অনুভূতির মায়াজাল পর্ব – ০৬

0
1942

#অনুভূতির মায়াজাল
#নাজমুন বৃষ্টি
#পর্ব-৬

নীলাদ্রি অপারেশন থিয়েটারের দরজার সামনে চেয়ারে মাথা উঁবু করে চোখ বন্ধ করে বসে রইল। হঠাৎ হাতের মোবাইলটার তীব্র শব্দে নীলাদ্রি ধড়ফড় করে চোখ খুলতেই দেখল, লোকমান সাহেবের মোবাইলে কেউ একজন কল করছে। নীলাদ্রি মোবাইলের স্ক্রিনের দিকে চোখ যেতেই দেখল,’ছন’ লেখা। সে বুঝতে পারলো হয়ত স্যারের ছেলে। সে তাড়াতাড়ি কলটা রিসিভ করতেই ওইপাশ থেকে একটা কণ্ঠ ভেসে আসলো,

-‘আমি অত্যন্ত দুঃখিত বাবা, ফোন কেটে দেয়াতে। রাগ করেছো? জরুরি মিটিং ছিল, সেটার খেয়াল একদমই ছিল না, পিএ এসে বলতেই খেয়াল হলো তাই তাড়াহুড়ো করে চলে গিয়েছিলাম। এই মাত্র মিটিং শেষ হলো। এই বার বলো, কী যেন বলছিলে!’

ওইপাশ থেকে অনর্গল কথায় নীলাদ্রি থম মেরে রইল। এরপর কোনোমতেই বললো,
-‘স…স্যারের অপারেশন চলছে।’

মাহতিম তার বাবার মোবাইলে অন্য কারো আওয়াজ শুনে ভ্রু কুঁচকে কান থেকে মোবাইল নামিয়ে দেখলো, নাম্বার ঠিক আছে কী না। না, নাম্বার তো ঠিকই আছে কিন্তু এ মেয়ে কে! কী বলছে! তাহলে বাবার কিছু হলো না তো! না, না বাবার কিছু হবে না। এই মেয়েটা হয়ত কোনো কারণে মজা করছে।

-‘এই মেয়ে! কী আজেবাজে বকছেন! আমার বাবার মোবাইল আপনার কাছে কেন!’

-‘আপনার বাবার অপারেশন চলছে। কেমন ছেলে আপনি! একমাত্র বয়স্ক বাবাকে একা ফেলে ওখানে আছেন!’ বলেই মোবাইলটা কেটে দিল নীলাদ্রি। কোনো অদ্ভুত কারণে ছেলেটার উপর ভীষণ রাগ পাচ্ছে তার। হয়ত আজ এই ছেলে পাশে থাকলে স্যার এতো অসুস্থ হতো না! নীলাদ্রি মাথা চেপে ধরে বসে রইল।

মাহতিমের হাত থেকে মোবাইল পড়ে গেল! কী বলছে এসব! তার বাবা!
সে আর কিছু ভাবতে পারলো না। তাড়াতাড়ি করে বাবার অফিসে কর্মরত এক আঙ্কেলকে কল করে জানতে পারলো, সত্যি। মাহতিম তাড়াতাড়ি ইমার্জেন্সি পাসপোর্ট নিয়ে দেশের উদ্দেশ্যে রওনা দিল। লাগবে না তার এতো অভিমান, জিদ! এই জিদের কারণে তো তার ভালোবাসাকে সে চাইলে আর ফিরে পাবে না কিন্তু সে চাইলে তার বাবাকে বাঁচাতে পারে। সে যে বাবাকে ছাড়া একদম অসহায়।

———–

অপারেশন শেষ হওয়ার অনেক সময় পেরিয়ে যাওয়ার পরও লোকমান সাহেবের কোনো হুশ না ফেরাতে সবাই উৎকণ্ঠা হয়ে পড়ল।
ডাক্তাররা জানালো, খুব তাড়াতাড়ি উনার হুশ ফিরবে।

নীলাদ্রি তার বাবা-মা’কে খবরটা দিল। সেদিন রাতটা সে লোকমান সাহেবের সাথে হাসপাতালেই কাটিয়ে দিল। ভোর হতেই লোকমান সাহেব আধো আধো চোখ খুলে দেখতে পেল, নীলাদ্রি ঘুম ঘুম অবস্থায় সিটে বসে দুলছে। লোকমান সাহেব তা দেখে স্বস্তি অনুভব করলো। এতো সফলতার পরেও তিনি কাওকে বিনা স্বার্থে তার পাশে পাননি কিন্তু এই মেয়েটাকে একটু উৎসাহ আর কোনোমতেই চলার মত একটা চাকরি দিতেই কতটা আপনের মতো সারারাত হাসপাতালেই কাটিয়ে দিল। তিনি অনেক মানুষকে চাকরি আর টাকা দিয়ে সাহায্য করেছিলেন কিন্তু দিন শেষে ওরা একটু সফল হতেই লোকমান সাহেবকে আর চিনলো না। প্রতি জায়গায় ঠকতে ঠকতে তিনি নিরাশ হয়ে পড়েছিলেন কিন্তু এই মেয়েটার কার্য দেখে তার মনে একটু হলেও স্বস্তি অনুভব করলেন। যাক, একজন হলেও পেলেন আপনজনের মতো।

নীলাদ্রি হঠাৎ হাতের পাশে নড়াচড়া অনুভব হতেই চোখ খুলে দেখল, লোকমান সাহেব দেয়ালের দিকে তাকিয়ে আছে।
নীলাদ্রি তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়ালো। এরপর লোকমান সাহেবের পাশে গিয়ে দাঁড়াতেই তিনি ধীর কণ্ঠস্বরে বললেন,

-‘তুমি সারারাত এখানে ছিলে? তুমি বাসায় ফিরে যাও মা।’

-‘আপনি আগে সুস্থ হয়ে উঠুন তারপর আমিও ফিরে যাবো। আপনার মেয়ে হলে এমন ভাবে ফিরে যেতে বলতেন স্যার?’ নীলাদ্রি অভিমান-ভরা কণ্ঠে বলে উঠল।

নীলাদ্রির কথায় লোকমান সাহেব মলিন হাসলেন।
-‘আমার মেয়ে বলছো, আবার স্যারও বলছো।’

নীলাদ্রি হেসে স্যুপ আনার উদ্দেশ্যে ক্যাবিন ছেড়ে বেরিয়ে যেতে গিয়ে লোকমান সাহেবের ডাকে থেমে গেল।

-‘আমার ছেলে ফোন করেছে, মা?’

নীলাদ্রি ‘হ্যাঁ’ বোধক মাথা নেড়ে স্যুপ আনার উদ্দেশ্যে ক্যাবিন ছেড়ে বেরিয়ে গেল।

———

মাহতিম তাড়াহুড়ো করে হাসপাতালে ক্যাবিন নাম্বার মিলিয়ে ঢুকতেই দেখল, তার বাবা একা একা শুয়ে আছে। কতবছর পর সামনাসামনি বাবাকে দেখছে! বাবার শরীর আর আগের মতো নেই, চোখগুলো কোঠরে ঢুকে গিয়েছে। মাহতিম আরেকটু এগিয়ে গেল, তার হঠাৎ করে বুকে চিনচিনে ব্যথা অনুভব করলো। হঠাৎ করে বাবার কাছ থেকে এতদিন দূরে থাকার জন্য তীব্র অপরাধবোধ জেগে উঠছে।

মাহতিম লোকমান সাহেবের দিকে এগিয়ে উনার মাথার উপর ডান হাতটা আলতো করে রাখতেই তিনি ফিরলেন। ছেলেকে দেখে তিনি এটা তার ভ্রম মনে করে পাশ ফিরে গেলেন। ভাবলেন, এটা আর নতুন কী! জীবনের শেষ সময় এসে গিয়েছে তাই সবসময় ছেলেটাকে চোখের উপর ভাসে। আজ তো একেবারে ছেলের ছোঁয়া অনুভবও করতে পারছে।

-‘বাবা?’

লোকমান সাহেবের পিলে চমকে উঠল। তার মানে কী এটা তার ভ্রম নয়! তার ছেলে সত্যিই এসেছে! এটা ভাবতেই উনার চোখ গড়িয়ে অশ্রু নির্গত হলো।

মাহতিম বাবার চোখে অশ্রু দেখে বাবাকে জড়িয়ে ধরে কান্না থামানোর বৃথা চেষ্টা চালিয়ে গেল। এরপর চোখ মুছে বাবাকে শান্ত করল। মাহতিম সবকিছু জানার জন্য ডাক্তারের সাথে কথা বলার উদ্দেশ্যে রওনা দিল।

নীলাদ্রি ডাক্তারের কাছ থেকে পরামর্শ নিয়ে স্যুপের বাটি নিয়ে ক্যাবিনে ঢুকতেই কারো সাথে ধাক্কা খেয়ে পড়ে যেতে যেতে নিজেকে কোনোমতেই সামলে নিল।

-‘দুঃখিত, দুঃখিত।’

-‘সমস্যা নেই।’বিরক্তিকে আড়ালে ঢেকে সামনের মানুষটার দিকে না তাকিয়ে জবাব দিল নীলাদ্রি।

মাহতিম অসহায় চোখে সামনের দিকে দৃষ্টি দিতেই থমকে গেল। তার মুখ আপনাআপনি হা হয়ে গেল। এটা কী সে স্বপ্ন দেখছে! না কি হাত বাড়িয়ে ছুঁতে গেলেই হাওয়ায় মিলিয়ে যাবে।

জামার কিছু অংশে স্যুপ পড়ায় নীলাদ্রি বিরক্তি-সূচক শব্দ করে কপাল কুঁচকে জামা ঝাড়তে ঝাড়তে ক্যাবিনে ঢুকে পড়ল আর মাহতিম এখনো এক দৃষ্টিতে নীলাদ্রির দিকে তাকিয়ে রইল।
তার মনে হচ্ছে, সে এখনো স্বপ্নের জগতে আছে, এইতো ঘুম ভাঙলেই সকালের বিরক্তিকর দিনটা শুরু হবে। মাহতিম তাড়াতাড়ি ওখান থেকে সরে গেল।

নীলাদ্রি লোকমান সাহেবকে খাইয়ে ক্যাবিন থেকে বেরিয়ে করিডরের শেষ মাথায় কাঁচের জানালাটা দিয়ে ব্যস্ত শহর দেখছিল।

-‘নীলাদ্রিতা!’

অনেক বছর পর হঠাৎ সেই অতি চিরচেনা ডাকটা কানে বাজতেই নীলাদ্রি চমকে উঠল। তার বুকে চিনচিনে ব্যথা অনুভব করলো। নীলাদ্রি বুঝতে পারলো না, সে তো এখন যথেষ্ট শক্ত হওয়ার চেষ্টা করেছিল তবুও এমন কেন লাগছে!কিন্তু মানুষটা এখানে! এতো বছর পর!

নীলাদ্রি ফিরতেই চার চোখের দৃষ্টি একসাথে হতেই নীলাদ্রি চোখ ফিরিয়ে বলে উঠল,

-‘এ কী মাহতিম ভাই!’

মাহতিম শান্ত দৃষ্টিতে নীলাদ্রির দিকে তাকালো। ভেতরে ভেতরে তার রক্তক্ষরণ হচ্ছে। এই মেয়েকে না কি সে একসময় মনে প্রাণে ভালোবাসতো! ভালোবাসতো কী! এখনো ভালোবাসে! কত বছর পর এই প্ৰিয় চেহারাটা দেখছে আবারও!

-‘কেমন আছো? তোমার স্বামী কেমন আছে?’ মাহতিমের কণ্ঠ শান্ত।

মাহতিমের প্রশ্ন শুনে নীলাদ্রি চুপ থেকে বলে উঠল,
-‘আমি ডিভোর্সি।’
কথাটা বলার সময় নীলাদ্রির কণ্ঠস্বরটা কেপে উঠছিল।

নীলাদ্রির উত্তর শুনে মাহতিমের পিলে চমকে উঠল। সে স্তব্ধ দৃষ্টিতে নীলাদ্রির দিকে তাকালো। তার এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না। নীলাদ্রিকে কেউ ডিভোর্স দিয়েছে! সোনার হরিণ হাতের নাগালে পেয়েও হারিয়ে ফেলল! মাহতিম এতো ভালোবেসেও পেলো না অথচ সেই ছেলেটা পেয়েও হারিয়ে ফেলল! আফসোস!

#চলবে ইন শা আল্লাহ।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে