অনুভূতির সুপ্ত কোণে পর্ব-৫+৬

0
2511

#অনুভূতির_সুপ্ত_কোণে🍂
#কায়ানাত_আফরিন(মাইশা)
পর্ব ৫+৬
.
একরাশ আগ্রহ নিয়ে ভার্সিটির চারিপাশে চোখ বুলাচ্ছে মেহের। আজ তার ভার্সিটিতে প্রথম দিন। তার পাশেই স্বাভাবিকভাবে দাঁড়িয়ে আছে আদ্রাফ। কিছুক্ষণ নীরবতা কাটিয়ে আদ্রাফ বলে ওঠে………..
.
—সিনিয়র কারও কাছ থেকে তোমার ক্লাস কোনটা জেনে নাও। নাদিয়া একটু পরেই এসে পড়বে।
.
আদ্রাফের পকেটে থাকা মোবাইল ফোনটা অনবরত বেজে চলছে । কিন্ত আদ্রাফ পার্কিং সাইটে দাঁড়িয়ে আছে মেহেরের সাথে। শেষমেষ মেহের বিরক্তি প্রকাশ করে বলে…….
.
—কখন থেকে ফোন বেজে চলছে ফোন তুলছো না কেন?
.
—অফিস থেকে ফোন করছে তাই। জরুরি মিটিং আছে।
.
—তাহলে যাচ্ছো না কেন?
.
—তোমাকে একা রেখে যাবো ? Impossible ! এমনিতেও আজ তোমার প্রথম দিন। তাও আবার নিউ স্টুডেন্ট;Versity Fresher যাকে বলে। তোমার কি মনে হয় নিউ স্টুডেন্ট তুমি , আর কোনো র্যাগিং এর শিকার হবে না? তাই নাদিয়া সাদাতকে নিয়ে আসুক , তার দায়িত্বে তোমাকে না রাখলে আমার শান্তি হবে না আফটার অল সাদাত ভাই ভার্সিটির প্রফেসর।
.
আদ্রাফের কথায় মেহেরের চোখ যেন কপালে উঠে গিয়েছে। কোমড়ে হাত দিয়ে রাগী গলায় বলে ওঠে……….
.
—কি বললে ? কি মনে হয় তোমার ? আমি ; এই মেহেরকে র্যাগিং করবে? আর এই ভয়ে তুমি আমাকে একা রেখে যাবে না? তাহলে সেটা হবে বেস্ট জোক অব দ্যা ইয়ার। আমারে র্যাগিং করা এত সহজ না বস্ !
.
আদ্রাফ এবার সশব্দে হেসে দেয়। যার কারনে মেহের বোকার মতো তাকিয়ে আছে আদ্রাফের দিকে। তার মতে সে কোনো হাসির কথা বলেনি যে এই কুমড়োপটাশ আদ্রাফকে সশব্দ হাসতে হবে।আদ্রাফ এবার হাসি থামিয়ে বলে………
.
—তোমার এটা মনে হচ্ছে মেহু? ওই সিনিয়রদের ভয়ে তোমায় একা রাখানি এটা নিতান্তই তোমার ভ্রান্ত ধারনা। বরংচ আমার তো এটা নিয়ে ভয় হচ্ছে তুমি না জানি ওদের সাথে কি খুন-খারাপি করে বসো। তারপর ভার্সিটির authority আমায় ডাকবে এটা আমি মোটেও চাইনা।
.
ভ্রু কুচকে মেহের তাকাতেই আদ্রাফ আস্তে করে চোখ ফিরিয়ে নেয় মেহেরের কাছ থেকে। আদ্রাফ জানে এখন মেহেরের দিকে তাকালেই মেহের পারলে চোখ দিয়ে ওকে ভস্ম করে ফেলবে। তাই আনমনে মোবাইল চালানোও এর থেকে অনেক ভালো।
.
.
কিছুক্ষণ পরেই নাদিয়া আর সাদাত এসে পড়ে। দুজনকে আজ দেখতে চমৎকার লাগছে। মেহের হাসিমুখ নিয়ে সাদাতের উদ্দেশ্যে বলে ওঠে……..
.
—আসসালামু আলাইকুম ভাইয়া , কেমন আছেন?
.
—এইতো আলহামদুলিল্লাহ । তুমি?
.
—আমিও আছি ! কোনোরকম……
.
মেহের দাঁতে দাঁত চেপে একথা বলে ওঠে। এমনিতেও আদ্রাফের কথায় এই মেয়ের মাথা আউট অফ কন্ট্রোলে আছে না জানি কখন আদ্রাফের উপর আগ্নোয়গিরির মতো ব্লাস্ট হয়ে যাবে এটা ভেবেই মনে আগুন পিষে রেখেছে সে।আদ্রাফ সাদাতকে বলে ,
.
—সাদাত ভাই ! মেহুর একটু খেয়াল রেখো। তুমি তো জানোই , মাথা গরম করা মেয়ে। না জানি কখন কার সাথে কি করে বসবে।আর নাদিয়া ! তুই কিন্ত মেহুর সাথে সাথে থাকবি।
.
অন্যদিকে মুখ ফুলিয়ে তাকিয়ে আছে মেহের। আদ্রাফ এমন ভাবে ওর খেয়াল রাখতে বলছে যেন ও কোনো বাচ্চা একটি মেয়ে। আদ্রাফের কথা শুনে নাদিয়া হাসবে না কাদবে বুঝতে পারছে না। কোনোমতে হাসি আটকিয়েবলে ওঠে……..
.
—রিলেক্স ভাই। এত টেনশন করার কিছুই নাই। আমার বেস্ট ফ্রেন্ড মেহু। আর তুমিতো এমনভাবে ওকে ট্রিট করতে বলছো যেন একটা বাচ্চা পালবো আমি।
.
—আগে তোমর বেসণটফ্রেন্ড ছিলো কিন্ত এখন তো আমার বউ । সো আমি যা বলছি তাই করো।
.
আদ্রাফের কড়াকড়ি প্রয়োগের জন্য নাদিয়া আর কিছু বলে নি। মেহের এবার রেগেমগে বলে ওঠে……
.
—ওই নাদিয়া ! চল তো ! তোর ভাইয়ের মর্মবাণী শেষ হলে এখন তাড়াতাড়ি চল।
.
এই বলে চলে যেতে নিলে পেছন থেকে মেহেরের হাতের কব্জি আকড়ে ধরে আদ্রাফ। একপ্রকার নির্লিপ্ত চাহিনী নিয়ে তাকিয়ে আছে সে মেহেরের দিকে। নাদিয়া আর সামাদ ভার্সিটির গেটের ভেতরে এতক্ষণে ঢুকে পড়েছে। আদ্রাফের নির্লিপ্ত চাহিনীর মায়ায় হারিয়ে মেহেরের রাগটা যেন হাওয়ার তালে উড়ে গেলো। আদ্রাফের হালকা আকাশী শার্ট পড়েছে । শ্যামবর্ণের ছেলে হলেও সবধরনের রঙের শার্ট পড়লেই বেশ সুর্দর্শন লাগে আদ্রাফকে দেখতে।
.
মেহেরের গালে আলতো করে নিজের হাত রেখে ঠোঁট নাড়িয়ে বলে…….
.
—কারও সাথে ঝগড়া করোনা কেমন? সবসময় নাদিয়ার সাথে থাকবে। কোনো প্রবলেম হলে অবশ্যই আমায় কল দিবে অথবা সাদাত ভাইয়ের কাছে যাবে। হয়তো আমিই তোমাকে নিতে আসতে পারি। আমি না নিতে আসলে ড্রাইভারকে পাঠিয়ে দেবো নে। টেক কেয়ার অফ ইউরসেল্ফ।
.
আদ্রাফের প্রতিটি কথার জালে মেহের যেন নিজেকে হারিয়ে ফেলছে। আদ্রাফ ওকে ইশারা করে ভারণসিটির প্রান্তে যেতে বলেই গাড়ি নিয়ে চলে যায়। মেহের তখনও একস্থানে দাঁড়িয়ে আছে। হয়তো আদ্রাফের প্রতি এ অদ্ভুদ অনুভূতির কোনো সূক্ষ্ণ নাম তার কাছে নেই।
.
.
.
আজ প্রথম দিনটা মোটামুটি ভালোই গিয়েছে মেহের আর নাদিয়ার। ক্লাস শেষে দুজন ক্যান্টিনে বসে হালকা-পাতলা কথা বলছে । সামনেই নবীন বরণ অনুষ্ঠান। মূলত এ বিষয় নিয়ে একটা আবছা পরিকল্পনা বানাচ্ছে দুজনে।ওদের কথার মাঝেই পেছন থেকে কেউ বলে ওঠে………..
.
—হেই স্টুপিট গার্লস ! ভার্সিটিতে নতুন নাকি? এই জায়গায় বসার কেউ সাহস পায় না আর তোমরা দুজনে জমপেশ বসে আড্ডা দিচ্ছো?
.
মেহের পেছনে তাকিয়ে দেখে তিনজন ছেলে আর দুজন মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। দুজনেই মূলতো একটু ওয়েস্টান কালচারের ড্রেস পড়া তবে উগ্র ধরনের না । ছেলেগুলোও এমনভাবে তাকিয়ে আছে মেহের আর নাদিয়ার দিকে যেন ওরা এমন দৃশ্য জীবনেও দেখেনি। আর মেয়ে দুটো তো দেখতে চমৎকার। একটু আগে সম্ভবত চুইংগাম চাবানো মেয়েটি তাদের উদ্দেশ্য কথা বলেছিলো এটা ভেবে নাদিয়া বলে ওঠে…….
.
—সরি আপু আমরা জানতাম না আমরা এখনি সরে যাচ্ছি।
.
নাদিয়া মেহেরের হাত চেপে সরে আসতে নিলেই চইংগাম চাবানো মেয়েটির পাশে পনিটেইল চুল করা মেয়েটি বলে ওঠে……..
.
—এমনি এমনি চলে যাবে freshers? আমাদের পার্মিশন ছাড়া আমাদের জায়গায় বসেছো একটা শাস্তি তো দিতেই হবে।
.
ভ্রু কুচকে ফেলে মেহের।নাদিয়ার কাছ থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে মেয়েটিকে প্রতিউত্তরে বলে.
.
—আমরা তো সরি বলেছি আমাদের না জানা সত্বেও। তাছাড়া এটা কোনো অপরাধ না। তাহলে শাস্তি কিসের?
.
মেহেরের কন্ঠে একপ্রকার চাপা রাগ প্রকাশ পাচ্ছে। কিন্ত এখন মোটেও কোনো সিনক্রিয়েট করতে চাচ্ছে না সে শুধুমাত্র আদ্রাফের কথার জন্য।মেহেরের রাগ দেখে ওদের মধ্যে একজন ছেলে টিটকারির সুরে বলে ওঠি……….
.
—ওমা ! মেয়ে দেখি এখনি ফেটে পড়বে ! এখানে রাগ দেখিয়ে কোনো লাভ নেই।শাস্তি তো পেতেই হবে।
.
—হ্যালো ! বিহেব ইউরসেল্ফ। তোমরাও যেমন সিনিয়র আমাদের কাছেও authority power আছে। সাদাত স্যার এখানে আমাদের gurdian হিসেবে আছে।
.
মেহেরের প্রখর গলা শুনে ওরা ভয় পাওয়ার ভান করে বরে যে,
.
—OMG ! We are scared !
একথা বলেই যেন হাসিতে মেতে ওঠে। চুইংগাম চাবানো মেয়েটি মেহেরের কাছে গিয়ে বলে………
.
—সাহসের দাম দিতে হবে তোমার। আর কি যেন বললে? তোমার কাছে authority power আছে?(তাচ্ছিল্যের স্বরে) listen , এখানে আমাদের পাওয়ার চলে। ভাইস প্রিন্সিপালকে নিয়ে আসো তবেও কিছু করতে পারবে না। আজ আমাদের ভিসি নেই তাই তোমাকে ছেড়ে দিলাম। তোমার ব্যবস্থা আমি তাকে দিয়েই করাবো।
.
.
মেহের কোনোমতে নিজের রাগটাকে নিয়ন্ত্রণ করে বেরিয়ে পড়ে সেখান থেকে।অনেক কষ্টে নিজের রাগ দমিয়ে রেখেছে সে। ওই মেয়েটার সাহস কি করে হলো মেহেরের সাথে উচু গলায় কথা বলে? পার্কিং সাইটে গিয়ে দেখে আদ্রাফ গাড়িতে হালকা ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
.
আদ্রাফকে নিজের রাগটা মেহের দেখাতে চাচ্ছে না। তাই নিজেকে স্বাভাবিক করে মেহের চুপচাপ ড্রাইভিং সিটের পাশের সিটে বসে পড়ে।আদ্রাফ খানিকটা অবাক হলেও মেহেরকে এ বিষয়ে কিছুই বলে না।
.
গাড়ি এগিয়ে যাচ্ছে সমান্তরালে।দু পাশে ব্যস্ত গাড়ি আর রিকশার আনাগোনা। মেহের আড়চোখে বারবার আদ্রাফকে দেখতে মগ্ন। বরাবরের মতোই সে প্রতিক্রিয়াহীনভাবে গাড়ি চালাচ্ছে। কানের একপাশে ব্লুটুথ এয়ারফোন গোঁজা। গরমের প্রবাহটা এতটাই বেশি যে আদ্রাফের কপালে একটু একটু ঘাম দেখা যাচ্ছে।
.
মেহের কিছুক্ষণ পর সেখান থেকে চোখ ঘুরিয়ে নেয়। ভার্সিটির ওই ঘটনাটার জন্য কিছুই যেন ভালোলাগছে না ওর।
.
— মিহু ? হঠাৎ এত চুপচাপ কেন?
.
এবার সত্যিই ক্ষেপে যায় মেহের। ওই মেয়ের ওপর জমানো ক্ষোভটা আদ্রাফের ওপর ঝাড়ার জন্য বলে………
.
—কেন? কোনো সমস্যা? তুমিই তো চাও আমি সবসময় এমন থাকি। চুপ থাকলেও দোষ না থাকলেও দোষ !
.
মেহেরের প্রখর কন্ঠ শুনে ঠোঁটে কিঞ্চিত হাসি রাখে আদ্রাফ। মেহের সাথে সাথে ভ্রু কুচকে ফেলে। এই ছেলেরে এত ধৈর্যশক্তি আল্লাহ কিভাবে দিয়েছে?মেহেরের কাছে আদ্রাফের প্রতিটা কাজই বড় অদ্ভুদ লাগে যা ওর ধারনার বাহিরে।আদ্রাফ তার মনের কথা বুঝে বলে ওঠে…….
.
—রাগ সবকিছুর সমাধান না। একটা সম্পর্কে যেমন রাগ থাকে তেমনি ধৈর্যও থাকা উচিত। দুজনেই যদি মনে রাগ , ক্ষোভ , অভিমান রাখি তাহলে সম্পর্কটা আগাবো কিভাবে?
.
আদ্রাফ নামের এই ব্যক্তিটা নিজের কথা আর কাজের জাদুতে অদ্ভুদভাবেই আগলে নিয়েছে মেহেরকে। এতটা গভীরভাবে মেহের কখনোই ভাবেনি এই সম্পর্কটি নিয়ে। হয়তো অনুভূতির এক সুপ্ত কোণে অজান্তেই সে লুকিয়ে রেখেছে আদ্রাফকে। এখন শুধু অপেক্ষা সময়ের সাথে তা প্রকাশ করার………..❤️
.
.
.
.
.
~চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে