#অনুভূতির_অন্তরালে
#পর্ব:৬
#Devjani
ওনার কথা উপেক্ষা করে গাড়ির হ্যান্ডেলে চাপ দিলাম।পেছনের দরজা খুলতেই ভয়ে ছিটকে দূরে সরে গেলাম।
পেছনের সিটে ওনার টাইগার ঘুমাচ্ছে। টাইগার ঘুমঘুম চোখে আমাকে একবার দেখে আবার চোখ বন্ধ করে নিল।
বুক ধড়ফড় করছে।এই কুকুর এখানে কোথা থেকে এলো!
উনি জোরে জোরে হাসা শুরু করলো।
— এটা কি হলো?
— চুপ আমার টাইগার ঘুমাচ্ছে।উঠলে তোরই বিপদ আমার কি!
আমি অসহায় ভাবে বললাম,আপনি এখানেও কুকুরটাকে নিয়ে এলেন? আপনি জানেন আমি এটাকে ভয় পাই।
উনি সাথে সাথে একটা ধমক দিলেন। বললেন, খবরদার!আমার টাইগারকে কুকুর বলবি তো!আর তুই ওকে দেখে ভয় পেলে ও তোকে ভয় দেখাবে এটা স্বাভাবিক।বাই দা ওয়ে,যা গিয়ে ওর পাশে বোস। তুই তো আবার আমার পাশে বসবি না।আর আমিও বসতে দেব না।আগেই বলেছিলাম!
আমি বোকার মতো হেসে বললাম,বসবো তো।বসবো।
— নাহ্! বসবি না এখানে।
— বসবো!
গিয়ে ওনার পাশে বসে পড়লাম।রাগ হচ্ছে ওনার উপর।এই কুকুরটাকে এখানে আনার কি দরকার ছিল!এবার শুধু ঘুম থেকে না উঠলেই ভালো। আল্লাহ্!এই কুকুরটা যেন একটু শান্তিতে ঘুমায়। আমি না পৌঁছানো পর্যন্ত ঘুমাক।
কিছুদূর যেতেই বাজেভাবে ট্রাফিক জ্যামে আটকে পড়লাম। কি ঝামেলা! কুকুরটা উঠে যাবে তো! পেছনে তাকিয়ে দেখি কুকুরটা উঠে গেছে।তবে শান্ত ভাবে বসে।আমার দিকে একবার তাকিয়ে দাঁড়িয়ে গিয়ে আলসেমি ঝেড়ে আবার বসে মাথা নিচু করে রাখলো।
সোজা হয়ে ঠিকভাবে বসলাম। হঠাৎ দেখলাম রাস্তার পাশে একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে।হাতে কিছু ফাইল।
আমি তাড়াতাড়ি ওনাকে ডেকে ওদিকে তাকাতে বললাম। কারণ ঐ মেয়েটা দেখতে রাইয়ের মতো।উনিও অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। উনি আমাকে উদ্দেশ্য করে বললেন,জ্যামটা ছাড়তে দেরি হবে। আমার মনে হচ্ছে ঐ মেয়েটা রাই।চল একবার যাচাই করে আসি।
আমি সায় দিলাম। ওনার সাথে নেমে নেমে ঐ মেয়েটার সামনে যেতেই ও এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে।তার মানে এটা রাই।
ও আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল,কেমন আছিস আরু?আমার তো খোঁজ খবর নিস না!
— সরি রাই।কেমন আছিস তুই?
— ভালো নেই।
রাইয়ের এই কথা শুনে বুক ধক করে উঠল।তার মানে কি ওগুলো সত্যি!ওনার দিকে তাকিয়ে দেখি উনিও অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।রাইকে জিজ্ঞেস করলাম, কেন?
ও মন খারাপ করে বলল, হাসানের সাথে আমার ডিভোর্স হয়েছে।
আমার আশঙ্কা সত্যি হলো।এই ভয়টাই আমি পাচ্ছিলাম।ও তেজি গলায় আবার বলা শুরু করলো,ও আমাকে ঠকিয়েছে।ও আগে বিয়ে করেছে আমাকে বলেনি। তবুও সবটা আমি মেনে নিয়েছিলাম। কিন্তু ও চায় আমি ওর সাথে ওয়েস্টার্ন ড্রেস পড়ে ক্লাবে যাই।পার্টি করি।মিল যেখানে নেই সেখানে সুখের কোনো প্রশ্নই আসে না।
উনি সান্ত্বনার সুরে বললেন,তুই চিন্তা করিস না রাই সব ঠিক হয়ে যাবে।
রাই করুন দৃষ্টিতে ওনার দিকে তাকিয়ে বলে, সত্যিই কি সব ঠিক হবে?
রাইয়ের চোখের দিকে তাকিয়ে উনি চোখ ফিরিয়ে নিলেন।ওর চোখের ভাষা অনেক গভীর।এই ভাষা বোঝার মতো ক্ষমতা আমার নেই।
ও মুখে হাসি নিয়ে বলে,আমাকে নিয়ে এতো চিন্তা করা লাগবে না।আমি ঠিক আছি।আমি একটা ভালো জব করে নিজের খরচ নিজেই চালাই। তোমাদের কথা বল।কেমন আছ?
আমি বললাম, ভালোই আছি রাই।
ও তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলে,তা তো থাকবেই।আমি আসি।ভালো থেকো।
ও রোদ্দুর ভাইয়ার দিকে একবার তাকিয়ে উল্টো দিকে হাঁটা শুরু করে।
আমরাও গাড়িতে উঠে বসে পড়লাম। রাইয়ের জন্য খারাপ লাগলেও ও নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছে ভেবে ভালো লাগল।
রোদ্দুর ভাইয়া আমাকে আমাদের এ্যাপার্টমেন্টের সামনে নামিয়ে দিয়ে কোথায় যেন চলে গেল।
বাসায় ঢুকতেই দাদি তীক্ষ্ণ কন্ঠে বললেন,কি মহারাণী কোথা থেকে আসা হচ্ছে শুনি?
— একটু বাইরে গিয়েছিলাম।
— শোন কাল মার্জিয়ারা আসবে। সুমাইয়াও থাকবে। ওদের সাথে কোনো ঝামেলা করবি না।যদি করেছিস তো তোর একদিন কি আমার একদিন।
মার্জিয়ার আসার কথা শুনে রাগ উঠে গলো।এ আবার কেন আসবে এখানে। নিশ্চয়ই কোনো কারণ আছে।দাদিকে জিজ্ঞেস করলাম।দাদি বলল কাল নাকি রোদ্দুর ভাইয়ারা মার্জিয়ার বড় বোন সুমাইয়া আপুকে দেখতে আসবে। রোদ্দুর ভাইয়ার মা নাকি সুমাইয়া আপুকে অনেক পছন্দ করে।
এই কথা শুনে নিজের অজান্তেই মনটা খারাপ হয়ে গেল। নিজের রুমে চলে আসলাম।ফ্রেশ হয়ে পড়তে বসলাম। কিন্তু মন বসছে না পড়ায়। কেন সেটা জানি না।
পড়ায় মন না বসলে শুধু শুধু বসে থেকে লাভ নেই।তাই ঘুমিয়ে পড়লাম।ঘুমালে সব ঠিক হয়ে যাবে।
☆☆☆
এনাটমি ডিসেকশন রুম থেকে সবে বের হলো আরাদ্ধা আর অদ্রি। এখানে কেটেকুটে হাতে কলমে শিখতে হয় সব।ভিসেরাও পড়তে হয়। এগুলো জারে প্রিজার্ভ করা হয়।হিস্টোলজি ক্লাসে স্লাইডে ভিসেরার মাইক্রোস্কোপিক গঠন দেখতে হয়।
আরাদ্ধা আর অদ্রি সোজা হেঁটে যাচ্ছে। ওদের পাশ কাটিয়ে দ্রুত পায়ে হেঁটে যাচ্ছিল মার্জিয়া।আরাদ্ধা পেছন থেকে ডাক দেয়,ম্যারি!
মার্জিয়া আরাদ্ধার মুখ থেকে এই নামটা শুনে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠে।ধমক দিয়ে বলে,হাউ ডেয়ার ইউ!আমাকে এই নামে ডাকার সাহস কি হয়?
আরাদ্ধা মেকি হাসি দেয়।মন খারাপ করে বলে,আমার কি দোষ? তুমিই তো সেদিন বলছিলে তোমার নাম ম্যারি।
মার্জিয়া রাগী গলায় বলে,সেটা শুধু রোদ্দুর স্যারের জন্য।ওকে?
আরাদ্ধা ভ্রু উঁচিয়ে বলে, স্যার তো তোমাকে এই নামে ডাকেই না। তাছাড়া সুমাইয়া আপুর সাথে যদি ওনার বিয়ে হয় তাহলে উনি তোমার দুলাভাই হবে।রাইট?
মার্জিয়া তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলে,সেটা নিয়ে তোমার মাথা ঘামাতে হবে না। যত্তসব!না জানি কোন চূড়ায় জন্ম হয়েছে।এসেছে আমার ব্যাপারে নাক গলাতে।হেহ!
মার্জিয়া হেলেদুলে চলে যায়।
আরাদ্ধার মন খারাপ হয়ে গেল।এটা কি ধরনের কথা!জন্ম যেখানেই হোক না কেন সে তো একটা মানুষ।একটা মানুষ হয়ে কিভাবে অন্য একটা মানুষকে এসব কথা বলে!
আরাদ্ধা পাশে থাকিয়ে দেখে শ্রেয়ান হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছে।আরাদ্ধা শ্রেয়ানের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। মুখের সামনে তুড়ি বাজিয়ে বলে, হাসছেন কেন অকারণে?
শ্রেয়ান খুশি হয়ে বলে,তোমার ঐ ফ্রেন্ডটা একটু আগে কি বলল?কেন বলল? কারণটা বলনা প্লিজ!
আরাদ্ধার রাগ হলো।তাকা বাজে কথা বলে গেল আর ছেলে হাসিমুখে আবার জিজ্ঞেস করছে। তীক্ষ্ণ কন্ঠে বলে,জানি না।
আরাদ্ধার আবার মন খারাপ হয়ে যায়।এমন কথা আগে অনেক শুনেছে। কিন্তু আজ এই কথায় খুব কষ্ট হচ্ছে। তাছাড়া আজকাল ছোটখাটো ব্যাপারেই মন খারাপ হয়ে যায়।হেঁটে চলে গেল।
শ্রেয়ান বোকার মতো দাঁড়িয়ে আছে। অদ্রি ওর সামনে এসে বলে, আমি আপনার সব প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছি।ও ওর মা বাবার এডোপ্টেড চাইল্ড।তাই মার্জিয়া এসব কথা বলল।
শ্রেয়ান আরাদ্ধার চলে যাওয়া দিকে তাকায়। অস্ফুট স্বরে উচ্চারণ করে, মোহিনী,,,,,,,
☆☆☆
ঘরে ঢুকেই আরাদ্ধা দেখে তার দাদি সোফায় বসে চা খাচ্ছে। ভেতরের রুম থেকে অনেক আওয়াজ আসছে।হয়ত মার্জিয়ার মা বাবা আর সুমাইয়া চলে এসেছে।আরাদ্ধা খুশি হয়ে যায়। কতদিন পর সবার সাথে দেখা হচ্ছে।আরাদ্ধা ভেতরের রুমের দিকে এগোতেই দাদি তীক্ষ্ণ কন্ঠে বলে,মনে থাকে যেন!কোনো ঝামেলা আমি চাই না।
আরাদ্ধা রাগ হয়।চোখ মুখ কুঁচকে বলে,ওরা এখানে এসেছে কেন? রোদ্দুর ভাইয়ারা তো ওদের বাসায় গিয়েও ওকে দেখে আসতে পারে তাই না? আমাদের বাসায় কেন এলো?
দাদি ধমক দিয়ে বলে,থাপড়ে গাল লাল করে দেব মুখপুরী।আমার বাসায় যে ইচ্ছা সে আসুক তোর কি?তোর বাসা মানে তুই নিজেই তো এখানে আশ্রিতা হয়ে থাকিস আবার বড়বড় কথা।যা সামনে থেকে।
আরাদ্ধার আবার মন খারাপ হয়ে যায়। মনের মধ্যে অভিমান বাসা বাঁধে। নিজের রুমে গিয়ে দরজা আটকে দেয়।মনে মনে বলে,এতো সমস্যা আমাকে নিয়ে!ঠিক আছে আর সমস্যায় থাকতে হবে না।চলে যাব অনেক দূরে।আর আসব না এখানে। সত্যি!
আরাদ্ধা ক্লান্ত দেহটা বিছানায় এলিয়ে দেয়।ক্লান্ত লাগছে। খুব!
চলবে,