অনুভবে
পর্ব-৪৪
নিলুফার ইয়াসমিন ঊষা
সুরভী চিন্তিত কন্ঠে বলল, “তাই ভেবে নে। সর্বনাশ হয়ে গেছে ইনু।”
সুরভির কথা শুনে এক লাফে উঠে বসে ইনারা, “হয়েছেটা কি?”
“নিউজ চ্যানেল দেখ।”
ইনারা তার পাশের সাইড টেবিল থেকে রিমোট নিয়ে টিভি চালু করে। সেখানে বড় বড় হেডলাইনে লেখা,
“বিখ্যাত গায়ক ও অভিনেতা জোহানের সাথে নতুন তারকা আইজা খাতুনের সম্পর্ক। প্রেমের ছড়াছড়ি ” মন” সিনেমার দুই নায়ক নায়িকার মধ্য।”
ইনারা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। সে ভাবে সুরভি জোহানের এ নিউজ দেখে ভয় পেয়েছে। সুরভি বরাবরই তাকে ও প্রিয়কে নিয়ে সেন্সিটিভ। তাদের নিয়ে ছোট ছোট ব্যাপারেও ভয় পেয়ে যায়। আগামী সাপ্তাহে তার ও জোহানের বাগদান। এর পূর্বে এমন নিউজ দেখে হয়তো সুরভি ভয় পেয়ে গেছে। সে সুরভীকে সান্ত্বনা দিয়ে বলে, “তুই জোহান এবং আইজা আপুর নিউজ দেখে এমন করছিস। তাদের ফিল্ম রিলিজ হয়েছে এক সাপ্তাহ আছে। এমন গুজব ছড়ায় এমন সময়। অনেকসময় ছবির সাথে যুক্ত মানুষরাই ছড়ায় মার্কিটিং এর জন্য।”
সুরভি মিনমিনে গলায় বলে, “আইজা আপুর আরেকটি নিউজ এসেছে। তা দেখ।”
“কোথায় আইজা আপুর… ”
চ্যানেল পরিবর্তন করতে করতে থেমে যায় ইনারা। তার হাত থেকে রিমোটটা পড়ে যায়। ফোনও। স্তব্ধ হয়ে যায় সে।
“পরিচালক মুশতাকের ভাগ্নি আইজা দাঁড়িয়েছেন এক অবলা নারীর পাশে। তার সহায়ক আহমেদ প্রিয় একজন নারী কর্মীকে একা পেয়ে ধর্ষণ করার চেষ্টা করেছেন। তার বিরুদ্ধে মামলা। গতরাতে গ্রেফতার করা হয় তাকে।আইজার এই পদক্ষেপে জনগণের পক্ষ থেকে ভালোবাসা পাচ্ছেন তিনি।”
সংবাদটা দেখে কিছু মুহূর্তে থমকে রইলো ইনারা। এই পৃথিবী উল্টে গেলেও সে বিশ্বাস করতে পারে না প্রিয় এমন কিছু করেছে। এটা অসম্ভব। সে দ্রুত ফোন হাতে নিয়ে সুরভীকে বলে, “এটা তো অসম্ভব। প্রিয় এটা করতেই পারে না।”
“আমি জানি। আমাদের ওর কাছে যেতে হবে।”
“আমি এক্ষুনি বের হচ্ছি।”
ইনারা সাথে সাথে উঠে বের হয়। প্রিয়র বাসায় ঢুকতেই সে শুনে কান্নাকাটির শব্দ। প্রিয়র মা কান্নাকাটি করে অস্থির হয়ে আছে। সেখানে রয়েছে প্রিয়র বোন এবং তার শশুড়বাড়ির লোকেরা। সাথে কিছু প্রতিবেশীও। ইনারা যেয়েই প্রিয়’র মা’য়ের কাছে বসে। সান্ত্বনা দিয়ে বলে, “আন্টি চিন্তা করেন না সব ঠিক হয়ে যাবে। আমি প্রিয়কে ফিরিয়ে নিয়ে আসবো।”
তখনই প্রিয়র বোনের শাশুড়ী বলে উঠেন, “ফিরিয়ে নিয়ে আসবে বললেই হলো। একটা মেয়ে হয়ে এসব কথা বলতে লজ্জা লাগে না? এক মাইয়ার ইজ্জত নিয়ে খেলা করতে গেছে আর সে ওই ছেলেকে ফিরিয়ে নিয়ে আসবে।”
“আন্টি প্লিজ আমি নিশ্চিত প্রিয় এমন কাজ কখনো করতে পারে না। আমাদের বন্ধুত্ব আছে পাঁচ বছর হবে। আজ পর্যন্ত আমি ওকে কোনো মেয়ের দিকে খারাপ নজরে তাকাতে দেখি নি।”
মহিলাটি ভেংচি কেটে বললেন, “একেবারে তাকায় নাই তো, কাম সারছে। নিজের ইজ্জত ডুবাইছে সাথে আমাদের ইজ্জতও ডুবাল। কেলেঙ্কারি মেখে গেল আমাদের মুখেও। একতো ভালো কিছু না পেয়েও গরিবের মেয়েকে বউ করে নিলাম। এর উপর বিনামূল্যে কেলেঙ্কারি দিয়ে গেল।”
ইনারা বিরক্ত হয়ে মুখ ফিরিয়ে নেয়। সে প্রিয়’র বোনকে বলে, “প্রীতি তোমার শাশুড়ীকে চুপ করতে বলো। মানুষ শুনছে।”
প্রীতিও কাঁদছিল। সে কাঁদতে কাঁদতে বল, “আর কী শোনার বাকি আছে আপু? সব তো এখন দুনিয়া জানে। ভাইয়া আমাদের কোথাও মুখ দেখানোর অবস্থায় ছাড়লো না। এখন তার জন্য প্রতিদিন যন্ত্রণা সহ্য করতে হবে আমাদের।”
“প্রীতি! তোমার ভাই তোমার জন্য কত কিছু করেছে সব ভুলে যেও না।”
“করেছে মানছি। কিন্তু করে কী লাভ? এখন তো জীবনটা জাহান্নাম থেকেও খারাপ করে দিলো। এর থেকে ভালো বাবা মরে যাবার পর আমাদের বিষ খাইয়ে মেরে ফেলতো। সকাল থেকে লোকের কত কথা শুনতে হয়েছে জানেন? সবাই থু থু করছে। আল্লাহ জানে তার জন্য সারা জীবন কত কথা শুনতে হবে।”
ইনারা সেখান থেকে উঠে যায়। দরজাতেই সে পেয়ে যায় সুরভিকে। সে রিক্সা থেকে নামছিলো। সুরভি তার কাছে এসে বলল, “ভেতরে না যেয়ে এখানে দাঁড়িয়ে আছিস কেন?”
“ভেতরে গিয়েছিলাম। কিন্তু তাদের কথা সহ্য করতে না পেরে বেরিয়ে আসলাম। আর সবার কথা বাদ,প্রিয় তার বোনের জন্য কত কিছু করল আর সে তার নামে….” দীর্ঘশ্বাস ফেলে ইনারা, “বাদ দে। আমি আইজা আপুকে কল দিচ্ছি। ঠিক কি হয়েছে জানতে হবে।”
ইনারা আইজাক কল।দেয়, “আপু… আপু এসব কী হচ্ছে?”
“কোনটা কি হচ্ছে ইনু?”
“প্রিয়… সে এমন করতেই পারে। অসম্ভব।”
“কিন্তু এমনটা তো হয়েছে। মেয়েটা নিজে আমার কাছে এসে বিচার দিলো।”
“আপু তুমিও তো প্রিয় কে এত বছর ধরে চিনো। তোমার মনে হয় ও এমন করতে পারে।”
“কার নিয়ত কখন বদলায় কে জানে? ধর্ষকের মুখে তো লেখা থাকে না যে সে এমন নিচু কাজ করতে পারে। মেয়েটা মিথ্যা কেন বলবে? ওর কি লাভ?” “আমি মেয়েটার সাথে কথা বলতে চাই।”
“অমৃতা আমার সাথেই আছে। মেয়েটা খুব ভয়ে আছে। আমি তো নতুন ফিল্মের শুটিং এর জন্য একটু দূরে আছি। ওখানে তো ওকে নিয়ে আসতে পারব না। যেহেতু শুটিং চলছে।”
“আমি তাহলে আসছি তোমার কাছে। ততক্ষণের জন্য প্রিয়কে ছাড়তে বলো। ওর অপরাধ প্রমাণ না হলে কেন তাকে বন্দী করে রাখা হবে?”
“যদি পালিয়ে যায়?”
“আমি গ্যারান্টি নিচ্ছি। ও কোথাও যাবে না।”
“আচ্ছা। আর শুন, একা আসবি। আমি চাই না। বেশি মানুষ দেখলেই মেয়েটা ভয় পেতে পারে। এছাড়া আমি চাই না আমাদের কথা বলার সময় অন্য কেউ বাঁধা দেক।”
“থ্যাঙ্কিউ আপু। আমি জানতাম তুমি আমার কথা বুঝবে।”
ইনারা ফোন রেখে সুরভিকে পাঠায় প্রিয়র কাছে। এবং নিজে যায় আইজার হোটেলে। সেখানে প্রায় আধাঘন্টা বসিয়ে রাখার পর তাকে রুমের চাবি দেওয়া হয় এবং বলা হয়, “ম্যাডাম আসছে। আপনাকে রুমে যেয়ে বসতে বলেছে।”
ইনারা চাবিটা নিয়ে যায় রুমে। চিন্তায়, ক্লান্তিতে তার মাথা ধরে আছে। সে ভাবলো রুমে যেয়ে সবার আগে সুরভিকে কল দিবে। প্রিয়’র খবর নিতে হবে। সেখানে আসলে কি হয়েছিল জানতে হবে। আর মেয়েটা কেন মিথ্যা কথা বলছে তাও জানতে হবে।
ইনারার কোনো ভাই নেই। তার ছোট থেকেই একটা ভাইয়ের শখ ছিল। প্রিয় তার জীবনে আসার পর ভাইয়ের কমতি অনুভব হয় নি। প্রিয় ও সুরভি তার কাছে বন্ধু থেকেও বেশি পরিবারের মতো। কেননা সে পরিবার থেকেও তার বন্ধুদের বেশি আপন করে পেয়েছে। কিন্তু বন্ধুত্ব বলে সে ভুলকে উৎসাহ দিবে না। প্রিয় এমন কিছু করতে পারে না তার অটল বিশ্বাস থাকারও তো কারণ আছে। প্রিয় এবং সুরভির সাথেই তার বেশি সময় কাটে। প্রিয়র কাছে কোনো মেয়ে নিজে এসে কথা বললেও সে চোখ তুলে তাকানোর সাহস করে নাও। আর সে এমন কিছু করবে? আর যদি করে থাকে তাহলে সে নিজে প্রিয়কে শাস্তি দেওয়াবে। কঠিন শাস্তি। কিন্তু অপরাধ প্রমাণ না হবার আগে তাকে অপরাধী বলে দেওয়া কী ঠিক?
ইনারা রুমের দরজা আটকে বিছানার সামনে এসে দাঁড়ায়। তার ব্যাগ ও ফোন রাখে। পাশের টেবিলে পানি দেখে সেদিকে যায়। খুব তৃষ্ণা পেয়েছে তার। গ্লাসে পানি ঢেলে পান করার জন্য ঠোঁটের কাছে নিতেই সে কারও হাতের স্পর্শ অনুভব করে। চমকে উঠে সে। হাতদুটো তার দেহে বাজে ভাবে স্পর্শ করল। বিস্ময়ে তার হাতের গ্লাসটা নিচে পরে যায়। কাঁচের গ্লাসটা ভেঙে চুরমার হয়ে যায়।
সে পিছনে ফিরতেই দেখে একটি মাঝবয়েসী পুরুষ দাঁড়ানো। তাকে চেনা লাগছিলো। সে তার সিনেমার একজন ইনভেস্টর। ইনারা সজোরে ধাক্কা দেয় তাকে, “আপনার সাহস কত বড় আমাকে ছোঁয়ার।”
“আহা সোনা রাগ করছ কেন? তুমি আমাকে খুশি করতে পারলে আমিও তোমাকে খুশি করবো। শুটিং তো সবে শুরু হয়েছে। তমি চাইলেই লিড রোল পেতে পারো। যাস্ট আমাকে খুশি রাখার দায়িত্ব তোমার।”
সে এগিয়ে আসে ইনারার দিকে। ইনারার উন্মুক্ত গলায় হাত দিয়ে কথাটা বলে। হাতটা নিচে নিতে থাকে সে। ইনারার শরীরটা ঘিনঘিন করে উঠে। সে এক ঝটকায় লোকটার হাত সরিয়ে দিয়ে ক্রোধিত স্বরে বলে, “আমার আপনার কোনো সাহায্য লাগবে না। উল্টো আপনার সাহায্যের প্রয়োজন হবে। যখন আপনাকে পুলিশ ধরে নিয়ে যাবে। তখন।”
ইনারা তার পাশ কাটিয়ে যেতে নিলে লোকটা আবারও তাকে পিছন থেকে ধরে নেয় শক্ত করে। তার হাতদুটো ধরে বলে, “তোর কি মনে হয়? তোর মতো সামান্য মেয়ে আমার ক্ষতি করতে পারবে। এত সুন্দর করে বললাম, মানলি না। আমি যা চাই তা হাসিল করেই ছাড়ি। তা জোর করে হোক না কেন।”
লোকটা আবার শরীরে বাজেভাবে দিচ্ছিল। ইনারা নড়তে থাকে, কিন্তু তার হাত শক্ত করে ধরে রেখেছে লোকটা। তার শক্তির সাথে পেরে উঠতে পারছে না সে। সে চিৎকার করে, কেউ আসে না। মুহূর্ত খানেকের জন্য হার মেনে নেয় সে। তার চোখে পানি চলে আসে। দম আটকে আসে সে। সে কেবল চোখ দুটো বন্ধ করে দোয়া করে এই মুহূর্তে এ অঘটনের ঘটার পূর্বে মৃত্যু হয় তার একটা মেয়ের জন্য এ পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি মূল্যবান জিনিস হলো তার সম্মান। তার জীবন থেকে বেশি সম্মান প্রিয়।
চোখ দুটো খুলে ইনারা। এভাবে সে পরাজিত হতে পারে না। কেউ আসবে না তাকে এখানে বাঁচাতে। তার লড়াই নিজে লড়তে হবে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে। বল থেকে বেশি বুদ্ধি কাজে লাগাতে হবে তার। তার হাত বাঁধা কিন্তু পা তো নয়। সজোরে পিছনের লোকটাকে পা দিয়ে লাথি মারে। সাথে সাথে লোকটা তাকে ছেড়ে মেঝেতে বসে যায়। আবার উঠতে নিয়ে বলে, “তোর এত বড় সাহস…” কিন্তু সে উঠার পূর্বেই ইনারা মেঝে থেকে কাঁচের টুকরো তুলে তার গালে আঁচড় নেরে দেয়। সাথে সাথে লোকটার গাল কেটে রক্ত বের হয়। সে লোকটার বুকে লাত্থি মেরে চেঁচিয়ে উঠে, “আরেক কদম এগোলে তোর চামড়া তুলে ফেলবো। আমাকে ছোঁয়ার সাহস কী করে হলো তোর? এখানে…এখানেই থাকবি তুই। এক পা বাড়ালে ভালো হবে না।”
ইনারা দ্রুত তার ব্যাগ ও ফোন নিয়ে বের হয়। সে ঘটনাটা জানায় হোটেলের ম্যানেজারকে। সে তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলল তারা লোকটাকে বেঁধে রাখবে। পুলিশ ডাকছে তারা। কেবল সাক্ষী দিতে ইনারাকে আবার আসতে হবে।
ইনারা রাজি হয়। সেখান থেকে বেরিয়ে যায় সে। বেরোতেই যেন এক শান্তির নিশ্বাস ফেলে সে। এতক্ষণ তার দম বন্ধ হয়ে আসছিলো। এখান থেকে বের হয়েই শান্তি পায় সে। সে নিজেও কাঁপছিলো। এই ঘটনা তার জীবনে প্রথম ঘটেছে। এমন ভয়ংকর ঘটনার অনুভূতি সে আর এই জীবনে অনুভব করতে চায় না। তবুও নিজেকে সংযত রাখল। এমনিতেই প্রিয়র চিন্তা। এ সময় ব্যাপারটা প্রিয় ও সুরভীকে জানানো যাবে না।
সন্ধ্যায় প্রিয়কে ছাড়া হয় কারাগার থেকে। প্রিয় জানায় মেয়েটা তাকে পছন্দ করতো। কয়েকবার বলেছে। একসময় সেও পছন্দ করতে শুরু করে তাকে। কিন্তু কখনো তাকে স্পর্শ করে নি। গতকাল শুটিং এ আইজার মেকাপ শেষে সে বাহিরে গেলে তারা দুইজন কক্ষে একা থাকে। কথা বলতে থাকে। হঠাৎ করেই সে চিৎকার করতে শুরু করে। তার লিপ্সটিক লেপ্টিয়ে, জামা খানিকটা ছিঁড়ে নেয়। সে কিছু বুঝে না। বুঝে উঠার সময় পায় না।তারপর যখন মানুষজন জমা হয় তখন তার নামে মিথ্যা অপবাদ লাগায়। তাকে নিয়ে বাসায় না যেয়ে সোজা আইজার শুটিং এ যায় ইনারা। সুরভি প্রিয়র বাসায়। তার মাকে সামলাচ্ছে। সবাই তাদের দিকে কেমন অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকাচ্ছিল। হয়তো প্রিয়কে সংবাদে দেখে নিজের মনেই কত ঘটনা সাজিয়ে নিয়েছে তারা।
একজন তাদের আইজার ভ্যানিটি রুম দেখিয়ে দেয়।
রুমে ঢুকতেই সে দেখে অমৃতা দাঁড়ানো। সে মেকাপ গুছাচ্ছে। প্রিয়কে দেখতেই তোর চোখের মুখের ভাব অন্যরকম হয়ে গেল। সে চোখ নিচে নামিয়ে নিল।
ইনারা প্রিয়কে জিজ্ঞেস করে, “এটাই কি সেই মেয়ে?”
“হুম।”
ইনারা মেয়েটির সামন যেয়ে দাঁড়ায়, “আমি তোমাকে ক’টা প্রশ্ন করতে চাই।”
“আ…আমি কোনো প্রশ্নের উওর দিতে চাই না।”
বলে মেয়েটা যেতে নিলেই ইনারা তার সামনে এসে দাঁড়ায়, “তুমি সত্যি বলছ তাই না? তাহলে তোমার মুখে এমন এমন চিন্তার রেখা কেন? তুমি সত্যি বললে তো তোমার ভয় পাবার কথা না।”
” দেখুন আমার আপনার সাথে কথা বলার ইচ্ছা নেই।”
“বাট কোর্টে তো এসবের উওর তোমাকে দিতেই হবে।”
“কোর্টে!” অমৃতা চমকে উঠে। তার মুখে ভয়ের ছাপ। সে এক ঢোক গিলে।
“অবশ্যই। তুমি এত বড় আরোপ লাগিয়েছ তার সত্যতা যাচাই হবে না? আর বিশ্বাস করো একবার যদি প্রমাণ হয় তুমি মিথ্যা বলেছ তারপর তোমার জন্য বড় শাস্তির ব্যবস্থা আমি করব।”
প্রিয় অমৃতাকে বলে, “আমি কখনো ভাবি নি তুমি আমার উপর এত বড় মিথ্যা অপবাদ লাগাতে পারো। আমি তো ভেবেছিলাম তুমি অনেক সরল, সহজ মেয়ে। অথচ…” গলা কেঁপে উঠে প্রিয়র, “তুমি এমন কেন করলে অমৃতা?”
“আমার কথায়।” দরজা কন্ঠটা এলো। সকলের দৃষ্টি যেয়ে আটকায় দরজায়। আইজা দাঁড়ানো। সে রুমে ঢুকে দরজা আটকে দেয়। তার মুখে এ কথাটা শুনে দ্বিধায় পড়ে গেল ইনারা। সে এক পা এগিয়ে এসে বলল, “তোমার কথায়! মানে কি আপু?”
“বাংলা ভাষায়ই তো বলছি। ও আমার কথায় এসব করেছে।”
“কিন্তু তুমি এমন কেন করবে?”
আইজা হাসে। সে মাথা নাড়িয়ে যেয়ে চেয়ারে পা’য়ের উপর পা তুলে বসে, “আমি না তোকে অনেক চালাক ভাবতাম ইনু। কিন্তু এখন তো দেখি তোর মাথায় কোনো বুদ্ধি নেই। মানে এখনো তুই বুঝিস নি? আমি ইচ্ছা করে প্রিয়র বিরুদ্ধে মামলা করেছি।”
বিস্ময়ে প্রিয়র চোখ যেন কোটর থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছে। সে হতভম্ব হয়ে প্রশ্ন করে, “আপনি কি এসব মজা পেয়েছেন? আমার জীবন শেষ করে দিয়েছেন আপনি। আমি আপনার কি ক্ষতি করেছি যে আপনি আমার সাথে এমন করলেন?”
“না, তুমি আমার সাথে কিছু করো নি। তোমার কেবল দোষ একটাই। তুমি ইনারার বন্ধু। তোমাকে ও সুরভিকে অনেক ভালোবাসে ও। কিন্তু সুরভি তো সাইদের বোন। সাইদকে আমি ভালোবাসি। ওকে আমি কষ্ট দিতে পারব না। তাই ভাবলাম তোমার দ্বারাই ইনারাকে কষ্ট দেই।”
ইনারার নিজের কানকে বিশ্বাস হলো না। তার মনে হলো সে স্বপ্ন দেখছে। এমনটা তো বাস্তব হতে পারে না। আইজা আপু কখনো তার সাথে এমন করতে পারে না। সে দৌড়ে যেয়ে আইজার সামনে বসে। তার হাত ধরে কাঁদোকাঁদো গলায় বলে, “তুমি তো আমাকেও ভালোবাসো আপু। তাহলে আমাকে কিভাবে কষ্ট দিতে পারো? তুমি এখন মিথ্যা বলছ তাইনা?”
আইজা হেসে ইনারার হাত থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিলো। তার ফোন বের করে ইনারার হাতে দিলো।
ফোনে একটা ভিডিও চলছে। আজ সকালের হোটেল রুমে তার ও লোকটার ভিডিও। কিন্তু ভিডিওটা এমন ভাবে তৈরি করা হয়েছে যা দেখে মনে হচ্ছে ইনারা ইচ্ছা করে লোকটার কাছে গেছে। লোকটা যে তার সাথে জোর করেছিলো বা সে লোকটাকে মেরে সেখান থেকে পালিয়েছে এমন কিছু নেই। ভিডিওর টাইটালে লেখা,
“সিনেমা জগতে নতুন অভিনেত্রীর আগমনের আগেই ভিডিও ভাইরাল। প্রধান চরিত্রের লোভে করলেন নষ্টামি।”
ভিডিওর নিচে হাজারো কমেন্ট। কমেন্টে কেবল তার জন্য গালি এবং বাজে কথা ছাড়া কিছু নেই। তাকে বৈশ্যা পর্যন্ত বলা হচ্ছে।
আইজা বলে, “তুই আসলেই এতটা গাঁধা যে আমি তোকে সেখানে পাঠালাম, তোর সাথে এত বড় ঘটনা হলো কিন্তু তোর একবারও মনে হয় নি আমি তোর সাথে এমনটা করেছি।”
স্তব্ধ ইনারা। সে নড়তেও যেন ভুলে গেছে। তার ফোনটা হাত থেকে নিচে পরে যায়। প্রিয় জিজ্ঞেস করে, “মোবাইলে কী আছে ইনারা?”
ইনারা উওর দেয় না। উওর দেবার মতো শক্তি তার নেই। প্রিয় নিজে মোবাইলটা নিয়ে ভিডিও দেখতেই চোখ বন্ধ করে। ক্রোধে ফোনটা ছুঁড়ে মারে সে, “এমন জঘন্য কাজ করতে বুক কাঁপে নি আপনার? ইনারা আপনাকে কত ভালোবাসতো, সম্মান করতো। আর আপনি…ছিঃ! আপনি নারী না হলে আপনাকে এ মুহূর্তে কি করতাম আমি নিজেও জানি না। আর নারী! আপনি তো নারী নামে কলঙ্ক।”
প্রিয় দৌড়ে ইনারার কাছে যেয়ে তার মাথায় হাত রেখে বলে, “তুই চিন্তা করিস না। সব ঠিক হয়ে যাবে আমি সব ঠিক করে দিব।”
ইনারা এক পলক তাকায় প্রিয়র দিকে। আবার আইজার দিকে তাকায়। এ মুহূর্তে আইজার জায়গায় অন্য কেউ হলে তার কি অবস্থা করতো ইনু নিজেও জানে না। কিন্তু তার বোন এমন করেছে এ কথা এখনো তোর বিশ্বাস হচ্ছে না। ভেঙে পড়ে সে। এ পৃথিবীতে কেবল কিছু মানুষকেই আপন ভাবে ইনারা। এর মধ্যে আইজাও আছে। ছোটবেলা থেকে আইজা তাকে আদর করে এসেছে। তাকে ভালোবেসে এসেছে। তাহলে আজ এমন কি হলো যে তার জীবনের শত্রু হয়ে দাঁড়ায় সে? ইনারা কাঁপা-কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করে, “আমার সাথে এমন কেন করলে আপু? আমি কী করেছি?”
“কি করিছিস? কী করিস নি? ছোটবেলা থেকে তোর রূপের প্রশংসা শুনতে শুনতে আমি ক্লান্ত। তবুও সবসময় ভাবতাম তোর এতে কোনো দোষ নেই। যা পাওয়ার জন্য আমার হাজারো চেষ্টা করতে হতো তা তোর সামনে চাওয়ার আগেই হাজির করা হতো। আমার মা পর্যন্ত তোর রূপের জন্য আমাকে কষ্ট দিয়েছে। আর এখন… আমি কতকিছু করেছি ফিল্ম করার জন্য। আমার স্বপ্ন পর্যন্ত ত্যাগ করেছি। কিন্তু তুই ঝট করে এত বড় ফিল্মে চান্স পেয়ে গেলি। অথচ এ ফিল্মে আসার জন্য আমি এত চেষ্টা করেছিলাম। তাও চুপ ছিলাম। কিন্তু কি হলো? এতমাস থেকেও জনগণের কাছে আমি কেবল ঘৃণা পেয়েছি, অকারণে। আর তুই না আসতেই প্রশংসা লুটিয়ে নিলি? এত সহজে না ইনারা। এত সহজে না। এখন আমি সবার ভালোবাসার পাত্র হব। আর তুই হবি ঘৃণার।”
ইনারা শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো আইজার দিকে, “তুমি নিজের ঈর্ষার কারণে আমাদের সম্পর্ক ভুলে গিয়ে আমার চরিত্র বদনাম করে দিলে?”
বাঁকা হাসে ইনারা, “উঁহু, তোমার চরিত্র তুই নিজে বদনাম করবি। আগামীকাল নিজে মিডিয়ার সামনে স্বীকার করবি তুই যা করেছিস স্ব-ইচ্ছায় করেছিস এবং নিজ ইচ্ছায় ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি ছেড়ে যাবি।”
“ইনারা এমন কিছু করবে না।” প্রিয় চেঁচিয়ে উঠে।
“তোমার সম্মান বাঁচাতে হলে ওর করতে হবে।” আইজা তাকাল ইনারার দিকে, “তুই এই স্টেটমেন্ট দেবার সাথে সাথে আমি প্রিয়র বিরুদ্ধে কেস ফিরিয়ে নিব।”
“ইনারা এমন কিছু করবে না।” প্রিয় আবার বলল।
ইনারা মুহূর্তে ব্যয় না করেই বলে, “আমি করব। তুমি…তুমি ওর বিরুদ্ধে মামলাটা ফিরিয়ে নিয়ে এটা ঘোষণা করে দিবে ওর বিরুদ্ধে যা বলা হয়েছে সব মিথ্যে।”
“ডান।”
ইনারা উঠে আসে। তাকে যন্ত্রের মতো দেখাচ্ছে। সে হাঁটছে। কিন্তু তার মাঝে কোনো অনুভূতি দেখা যাচ্ছে না। সে গাড়িতে বসলো। কিন্তু কোনো কথা বলল না। প্রিয়’র বাসার সামনে এসে গাড়ি থামার পর ইনারা প্রিয়’র হাত ধরে কেবল জোরপূর্বক হেসে বলল, “তুই চিন্তা করিস না। আমি সব সামলে নিব।”
প্রিয় কিছু বলে না। মাথা নাড়িয়ে নেমে যায় গাড়ি থেকে।
গাড়ি চালু হয়। ইনারার বাসায় যেয়ে পৌঁছাতে লাগে পয়তাল্লিশ মিনিট। গ্যারেজে গাড়ি রাখা হয়। ড্রাইভার বলে, “বাসা এসে পড়েছে।”
“চাচা আপনি একটু যান। আমি এখানেই থাকব।”
ড্রাইভার নেমে যায়। আশেপাশে কেউ নেই। ইনারার চোখের পানি আর থামে না। সামনে সিটে মাথা রেখে মুখ চেপে ধরে সে। যেন নীরবে কাঁদতে পারে সে। কেউ তার কান্নার শব্দ নানশুনে, কেউ তার চোখের জল না দেখে। প্রায় দুই ঘন্টা পর সুরভির কল আসে। সে কল ধরে। ভারী গলায় বলে, “বল।”
ওপাশ থেকে সুরভির আতঙ্কিত কন্ঠ, “ইনু প্রিয়…. প্রিয় আর নেই।”
কথাটা শুনতেই ইনারার হাত থেকে ফোন পড়ে যায়।
.
.
যত দ্রুত সম্ভব ইনারা যেয়ে পৌঁছায় প্রিয়র বাসায়। মেঝেতে তার লাশ পড়ে আছে। পাখার সাথে ঝুলে আছে একটি গামছা। প্রিয়র মা প্রিয়কে বুকে জড়িয়ে ধরে শব্দ করে কাঁদছেন। চার দেয়ালে গুঁজছে তার কান্নার শব্দ। সে কান্না করতে করতে বলল, “আমার বা’জান আমারে ছাইড়া চলে গেল রে। আমার বা’জান আমারে ছাইড়া চইলা গেল। আমারে একা ফালাইয়া চলে গেল।”
সুরভি প্রিয়’র বামপাশে বসে ছিলো। সে ইনারাকে দেখে ছুটে আসে, “দোস্ত দেখ প্রিয় উঠে না। কত ডেকেছি উঠেই না। এই সবার কারণে ও আজ নেই। আসার পর এই সবাই… সবাই ওকে কত বাজে কথা বলেছে। এই’যে ওর মা এখন কাঁদতেছে না? সে বলতেছিলো যে তার মতো ছেলেকে জন্ম দিয়ে সে কোনো পাপ করছে। মরে যেতে। আর দেখ আসলেই….” সুরভির নিশ্বাস আটকে এলো। তাও সে বলল, “এইখানে সবাই ওর মৃত্যুর দায়ী। আমি রুম আটকে ওর পাশে বসে ছিলাম। আমি শুনেছি কত কি শুনিয়েছে এরা প্রিয়কে। আমি ওর জন্য বাহিরে খাবার নিতে গিয়েছিলাম আর এসে দেখি…” ফুঁপিয়ে কান্না করে উঠে সুরভি।
ইনারা থপ করে ভসে পড়ে নিচে। শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে প্রিয়’র দিকে। সুরভি তার পাশে বসে। তার দিকে একটি কাগজ এগিয়ে দিয়ে বলে, “প্রিয় এটা মৃত্যুর পূর্বে এটা রেখে গেছে।”
ইনারা হাতে চিঠিটা নিয়ে খুলল,
“আমি প্রিয়। যখন সবাই এই চিঠিটা পাবে তখন হয়তো আমি এই পৃথিবীতে থাকবো না। আমি নিজের চরিত্রের কোনো সাফাই দিব না। আমার আল্লাহ জানে আমি কোনো পাপ করি নি। আমি এই সব দুনিয়ার কথা সহ্য করতে পারবো কিন্তু আমার যে মা এবং বোনের জন্য আমার জীবন উৎসর্গ করেছি তাদের চোখে আমার জন্য ঘৃণা সহ্য করার ক্ষমতা আমার নেই। আমার জন্য তাদের কষ্ট পেতে হবে, সকলের কাছে অপমানিত হতে হবে। এটা আমি ভাবতেও পারি না। এ কথাটা ভাবতেই তো আমার বুকের ভেতর হাহাকার করে উঠে। যে এলাকায় ছোট থেকে বড় হয়েছি তারা যখন আমায় দেখে বাজে কথা বলল তখন আমার অনেক যন্ত্রণা হচ্ছিল। বাবা শিখিয়েছিলেন, বাঁচলে সম্মান নিয়ে বাঁচতে। কিন্তু সে সম্মান হারিয়ে গেল আমার। আমি হয়তো খুব দুর্বল ছিলাম তাই এই জগতের সাথে যুদ্ধ করার সাহস আমার নেই। কিন্তু ইনু, আমি জানি তোর অনেক সাহস আছে। আমার জন্য তুই তোর যুদ্ধে হেরে যাবি না। তুই আমার কাছে আমার বোনের মতো। আমি বলেছিলাম তোর সম্মান রক্ষা করা আমার দায়িত্ব। তাহলে আমার জন্য তোর চরিত্রে দাগ কীভাবে লাগতে দেই? ইনু আমার শেষ ইচ্ছা তুই সেরা অভিনেত্রী হয়ে জগৎ-কে দেখিয়ে দিবি। কখনো পরাজিত হবি না। আমি চলে যাচ্ছি। সুরভির খেয়াল রাখিস। মা আর প্রীতিকে বুঝিয়ে বলিস, আমি কখনো এমন কাজ করি নি যে তাদের অপমানিত হতে হয়।”
.
.
প্রিয়কে কবর দেওয়ার জন্য দেশের বাড়ি নেওয়া হয়েছে। রাত এগারোটায় বাড়ি এসে পৌঁছায় ইনারা। তার চুল আওলিয়ে আছে। চোখটা লালচে। তার হাতে এখনো চিঠিটা। ড্রইংরুমে বসে ছিলো আইজা, তার ফুপি এবং মুশতাক সাহেব। তাকে দেখে ফুপি বললেন, “মানুষের লাজ শরমও তো থাকে। জগতে তার হোটেলরুমের ঘটনার চর্চা হচ্ছে আর সে মুখ তুলে এখানে এসেছে। কি নিলজ্জ!”
ইনারা অগ্নি দৃষ্টিতে তাকায় তার ফুপির দিকে। তার দৃষ্টিতে দেখেই ভয়ে চুপ হয়ে যান ফুপি। শঙ্কিত হয়ে যান। আইজা উঠে আসে তার দিকে। সামনে এগোতে এগোতে বলল, “চোখ নিচে। আমার মা’য়ের দিকে এভাবে তাকানোর সাহস কীভাবে পেলি তুই? চোখ নিচে নামা, নাহয়…”
“নাহয়? নাহয় কী? এবার কার চরিত্রের তামাশা বানাবেন?” ইনারা চিঠিটা আইজার মুখের উপর ছুড়ে মারে।
“ইনারা এটা কী ধরনের ফাইজলামি? তুই জানিস আমি কী করতে পারি?”
“আমি জানি আপনি কী করতে পারেন। এটা তারই প্রমাণ। এটা কী জানেন? প্রিয়র আত্নহত্যার চিঠি। ওর শেষ চিঠি। সরি, আত্নহত্যা নয়। হত্যার আগের লেখা চিঠি।”
আইজা স্তব্ধ হয়ে যায়। সে এই কথা শুনবে কখনো ভাবতেও পারি নি। তার জন্য কেউ মারা গেছে? কথাটা শুনে তার ভেতরের আত্নাটাও কেঁপে উঠে।
ইনারা আবার বলে, ” আপনি নিজের অহংকারকে শান্ত করতে ওর খুন করেছেন। আপনার জন্য… আপনার জন্য…”
ইনারা রাগের বশে আইজার উপর হাত তুলতে হাত তুলতে নিলেই মুশতাক সাহেব তার হাত ধরে নেই। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকায় ইনারার দিকে, “তোর সাহস কি করে হয় আইজার উপর হাত তোলার?” বলেই সজোরে চর মারেন ইনারাকে।
ইনারা যেয়ে পড়ে মেঝেতে। সোফার কাছে যেয়ে পড়ে সে। সোফার এক কোণে মাথা লেগে তার কপাল ফেটে যায়। ইনারা তার মাথায় হাত দিয়ে হতভম্ব হয়ে তাকায় তার বাবার দিকে। কিছু মুহূর্ত সময় নিয়ে বলল, “বাবা তুমি জানো না উনি কি করেছে। উনি প্রিয়র নামে মিথ্যা মামলা করেছে। আমাকে হোটেলে ডেকে আমার ভিডিও বানিয়ে….”
“আমি জানি।” শান্ত গলায় বললেন মুশতাক সাহেব, “আমি জানি। কারণ আমিই ওকে সব করতে বলেছি। ইনফ্যান্ট ওই ইনভেস্টর আমার কথায় সেখানে গিয়েছে।”
ইনারার নিজের কানকে বিশ্বাস হলো না। সে জানে মুশতাক সাহেব তার উপর রাগ করে থাকে। কিন্তু নিজের মেয়ের সাথে এমনটা সে করতে পারে না। ইনারা উঠেই তার হাত ধরে বলেন, “না বাবা, তুমি মিথ্যা বলছো। তুমি আমার সাথে এমন করতে পারো না। আমি তোমার মেয়ে।”
মুশতাক সাহেব এক ধাক্কায় তাকে দূরে সরিয়ে দেয়। সে পরে যেতে নেবার আগেই খালাজান এসে ধরে নেয় তাকে। তাকে বুকে ভরে নিয়ে মুশতাক সাহেবকে বলে, “সাহেব কী করাতছেন এটা? আপনে আপাজানকে ওয়াদা করছিলেন জীবনে ইনুমণিকে কষ্ট পেতে দিবেন না আর আজ হাত তুলতাছেন?”
“চুপ। এক সামান্য কাজের লোক হয়ে আমার সাথে তর্ক করতেছেন? চাইলেই আমি মিনিটে তোকে ঘর থেকে বের করে দিতে পারি।”
খালাজান ইনারাকে ছেড়ে মোশতাক সাহেবের সামনে এসে দাঁড়ায়, “হ্যাঁ আমি কাজের লোক। কিন্তু আপনি চাইলেই আমাকে ঘর থেকে। বের করতে পারবেন না। কারণ এই ঘর আমার ইনুমণির। সাইয়ারা আপা এটা ইনুমণিকে দিয়ে গেছে।”
শব্দ করে হাসলেন মুশতাক সাহেব, “দিয়ে গিয়েছিলো। এখন শুধু এই ঘর না ওর সব সম্পত্তি আমার নামে। ওর আঠারো বছর শেষ। অর্থাৎ এখন ওর সাইনে এই বাড়ি আমি নিজের করতে পারতাম। আর করে নিয়েছি।”
“কী? কী বললেন আপনি? আপনি কীভাবে এটা করতে পারেন? আপা কত ভরসা করেছিলো আপনার উপর। আর আপনি…” খালাজান তার কোর্ট ধরে আতঙ্কিত সুরে কথাগুলো বলছিলেন। মুশতাক সাহেব বিরক্ত হয়ে তাকে ধাক্কা দিয়ে নিচে ফেলে দেয়। এবং বলে, “ছোটলোক কোথাকার এত বছর তোকে খাওয়ালাম আর তুই আমার মুখের উপর জবাব দেস?”
ইনারা ছুটে আসে খালাজানের কাছে। চিন্তিত সুরে বলে, “খালাজান তুমি ঠিক আছো?”
“ইনুমণি… ইনুমণি শুন, সাইয়ারা আপা কখনো চায় নি তুই এ সত্যি জানিস। কিন্তু আজ দেখি উনি তোর সাথে জুলুম করছে, তোর সব সম্পত্তি নিয়ে নিয়েছে। তোর সত্যটা জানা উচিত। এই লোক… এই লোক তোর আসল বাবা না। সাইয়ারা আপা তোর জন্য এই লোককে বিয়ে করেছিলো আর এই লোক আজ তোর উপর জুলুম…” সম্পূর্ণ কথা শেষ হবার পূর্বেই মুশতাক সাহেব এক লোককে আদেশ দেয়, “এই শুন, ওকে নিয়ে রুমে বন্দী করে রাখ।”
লোকটা এসে নিয়ে গেল খালাজানকে।
ইনারা নম্র চোখে দেখা মুশতাক সাহেবের দিকে, “বাবা খালাজান…সে মিথ্যা বলছিলো তাই না? তুমিই তো।আমার বাবা, তাই না?”
মুশতাক সাহেব ইনারার চুলের মুঠো শক্ত করে ধরে উঠায় তাকে, “আজ তাহলে এতবছর পর সত্য তোর সামনে এলোই। জানিস এই দিনের কত অপেক্ষা করেছি আমি। প্রতি মুহূর্ত আমার তোকে দেখে গা জ্বলতো দে। তোর চেহারা দেইখা আমার তোর বেঈমান মা’য়ের কথা মনে পড়তো। আর চোখ দেখে ওর প্রেমিকের। ওই বেঈমানের জন্য কি করি নি আমি। তাও তোর বাপকে ভুলতে পারতো না। মরার পর যখন আমরা বিয়ে করি তাও সারাক্ষণ তোর মরা বাপের কথা ভাবতো।”
ইনারা ব্যাথায় কুঁকড়ে উঠে। সে বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে মুশতাক সাহেবের দিকে। আজকের এই একদিনে তার সম্পূর্ণ পৃথিবী যেন উলটে গেছে। সম্পূর্ণ জীবনটাই মিথ্যা লাগছে তার কাছে। এর থেকে বেশি কিছু শোনার মতো শক্তি নাই। কিন্তু শুনতে হলো তাকে। সে ইনারার কানের কাছে এসে বলল, “যেদিন সে মরে গেছিলো না? সেদিনও তোর বাপের কথাই ভাবছিলো। আমাকে বলতেছিলো ওর কথা। আমার শরীর জ্বলে উঠছে। এক জীবন কেবল তোর মা’কেই ভালোবেসেছিলাম। কিন্তু ও মূল্য দিলো না। তাই ধাক্কা মেরে ছাদ থেকে ফালিয়ে দিয়েছি।”
কথাটা শুনে ইনারার সম্পূর্ণ দুনিয়া যেন সেখানেই থেমে গেলে। সে হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলো মুশতাক সাহেবের দিকে। কিছু সময় কাটে। তারপর হঠাৎ করে আক্রমণ করে বসে সে মুশতাক সাহেবকে। তার গলা চেপে ধরে। অনেককিছু বলতে চেয়েও কিছু বলতে পারে না সে। দুইজন লোক এসে ছাড়ায় তাকে। অতঃপর মুশতাক সাহেব ঘন নিশ্বাস ফেলে দ্বিগুণ রাগ নিয়ে এসে চড় মারেন ইনারাকে।
ইনারার দৃষ্টিতে ক্ষোভ, ক্রোধ, ঘৃণা। তার দৃষ্টি দেখে মুশতাক সাহেব আদেশের সুরে বললেন, “চোখ নামা।”
সে চোখ নামায় না। চোখ দিয়ে যেন মেরে ফেলবে তাকে। লোকটা আরও উঁচু স্বরে বলে, “চোখ নামাতে বলেছি।”
ইনারার চোখ নামায় না।
“ঠিকাছে আমিও দেখি চোখ কতক্ষণ না নামিয়ে থাকি। হয়তো তোর জীবন যাবে নাহলে তোর চোখ ঝুঁকবে।”
এরপর জানোয়ারের মতো অত্যাচার করেন তিনি ইনারার উপর। বেল্ট খুলে মারতে থাকেন। তার ফুপি চুপচাপ কেবল দৃশ্যটা দেখে। তার চোখেমুখে কোনো দয়া মায়া নেই ইনারার জন্য। কিন্তু আইজা খুব চেয়েও চুপ থাকতে পারে না। সে তার মামার হাত ধরে বলে, “মামা, অনেক হয়েছে। ওর চামড়া কেটে রক্ত বের হচ্ছে। ওকে ছেড়ে দিন।”
আইজার কথায় একটু শান্ত হন তিনি। ইনারার দিকে তাকিয়ে বলে, “এ বাড়ি এখন আমার। আর তোকে এই বাড়ির আশেপাশেও দেখতে চাই না আমি। জানিস আজ এতকিছু কেন হলো তোর সাথে? যেন তুই এ ব্যাপারে কিছু না করতে পারিস। আজ তোর কেউ নেই। তোর সাহায্য করার মতোও কেউ নেই। আর চেয়েও তুই আমার কিছু করতে পারবি না।”
আবার লোকগুলোকে সে বলে, “যা এই আবর্জনাকে বাহিরে ফেলে আয়।”
একজন লোক তাকে ধরে নিয়ে বাহিরের দিকে রওনা দেয়। ইনারা যে কিছু বলবে বা করবে তার শক্তিটুকুও নেই।
দরজার কাছে আসতেই সে আবছা দেখতে পায় দুটো পুরুষকে। সে ভালো করে তাকিয়ে দেখে তাহসানের জোহান এবং তার বাবা দাঁড়ানো। জোহান তাকে দেখেই এসে ধরে আতঙ্কিত গলায় জিজ্ঞেস করে, “এ কি নির্মম অবস্থা তোমার?”
তার পাশের লোকটা তাকে ছাড়তেই ইনারা মেঝেতে বসে পরে। দাঁড়িয়ে থাকার শক্তিটুকুও তার নেই। জোহান তার সামনে বসে পড়ে। তার রক্তমাখা কপালে হাত রেখে বলে, “এমনটা কে করেছে তোমার সাথে?”
তারপর সে হাত ধরে ইনারার। উঠানোর চেষ্টা করে।
ইনারার চোখ বন্ধ হয়ে আসছে। সে বহু কষ্টে জোহানকে বলল, “জো..জোহান এনারা…এনারা আমার…”
এমতো সময় মুশতাক সাহেব বাঁধা দিয়ে বলে, “আরে জোহান বাবা তুমি এসেছ? আসো আসো। আজ তো আমার খুশির দিন। আজ আমরা উৎসব পালন করব। তুমি না থাকলে তো এসব কিছুতেই হতো না।”
ইনারা আবারও চমকে তাকায় জোহানের দিকে। কিছু সময় তাকিয়েই রয়। তাহলে জোহানও এসবের মাঝে ছিলো। আর অবাক হলো না ইনারা। যেখানে তার আপনরাই তার সাথে এত বড় ধোঁকা করল সেখানে জোহান তার কে?
মুশতাক সাহেব আরও বলে, “আরে মিঃ হক আসুন। আপনি না থাকলে এই সম্পত্তি আজ কীভাবে পেতাম আমি? নাহলে এ মেয়েকে যে কতবছর সহ্য করতে হতো কে জানে?”
মিঃ হক এগিয়ে গেলেন, “আমার যেখানে লাভ আছে সেখানে তো আমি থাকবোই। তবে সব কৃতিত্ব আপনার। আপনি এত সুন্দর পরিকল্পনা না করলে কিছুই হতো না। তবে আমার ভাগের কথা মনে আছে তো?”
ইনারা আর কাঁদলো না। তার চোখের জল যেন শুকিয়ে গেছে। সে জোহানের হাত এক ঝটকায় সরিয়ে দেয়। ঘৃণাভরা চোখে তাকাল জোহানের দিকে। তারপর উঠে দাঁড়াতে চাইলো। কিন্তু পারছেনা সে। তার কষ্ট হচ্ছে। সে আবার পড়ে যেতে নিলেই জোহান হাত বাড়ায় তাকে সহযোগিতা করার জন্য। তাকে ধরার জন্য।
কিন্তু তাকে ছোঁয়ার পূর্বেই ইনারা হাতের ইশারায় তাকে থামায়। দরজা ধরে উঠে দাঁড়ায় সে। সে এখনো কাঁপছে। তোর শরীরের আঘাতের অংশ দিয়ে রক্ত ঝরছে। কপাল বেয়ে যে রক্ত যাচ্ছে তা সে দেখতেও পারছে। তবুও সে কঠিন দৃষ্টিতে তাকায় কক্ষে উপস্থিত সকলের দিকে। নিজের সর্বত্র শক্তি দিয়ে বলে, “আমি আজ এখান থেকে চলে যাচ্ছি। কিন্তু আমি কক্ষে উপস্থিত সকলকে ওয়াদা করছি যখন আমি ফিরে আসবো তখন সকলের নিজের জীবনের উপর আফসোস হবে। সকলের জীবন ধ্বংস করে দিব আমি। জিন্নাত ইনারা কারও ঋণ রাখে না। আমাকে যা কষ্ট দেওয়া হয়েছে তার দশগুণ বেশি ফিরিয়ে দিব।”
কথাটা শুনতেই রাগে জ্বলে উঠে মুশতাক সাহেব। সে বলে, “এই মেয়েকে আমার চোখের সামনে থেকে দূর করো বাহিরে ফেলে আসো একে।”
একটি লোক ইনারার বাহু ধরে তাকে টেনে বাহিরে নিয়ে গেলেন। তাকে মেইন গেইট দিয়ে বের করে দেওয়া হলো।
যে বাড়িতে সে ছোট থেকে বড় হয়েছে সে বাড়ির দরজা তার মুখের উপর বন্ধ করে দেওয়া হলো। মুহূর্তে নিঃস্ব হয়ে গেল সে। কি করবে, কোথায় যাবে কিছু জানে না। তবুও তার যেতে হবে।
নীরব পথ। চারপাশটা থমথমে। আজ আশেপাশে লোক নেই। ইনারা হেঁটে যাচ্ছে অচেনা পথে। বাড়ি থেকে বেশিদূর আসেনি সে। ছোট ছোট পা’য়ে হাঁটছে। তার চোখের অশ্রুর নোনাজল মিশে যাচ্ছে রক্তের সাথে। যত রক্ত ঝরছে সে ততই দুর্বল হয়ে পড়ছে। একসময় আর হাঁটা তো দূরের কথা দাড়িয়ে থাকাটাও দুষ্কর হয়ে পড়েছিলো। মাথা ঘুরাচ্ছে প্রচুর। চোখের সামনের সব ঝাপসা দেখছে। থপ করে রাস্তাতে পড়ে যায় সে। এটাই কী তার শেষ মুহূর্ত? সেও কি তার মা ও প্রিয়র কাছে চলে যাবে? না, সে এভাবে তার প্রতিশোধ অসমাপ্ত ছাড়তে পারে না। শাস্তি দিবে সে তার মা ও বন্ধুর অপরাধীদের। তাদের শাস্তি দেওয়া ছাড়া এভাবে সে চলে যেতে পারে না। তার দুঃখের অনুভবে জ্বলে মরতে হবে তাদের। সে তাদের ধ্বংস না করে এভাবে যেতে পারে না। যেতে পারে না।
ঝাপসা চোখে দেখলো একটি গাড়ি তার দিকে এগিয়ে আসছে। গাড়িটি এসে থামলো তার সামনে। একটি স্যুট পরা পুরুষ বের হয়ে এলো। তার চেহেরা দেখতে পায় না ইনারা। এর পূর্বেই তার চোখের সামনের সব কালো হয়ে আসে। সে জ্ঞান হারায়।
চলবে…..
অনুভবে
পর্ব-৪৫
নিলুফার ইয়াসমিন ঊষা
“আমি তোমাকে বিশ্বাস করেছিলাম। ভালোবেসেছিলাম। আর তুমি এই মূল্য দিলে আমার ভালোবাসার? আমার তোমার উপর ঘৃণা করা উচিত। কিন্তু তোমায় এত ভালোবাসি যে ঘৃণাও করতে পারছি না। তোমায় ভালোবাসাটা কী আমার অপরাধ ছিলো?” ইনারা মেঝেতে বসা। তার চোখে অশ্রুজল। সে অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার সামনের পুরুষটির দিকে। সে পুরুষটি বিরক্তির সুরে বলল, “দেখো, আমাদের সম্পর্কের চারবছর কেটে গেছে। আমি আগের মতো আর তোমাকে ভালোবাসতে পারি না। আমি এখন লিন্ডাকে ভালোবাসি। আর ওর সাথেই জীবন কাটাতে চাই।”
“তাহলে আমার কী হবে? আমি মরে যাব তোমাকে ছাড়া।”
লোকটার চোখেমুখে বিরক্তি বাড়ে। সে তার স্যুটকেস নিয়ে যেতে নিলেই ইনারা এসে তার হাত ধরে নেই। কাঁদতে কাঁদতে বলে, “ছেড়ে যেও না আমায়। যেও না। আমি মরে যাব তোমাকে ছাড়া।”
কিন্তু লোকটা কথা শুনে না। এক ঝটকায় ইনারার হাত সরিয়ে দিয়ে বলে, “যা ইচ্ছা করো।”
বলে সে চলে যায়। ইনারা বসে থাকে মেঝেতেই। শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে লোকটার যাওয়ার দিকে। আর তার চোখের জল অবাধ্য হয়ে ঝরতে থাকে।
আশেপাশের বাতি জ্বলে উঠে। তালির বর্ষণ শুনা যায়। থিয়েটারে কেবল কয়েকটা লোক। কেবল স্টাফরা। এতক্ষণ এক নাটকের রিহার্সাল চলছিলো। যেখানে ইনারা প্রধান চরিত্রে ছিলো। নাটকটি সম্পূর্ণ ইংরেজিতে। তার সংলাপও। দৃশ্যটি শেষ হবার সাথে সাথে ডিরেক্টর ইংরেজিতে বলে উঠে, “বাহ ইনারা, অসম্ভব সুন্দর কাজ করলে তুমি। আমি নিজে এই কাহিনীটা লিখিছি তবুও আমার কান্না এসে পড়ছিলো। তুমি যদি আসলেই এই নাটকটায় কাজ করতে।”
ইনারা মেঝে থেকে উঠে দাঁড়ায়। নিজের চুল ঠিক করে বলে, “একটি পুরুষ তার গার্লফ্রেন্ডের সাথে চারবছর থাকার পর বিয়ের আগে বলে সে অন্যকাওকে ভালোবাসে এবং মেয়েটা তার কাছে ভিক্ষা চায় থাকার জন্য। আর অবশেষে ওই পুরুষের সাথেই তার বিয়ে হয়ে হ্যাপি এন্ডিং হয়। নো, এমন সেন্সলেস ড্রামায় আমি কাজ করি না। ব্রিয়ানা ম্যাম বলেছিলো বলে এখানে এলাম দেখাতে কীভাবে এক্টিং করতে হয়।”
“কাম অন ইনারা, এতটা রুক্ষ না হলেও পারো।”
ইনারা তার ব্যাগ নিয়ে স্টেজ থেকে নিচে নামতে নামতে বলল, “যা সত্যি তাই বললাম। আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে। আমি গেলাম।”
ইনারা তার পাশ কাটিয়ে বাহিরের দিকে এগোয়। ডিরেক্টর এর নাম টম। সে এবং ইনারা একসাথেই এই ইন্সটিটিউটে ভর্তি হয়েছি। পার্থক্য হলো ইনারা এক্টিং এর জন্য ভর্তি হয়েছিলো এবং সে ডিরেক্টর হবার জন্য। প্রথম দেখা থেকেই সে ইনারাকে পছন্দ করে। অনেকবার ইনারাকে বলেছেও কিন্তু বারবার রিজেক্ট হয়েছে। কিন্তু আজ সে আবার চেষ্টা করবে। কেননা ইনারা আগামীকালই দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছে। আর শেষ চেষ্টা না করে সে ছাড়বে না। সে ইনারার হাত ধরে নেয়, “ইনারা তুমি জানো আমি তোমাকে পছন্দ করি। তাহলে এত ইগনোর করছ কেন? আমি কি দেখতে শুনতে খারাপ? কত মেয়েরা আমার জন্য পাগল। আরেকবার ভেবে দেখো, তোমাকে আমাকে একসাথে কত ভাল্লাগবে।”
“ঠিকাছে ভাবছি।” এক মুহূর্ত না কাটতেই ইনারা উওর দেয়, “না। এখন আমার হাত ছাড়।”
“ছাড়বো না। তোমার আমাকে বলতেই হবে আমার সাথে রিলেশন এ যেতে তোমার সমস্যা কোথায়?”
“আমি কোনো সম্পর্কে যাব না। এটাই সমস্যা। এখন তুমি আমার হাত ছাড়ো, আমি ব্যাথা পাচ্ছি।”
“আমার কিছু আসে যায় না। তুমি আমাকে বলো আমার সাথে রিলেশনে যাবে কি-না।”
ইনারা বিরক্ত হয়ে টমের হাত ধরে উল্টো তার হাত মুড়িয়ে ধরে। ব্যাথায় চেঁচিয়ে উঠে টম। ইনারা বলে, “তোমাকে বলতে ভুলে গিয়েছিলাম। দুই বছর আগে আমি ক্যারাটে ক্লাস করতাম। তোমার শব্দ শুনে মনে হচ্ছে ভালোই শিখেছি। থ্যাংকস বাডি।”
বলেই তাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয়। কাঁধে তার ব্যাকপ্যাক নিয়ে চলে যায় সেখানে থেকে।
ইনারা একটি উবার ডেকে বাসার জন্য রওনা দেয়। ইন্সটিটিউটটির দিকে তাকায়। তিন বছর আগে সে এসেছিলো আমেরিকায়। এসেই এই ইন্সটিটিউট এ ভর্তি হয়। আর আজ এখানে তার শেষ দিন। দীর্ঘশ্বাস ফেলে ইনারা। চোখ বন্ধ করে হেলান দেয় সিটে। মনে পড়ে যায় তিন বছর আগের ঘটনা। সে রাতে অজ্ঞান হবার পর চোখ খুলেছিলো হাস্পাতালে। প্রায় একদিন অজ্ঞান থাকে সে। চোখ খোলার পর সে দেখতে পায় কতগুলো লোক দাঁড়িয়ে আছে তার রুমে। সব মুখ অচেনা। সকলে সাদা শার্টের উপর কালো কোর্ট পরে দাঁড়িয়ে আছে সিরিয়াল ধরে। তার হাতে স্যালাইন দেওয়া। তাকে দেখে একজন পুরুষ এগিয়ে আসে, “ম্যাম কেমন অনুভব করছেন আপনি?”
ইনারা চিনে না তাকে। সে চোখ দুটো সরু করে জিজ্ঞেস করে, “আপনারা কে? এবং আমি এখানে কি করছি?”
“আমার নাম রহমান। আপনি আমাদের স্যারের গাড়ির সামনে এসে পড়েছিলেন। আপনার অবস্থা করুণ ছিলো। তাই হাস্পাতালে আনা হয়েছে।”
ইনারা ঠিকভাবে কথাও বলতে পারছিলো না। তবুও সে কষ্ট করে উঠে বসতে নিলে লোকটা আবার বলে, “ম্যাম আপনি শুয়ে থাকুন। আপনার রেস্ট দরকার।”
“আপনাদের ধন্যবাদ। কিন্তু আমার এত সামর্থ্য নেই যে আমি এই হাস্পাতালের বিল দিতে পারব।”
“আপনাকে কিছু দিতে হবে না ম্যাডাম। উল্টো আপনার সব ভরণপোষণের দায়িত্ব আমাদের স্যার নিবে। আপনার পড়াশোনা, থাকা, আর আপনার যা চাই। সব করতে পারবেন।”
কপাল কুঁচকে নেয় ইনারা, “আমার দায়িত্ব আপনার স্যার নিবেন কেন?”
“পরিবর্তে তার একটা শর্ত আপনার মানতে হবে।”
“কী শর্ত?”
“তা এখন আমি বলতে পারবো না। আমি নিজেও জানি না। স্যার অফার দিয়েছেন যে আপনি কিছু বছর বাহিরের দেশে যেয়ে পড়াশোনা কন্টিনিউ করবেন। আপনাকে সেখানের সবচেয়ে বড় এক্টিং ইন্সটিটিউটে পড়তে পারবেন। আপনার থাকা, খাওয়া, যাবতীয় সকল খরচ স্যার দিবেন। পরিবর্তে সময় হলে আপনাকে যা বলা হবে আপনি তা করবেন।”
“আপনার স্যার কোথায়? ”
“তা আপনার জানার প্রয়োজন নেই। সময় হলে সে নিজেই আপনাকে দেখা দিবে।”
“ফাজলামো চলছে? চিনি না, জানি না আমি যে কারও কথায় বিদেশে চলে যাব? আমার সাথে কি করা হবে কে জানে?” ইনারা রাগে একটানে তার হাতের ক্যানোলা খুলে উঠে দাঁড়াতে নিলেই তার মাথা ঘুরান দিয়ে উঠে।
রহমান আতঙ্কিত সুরে বলে উঠে, “ম্যাম এখনো আপনার শরীর দুর্বল। উঠবেন না।”
ইনারা তবুও উঠে। সে উঠে দরজার সামনে যেতেই কয়েকজন লোক তার রাস্তা আটকায়।
রহমান দ্রুত কাওকে কল করল। ব্যাপারটা জানাল। এরপর সে লোকগুলোকে বলল, “ম্যামকে যেতে দেও। স্যার আদেশ দিয়েছে।”
ইনারার রাস্তা ছাড়া হয়। সে বেরিয়ে যায় সেখান থেকে। হাস্পাতাল থেকে বের হবার সময়ও সে খেয়াল করল লোকজন তার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। রাস্তায়ও এ জিনিসটা চোখ এড়ায় না তার। সে একটি মহিলাকে কথা বলতে শুনলো, “এটা সে মেয়ে না যার ভিডিও ভাইরাল হইছিলো? ছিঃছিঃ একটু স্বার্থের জন্য চরিত্র শরীর বিক্রি করে দিলো। কোন দুনিয়ায় এসে পড়ছি। এর উপর এমন বেহায়ার মতো ঘুরছে। লজ্জাও লাগে না।”
তার পাশের মহিলাটা বলল, “আরে আপা দেখেন শরীরে কত দাগ! মনে হয় কেউ বাজেভাবে মেরেছে।”
“রাখেন তো। এসব মেয়ে মরলে সমাজ একটু পরিষ্কার হবে। মনে হয় কীর্তি সবার সামনে আসার পর মা বাপে মারছে। এমন মেয়ে থাকার চেয়ে না থাকা ভালো। আমার মেয়ে হইলে তো জিন্দা পুড়ায় দিতাম।”
“তা যা বলেছেন। আজকালকার মেয়েদের লাজ শরম বলতে কিছু নাই।”
ইনারা আর শুনতে পারে না। তার কোনো ভুল নেই। তবুও এমন কটু কথা শুনতে হচ্ছে তাকে। কিন্তু মুখে উওর দেবার শক্তিটুকুও তার নেই। আর বললেও এমন না যে তারা বিশ্বাস করবে ইনারার কথা। তাই সে রিক্সাতে উঠে রওনা দেয় সুরভির বাসার উদ্দেশ্যে। তার আর কোথাও যে যাবার জায়গা নেই।
কলিংবেল বাজায় ইনারা। সুরভি এসে দরজা খুলে ইনারাকে দেখতেই তার চোখদুটো বড় বড় হয়ে গেল। সে ইনারার হাত ধরে কাঁপা-কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করল, “এ’কি অবস্থা তোর? কি হয়েছে তোর? কোথায় ছিলি তুই? কত কল দিলাম, তোর বাসায় গেলাম কোথাও খোঁজ নেই তোর।” সুরভি জড়িয়ে ধরে ইনারাকে, “আমার জান আটকে আসছিলো। প্রিয়কে হারানোর পর আর তোকে হারানোর সাহস আমার নেই।”
“কে এলো রে?” সুরভীর মা রান্না ঘর থেকে বের হতে হতে জিজ্ঞেস করলেন। ইনারাকে দেখে ছুটে এলেন সে। তার মেয়েকে দূরে সরিয়ে বলল, “তুই ওর কাছে যাবি না। দূরে যা। সর।”
ইনারা হতভম্ব। দশেক বছরের মতো হবে সে সুরভির বাসায় আসে। সুরভির মা অনেক আদর যত্ন করে তাকে। আর আজ হঠাৎ এমন কথা বলছেন তিনি!
সুরভি বিস্মিত গলায় বলল, “মা একি বলছো তুমি?”
“ঠিক বলছি…একদম ঠিক বলছি। ওর জন্য আজ প্রিয় আমাদের মাঝে নেই। আর তুই ওর সাথে যদি তোরও কিছু… না না। তুই ওর কাছে থাকবি না। ইনারা তুমি বের হও। যাও এখান থেকে।”
“মা তুমি ওর অবস্থা দেখছ? ওর হাত, পা, মুখ সব জায়গায় আঘাত।”
“তুই চুপ কর।” সুরভির মা তার হাত ধরে টেনে রুমে নিয়ে দরজা আটকে দিলেন। সুরভি বারবার দরজা ধাক্কা দিতে থাকে। অনুরোধ করে ইনারাকে বের না করার জন্য। কিন্তু সুরভির মা মানে না। সে ইনারার সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলে, “দেখ ইনারা তোমাকে আমি অনেক আদর করি। কিন্তু আমার পোলাপান থেকে বেশি না। তুমি ওদের আশেপাশে থাকলে কখন না ওদেরও জীবন নষ্ট হয়ে যায়। এছাড়া তোমার চরিত্র নিয়ে সকলে কত কথা বলছে। আমি জানি তুমি এমন কিছু করতে পারো না। কিন্তু লোকে মানবে কীভাবে? তুমি আমার মেয়ের সাথে থাকলে ওর ভবিষ্যত শেষ হয়ে যাবে। ওকে কে বিয়ে করতে রাজি হবে বলো। প্লিজ তুমি চলে যাও। এক মা অনুরোধ করছে। প্রয়োজনে মাই তোমার পা’য়ে পড়ছি।”
সুরভির মা আসলেই ঝুঁকে তার পা ধরতে নেই। সাথে সাথে ইনারা তার হাত ধরে নেয়, “আন্টি আমাকে পাপের ভাগিদার করবেন না। আপনি আমার মা’য়ের মতো। আপনাকে দোষারোপ করছি না আমি। আপনি ভুল বলেন নি। আমার সাথে থাকলে প্রিয়র মতো যদি সুরভির সাথেও…না। আমি চাই না ওর কিছু হোক। আমি আসি আন্টি। ওর খেয়াল রেখেন।” শান্ত গলায় বলে ইনারা। ফিরে রওনা দেয়। কিন্তু সুরভির মা তাকে থামিয়ে দিয়ে তার হাতে কিছু টাকা গুঁজে দিয়ে বলে, “এটা রাখো। তোমার যদি কাজে লাগে।”
ইনারা বাড়ির সামনে দাঁড়ানো রিক্সাকে টাকা দিয়ে হাঁটতে শুরু করে। কোথায় যাচ্ছে সে জানে না। তার কোনো গন্তব্য নেই। সে হেঁটে চলেছে অচেনা পথে। সহ্য করছে পথের লোকজনের দৃষ্টি সব দৃষ্টি তার দিকেই স্থির। হঠাৎ সে শুনতে পায় কিছু ছেলের কন্ঠ, “এটা ঐ হোটেলের মেয়ে না? মাইয়াটা কী সুন্দর দেখসোস?”
“সেই। আমাদের সাথে কী একরাত কাটাইব রে?”
ছেলেগুলো পা’য়ের শব্দ তার দিকে এগোল। ইনারা তার হাঁটার গতি বাড়ায়। সাথে পিছনের ছেলেদের পায়ের শব্দও বাড়ে। এর মধ্যে এক ছেলে বলে, “ওগো সুন্দরী আমাদের সাথে হোটেলে যাবা? আমরা ছবি দিতে না পারলেও টাকা দিতে পারমু। এক রাতের কত?”
ইনারা জানে না এখানে কত ছেলে আছে। সে পিছনে ফিরেও তাকায় না। কেবল দ্রুত হাঁটতে থাকে। যত দ্রুত সম্ভব। ভয়ে তার জান যেন দেহ থেকে বেরিয়ে আসবে। সে দেখে তার সামনে দিয়ে কতগুলো গাড়ি আসছে। গাড়িগুলো তো সামনে এসেই থামে। এর মধ্য থেকে বের হয় রহমান এবং কতগুলো লোক। রহমান ইনারার দিকে তাকিয়ে বলে, “ম্যাম আপনি ঠিক আছেন?”
তাদের দেখেই ছেলেগুলো দৌড়ে পালায়। ইনারার যেন জানে জান আসে। রহমান আবার বলে, “ম্যাম আবার এ প্রস্তাবে পরিকল্পনা করে দেখুন। আপনার জন্য ভালো হবে।”
ইনারার আর এ ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না। তার কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই। কিন্তু এদেরকেই বা বিশ্বাস করে কিভাবে? তাই সে বলল, “আপনাদের সাথে আমি সেইফ থাকব এর গ্যারান্টি কী?”
“আমাদের উপর এখন বিশ্বাস না-ই থাকতে পারে। স্বাভাবিক। তাই কাওকে নিয়ে এসেছি।”
গাড়ির দরজা খোলা হলো। তার খালাজান বের হলো গাড়ি থেকে। তাকে দেখেই ইনারা ছুটে এসে জড়িয়ে ধরে। খালাজান তার গালে চুমু দিয়ে বলে, “আমার ফুলের মতো ইনুমণিটারে ওই জানোয়ার কি অবস্থা করছে!”
রহমান আবারও জিজ্ঞেস করে, “এবারও কি আপনি প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করবেন? রাস্তায় আসার সময় আপনার খালাজান আমাদের সব জানিয়েছে। আমাদের স্যার আপনার সব কিছুতে সাহায্য করতে পারে। আপনি যদি রাজি হন।”
“এতে আপনার স্যারের লাভ কি?”
“সে চিন্তা আপনার করতে হবে না। আপনি কেবল রাজি হয়ে যান। আপনি রাজি?”
ইনারা ভাবার জন্য এক মুহূর্ত নেয়। মাথা নাড়ায় সে। সে রাজি।
.
.
ড্রাইভারের কন্ঠে চোখ খুলে ইনারা। তারা অ্যাপার্মেন্ট এসে পড়েছে। আজ তিন বছর হয়ে গেল অথচ সেদিনগুলোর স্মৃতি আজও তার চোখে ভাসে, কানে গুঁজে। তার শরীরের আঘাতের দাগ চলে গেছে কিন্তু হৃদয়ের আঘাত এখনো তাজা। প্রতি মুহূর্তে প্রতিশোধের আগুনে জ্বলে সে। এতদিনে তার অপেক্ষার সমাপ্তি ঘটেছে। কাল সে তার দেশে ফিরে যাচ্ছে। যারা তার থেকে জীবনের সকল খুশির কারণ কেড়ে নিয়েছে আগামীকাল তাদের কাছে ফিরে যাচ্ছে সে। তাদের সর্বনাশ করতে।
সে দরজা খুলে এপার্টমেন্টে প্রবেশ করে দেখে অনেকগুলো কাপড়চোপড় মেঝেতে পড়ে আছে। আর তার খালাজান আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে সানগ্লাস পড়ছে। তাকে দেখে ইনারা জিজ্ঞেস করে, “খালাজান, কি করছেন?”
“আরে ইনুমণি দেখ…দেখ আমাকে মর্টিন লাগতাছে না?”
ইনারা হাসে, “ওটা মর্টিন না খালাজান, মর্ডান।”
“কিন্তু আপনি এভাবে কাপড় এলোমেলো করে রেখেছেন কেন?”
“কেন আগামীকাল আমরা দেশে যাইতাসি মকিং করতে হবে না? ”
“মকিং না প্যাকিং।”
“ওই একই। আমার গ্রামের সবাইকে যাইয়া এই সুন্দর সুন্দর জামা দেখাইয়া ভাব নিমু। আহ সবগুলো জ্বইলা পুইড়া ছাই হইয়া যাবে।”
“কিন্তু দেশে তো যাচ্ছি আমি একা।”
“একা? একা মানে?” খালাজান আতঙ্কিত সুরে বলল। ইনারার দিকে এগিয়ে এলেন তিনি, “না, তোমাকে আমি একা যেতে দেবো না। গতবার ওই জানোয়ারগুলো তোমার সাথে কি করেছিলো।”
“কিন্তু এখনতো আমি আর গতবারের ইনু না। কেউ আমাকে ছুঁয়েও দেখতে পারবে না। এছাড়া রহমান ভাই তো আছে। সে আমার খেয়াল রাখবেন সেখানে।”
“কিন্তু…”
ইনারা খালাজানকে থামিয়ে তাকে সোফায় বসাল। বলল, “খালাজান এ তিন বছর এখানে আছি। কোনো সমস্যা হয়েছে? কারণ রহমান ভাই বা তার যে স্যারই হোক না কেন সে রক্ষার ব্যবস্থা করেছেন। সেখানেও এমন হবে। আর তুমি কি চাও আমি এখানে হাতের উপর হাত রেখে বসে থাকি? আমার মা ও প্রিয়র সাথে যা হয়েছে, আমার সাথে যা হয়েছে তা ভুলে ওদের স্বাধীনভাবে বাঁচতে দেই?”
“না, আমি চাই তুমি তাদের রক্তের কান্না করাও। তোমারে যা কষ্ট দিসে তার জন্য যেন তারা তোমার কাছে এক মুহূর্ত শান্তির জন্যও ভিক্ষা চায়।”
“তাহলে তো আমার ভয় পেলে চলবে না। তাদের মুখোমুখি হতে হবে। এছাড়া স্যার আছে তো। হ্যাঁ আমি তাকে কখনো দেখি নি। কিন্তু তিনি এ পর্যন্ত আমাদের জন্য যা করেছে তাতে আমার এতটুকু বিশ্বাস হয়েছে যে সেই আমার যাত্রায় আমাকে সাহায্য করতে পারেন।”
“এমনিতেই তো তোকে সাহায্য করবে না তাই না? তার এক শর্ত ছিলো। কি শর্ত বলেছে?”
এক মুহূর্তের জন্য স্থির হয়ে গেল ইনারা। উঠে গেল সে। টেবিল থেকে পানি নিয়ে গ্লাসে ঢালতে ঢালতে বলল, “না। পরে বলবেন।”
“আচ্ছা। সুরভি কে জানাইসো যে তুমি দেশে যাইতেছো?”
“না, সময় হলে জানাব। তুমি চিন্তা করো না খালাজান আমি নিজের খেয়াল রাখব। আর তুমিও এখানে নিজের খেয়াল রেখো। রহমান ভাই তোমার জন্য লোক পাঠাবে তোমার সাথে থাকার জন্য। ওখানে সব গুছানো হলেও আমি তোমাকে নিয়ে যাব।”
খালাজান মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিলেন। আর বললেন, “তোমার জন্য খাবার আনি। আজকে নিজের হাতে খাইয়ে দিব।”
খালাজান যেতেই ইনারা শান্তির নিশ্বাস ফেলে। খালাজানের কাছে ধরা খায় নি সে। রহমান সাহেব তাকে শর্তটা বলেছিলেন। এ সুবাদেই তো সে দেশে যেতে পারছে। নাহয় স্যারের অনুমতি ছাড়া তার যাওয়াটা প্রায় অসম্ভব ছিলো। কিন্তু এই শর্তের কথা সে বলতে পারবে না খালাজানকে, নাহলে সে কিছুতেই ইনারাকে এই কাজ করতে দিবে না।
.
.
পরের দিন সকালের ফ্লাইটে ইনারা রওনা দেয় বাংলাদেশের জন্য। তার পাশে একটি মেয়ে বসেই জিজ্ঞেস করে, “এক্সকিউজ মি আপু, আপনি কোথায় যাচ্ছেন?”
ইনারা বিরক্তির স্বরে বলে, “এটা বাংলাদেশ ফ্লাইট। তাহলে বাংলাদেশেই তো যাব তাই না?”
“ও হ্যাঁ। আমি অনেক বোকার মত প্রশ্ন করছি। হাই আমি সৃষ্টি। আমি না অনেক বছর ধরে আমেরিকাতেই থাকি। এই প্রথম দেশে যাচ্ছি। জানেন কেন? এক্টর হব বলে। আমার আব্বাজান বলে আমি অনেক ভালো অভিনয় করি। সেখানে যেয়ে সব নায়িকাকে এক ছক্কায় উড়ায় দিব।”
ইনারা কিছু বলে না। চুপচাপ মুখ ফিরিয়ে নেয়। কিন্তু সৃষ্টির কথাই থামে না। ফ্লাইন টেক অফফ করে কিন্তু তার কথা শেষ হবার নাম নেই। সে কানে হেডফোন দেয় তাও সৃষ্টি চুপ হয় না। সে ইনারার কানের হেডফোন খুলে বলে, “আপু দেখেন আমার কাছে কি আছে। ”
এবার ইনারার ধৈর্য হার মানে। সে বিরক্ত হয়ে কিছু একটা বলতে নিবে এমন সময় সে দেখে সৃষ্টি হাতে
একটি ম্যাগাজিন। ম্যাগাজিনটা পুরনো। প্রায় পাঁচ বছর পূর্বেই। পঞ্চসুরের ম্যাগাজিন। কভারেই পঞ্চসুরের ছবি।
সৃষ্টি তাকে জিজ্ঞেস করে, “আপনিতো বাংলাদেশি। তাহলে নিশ্চয়ই পঞ্চসুরকে চিনেন। গান শুনেছেন তাদের?”
“হুম, শুনেছি।”
“বলেন কি? আমি চৌদ্দ বছর থেকে তাদের গান শুনছি। তারা বেস্ট। কিন্তু আফসোস হঠাৎ করে আলাদা হয়ে গেল তারা। আর একজন মেম্বার তো হারিয়েই গেল।”
ইনারার বুকের ভিতরটা ভারী হয়ে গেল। সে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। সৃষ্টি আবারও বলে, “আমি এখনো সবাইকে ফলো করি। জোহান ও সামি আমার ফেভারেট। আপনিও কি এখনো কাওকে ফলো করেন? আপনার ফেভারিট কে ছিলো?”
ইনারা মুখ ফিরিয়ে নেয়। অন্যদিকে তাকিয়ে সে বলে, “আমার মাথা ব্যাথা করছে। কথা বলেন না প্লিজ।”
“আরে সরি সরি আপু। আমি বুঝতে পারি নি। এই আমি চুপ। আর কোনো কথা বলব না।”
ইনারা তাকিয়ে আছে জানালার ওপাড়ে। এখান থেকে শুভ্র মেঘকে খুব কাছে থেকে দেখা যাচ্ছে। মেঘেদের মাঝে ভাসছে সে। সে সবাইকেই ফলো করে। সব খোঁজ রেখে আসছে সে। আজ ইরফান দেশের বিখ্যাত লেখক। তার লেখা সব সিনেমা সুপারহিট হয়েছে। সে গান গাওয়া ছেড়ে দিলেও লেখা ছাড়ে নি। ঐশি এখনো গানের জগতে আছে। কিন্তু তার নাম কমে গেছে। অন্যান্য সদস্যদের মতো সে সাফল্যতা পায় নি। সামি দেশের সবচেয়ে বড় এজান্সির আন্ডারের সোলো আর্টিস্ট এবং আজকাল জোহানের গানের থেকে বেশি ছবি চলে। দেশের নামকরা অভিনেতার মধ্যে একজন সে। ভাবতেই তাচ্ছিল্য হাসে সে। নিজ থেকেই সৃষ্টিকে জিজ্ঞেস করে, “জোহান তোমার ফেভারিট?”
“একদম। সে বেস্ট। আমার ক্রাশও। ”
“তাহলে এটাও শুনেছ তার এনগেজমেন্ট হয়েছে।”
“এটা আবার শুনব না? যদিও খারাপ লেগেছে তারপরেও এতটুকু শান্তি যে এত ভালো মানুষের সাথে জীবন কাটাবে সে। দেখেন অভিনেত্রী আইজা আমাদের দেশের সবচেয়ে বড় অভিনেত্রী হবার পড়েও তার কোনো অহংকার নেই। দেশের সবচেয়ে প্রিয় নায়িকা সে।”
ইনারা তাচ্ছিল্য হাসে। কিছু বলে না। সৃষ্টি আবার বলে, “এখন তো সামি এবং জোহান আমার ফেভারিট। কিন্তু সে সময় সকলের মুখে কেবল একটি নাম থাকতো, সভ্যের। না জানি কোথায় হারিয়ে গেল আমাদের স্বপ্নের প্রিন্স।”
সভ্যের নাম শুনতেই তার বুকের ভিতরটা কামড়ে উঠলো। নিঃশ্বাসটা কেমন বন্ধ হয়ে আসছিল। সে মুখ ফিরিয়ে আবার জানালার দিকে তাকালো। কাঁপানো গলায় বলল, “কিছু মানুষ জীবনে আসেই হারিয়ে যাবার জন্য।”
ফ্লাইট ল্যান্ড করেছে দেশে। সন্ধ্যার সময়। সৃষ্টি তার সাথেই বের হয়। দুজনে একসাথে চেক আউট করে। ইনারা বলে, “দেখা করে ভালো লাগলো। আমার জন্য গাড়ি অপেক্ষা করছে। তাহলে বিদায় নিলাম।”
“আপু আমার বাসায় আসেন না। আব্বাজান যা খুশি হবে। আপনাকে পুরান ঢাকার বিরিয়ানি খাওয়াব।”
“আরেকদিন। নাম্বার তো দিয়েছ। আজ আমার যেতে হবে।”
“আজ একটু বের করে আসতে পারবেন না।”
“না কারণ আজ আমার বিয়ে।”
.
.
ইনারা গাড়িতে বসে আছে। সবে পার্লার থেকে বের হয়েছে সে। তাকে বউ সাজানো হয়েছে। এয়ারপোর্ট থেকে সোজা পার্লারে যাওয়া হয় তাকে। যেয়ে দেখে তার জন্য সোনালী কাজ ভর্তি একটি লাল লেহেঙ্গা এবং ভারী গয়না রাখা আছে। এতকিছু করার মানে হয় না। শর্ত অনুযায়ী তার স্যারকে বিয়ে করতে হবে। লোকটা কে বা দেখতে কেমন ইনারা তাও জানে না। তবে যে এত সম্পত্তির মালিক সে কোনো যুবক হবে না। নিশ্চিয়ই বুড়ো লোক। অন্তত রহমান ভাইয়ের কথা শুনে তো তাই মনে হয়েছে। যে তাদের বড় স্যার বয়স্ক মানুষ।শর্তানুযায়ী তাদের দুইবছর বিয়ের বন্ধনে থাকতে হবে। এরপর যে যার রাস্তায় যেতে যেতে পারে। কেবল দু’বছরের জন্য বিয়ে করার কারণটা সে আজ পর্যন্ত বুঝতে পারলো না। কিন্তু সে বিরোধ করতে পারে না। কেননা এতদিনে সে এতোটুকু বুঝেছে মুখে বললেই প্রতিশোধ নেওয়া যায় না। তার এর জন্য ক্ষমতা লাগবে। যা স্যারের কাছে আছে। আর সে নিজে প্রতিশোধের জন্য যে কোনো সীমা পেরিয়ে যেতে পারবে। তার জীবনে কোনো পিছুটান নেই। তার বাঁচারও কোনো কারণ নেই। কেবল একটি কারণেই সে নিশ্বাস নিচ্ছে, তার শত্রুদের ধ্বংস করার জন্য। এর পরিণাম যাই হোক না কেন সে মানতে রাজি।
কাজি অফিসের সামনে এসে গাড়ি থামে তাদের। তাদের সামনেই আরেকটি গাড়ি ফুল দিয়ে সাজানো। সে রহমানকে জিজ্ঞেস করে, “এটাই কি আপনার স্যারের গাড়ি।”
“জ্বি ম্যাম।”
“এ বয়সে এসেও আপনার স্যারের এতো শখ। এসব না করে কি একবারে বিয়ে সারলে হতো না? এ লেহেঙ্গা আমার থেকেও বেশি ভারী।”
“বড় স্যারের আদেশ অনুযায়ী সব হচ্ছে।”
“আচ্ছা বলুন তো আপনার স্যার কি এখনো বিবাহিত না ডিভোর্স হয়েছে?”
“ম্যাম এ কি বলছেন আপনি? স্যারের বিয়ে তো হয় নি। আপনার সাথে আজ তার বিয়ে।”
কপালে ভাঁজ পরে ইনারার, “এত বয়সেও বিয়ে হয় নি তার?”
“এত বয়স? ছোট স্যারের কেবল আটাশ বছর।”
“কিন্তু আপনি না বললেন আপনার স্যার ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির সাথে জড়িত পঞ্চাশ বছর ধরে। তার থেকে বেশি আমাকে কেউ সাহায্য করার ক্ষমতা রাখে না। তাহলে?”
“আপনি ভুল ভাবছেন ম্যাম। আপনার বিয়ে বড় স্যারের নাতির সাথে। আমাদের ছোট স্যার।”
ইনারা কাজির কক্ষের দরজায় এসে দাঁড়ায়। বিস্মিত সুরে বলে উঠে, “কী!”
রহমান রুমে ঢুকে বলে, “ছোট স্যারও এখানে উপস্থিত।”
ইনারা সামনের দিকে তাকায়। কাজির সামনে চেয়ারে বসা। তার মুখ দেখা যাচ্ছে না। তার দিকে পিঠ করে বসে আছে সে। একটি কালো রঙের স্যুট পরা।
রহমান সে পুরুষটির কাছে যেয়ে বলল, “স্যার ম্যামকে নিয়ে এসেছি।”
লোকটি উঠে দাঁড়ায়। তার দিকে তাকানোর পূর্বেই রহমান বলে, “বড় স্যারের আদেশে আজ আপনার বিয়ে আমাদের ছোট স্যারের সাথে। সাফওয়াত ইসমাত সভ্যের সাথে।”
পুরুষটা পিছনে ফিরতেই ইনারা থমকে যায়। সে অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয় সামনের লোকটার দিকে। তার ভেতরটা যেন মুহূর্তে এলোমেলো হয়ে গেল।
সমাপ্তি
গল্প- অনুভবে সিজন-০২ আসবে আগামীকাল।