”
মেঘালয় একবার রোদের দিকে তাকিয়ে মিশুকে বললো, “আমার মনেহয় মেয়েটা সুইসাইড করার জন্য এসেছিলো। কিন্তু সেটা পারেনি, হয়ত মরার মত সাহস ছিলোনা। তাই ট্রেনে উঠেই বসে আছে। এখন কোথায় যাবে তাও জানেনা।”
মিশু মাথা ঝাঁকিয়ে বললো, “হতেও পারে। নাও হতে পারে, অন্য কোনো কষ্ট আছে মেয়েটার।”
– “এখন কি তাকে নিয়েই ভাব্বে? তোমার না খিদে পেয়েছে? খাবেনা?”
– “হুম চলুন। আচ্ছা আপনার বন্ধু আমাকে ভাবি ডাকলো কেন?”
মেঘালয় হেসে বললো, “সে তোমাকে আমার বউ ভেবেছে।”
বউ কথাটা শুনতে কেন যেন অনেক ভালো লাগলো মিশুর। মুখ টিপে হাসলো ও। তারপর খাবার বগিতে যাওয়ার জন্য উঠে দাঁড়ালো।
চলন্ত ট্রেনে হাটতে গিয়ে পড়ে যাচ্ছিলো মিশু। টাল সামলাতে পারছে না, মেঘালয় ওর হাত ধরে ধরে নিয়ে যাচ্ছে। মিশুর মনটা বেশ উৎফুল্ল। মেঘালয়কে খুব আপন মনেহচ্ছে ওর। বারবার মেঘালয় ওর হাত ধরছে, এই ব্যাপার টাকেও অনেক ভালো লাগছে!
খাবার খেতে খেতে অনেক বকবক করলো মিশু। রোদের জন্য কিছু নাস্তা ও চা নিয়ে আবারো নিজেদের সিটে ফিরে এলো। মিশু নিজেই গিয়ে রোদকে নাস্তা ও চা দিয়ে শুধু বললো, “খেয়ে নাও।”
কথাটা বলেই নিজের জায়গায় ফিরে আসলো। রোদ অনেক্ষণ চুপ করে বসে রইল। তারপর চায়ে চুমুক দিতে লাগলো। ওকে খেতে আনন্দে লাফাতে ইচ্ছে করছে মিশুর। আর মিশুর আনন্দ দেখে বড্ড ভালো লাগছে মেঘালয়ের।
মিশু হঠাৎ বললো, “আচ্ছা আমরা এখন কোথায় যাচ্ছি?”
– “আপাতত গন্তব্যস্থান জানা নেই।”
– “আচ্ছা তাহলে ভোরের ট্রেনে আবারো ঢাকায় ফিরে আসবো?”
– “হুম তা করা যায়। টানা এতক্ষণ জার্নি করতে খারাপ লাগবে না?”
– “আরে নাহ, আমার জার্নিতে কোনো সমস্যা নেই। আমার মন খারাপ লাগছে ওই মেয়েটার জন্য।”
– “মিশু, প্লিজ এত মন খারাপ করোনা। ওকে ওর মত থাকতে দাও, অনেক চেষ্টা করেও একটা কথা বের করতে পেরেছো? পারোনি। অযথা কষ্ট দেয়ার দরকার নেই।”
– “আমিতো কষ্টটা কমাতে চাইছিলাম।”
– “কেউ যদি কমাতে না চায়, তুমি জোর করে কমাবা?”
মিশু আর কিছু বললো না। মুখ বাঁকিয়ে জানালা দিয়ে বাইরে তাকালো। বাতাসে চুল উড়তে শুরু করেছে। ঘুম এসে যাচ্ছে ওর। কিন্তু ঘুমাতে ইচ্ছে করছে না, আবারো যদি মেঘালয়ের কাঁধে ঢলে পড়ে তাহলে লজ্জা লাগবে ভীষণ। এরচেয়ে বরং জেগে থাকাই ভালো।
জেগে থাকতে চেয়েও বেশিক্ষণ জেগে থাকতে পারলো না। আস্তে আস্তে ঘুম এসে গেলো চোখে। কিছুক্ষণ পরেই গাড় ঘুমে তলিয়ে গেলো মিশু। মাথাটা আস্তে করে মেঘালয়ের কাঁধের উপর এসে পড়লো। মেঘালয় মিশুর ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো নিষ্পলক ভাবে। ধীরেধীরে মিশুর প্রতি অন্যরকম অনুভূতি কাজ করতে শুরু করেছে ওর।
চলবে..