অনুভূতির সুপ্ত কোণে পর্ব-০৯

0
2372

#অনুভূতির_সুপ্ত_কোণে🍂
#কায়ানাত_আফরিন(মাইশা)
পর্ব:৯
.
নিশার কন্ঠ শুনে আস্তে করে পেছনে ঘুরে শাওন নামের এই ছেলেটি। তার মুখমন্ডল মেহেরের কাছে কি একটা কারনে খুব পরিচিত মনে হলো। ছেলেটাকে শুধু ফর্সা বললে ভুল হবে ; একেবারে মারাত্নক রকমের ফর্সা। কালো রংয়ের শার্টে তা যেন আরও গভীরভাবে ফুটে উঠেছে। শার্টের হাতাটি ভাঁজ করে রাখার কারনে কব্জির একপাশে অস্পষ্টভাবে একটি ট্যাটু দেখতে পারছে মেহের। ডান হাতে রয়েছে একটা জ্বলন্ত সিগারেট।
.
এমন সুন্দর একটি ছেলের হাতে সিগারেট খুবই বেমানান মনে হচ্ছে মেহেরের কাছে। শাওনের তীব্র দৃষ্টি সরাসরি মেহের আর নাদিয়ার দিকে। মেহেরের দিকে তাকিয়ে নিশার উদ্দেশ্যে বলে ওঠে…….
.
—নিশা? Is this girl যার কথা গতকাল বলেছিলে?
.
—ইয়াহ্।
.
শাওন বাইক থেকে ওঠে মেহের আর নাদিয়ার কাছে দাঁড়ায়। বেচারা নাদিয়া তো কাচুমাচু করে দাঁড়িয়ে আছে। সাদাতের কাছে শুনেছে শাওন নামের এই ছেলেটির কথা। ভার্সিটির সিনিয়র স্টুডেন্ট আর পলিটিকার লিডারের ছেলে বলেই বড্ড রকমের উগ্র এই ছেলেটা।পকেট থেকে আর একটা সিগারেটের প্যাকেট বের করে একটা সিগারেট এগিয়ে দেয় নাদিয়ার কাছে।
.
—নাও। সিগারেট খাও।
.
মেহেরের মাথায় যেন রক্ত উঠে গেছে নাদিয়ার কাছে সিগারেট এগিয়ে দিয়েছে বলে। দাঁতে দাঁত চেপে বলে ওঠে………..
.
—ভদ্র ঘরের সন্তানেরা সিগারেট খায় না।
.
শাওন হেসে ওঠে। যেন মেহের খুব মজার একটা কথা বলেছে। কিছুক্ষণ পর মেহেরকে বলে……
.
—ভার্সিটির সিনিয়রদের সাথে বেয়াদবি করো এটা কোন ধরনের ভদ্রতা? ওকে ! তাহলে তুমি খাও।
.
মেহেরের কাছে সিগারেট এগিয়ে দিতেই মেহের কষে একটা চড় মারে শাওনকে। এ দৃশ্য দেখে সব স্টুডেন্ট যেন হতভম্ব হয়ে যায়। ইভেন শাওন নিজেও। এই শাওন চৌধুরিকে কেউ কখনো থাপ্পড় মারতে পারবে এটা ভাবতেই ফর্সা মুখ লাল বর্ণ হতে শুরু করেছে শাওনের।
.
এদিকে মেহেরেরও রাগে চোখ দিয়ে পানি ঝড়ছে। শাওন একটা জোরে লাথি দিয়ে পেছনে পার্কিংয়ে থাকা নিজের বাইকটা ফেলে দেয়। ওর মন চাচ্ছে এই মেহেরকে জাস্ট খুন করে ফেলতে। রাগে চিল্লিয়ে বলে ওঠে………
.
—তুমি শুধু মেয়ে বলেই তোমায় ছেড়ে দিলাম । নাহলে এক্ষুণি জান কবজ হয়ে যেত তোমার।
.
.
.
—–কি হচ্ছে এখানে?
.
আদ্রাফের কন্ঠ শুনতেই চোখ-মুখ শুকিয়ে গিয়েছে মেহেরের। আদ্রাফ বারবার বলেছিলো ভার্সিটিতে কোনো ঝামেলা না করতে। কিন্ত এখানে তারই বা কি দোষ। শাওন ওকে সিগারেট অফার করেছে এটা ভাবতে আর নিজেকে সামলিয়ে ওঠতে পারেনি মেহের।
.
পেছনে ঘুরে দেখে আদ্রাফ জিজ্ঞাসু চোখে তাকিয়ে আছে সবার দিকে। মেহের নিজের শুষ্ক ঠোঁটজোড়া হালকা নাড়িয়ে বলে…….
.
—আদ্রাফ তুমি?
.
—হু আর ইউ?
.
মেহেরের কথার মাঝখানে নিশা আদ্রাফকে প্রশ্ন করায় থমকে যায় মেহের।আদ্রাফ তখনও তাকিয়ে আছে মেহেরের দিকে। নিশার প্রশ্ন উপেক্ষা করে মেহেরকে আবারও প্রশ্ন করে……….
.
—কি হয়েছে মেহু?
.
——শাওন নামের এই ছেলেটি আমায় আর নাদিয়াকে সিগারেট অফার করেছিলো। আমি না করা সত্বেও উল্টোপাল্টা কথা বলে যে আমরা নাকি তাদের সাথে বেয়াদবি করেছি যেমন কিছুই হয়নি। তাই আমি তাকে চড়…….
.
মেহের নিজের কন্ঠস্বর মিলিয়ে ফেলতেই আদ্রাফের চোয়াল শক্ত হয়ে যায়। কারন এসব উগ্রতা আদ্রাফের কাছে ঘৃণ্য এক বস্তু। কিন্ত এখন এই পরিস্থিতিটা নষ্ট করতে চায় না সে। তাই নিজের রাগটাকে দমিয়ে শাওনের কাছে দাঁড়ায় সে।
.
—-এরকম পাব্লিক প্লেসে একটা মেয়েকে সিগারেট অফার করলে যে থাপ্পড় খাবে এটাই স্বাভাবিক। আমি মানছি ওর রাগ অনেক বেশি বাট নেক্সট টাইম ওর সাথে আর এমন না করলেই হবে কেমন?
.
রাগে মুখন্ডল লাল বর্ণ ধারন করেছে শাওনের।ক্ষীপ্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আদ্রাফের দিকে যেন পারলে এই মুহূর্তেই তাকে শেষ করে ফেলবে। দাঁতে দাঁত চেপে সে বলে ওঠে,
.
—কে হও তুমি সাফাই দেওয়ার?
.
আলতো হাসে আদ্রাফ। শাওনের চোখে চোখ রেখে বলে ওঠে……
.
—She is my life partner…….my everything……..
.
—-তাহলে বলে দিও তোমার লাইফপার্টনারকে। শাওন চৌধুরিকে মারার দুঃসাহস দেখিয়েছে সে। এত সহজে ছাড়বো না ওকে।
.
শাওননের এই কথাটা বলার সাথে সাথেই ওর কলার চেপে ধরে আদ্রাফ। আদ্রাফ বরাবরই রাগ প্রকাশ করতে অপছন্দ করে কিন্ত এবার নিজেকে দমিয়ে রাখতে পারেনি সে।কড়া গলায় বলে ওঠে ,
.
—-এরকম কিন্ত কল্পনাতেও আনবে না। আমাকে যতটা শান্ত মনে হচ্ছে ততটাই ভয়ঙ্কর আমি। সো স্টে আওয়ে ফ্রম হার। আদারওয়াইজ ইউ উইল নেভার লিভ।
.
এতটুকু বলেই মেহের আর নাদিয়াকে নিয়ে আসে সেখান থেকে। শাওনকে এতটা নীরব দেখে নিশা , রাহাত আর বাকিরা প্রচন্ড পরিমাণে ভয় পাচ্ছে। কারন শাওন যে এত সহজে ওদের ছাড়বে না এটা ভালোমতোই বুঝে নিয়েছে সবাই। শাওন আনমনে বলে ওঠে…….
.
—শাওন চৌধুরির নজরে পড়েছো তোমরা। এত সহজে নিস্তার পাবে না।
.
.
.
.
বাতাসের পাল্টা প্রবাহের মধ্য দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে গাড়িটা। বেশ হাইস্পিডেই এগিয়ে যাচ্ছে। রাগে টগবগ করতে থাকা মেহের এখন চুপসে বসে আছে শুধুমাত্র আদ্রাফের কারনে। আদ্রাফ ভয়ঙ্করভাবে রেগে আছে। রাগের কারনে কপালের আর গলার রগ কেমন যেন ফুলে আছে। আদ্রাফ যে এতটাও রাগতে পারে মেহেরের তা কল্পনার বাইরে ছিলো।
.
কথাটা আসলেই সত্যি যে , শান্ত মানুষের রাগ অনেক বেশি। সহজে তারা রাগে না কিন্ত যখন রাগে ; তখন তো……….
.
এখন আর ভাবার মতো মনমানসিকতা মেহেরের কাছে নেই।একটু সাহস কুড়িয়ে সে বলে ওঠে……..
.
—আদ্রাফ?
.
আদ্রাফ তখনও গাড়ি চালাতে মগ্ন।মেহের এবার বলে যে……
.
—-আমি বুঝছি না তুমি এত রাগ করছো কেন?
.
এবার গাড়ি থামিয়ে ক্ষীপ্র চোখে আদ্রাফ তাকায় মেহেরের দিকে। একপ্রকার গর্জে বলে ওঠে………..
.
—আর একটা প্রশ্ন করলে তোমার যে কি অবস্থা করবো ভাবতেও পারবে না তুমি? কবে জানি তোমার চিন্তায় আমায় মরেই যেতে হবে। তোমায় আমি বারবার বলেছি যে কেও কিছু বললে হুটহাট রেগে যেওনা আর তুমি?
.
—ওই ছেলে আমায় সিগারেট খেতে বলেছে আর তুমি……
.
—থামো।(ধমকে বলে ওঠে) ওই সিচুয়েশনে যে কেউই এমন করবে। আর ঘটনাটির শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত নাদিয়া আমায় সবই বলেছে।(একটু থেমে) কি বলেছিলাম আমি? মনে আছে? তোমায় আমি বারবার বলেছি যে এইসব সিচুয়েশনে জড়াতে না। ক্যান্টিনে তাদের কথা শুনিয়েছো ভালো কথা কিন্ত আজ কেন ওদের সাথে ড্যাং ড্যাং করে চলে গেলে? যেহেতু ওরা ভার্সিটির কোনো প্রফেসরকে ভয় পায়না তাহলে বুঝে নিবে হয়তো ওদের ক্ষমতা আছে বলেই এমন করেছে।
আর তারা চাইছে তুমি নিজের থেকে ওদের সাথে ঝামেলা করো যাতে তোমায় সহজেই ভার্সিটি থেকে বের করে দিতে পারবে। এতটুকু তুমি বুঝনা?
.
মেহের চুপ হয়ে আছে। আসলেই তো ! এই কথাটা ওর মাথায়ই আসেনি। কত বড় একটা বোকামি করে ফেলেছে এটা বুঝেই মেহের থম মেরে রইলো। আদ্রাফ গাড়ির সিটে হেলান দিয়ে ক্রমাগত চেষ্টা করছে নিজের রাগকে নিয়ন্ত্রণ করার। এই প্রথমবার সে ব্যর্থ হলো। শাওনের মেহেরের উদ্দেশ্যে সেই কথাগুলো কানে ভেসে আসতেই বারবার চোখ-মুখ শক্ত হয়ে আসছে ওর।
.
শেষমেষ মেহেরের বাহু চেপে নিজের কাছে নিয়ে আসে আদ্রাফ। এতটাই কাছে যে একে অপরের নিঃশ্বাস গুণতে পারবে দুজনে। আদ্রাফ এবার কড়া গলায় বলে ওঠে………
.
—একটাবার আমায় শুধু বলো আমার কথা শুনলে কি এমন প্রবলেম হয় তোমার? কেন আমার কথা তুমি শুনো না। বিয়ের পর থেকেই দেখে আসছি তোমার এই উদ্ভট কাজগুলো। আর আজ? আজ ওই কে না কে তোমার নামে………..
.
এতটুকু বলেই থেমে যায় আদ্রাফ। এই প্রথম মেহেরের চোখ দিয়ে নোনাজল গড়িয়ে পড়ছে কিন্ত আদ্রাফ তা দেখে তাচ্ছিল্যের হাসি হাসে।
.
—আজ কান্না করে কি আর হবে? ভেবেছিলাম তুমি যেমনই হও না কেন একসময় আমায় মেনে নিবে বাট না। (এতটুকু বলেই কিছুক্ষণ থেমে থাকে)
তোমায় কিছু বলাই বেকার। এখন বাসায় চলো।
.
.
.
.
মেহেরকে বাড়ির সামনে নামিয়ে দিয়ে আদ্রাফ কোনো কথা না বলেই অফিসে চলে যায়। এবার মেহেরের অভিমান হয়েছে। প্রচন্ড রকমের অভিমান। সে মানছে যে আদ্রাফের কথা না শুনে ভুল করেছে সে তাই বলে এত জঘণ্য ব্যবহার করবে সে? মেহেরের বাহুজোড়া আদ্রাফ এত ক্রুড়ভাবে চেপে ধরেছিলো যে এখন ব্যাথা অনুভব হচ্ছে মেহেরের।
.
নবীনবরণ উপলক্ষে ভার্সিটি কিছুদিন বন্ধ থাকবে তাই রুমে গিয়ে কাপড় গুছিয়ে নেয় সে নিজের বাড়ি যাওয়ার জন্য। এই আদ্রাফের সাথে এখন থাকবেনা সে। তনু বেগমকে বলেই একাই সে চলে যায় নিজের বাড়িতে।
.
.
.
.
বিকেলের দিকে মেহেরের বাবা-মা, বোন হঠাৎ নিজের আদরের মেহেরকে দেখে ঘরে যেন খুশির জোয়ার বসিয়ে দেয়। যদিও সবাই জিজ্ঞেস করেছিলো যে আদ্রাফ কোথায় মেহের বরাবরই নিপুণতার সাথে সেই প্রশ্ন এড়িয়ে দিয়েছে।
.
রাত এখন প্রায় সাড়ে ১২টা । নিজের ছোট্ট বোন পূবার সাথে কে.জি.এফ মুভিটা খুব মনোযোগ দিয়ে দেখছে মেহেরর। সামনের টেবিলটাতে অগোছালোভাবে পড়ে রয়েছে চিপস-কোকাকোলা আর রেড ভেলভেট কেকের প্যাকেট।পুরা মুভিটাই হচ্ছে টুইস্ট দিয়ে ভরপুর। একটা সিন মিস করলেই কিছু বোঝা যাবে না তাই এত মনোযোগ দিয়ে দেখছে দুজনে। হঠাৎ অনবরত কলিংবেল বেজে উঠতেই সাথে সাথে মেহের চলে যায় দরজা খোলার জন্য। আধঘন্টা আগে পিৎজা হাট থেকে একটা পিৎজা অর্ডার করেছিলো সে।
.
কিন্ত দরজা খোলার সাথে সাথেই মেহের যেন অবাকের চূড়ান্ত পর্যায়ে চলে গিয়েছে। আদ্রাফ গহীন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মেহেরের দিকে। কালো সিল্কি চুলগুলো খনিকটা অগোছালো…….শার্টের হাতাদুটো ফোল্ড করে এক হাত পকেটে ঢুকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
.
মেহের একটা শুকনো ঢোক গিলে বলে…….
.
—তুমি?
.
.
.
.
~চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে