#অনুভূতির_সুপ্ত_কোণে🍂
#কায়ানাত_আফরিন (মাইশা)
পর্ব:১১
.
বিগত তিনদিন ধরে আদ্রাফের সাথে কোনো যোগাযোগ না থাকায় মেহেরের মাথার নিউরন যেন বিধ্ধস্ত হয়ে গিয়েছে। এই ছেলেটা যে এত পরিমাণ জেদি হয়তো এই তিনদিন তার জীবনে না আসলে এই ইহকালে সে জানতে পারতো না। আজ তাই তড়িঘড়ি করে তনু বেগমের সাথেই ফিরে এসেছে আদ্রাফদের বাড়িতে।
এখন আদ্রাফ বাসায় নেই। অফিসে গিয়েছে বলেই মেহেরের ধারনা। তাছাড়া এখন মাত্র সন্ধ্যা। আদ্রাফ আসবে প্রায় নয়টার দিকে। সোফায় বসে বসে ঠোঁট কামড়াচ্ছে আর ভাবছে যে আদ্রাফের রাগটা কি করে কমানো যায়। কিন্ত তার ছোট্ট মস্তিষ্ক এর কোনো সমাধান দিতে পারলো না। তনু বেগম মেহেরকে বারবার দেখছেন যে হচ্ছেটা কি। পরে সে বলে ওঠে………….
.
—-মেহের ? কি ভাবছো?
.
—-ভাবছি কিভাবে আপনার আদরের পুত্রটার মাথা ঠান্ডা করা যায়।
.
মেহের কথাটি বিড়বিড়িয়ে বললেও তা বুঝতে পেরেছিলেন তনু বেগম। আনমনে হেসে ওঠে মেহেরের কথা শুনে।
.
—–এভাবে বসে থাকলে কি আর হবে?এক কাজ করো। আদ্রাফের জন্য ওর পছন্দের খাবার বানিয়ে রাখো। পারবে তো?
.
কথায় বলে , খাবার নাকি শত্রুকে বন্ধু করতে পারে। আর আদ্রাফ তো ওই ধারের কাছেও না। তবে ওর রাগটা কি ঠান্ডা করা যাবে না। মেহের এটা ভেবেই দাঁত কেলিয়ে একটা প্রশস্ত হাসি দেয়। যেন পিরামিডের ভেতরে প্রবেশের মানচিত্র উদ্ধার করেছে সে। আবেগে আপ্লুত হয়ে সে তনু বেগমকে বলে ,
.
—মা , ফাটাফাটি একটা বুদ্ধি দিয়েছো। আচ্ছা বলতো কি রান্না করতে পারি?ওর পছন্দের খাবার কি? পোলাও-বিরিয়ানি-নাকি খিচুড়ি?
.
—-নারে মেহের? আদ্রাফ ঝাল তেমন একটা খেতে পারে না। ওর জন্য মিষ্টি আইটেম যেমন ফালুদা-গাজরের হালুয়া বা সুজির হালুয়া-পায়েস, ক্ষীর এগুলা বানাও। আর রাতে ভাত মাংস যা আছে ওগুলাই খাবে।
.
মুখটা মলিন করে ফেলে মেহের। পায়েস ছাড়া মেহের আর কিছুই বানাতে পারেনা। মুখ ফুলিয়ে বলে ওঠে………..
.
—-তোমার এক মেয়ে তো কম্পিটিশনে আমার সাথে ঝাল ফুচকা খেতো আর আরেক ছেলে দেখি ঝালই খেতে পারেনা। কি ভয়ঙ্কর !
.
মেহেরের কথা শুনে হেসে দেয় তনু বেগম। মেহেরের মাথায় হাত বুলিয়ে বলে………..
.
—-আরে আমি আছি না ! তোমায় হালুয়া আর ফালুদা বানানো শিখিয়ে দেবো নে। ফালুদা বানানো সহজ।সেখানে ডেকোরেটিংটাই আসল বিষয়। আর হালুয়া বানানো একটু ঝামেলাদায়ক। বাসায় তো গাজর নেই তাই আজ সুজির হালুয়া বানিয়ো কেমন?
.
—হুম😒
.
.
.
.
একে একে পায়েস-ফালুদা আর সবশেষে সুজির হালুয়া বানিয়ে মেহেরের নিজেকে বিধ্ধস্তবেশী মনে হচ্ছে। হাতে-নাকে-মুখে সবজায়গাতেই সুজি দিয়ে মাখামাখি। নাকের ডগায় আর কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম থাকার কারনে সুজিগুলো একেবারে মুখের সাথে লেপ্টে আছে। কোনো ময়দা সুন্দরী থেকে মেহেরকে এখন কম কিছু মনে হচ্ছ না। তনু বেগম মেহেরের এ দৃশ্য দেখে হাসি চেপে রেখেছে।
মেহের কাদো কাদো স্বরে বলে ওঠে………….
.
—-মা ! তুমি আমায় দেখে এভাবে হাসছো কেন? আমায় দেখতে কি পুরাই বেঁদের মেয়ে জোছনা লাগছে?
.
—-আয়নায় গিয়ে নিজের মুখ দেখো। রাধঁতে গিয়ে দেখো কি অবস্থা করেছো !
.
—-আমি এখনই গোসল করে আসছি। তাছাড়া আদ্রাফের আসতে এখন অনেক দেরি। আমি গেলাম।
এই বলে মেহের হুড়মুড়িয়ে রান্নাঘর থেকে চলে আসে।
.
.
.
আজ অফিস থেকে বেশ তাড়াতাড়িই বাড়ি ফিরে এসেছে আদ্রাফ। কাজ মোটামুটি তাড়াতাড়িই শেষ হয়ে গিয়েছিলো। সারাদিন এত প্রেশারে থাকার কারনে নিজেকে বেশ ভারসাম্যহীন লাগছে আদ্রাফের। তাই বাড়িতে এসেই তাড়াতাড়ি ফ্রেস হওয়ার জন্য রুমে চলে যায় সে। যদিও বাড়িতে ঢোকার সময় তনু বেগম কিছু বলতে চেয়েছিলেন কিন্ত আদ্রাফ তাকে সময় না দিয়ে বলে ওঠে…….
.
—-মা আমি ফ্রেস হয়ে এসে কথা বলছি।
.
নিজের রুমে প্রবেশ করতেই অদ্ভুত এক কারনে মেহেরের গায়ের ঘ্রাণ আদ্রাফের নাকে আসতেই আদ্রাফ একটু অবাক হয়। ঘরটা মোটামোটি আধাঁরে ছেয়ে আছে। লাইট জ্বালিয়ে কাউকে না পেয়েই নিশ্চিত হয় যে মেহের এখানে নেই।
মেহেরের চিন্তাটা সে মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতে চাচ্ছে । দরজাটি লাগিয়ে নিজের শার্টটি খুলে আলমারি থেকে নিজের গেন্জি আর ট্রাউজার বের করতেই ওয়াশরুম থেকে কারও দরজা খোলার শব্দ পায়।পেছনে ঘুরে আদ্রাফ যেন রীতিমতো শকড হয়ে গিয়েছে। কেননা তার সামনে স্বয়ং মেহের দাঁড়ানো।
.
গোসল শেষে দরজা খুলে হঠাৎ আদ্রাফের সামনে পড়তেই মেহের থমকে যায়। একবার নিজের দিকে তাকায় আর একবার আদ্রাফের দিকে তাকায়। জীবনে হয়তো এর থেকে জঘণ্য কোনো পরিস্থিতিতে আদৌ পড়েছে কি-না মেহেরের তা মনে হয় না। মেহেরের গায়ে কোনো ওড়না নেই। এটাই স্বাভাবিক। দুমিনিটের মাথায় যখন দুজনেই বুঝলো যে এখন তারা কোথায় আছে এটা বুঝতেই সাথে সাথে চিৎকার দিয়ে ওঠে দুজনে।
.
লজ্জায় মেহেরের মরে যেতে ইচ্ছে করছে। আর আদ্রাফও প্রচন্ড পরিমাণে অস্বস্তিতে পড়েছে । যখন বুঝলো যে মেহেরের গলার সাউন্ডটা চক্রবৃদ্ধিহারে বেড়ে যাচ্ছে আদ্রাফ সাথে সাথেই মেহেরের মুখ চেপে ধরে।মিহি কন্ঠে বলে ওঠে………..
.
—আরে থামো তো ! আমি চিল্লানো থামালাম তুমি থামছো না কেন?
.
মেহেরের মন চাচ্ছে আদ্রাফের মাথাটা ফাটিয়ে দিতে। একে তো উইথআউট শার্ট ছেলেটা ওর সাথে চিপ্কে আছে আবার অন্যদিকে ওর মুখ চেপে প্রশ্ন করে যাচ্ছে।ইশারায় আদ্রাফকে মুখটা ছাড়তে বললেই ছেড়ে দেয় আদ্রাফ।
.
মেহেরের এবার লজ্জা লাগছে। প্রচন্ড পরিমাণে লজ্জা লাগছে। সে তো চেয়েছিলো আদ্রাফের রাগ ভাঙগাতে । কিন্ত এ পরিস্থিতে যে সে পড়ে যাবে মেহের তা আন্দাজ করতে পারেনি।
.
—-তুমি এখানে কি করছো?
.
আদ্রাফের প্রশ্ন শুনে মেহের ওর দিকে তাকায়। আদ্রাফ ভ্রু কুচকে তাকিয়ে আছে তার দিকে। মেহের কোনো উত্তর না দিলে আদ্রাফ মেহেরের কাছে এসে পড়ে। এমনিতেও আদ্রাফকে এমনভাবে দেখতে মেহের অভ্যস্ত না তাই কাঁপাকাপাঁ গলায় বলে ওঠে……….
.
—-একটু দূরে সরো প্লিজ ! এভাবে সামনে আসছো কেন?
.
মেহেরের কথায় আদ্রাফ ভ্রুক্ষেপ না করে মেহেরের দুপাশে দেয়ালে হাত দিয়ে নিজের কাছে আবদ্ধ করে নেয়। আদ্রাফের চোখে-মুখে লজ্জা , অস্বস্তি সবকিছু ছেড়ে এবার প্রখরতা ভর করেছে। আদ্রাফ মেহেরকে বলে ওঠে…………
.
—-আমি সরবো না। আগে বলো তুমি এখানে কেন? খুব তো বলেছিলে জীবনেও আমার কাছে আসবে না ; তাহলে?
.
—-আরে ওটাতো রাগের মাথায় বলে দিয়েছিলাম………(মুখ ছোট করে)
.
আদ্রাফ কিছু বলতে যাবে মেহেরকে এ অবস্থায় দেখে চোখ সরিয়ে ফেলে মেহেরের কাছ থেকে।পাশের থেকে টাওয়েল নিয়ে ওয়াশরুমে যেতে যেতে বলে ওঠে…………
.
—-তোমায় আমি পরে দেখছি।
আদ্রাফ সশব্দে ওয়াশরুমের দরজা লাগাতেই মেহের যেন এক স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ে।
,
,
,
,
ডাইনিং টেবিলে এত খাবারের বাহার দেখে আদ্রাফের মুখে অবাকের রেশ দেখা যাচ্ছে। আদ্রাফের বাবা বলে ওঠে……….
.
—-বাবাহ ! আজ তো দেখি আদ্রাফের সব পছন্দের খাবার বানানো হয়েছে।
.
—–মেহের বানিয়েছে।
.
তনু বেগমের উত্তর শুনে আদ্রাফ মেহেরের দিকে তাকায় । মেহের বিনিময়ে একটা মেকি হাসি দিতেই আদ্রাফ চোখ ফিরিয়ে নেয়। মেহেরের এতে খুব অপমানবোধ হয়েছে। মনে মনে সে বলে যে…….
.
—-এমনে জীবনেও আদ্রাফরে মানানো যাবে না। আমাকে আমার স্টাইলে ওরে মানাতে হবে।
.
মেহের এবার আদ্রাফের পায়ে সুড়সুড়ি দিতেই আদ্রাফের হাত থেকে গ্লাস পড়ে যায়। আদ্রাফ মেহেরের দিকে তাকাতেই মেহের ফ্লাইং কিস দেয় ওকে। যার কারনে আদ্রাফের গলায় যেন খাবার আটকে গিয়েছে। আবদুল্লাহ সাহেব বলে ওঠে………
.
—-কি হয়েছে আদ্রাফ? তনু ! ওকে পানি দাও তো।
.
যতবারই মেহেরের সাথে চোখাচোখি হচ্ছে মেহের ততবারই হয়তো ফ্লাইং কিস দিচ্ছে নয়তো চোখ টিপ দিচ্ছে। বেচারা আদ্রাফ তো না পারছে থাকতে আর না পারছে সরে আসতে। মেহের যে কি কারনে এমন করছে আদ্রাফ এটা ভালোমতোই জানে। এই মেয়ে যে ভবিষ্যতে ওকে জ্বালিয়ে মারবে এ নিয়েও ওর কোনো সন্দেহ নেই। মনে মনে আদ্রাফ বলে ওঠে……
.
—-কি ভয়ঙ্কর মেয়েরে বাবা !😩
.
.
,
,
,
~চলবে