#অনুভূতির_সুপ্ত_কোণে🍂
#কায়ানাত_আফরিন (মাইশা)
পর্ব : ১৩
.
বিয়ের রাতে বেনারসী শাড়ি পড়ে ছাদে যখন ঘুরঘুর করছিলো তখন তো পুরাই দেওভূত লাগছিলো । আর আজ তো শাড়ি পড়লে পুরাই শ্যাওড়া গাছের পেত্নী লাগবে !
.
আদ্রাফের কথা শুনে মেহের যেন বিস্মিত। সিরিয়াসলি ! শ্যাওড়া গাছের পেত্নী? এই উপাধি শুনে মেহেরের মরে যেতে মন চাচ্ছে। আয়ানায় আবারো খুটিয়ে খুটিয়ে দেখতে থাকে নিজেকে যে ঠিক কি কারনে আদ্রাফ মেহেরকে এ কথা বললো। কিন্ত অদ্ভুত বিষয় ; মেহেরের কাছে এরকম কিছুই লাগছে না। মেহের রক্তচক্ষু নিয়ে তাকায় আদ্রাফের দিকে।
.
আদ্রাফ এখনও নিজের কাজে মগ্ন। মেহের এবার গর্জে বলে ওঠে……..
.
—-কোন আ্যঙ্গেল থেকে আমায় শেওড়া গাছের পেত্নী লাগছে একটু বলবে?
.
—-এসব শাড়ি টাড়ি বাদ দিয়ে অন্য কিছু পড়ো। তোমার মতো দস্যু মেয়েকে শাড়ি মানায় না।
.
আদ্রাফের কথায় মেহের এবার বিরক্ত। শুধু বিরক্ত বললে ভুল হবে ; প্রচন্ড পরিমাণে বিরক্ত। কই একটু ভেবেছিলো আদ্রাফও বুঝি ওর প্রেমে পড়ে যাবে কিন্ত হলো আরও উল্টো। মুখ ফুলিয়ে বলে ওঠে……….
.
—-হুহ ! শাড়ি না পড়ে ওয়েস্টান পড়লে ভালো হতো। তখন আর শ্যাওড়া গাছের পেত্নী না লাগলেও পাক্কা সানি লিওন লাগবে।😁
.
এই বলে মেহের দাঁত কেলিয়ে আদ্রাফের দিকে তাকাতেই মুখের হাসিটা কেমন করে যেন মিলিয়ে যায়। আদ্রাফের চোখ-মুখ অদ্ভুদ কারনেই একেবারে লাল হয়ে গিয়েছে। ফাইল রেখে সে শান্তভাবে এগিয়ে আসতে থাকে মেহেরের দিকে। এটাই বুঝি ঝড়ের পূর্বাভাস। মেহেরের পিঠ একপর্যায়ে দেয়ালে ঠেকে যেতেই আদ্রাফ একেবারে মিশে দাঁড়ায় মেহেরের সাথে।
মেহেরের শ্বাসের গতি এবার যেন বেড়ে গিয়েছে।
.
—-এতই যখন সানি লিওন সাজার ইচ্ছা আমিও তবে নাহয় ইমরান হাশমি হয়ে যাই,……….কি বলো?
.
এতক্ষণ শ্বাসের গতি বেড়ে থাকলেও আদ্রাফের কথা শুনে মেহেরের শ্বাস একেবারে নিঃশ্বেস হয়ে গিয়েছে। বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে আছে সে আদ্রাফের দিকে। এ আবার কেমন কথা?তবে কি আদ্রাফও ইমরান হাশমির মতো উল্টাপাল্টা কাজ করবে বলছে? ছিঃ
.
—–নাউযুবিল্লাহ ! দেখো আদ্রাফ? আমি ভদ্র মেয়ে । আমার সাথে এমন লুতুপুতুমার্কা কাজ করবে না খবরদার !
.
—–তুমি করলে কিছু না আর আমি করলে তা লুতুপুতুমার্কা হয়ে যাবে? How Stunning !
.
এই কথাটা একপ্রকার মেহেরের ওপর হালকা ঝুঁকে পড়েই বলেছে আদ্রাফ। তার সব সাজানো গোছানো কথাগুলো নিমিষেই যেনো হাওয়াই মিঠাইয়ের মতো উধাও হয়ে ।
ছোট ছোট চোখ করে সে বলে ওঠে,
.
—–তোমার সাথে কথা বলাই বেকার………..
.
—– এখন তো এ কথাই বলবে………
.
—–আমায় ভার্সিটি দিয়ে আসবে কি-না?
.
দাঁতে দাঁত চেপে আদ্রাফকে মেহের প্রশ্ন ছুড়ে মারে। আদ্রাফ বলে ওঠে…..
.
—–তাহলে কে দিয়ে আসবে হ্যাঁ। একা তো কখনই ছাড়ছি না তোমায়। এমনিতেও পেত্নী লাগছে । না জানি রাস্তায় কতজনের মাথায় চড়ে বসবে।
নিচে চলো?😒
.
.
.
.
.
চরম বিরক্তি নিয়ে মেহের নাদিয়ার জন্য অপেক্ষা করছে। তার সাথেই আদ্রাফ দাঁড়ানো। নাদিয়া আসতেই সে চলে যাবে। কিন্ত মেহেরকে এখন একা ছাড়বে না সে। এমনিতেও ক’দিন আগে ভার্সিটির সিনিয়রদের সাথে ঝামেলা বাড়িয়েছে তাও আবার এখানকার পপুলার পাওয়ারকে। তাই মেহেরকে আদ্রাফ মোটেও একা ছাড়বে না।
.
—-বুঝতেসিনা নাদিয়া কি তীর্থ যাত্রা করে ভার্সিটিতে আসবো নাকি?
.
মেহেরের কথা শুনে আদ্রাফ ওর দিকে মনোনিবেশ করে। মেহেরের চোখ-মুখ বলে দিচ্ছে যে কতটা অধৈর্য হয়ে পড়েছে সে।
.
—–সবাই কি তোমার মতো মানুষের মাথায় পেত্নী সেজে চেপে বসবে নাকি ! একটু ওয়েট করো। টাইমমতো ঠিকই এসে পড়বে।
.
—–আমার সাথে ভালোমতো কথা বললে এই ব্যাটার মহাভারত কি অশুদ্ধ হয়ে যাইবো………………কিছু বুঝিনা [মেহের মনেমনে]
.
কিছুক্ষণ পরেই নাদিয়া এসে পড়ে সাদাতকে নিয়ে। নাদিয়া আজকে সবুজ রঙের শাড়ি পড়েছে যা ওর গায়ের সাথে চমৎকারভাবে ফুটে উঠেছে। সাদাতও সবুজ রঙের একটা পান্জাবী পড়েছে। দুজনের জুটিটা বলতে গেলে একেবারে চমৎকার লাগছে। মেহের খুশিতে গদগদ হয়ে বলে ওঠে……
.
—-দোস্তোওও ! তোরে একেবারে ঝাক্কাস লাগছে। আর ভাইয়া তোমাকেও। তবে তোমার বউয়ের থেকে বেশি না।
.
সাদাত হেসে দেয় মেহেরের কথা শুনে।
.
—-এটা বলতে পারলে মেহের? আমি তো ভেবেছিলাম কতজনকে আমার সুন্দর রূপ দিয়ে ঘায়েল করবো,,,,,,,,
.
আর কিছু বলতে যাবে সে তবে নাদিয়ার দৃষ্টি দেখে সে থেমে যায়। আদ্রাফ এতক্ষণ নীরব দর্শকের মতো ছিলো। সবার কথা শেষ হতেই আদ্রাফ সাদাতকে বলে ওঠে…………
.
—–দেখো সাদাত ভাই ! আমি জানি যে নবীনবরণের অনুষ্ঠানের জন্য তুমি অনেক ব্যস্ত থাকতে পারো। কিন্ত সময় পেলে খেয়াল রাখবে যে পাগল দুইটায় আবার যে ওই সিনিয়র গ্রুপের কাছে না যায়।
.
——আমি চেষ্টা করবো।
.
——আর কতবার বলবে একই কথা? বলেছিতো যাবোনা।
মেহেরের মিনমিনিয়ে কথা বলা দেখে আদ্রাফ কোনো প্রতিক্রিয়া দেখায় না। যেন মেহেরের আর কোনো কথারই দাম নেই আদ্রাফের কাছে।মেহেরের হাত নিজের কাছে নিয়ে এসে গম্ভীর কন্ঠে বলে ওঠে…….
.
—–একবার না হাজারবার একই কথা বলবো। কারন তোমায় সম্পূর্ণ সেফ রাখতে চাই আমি।আশা করি আমার কথার আর নড়চড় হবে না। Take care of yourself………
.
আদ্রাফ একথা বলেই সেখান থেকে চলে যায়। মেহের একটা নীরব চাহিনী দিয়ে তাকিয়ে আছে সেদিকে। মেহেরের কাছে আদৌ এটা অজানা যে ছেলেটা তাকে ভালোবাসে কি না? মাঝে মাঝে তার ছোট ছোট যত্নে গড়া কথাগুলোও যেন অন্য দুনিয়ায় নিয়ে যায় মেহেরকে। হয়তো এটাই আদ্রাফের সুপ্ত কোণে থাকা এক বদ্ধ অনুভূতি !
.
.
.
.
ভার্সিটির চারিদিকের উৎসবমুখর পরিবেশের মাঝ দিয়েই প্রবেশ করে শাওন আর তার বাকি বন্ধুরা। শাওন আজ ব্ল্যাক কালার পান্জাবী পড়েছে। চুলগুলো হালকা স্পাইক করা। হাতে রয়েছে একটি সিলভার ওয়াচ। পুরাই যেন একটা ক্রাশ বয়। তার অন্যান্য বন্ধুদেরও বেশ চমৎকার লাগছে বিশেষ করে নিশিকে। নিশি অন্য চার-পাঁচটা মেয়ের মতো শাড়ি না পড়ে সিলভার রঙের একটি গাউন পড়েছে। মুখে রয়েছে ডার্ক মেকাপ।
.
নিশিকে দেখলে যে কেউ এটাই বলবে যে এই মেয়েকে শাড়ি না পড়ে গাউনেই বেশি মানাচ্ছে। রাহাত আশেপাশের মেয়েগুলোকে দেখছে আর ছোটখাটো মন্তব্য করে চলছে রাতুলের সাথে। শাওন এবার দুজনকে ধমক দিয়ে বলে ওঠে………
.
——এসব silly fact নিয়ে আলোচনা আমি মোটেও পছন্দ করে না। So shut up !
.
রাতুল এবার বিড়বিড়িয়ে বলে ওঠে……….
.
—–শালা নিজে তো ফ্লাটিং করস না আমারেও করতে দেস না।
.
.
.
.
শাওনকে স্টেজের কাছে দেখতেই মেহের সেদিকে আর এগোয় না। যদিও শাওনকে সে মোটেও ভয় পায় না তবুও শুধুমাত্র আদ্রাফের কথা মানার জন্যই অডিয়েন্স সিটে বসেছে সে। একে একে অনেকেই পার্ফম করছে স্টেজে।
কিন্ত মেহের আর নাদিয়া নিজেদের মধ্যে আলাপচারিতা চালাচ্ছে। নবীনবরণের অনুষ্ঠানটি বলতে গেলে একেবারে চমৎকারভাবেই চলছে। মেহের এবার স্টেজে উঠে দাঁড়ায় একজন নিউ স্টুডেন্ট হিসেবে কিছু স্পীচ দেয়ার জন্য।
এত মানুষের সামনে দাঁড়িয়ে বুকটা ধকধক করছে মেহেরের। যদিও এ কোনো নতুন অভিজ্ঞতা না কিন্ত বিষয়টি খুবই রোমাঞ্চকর মনে হয় মেহেরের কাছে।শাওন স্টেজের একপ্রান্তে নীরব চাহিনী দিয়ে তাকিয়ে আছে মেহেরের প্রতিটা কার্যকলাপের দিকে।
.
একটা লম্বা শ্বাস নিয়ে মেহের কিছু বলা শুরু করবে তখনই ঘটে গেলো এক দুর্ঘটনা। শর্ট সার্কিট হয়ার কারনে অডিটোরিয়ামে আগুন লেগে গিয়েছে। চারিদিকে আগুনের ছড়াছড়ি।
.
আগুনের তাপদাহ স্টেজকে ঘিরে থাকার কারনে সেখান থেকে বেরোতে পারছে না মেহের। সবাই মোটামুটি ছুটোছুটি করা শুরু করেছে। কালো ধোঁয়ার প্রবাহে মেহেরের নিঃশ্বাস ক্রমাগত ভারী হয়ে যাচ্ছে। চোখদুটোও বন্ধ হয়ে যাচ্ছে আবছাভাবে। অদূরেই নাদিয়ার চিৎকার তার কানে বেজে উঠতেই মেহেরের মনে ভয়ের সঞ্চার হয়।
এই আগুনরাশির জালে সে কি তবে ভস্ম হয়ে যাবে? তবে কি কখনোই সে পারবে না আদ্রাফকে তার মনের অনুভূতি ব্যক্ত করতে।
.
.
মেহেরের জীবন প্রহর হয়তো এখানেই থেমে যাবে এটা বিশ্বাস করতে হচ্ছে তাকে। কিন্ত না ; তার একটুকরো আশায় আলোর ঝলক হয়ে আসে একজন। হাত বাড়িয়ে আগলে নেয় মেহেরকে। তার বুকের হৃদপিন্ড কড়াকড়িভাবে মেহের অনুভব করতে পারছে। কিন্ত কে এই আগন্তুক যে তাকে আগুনের গন্ডি থেকে মুক্ত করে নিয়ে আসছে।
.
চোখ খোলার জন্য মেহেরের নিউরন যেনো সাড়া দিচ্ছে না। তবুও একপ্রকার যুদ্ধ করেই পিটপিট করে চোখ খুলে মেহের। আবছাভাবেদেখতে পায় শাওনের বিবর্ণ মুখ। এতটুকু দেখেই মেহের স্তব্ধ। ধীরে ধীরে সে মিলিয়ে যায় কোনো অজানা এক রাজত্বে।
.
.
.
সারা হসপিটাল মাথায় তুলে ফেলেছে শাওন। কোনো বার্ন স্পেশালিস্টকে না পেয়ে একপ্রকার তান্ডব রটিয়ে দিয়েছে । শাওনের বাবা যেহেতু বড় রাজনৈতিক নেতা তাই এখানে সবাই ভয়ে তটস্থ হয়ে আছে। প্রায় আধঘন্টা পর ডক্টর আসতেই শাওন প্রখর গলায় বলে ওঠে……..
.
—-Doctor ! Operate her imidiately…….She is in danger!
.
মূলত মেহেরের উদ্দেশ্যেই শাওন এমন করছে। ডাক্তার একটু সাহস জুগিয়ে বলে ওঠে……….
.
—–Yes ; I tried my best….but আপনাকে একটা কনফার্ম লেটার সাইন করতে হবে এক্ষুণি। কি হয় মেয়েটি আপনার?
.
—–আমার বোন হয়……….Is it clear for you?
.
.
.
.
~চলবে।