অনুভবে পর্ব-৪২+৪৩

0
711

অনুভবে
পর্ব-৪২
নিলুফার ইয়াসমিন ঊষা

সভ্য ইনারার গালে নিজের গাল মিশিয়ে রঙটা তাকেও মাখিয়ে দেয়। একটু সরে সে তাকায় ইনারার দিকে। হাসে। ইনারার দিকে ঝুঁকে তার চুল কানের পিছনে গুঁজে দেয় এবং মৃদুস্বরে বলে, “এবার তো তুমি আমার রঙে রঙিন হয়ে গেলে। এখন কি করবে?”

ইনারা লজ্জা পেয়ে চোখ নামিয়ে নেয়। তার এই লজ্জামাখা মুখ দেখে তো সভ্য পাগল হয়ে যায়। মাতোয়ারা হতে ইচ্ছে হয় তার। আর তাকে সবচেয়ে বেশি আসক্ত করে ইনারার নীলাভ চোখদুটো। সে কখনো মদ্য ছুঁয়েও দেখে নি, তবুও সে নিশ্চিত একটানা মেয়েটার চোখে তাকিয়ে থাকলে মদ্য থেকেও বেশি নেশায় ডুবে যাবে সে। সে ইনারার চিবুকে হাত রেখে তার চোখে চোখ রাখে এবং বলে, “ইনারা তুমি জানো তোমার চোখজোড়া সায়রের মতো। যে কাওকে মুহূর্তে ডুবাতে বা ভাসাতে পারে।”
হারিয়ে যাওয়া মুহূর্তটির সমাপ্তি ঘটে কলিংবেলের শব্দে। দুইজনে চমকে উঠে। যেন কেউ তাদের চুরি ধরে নিয়েছে। সভ্য উঠে যেয়ে দরজা খুলে। সে দেখে সকলে এসে পড়েছে রাতের খাবার নিয়ে। এরপর সভ্য কেক বানাতে চলে যায়। আর সকলে কথা বলতে থাকে। সকলে বলতে প্রধানত ইনারা এবং সামি। দুইজনে হাসি ঠাট্টায় মেতে থাকে। আগে তাদের আড্ডায় ঐশিও যোগ দিতো কিন্তু এখন আর সে ইনারার সাথে কোন কথাই বলে না। সে সোজা গেল সভ্যের কাছে। রান্নাঘরে।

তার সভ্যের কাছে যাওয়াটা দেখেই ইনারার মুখের হাসি মলিন হয়ে আসে। কোনো এক কারণে সে সভ্যের আসেপাশে ঐশিকে দেখে ঈর্ষান্বিত অনুভব করে। কিন্তু কথাটা প্রকাশ করতে পারে না। সে সামি এবং ইরফানের সাথে কথা বললেও বারবার দৃষ্টি যায় রান্না ঘরের দিকেই।

খাবার শেষে ইরফান ঐশিকে বাসায় পৌঁছে দিতে যায় এবং সামি কিছু সময়ের জন্য যায় তার রুমে। ইনারা বারান্দায় বসে দোলনায় দোল খাচ্ছিল। সভ্য এলো এক প্লেটে কেকের স্লাইস নিয়ে এবং অন্যহাতে তার কফি নিয়ে। সে ইনারার হাতে কেকের প্লেট দিয়ে নিজে এক চেয়ার এনে বসে।

“আজকে চাঁদটা খুব সুন্দর লাগছে তাই না? মনে হচ্ছে না অন্ধকার আকাশ ছড়িয়ে আছে সে চাঁদের জ্যোৎস্নায়।”
সভ্য হেসে চায়ে চুমুক দেয়, “তুমি এরকম কবি কবি কথা কবে থেকে বলা শুরু করলে? তোমার মুখে এসব মানায় না।”
মুখ বানায় ইনারা, “মানাবে না কেন? এখন অভিনেত্রী হলে তো মানাতেই হবে। আজ বিকালে যখন নাটক প্রদর্শন করেছিলাম তখনও কি মানায়নি? বাজে লাগছিল?”
“আমি ইনারার কথা বলেছি। তুমি যখন ওই চরিত্র প্রদর্শন করেছিলে তখন সে চরিত্র হিসেবে মানিয়ে নিয়েছ।”
“সত্যি বলুন, পার্ফোরমেন্স ভালো হয়েছে তো।”
“দেখ আমি কাওকে মাখন মেরে কথা বলতে পারি না। যা সত্য তা বলছি। তুমি নতুন। তাই সেরা হবে না স্বাভাবিক। কিন্তু তোমার এক্টিং এ কোনো অভিজ্ঞতা নেই বা তুমি কখনো এক্টিং ক্লাস করো নি একথা বলাটা মুশকিল। তোমার অভিনয়ে আবেগটা কম ছিলো। বিশেষ করে তোমার কান্নাটা আসল মনে হয় নি। আর যখন কারও কান্না আসল না মনে হয় বা সে চরিত্রটাকে আসল না মনে হয় তাহলে জনগণ তোমার সাথে কানেক্ট হতে পারে না। এছাড়া তোমাকে অস্থির লাগছিলো। স্টেজে তোমার আত্নবিশ্বাসী হতে হবে। আত্নবিশ্বাসী হলে তুমি ভুল করলেও সেটা মানুষের চোখ এড়িয়ে যেতে পারে। আর নার্ভাস থাকলে সবাই তোমার ভুল ধরার চেষ্টা করে। আর তোমার অন্যান্য চরিত্রের সাথে সম্পর্কেও কিছু একটা মিসিং লেগেছে।” এরপর এক এক করে সভ্য তার ভুলগুলো বলতে থাকে। অবশেষে সে বলে, “তোমার কাছে অনেক সময় আছে। চেষ্টা করলে তুমি খুব দ্রুতই সব শিখে যাবে।”
ইনারা সভ্যের কথা শুনে নিজেই ভয় পেয়ে গেল। চিকন সুরে বলল, “আপনি এক নিশ্বাসে এতকিছু বললেন কীভাবে? আর এতকিছু আপনি জানেন কীভাবে? আপনি তো গানের ইন্ডাস্ট্রিতে আছেন।”
“অভিনয় দেখলেই জানা যায়। তুমি যদি বেস্ট হতে চাও তাহলে পরিশ্রম তো করতে হবে।”
“করব। আমার যা করা লাগে সব করব। আর একদিন আমি আমার মায়ের মতো সবাইকে সেরা অভিনেত্রী হয়ে দেখাবো।”
বলেই দাঁত দিয়ে জিহ্বায় কামড় দেয় সে। কথাটা ভুলে মুখ দিয়ে বের হয়ে গেছে।

সভ্য কফিতে চুমুক দিতে গিয়েও থেমে গেল। সে তাকাল ইনারার দিকে। তাকে চিন্তায় ফেলার এক দুষ্টুমি বুদ্ধি এসেছে তার মাথায়। সে বলে, “মায়ের মতো? এ কথার অর্থ কি?”
ইনারা পড়ে গেল চিন্তায়। সে কি বলবে বুঝতে পারল না। কিন্তু অবশেষে সিদ্ধান্ত নিল সভ্য থেকে তার পরিচয় লুকাবে না। সে সভ্যকে ভালোবাসে, সেই ভালবাসার মর্যাদাও থাকা উচিত। সে যদি ভালোবাসার মানুষটির কাছে নিজের পরিচয় লুকাতে ব্যস্ত থাকে তাহলে কিসের ভালোবাসলো। কিন্তু তার ভয়ও হচ্ছে। সে জানে সভ্য মিথ্যা অপছন্দ করে। সভ্য তাকে ভুল বুঝবে না তো?

সে বলল, “আচ্ছা আমি যদি আপনার কাছ থেকে একটা বড় তথ্য লুকাই। আপনি কি একটু বেশি রাগ করবেন?”
“কীসের কথা বলছ?”
দীর্ঘশ্বাস ফেলে ইনারা। সাহস জোগাড় করে বলে, “আমি আমার মিথ্যা পরিচয় দিয়েছি। আমি কোন মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে নই, অভিনেত্রী সাইয়ারা এবং পরিচালক মুশতাকের মেয়ে। আসলে আমার মা সবসময়ই চাইতো আমি নিজের বুঝ না হওয়া পর্যন্ত সাধারণভাবে সমাজের মাঝে জীবনযাপন করি। যেন ভবিষ্যতে নিজের জীবনের সিদ্ধান্ত নিতে আমার সমস্যা না হয়। বাবাও তাই চাইতেন। তাই আমার সবাইকেই মিথ্যা বলতে হতো।”
সভ্যর চোখেমুখে রাগ ভেসে উঠে। সে চেঁচিয়ে উঠে, “হোয়াট দ্যা হেল! তুমি এত বড় মিথ্যা কথা বলে এতদিন আমাদের সাথে ছিলে?”
ভয়ে কেঁপে উঠে ইনারা। শঙ্কিত হয়ে যায় সভ্যের উঁচু স্বর শুনে, “স..সরি।”
সভ্য আর পারে না। ফিক করে হেসে দেয় সে। ইনারার গাল টেনে বলে, “ভয় পেলে কত কিউট লাগে তোমাকে। আমি মজা করছিলাম। আমি বুঝতে পেরেছি। এখানে রাগ করার কিছু নেই। কখনো কখনো আমাদের নিজের এবং আপনজনদের জন্য কিছু লুকাতে হয়।”
হাফ ছাড়ে ইনারা। সভ্যের বাহুতে মেরে বলে, “আপনি অনেক খারাপ বুঝলেন? এভাবে ভয় দেখায় কেউ।”
“তুমি জানো তোমার চোখ ছাড়া অনেক কিছুই মিলে তোমার মা’য়ের সাথে। খুব কাছের থেকে না দেখলে বুঝা যায় না। তোমার গাল একটু ফোলা ফোলা তো তাই।”
ইনারা নিজের গালে হাত রেখে বলে, “আসলেই তো। আমার ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে ঢোকার পূর্বে শুকাতে হবে তাই না?” তারপর কাঁদোকাঁদো গলায় বলল, “আমার কেক, হালুয়া, বার্গার, ফ্রেঞ্চফাই, বিরিয়ানি, আর যা প্রেমি আছে সব ছাড়তে হবে? আমি কীভাবে থাকব ওদের ছাড়া।”
সভ্য শব্দ করে হেসে দেয়, “তুমি একটা পাগল। আর মনে রাখবে, তুমি যেমন আছো সুন্দর আছো। সবচেয়ে বেশি সুন্দর। তোমার পার্সোনালিটি এবং লুক তোমাকে অন্য সবার থেকে ভিন্ন করে বুঝলে?”
মৃদু হাসে ইনারা, “আপনি বিদেশে যেয়ে আমাকে ভুলে যাবেন না-তো?”
“প্রতিদিন রাতে কল দিব তোমাকে।”
“একদম না।”
“কেন? আমার সাথে কথা বলতে ইচ্ছে হয় না?”
“কিন্তু আপনার পরীক্ষার সময় না। আপনার যে এক্সামের পূর্বএ বেশি বন্ধ থাকবে কেবল সেদিন কল।দিবেন। আচ্ছা আপনি এডুকেশন দিয়ে করবেন কি? আপনার তো ক্যারিয়ার সেট। আমার তো ভার্সিটির পড়া পড়তে আলসামি আসে আর আপনি তাও পড়াশোনা কন্টিনিউ করছন। ধন্য আপনি।”
হাসে সভ্য। জিজ্ঞেস করে, “আচ্ছা তোমার আসল পরিচয় কে কে জানে?”
“সুরভি, প্রিয় ও সাইদ ভাইয়া। সাইদ ভাইয়া জানে কারণ সে আইজা আপুর ফ্রেন্ড। ওহ হ্যাঁ, জোহান জানে।”
সভ্য চমকে তাকায় ইনারার দিকে। জোহান জানে? ইনারা তাকে বলে নি কিন্তু জোহানকে বলেছে? কথাটা জানতেই তার মাঝে অস্বস্তি ছড়িয়ে গেল। সে এ নিয়ে প্রশ্ন করতে চেয়েও করল না। কোন অধিকারে এ প্রশ্ন করবে সে?

এমন সময় ফোন আসে তার ফুপুর। সে সাথে সাথে দাঁড়িয়ে যায়, “আয়হায় বাসায় যেতে দেরি হয়ে যাচ্ছে। এখনই রওনা দিতে হবে।”
“আমি তোমাকে দিয়ে আসছি।”
“না না আপনার অনেক কাজ বাকি। আমি ড্রাইভার আংকেলের সাথে চলে যাব। গাড়ি আছে নিচে।”

সভ্য নিচে এলো ইনারাকে এগিয়ে দিতে। ইনারা বলল, “আচ্ছা তাহলে আমি যাই। আপনি সাবধানে যেয়েন।”
ইনারা যেতে নিলেই সভ্য তার হাত ধরে নেয়। কেন যে তাকে নিজের চোখ থেকে উধাও হতে দিতে চায় না সভ্য। তাকে কি এতটাই ভালোবেসে ফেলেছে? না’কি ভয় হচ্ছে তার ইনারাকে হারানোর? তার ইচ্ছা করছে ইনারাকে বলতে, “আমি এভাবেই তোমার হাত সারাজীবনের জন্য ধরে রাখতে চাই। তোমাকে দূরে যেতে দিতে চাই না।” কিন্তু বলতে পারে না।

ইনারা জিজ্ঞেস করে, “কী হলো?”
সভ্য মাথা নাড়ায়। জোরপূর্বক হেসে বলে, ‘কিছু না।”
সভ্য হাত ছেড়ে দেয় ইনারার। সে গাড়িতে উঠে। গাড়ি স্টার্ট হয়। আবার পিছনে ফিরে তাকায় সে। সভ্য এখনো দাঁড়ানো। বুকের ভেতর কেমন এক অনুভূতি হয় তার। শান্তির, আবার অস্বস্তির। হঠাৎ তার কানে ভাসে সভ্যের কথা, “ইনারা তুমি জানো তোমার চোখজোড়া সায়রের মতো। যে কাওকে মুহূর্তে ডুবাতে বা ভাসাতে পারে।” ভাবতেই তার হৃদয়ে কেমন করে উঠে। আচ্ছা সভ্যের এমন প্রশংসা করার অর্থ কী? সভ্যের মনেও কি কিছু আছে তাকে নিয়ে? একবার আসুক সভ্য, তাকেই জিজ্ঞেস করবে। তার এমন কথা বলার অর্থ কী? হঠাৎ এভাবে কাছে আসার কারণ কী? তার মনে থাকা সব প্রশ্ন করবে। কিন্তু এখন নয়। আগে সভ্যের পরীক্ষা শেষ হোক। সে আবার ফিরে আসুক তার কাছে।
.
.
কয়েকদিন পর,
পরীক্ষা একদিন বাদেই। সভ্য পড়ছিলো। খুব ভালো ছাত্র হওয়া সত্ত্বেও তার বিশেষ কোনো ইন্টারেস্ট নেই পড়াশোনায়। কিন্তু তার দাদাসাহেবের হুকুমে পড়তে হয়। হঠাৎ করে তার ফোন বেজে উঠে। ঐশির কল। সে কল ধরে বলে, “হ্যাঁ ঐশি, বল।”
“স…সভ্য…মা!” নিশ্বাস যেন আটকে আছে ঐশির। সে ঠিকমতো কথা বলতে পারছে না।
“তুই কাঁদছিস? কী হয়েছে? সব ঠিক আছে তো?” আতঙ্কিত সুরে বলল সভ্য। কিন্তু ঐশি কান্নার জন্য কথা বলতে পারছিলো না। এরপর সামির কন্ঠ শুনতে পায় সে, “দোস্ত মামীর অবস্থা জটিল। ইসকেমিক স্টোক করেছে। ডাক্তার বলেছে তার অবস্থা ক্রিটিকাল। ”
“আমি আসছি।”
“না, আমি তোকে এখানের অবস্থা জানাব। প্রয়োজনে পরে আসিস। ঐশি না বুঝে তোকে কল দিয়ে দিয়েছে।”
“কিন্তু… ”
“কোনো কিন্তু না। তুই দেশে নেই যে এসে পরবি। আর তুই আসলেই তো আন্টি সুস্থ হয়ে উঠবেন না। আর আমরা সকলে আছি এখানে। আমি তোকে সব জানাব।”
“জোহান কোথায়? ও ঠিক আছে তো?”
কিছু মুহূর্ত সময় নিয়ে সামি জানায়, “ওর অবস্থা তেমন ভালো নয়। ও নিজেকে দোষারোপ করছে আন্টির এ অবস্থার জন্য।”
” কিন্তু কেন?”
“আন্টি কয়েকদিন ধরে ওকে তার কাছে একবারের জন্য আসতে বলছিলো। যায় নি জোহান। আজ স্টোক করার কিছুক্ষণ পূর্বেও ওকে কল দিয়ে আসতে বলেছিল। জোহান বিরক্ত হয়ে কল কেটে দিলো। ওর মতে এসব ওর দোষ।”
“এখন ও কোথায়?”
“বাড়ি গিয়েছে। খুব ডিস্টার্ব দেখাচ্ছিল।”
“তাহলে তোরা এখানে কি করছিস? ওকে একা ছাড়লি কীভাবে তুই? ও যদি উল্টাপাল্টা কিছু করে বসে? জলদি ওর কাছে কেউ যা।” আতঙ্কিত হয়ে উঠে সভ্য।
সামি গম্ভীরমুখে বলে, “ইনারা তার পিছু গিয়েছে।”
মুহূর্তে চুপ হয়ে যায় সভ্য। নিজের অনুভূতি বুঝার চেষ্টা করার সময় নিলো। তার মনে হলো তার হৃদয়ের ঈর্ষা তার মনের মায়ার উপর ভারী হচ্ছে। এ মুহূর্তে তার মনে এ খেয়াল কীভাবে আসতে পারে যে ইনারা আবার জোহানের প্রতি দুর্বল হয়ে পড়বে না’কি! এমন করুণ সময় এটা কীভাবে ভাবতে পারে সে? তার মানবতাও কি হ্রাস পাচ্ছে? এসময় জোহানের কাউকে প্রয়োজন। এখন এটাই গুরুত্বপূর্ণ।

জোহান হাওয়ার গতিতে তার রুমে ঢুকে কাঁচের আসবাবপত্র ভাঙতে শুরু করে। এক এক করে পুরা রুমের আসবাবপত্র ভেঙে মেঝেতে বসে পড়ে। তার হাত পা কাঁপছে। সে বুঝতে পারছে না কি করবে! শরীরের ভেতর কাঁপছে। বুকের ভেতরটা যন্ত্রণা দিচ্ছে। মনে হচ্ছে মাথার ভেতরও কাঁপছে। তার চোখের সামনে ভাসতে থাকে তার মা’য়ের সাথে কাটানো সব সুন্দর মুহূর্ত। তাকে অবহেলা করার মুহূর্তও। যন্ত্রণা অনুভব করে সে। কাঁদতে চায় না। কিন্তু চোখ ভিজে আসে তার। তার অস্থিরতা মেটানোর জন্য আরও যন্ত্রণা দিতে চায় সে নিজেকে। পাশে থাকা একটি কাঁচের টুকরা হাতের মুঠোয় শক্ত করে ধরে নেয়।

ইনারা জোহানের পিছনে আরেকটা গাড়ি নিয়ে আসছে। জোহানের রুমের বাহিরে কিছু মানুষ দাঁড়িয়ে ছিলো। তাকে দেখেই তারা চলে যায়। রুমে প্রবেশ করতে দেখে সারা কক্ষ কাঁচের টুকরোয় ভরা। এক কোণায় বসে আছে জোহান। তার দৃষ্টি মেঝেতে। তার চোখের পলক পরছে না। কেবল চোখ দিয়ে অশ্রুজল ভাসছে। আর হাতের মুঠোতে ভাসছে রক্ত। তার হাত দেখতেই কেঁপে উঠে ইনারা। মা’য়ের মৃত্যুর পর থেকে সে রক্ত দেখলে ভয় পায়। আর কেমন টুপ টুপ করে মেঝেতে পড়সে রক্ত। এ দৃশ্যটা শিউরে দেবার মতোই।

সে দৌড়ে যেয়ে জোহানের পাশে বসে। হাত থেকে কাঁচের টুকরো ছাড়ানোর চেষ্টা করে করে বলে, “কি করছেন এসব? ছাড়েন কাঁচের টুকরো।”
জোহানের গলার স্বর কাঁপা কাঁপা, “তুমি এখান থেকে যাও ইনারা, নাহলে আমি তোমারও কোনো ক্ষতি করতে পারি। দেখ নি আমার জন্য মা’য়ের আজ কি অবস্থা?”
“আপনার জন্য কিছু হয় নি। আপনি অকারণে নিজেকে দোষারোপ করছেন।”
“অকারণে না। অকারণে না ইনারা। আমি…আমি অনেক খারাপ জানো? আমি অনেক খারাপ। আমি মা’কে অনেক কষ্ট দিয়েছি। তাকে অনেক অবহেলা করেছি। যে…যে আমার জন্য… আমার স্বপ্নের জন্য তার গুছানো জগত ছেড়ে আমার সাথে গেছে তাকে নিয়ে না’কি আমি লজ্জা পেতাম। সে..সে হাইক্লাস না বলে। আমি তাকে কত কষ্ট দিয়েছি। অবহেলা করেছি। অসুস্থ হলে তার খবর নিতাম না। নিজের মজায় ডুবে থাকতাম। আমি এই ফ্রেমেএ জগতে হারিয়ে নিজের মা’কে কীভাবে তুচ্ছ করতে পারি? ” জোহান চোখদুটো বড় বড় করে তাকায় ইনারার দিকে। চোখদুটো রক্তিম। তার মুখে ভয়, অপরাধবোধ, দুঃখ। সে কাঁপানো গলায় বলে, “আর আজ…আজ সে আমার সামনে পরে ছিলো। কিন্তু আমার সাথে কথা বলে নি। মা আমায় দেখলেই আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতো কিন্তু আজ নড়েও নি। হাত তুলে আমার চুলে হাত বুলিয়ে দেয় নি। ডাক্তার বলেছে…তার বাঁচার নিশ্চয়তা নেই। তুমি বলো কার দোষ? কার দোষ এখানে?”
ইনারা কি বলবে বুঝতে পারে না? এই মুহূর্তে তার কি বলা উচিত তাও বুঝতে পারে না। জোহানকে শান্ত করার জন্য বানিয়ে এক মিথ্যে কথা বলে, “আসার সময় সামি কল করেছিলো। আন্টি এখন অনেকটা বেটার। সে ঠিক হয়ে যাবে।

সাথে সাথে জোহান তাকায় ইনারার দিকে। দৃষ্টিটা অন্যরকম। দৃষ্টিতে আশার আলো ছিলো। সে বলে, ” সত্যি? তুমি সত্যি বলছ?”
ইনারা মাথা নাড়ায়। সে বসে জোহানের পাশে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, “আমরা সবাই জীবনে কোনো না কোনো ভুল করে থাকি। কেউ পার্ফেক্ট হয় না। জীবন আমাদের তা ঠিক করার একটি সুযোগ দেয়। সে সুযোগ আমরা কীভাবে কাজে লাগাব তা আমাদের উপর নির্ভর করে। তাই না?”
ইনারা হাতে জোহানের হাত নেয়। তার হাতের মুঠো খুলে কাঁচটি বের করে মেঝেতে ফেলে। সে একটু উঁচু হয়ে জোহানের মাথায় হাত রেখে বলে, “সব ঠিক হয়ে যাবে। আপনি চিন্তা করেন না।”
জোহান তাকিয়ে রইলো ইনারার দিকে। ঠিক সে মুহূর্তে হঠাৎ তার মনে হলো তার বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠেছে। হৃদয়ের স্পন্দন থেমে গেছে। ইনারাকে নিজ অজান্তেই খুব আপন মনে হয় তার। এই প্রথম তার মনে হলো তার পাশে বসা মেয়েটাকে সারাজীবন এভাবে দেখে গেলেও তার দৃষ্টি ক্লান্ত হবে না।

ইনারা জোহানকে সেদিন আর হাস্পাতালে নিয়ে যায় না। তার অবস্থা খারাপ হওয়ায় তাকে ঔষধ দিয়ে ঘুম পারায়। সেদিন সে প্রথম জানতে পায় জোহানের অসুস্থতার কথা। ভাগ্যবশত সেদিন রাতেই সৌমিতা আন্টি সুস্থ হয়ে উঠে।
.
.
প্রায় দুইমাস পর বাংলাদেশে এসে পৌঁছায় সভ্য। তার আসার খবর এখনো ইনারা জানেনা। তাকে না জানানোর একটি বিশেষ কারণ আছে। সে যখন অস্ট্রেলিয়াতে ছিল তখন ইনারার জন্মদিন যায়। অথচ সে ইনারার সাথে জন্মদিন পালন করতে সাথে ছিলো না। তাদের দেখা হবার পর ইনারার প্রথম জন্মদিন ছিলো কিন্তু সে সাথে ছিলো না। ভাবতেই মনটা উদাসীন হয়ে যায় তার। তাই সে ভেবেছে ইনারাকে স্যারপ্রাইজ দিবে। এজন্য সে ইনারাকে তার আসার খবর দেয় নি। সামিকেও দিতে মানা করেছে। ইনারার তাকে বাদে কেবল সামির সাথেও যোগাযোগ হয়। আর জোহানের সাথেও আজকাল ইনারার ভালোই যোগাযোগ হয়। কতটুকু সে ধরতে পারে না। কিন্তু প্রায়ই ইনারাকে ফোন দিলে জোহান পাশে থাকে। সম্ভবত সৌমিতা আন্টির অসুস্থতা এর কারণ।

ইনারার সাথে আগের মতো কথা হয় নি তার। প্রথম ক’দিন ভালোই কথা হলেও পরে সৌমিতা আন্টি অসুস্থ হবার পর তাকে সময় দিতে হয়। যখন সে ব্যস্ত থাকে তখন ইনারা কল দেয়, আবার যখন তার সময় ফ্রী থাকে তখন ইনারা ব্যস্ত থাকে। এজন্য তাদের যোগাযোগে সমস্যা হয়ে যায়। কিন্তু এখন সব ঠিক হয়ে যাবে। সে যে এসে পড়েছে। ইনারাকে এক মুহূর্তের জন্যও একা ছাড়বে না। মেয়েটা তাকে হঠাৎ এখানে দেখে খুশিই হবে। তার মুখের উৎসুকভাব মনে করতেই কেমন খুশি লাগে তার।

কোম্পানিতে যেয়ে সকলের সাথে দেখা করেই সে সামিকে নিয়ে বাসায় আসে। আরামও করে না। এই ক্লান্ত শরীর নিয়ে লেগে পরে ইনারার বিশেষ দিন পালনের আয়োজনে। সে নিজের হাতে কেক বানানোর প্রস্তুতি নেয়। বেলুন দিয়ে ঘর সাজাতে সাহায্য করে সামি। তারপর ফুল আনতে যায়। এর মধ্যে সভ্য রাতের খাবারের প্রস্তুতি নেয়। ইনারার পছন্দের খাবার আজ নিজের হাতে রান্না করবে সে। এমন সময় কলিংবেল বাজে। সে ভাবে সামি এসেছে। যেয়ে দরজা খুলতে খুলতে বলে, “সামি তুই এত জলদি…”
চুপ হয়ে যায় সে। তার সামনে সামি না, জোহান দাঁড়ানো। তাকে দেখে বিস্ময়কর দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো সে।

জোহান হাসে, “সামি না জোহান। কোম্পানিতে না-কি সবার সাথে দেখা করে এলি। আমার সাথেই দেখা করিস নি। তাই আমি দেখা করতে চলে এলাম। এসেছি বলে নিরাশ হয়েছিস না-কি?”
সভ্য মাথা নাড়ায়, “নিরাশ না। অবাক হচ্ছি তোকে দেখে। তাও আমার ঘরে।”
“ভেতরে ডাকবি না?”
“আজও তোর আমার বাসায় আসতে পারমিশন লাগবে না।”
জোহান ভেতরে ঢুকে সোফায় বসে। সভ্য বসে তার সামনে। জিজ্ঞেস করে, “আন্টি কেমন আছে এখন?”
“ভালোই। আগের থেকে অনেক ভালো আছে। আর খুশিও। ঠিক বলেছিলি তুই, মা’কে আমি অনেক ভালোবাসি। নিজের বোকামিতে তাকে অবহেলা করে যে এত কষ্ট দিচ্ছি তা বুঝতে পেরেছি। আর তাকে হারানোর ভয়ও অনুভব করতে পেরেছি। তাকে হারানোটা সহ্য করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।”
জোহানের এমন কথা শুনে সভ্যের ঠোঁটে হাসি এঁকে উঠে, “আমি অনেক খুশি হয়েছি তুই কথাটা বুঝতে পেরেছিস।”
“এই সেটআপ কি ইনারার জন্য?”
প্রশ্নটা অন্যকেউ করলে হয়তো সভ্যের উওর দিতে দ্বিধাবোধ হতো না। কিন্তু জোহান প্রশ্নটা করায় তার একটু অকপটে লাগলো। তবুও সে মাথায় নাড়িয়ে হ্যাঁ উওর দেয়, “ওর জন্মদিনে ছিলাম না। তাই ভাবলাম একটা স্যারপ্রাইজ দিব।”,

জোহান বলে, “সাজ অনেক সুন্দর হয়েছে। স্যারপ্রাইজ মন্দ হবে না। কিন্তু ওর জন্মদিন বাদে অন্যকিছুর জন্য স্যারপ্রাইজটা বেশি মানায়।”
সভ্য বিস্মিত সুরে জিজ্ঞেস করে, “কী নিয়ে?”
“আর কি আমার এবং ইনারার বিয়ের জন্য স্যারপ্রাইজটা দিলে বেশি ভালো হয়।”
বিয়ের কথা শুনতেই সভ্য স্তব্ধ হয়ে যায়। তার ঠোঁটের হাসি মলিন হয়ে আসে। সে জোহানের কথার উওরে প্রশ্ন যে করবে তাও পারছে না। তার গলা দিয়ে কোনো শব্দই বের হচ্ছে না।

জোহান আবারও বলল, “এই মুহূর্তে মা, বাবা এবং ঐশি ইনারার বাসায় গেছে। বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এবং তারা রাজিও হয়ে গেছে।”

চলবে…..

অনুভবে
পর্ব-৪৩
নিলুফার ইয়াসমিন ঊষা

জোহান আবারও বলল, “এই মুহূর্তে মা, বাবা এবং ঐশি ইনারার বাসায় গেছে। বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এবং তারা রাজিও হয়ে গেছে।”
বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠছে সভ্যের। মুহূর্ত যেন তার আশেপাশের সব শুণ্য হয়ে গেল। সে কাঁপা কাঁপা গলায় বললো, “আমি মানতে রাজি না।”

ফোন বের করে জোহান। ঐশিকে কল দেয়। দুষ্টুমির সুরে বলে, “হ্যালো ভাই, তোর তর না হইলে নিজেই এসে পড়তে। এ নিয়ে কতবার কল দিলে বলতো।” বলে মিটিমিটি হাসে সে।
“আচ্ছা শুন ইনারার পরিবার রাজি তো বিয়ের জন্য?”
“একটু আগেও তো তোমাকে মেসেজ দিলাম। তারা এক কথায় রাজি। আর ভাই তোমার সাথে আমি রাগ। তোমরা সবাই জানতে ইনারা যে সাইয়ারা আন্টির মেয়ে। আমার বলো নি? আজ আসো। তোমার খবর আছে।”
“আচ্ছা তাহলে আপাতত রাখছি।”
কল কেটে জোহান আবার তাকালো সভ্যের দিকে। তার চোখে মুখে এখনো অবিশ্বাস্যতার ছাপ।

জোহান আবার বলল, ” আমার কথা বিশ্বাস হয় নি? তাহলে এবার ইনারার মুখ থেকে শুনে নিতে পারিস।”
সে ইনারাকে কল দেয়। ইনারার কল ধরতে একটু দেরি হয় বটে। সে কল ধরেই বলে, “জোহান জানেন আজ কি হয়েছে? আমি সুপার ডুপার এক্সাইটেড সবাইকে বলার জন্য। উপস আপনি তো জানবেনই। আপনিই তো সব ফিক্স করলেন।”
“তুমি খুশি তো?”
“এটা আবার জিজ্ঞেস করতে হয়। অনেক খুশি আমি। কাল কোম্পানিতে আসবেন। সবাইকে একত্রে খুশির সংবাদটা দিব।”
“মানে বাবার প্রস্তাবে তো রাজি তুমি।”
“অবশ্যই। এটা আবার জিজ্ঞেস করতে হয়?”
“আচ্ছা। তাহলে কাল দেখা হচ্ছে।”
জোহান আবারও কল কেটে দেয়। সভ্য বসে আছে। স্থির হয়ে। তার মুখে কোনো কথা নেই। তার দৃষ্টি শূন্য।

জোহান সভ্যকে জিজ্ঞেস করে, “এখন বিশ্বাস হয়েছে? দেখেছিস ও কতটা খুশি। তোকে বলেছিলাম না ও আমাকে ভালোবেসেছিল আর হাজারো অভিমান করুক না কেন ও আমার কাছে ফিরে আসবে।”
সভ্যের চোখে পানি এসে জমেছে। তার মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পরেছে। তার নিশ্বাস ফেলতেও কষ্ট হচ্ছে। সে কাঁপা-কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করে, “তোর কী?” সে চোখ তুলে তাকায় তার সামনে বসে থাকা জোহানের দিকে, “আজ ওকে পেয়ে তো তোর জেদ শেষ। দুইদিন পর ওর সৌন্দর্যের তৃপ্তি মিটে গেলে অন্য মেয়ের জন্য…”

“আমি ওকে ভালোবাসি…” জোর গলায় বলল জোহান, “আমি ওকে আসলেই অনেক ভালোবাসি। একারণেই বিয়ের কথা বলেছি, নাহয় আমি কাওকে অকারণে বিয়ের কথা বলবো না। ও এখন আর আমার জেদ না, ভালোবাসা। আর আমি ওকে ছাড়া থাকতে পারব না। এটা সত্য যে প্রথমে আমি ওকে ওর সৌন্দর্যের জন্য পছন্দ করেছিলাম। কিন্তু বিগত মাসে এমন কিছু হয়েছে যা ওর প্রতি আমার হৃদয়ে অন্যরকম এক অনুভূতি জাগ্রত করেছে। যা আর কখনো হয় নি।”
কথাগুলো বলার সময় সভ্য এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। জোহানের চোখে সত্যতা দেখতে পেল সে। অথচ এই সত্যতা তার দম বন্ধ করে দিচ্ছে।

“গুড, তাহলে তুই ওকে ভালোবাসির। আর ও…তোকে। তাহলে আমার কাছে কী? আমাকে সংবাদ দিতে কেন এসেছিস?” ভেজা গলায় জিজ্ঞেস করে সভ্য। সে উঠে যেয়ে পিঠ করে দাঁড়ায়। জোহানও উঠে তার পিছনে এসে দাঁড়ায়, “তোর মনে আছে তুই বলছিলি আমি একবার বললে তুই গান ছেড়ে দিবি।”
উওর দেয় না সভ্য। চুপ করে থাকে।” জোহান আবারও বলে, “আমি চাই তুই গান ছেড়ে দে। আমাদের সকলের জীবন থেকে বের হয়ে যা।”
“কেন?” পিছনে ফিরে তাকায় সভ্য। জিজ্ঞেস করে, “কেন যাব আমি? তোরা একে অপরকে ভালোবাসিস। তাহলে আমার যাবার কথা উঠছে কেন শুনি।”
“কারণ তুই ওকে আমার থেকে বেশি ভালোবাসিস। আর এটা আমার সহ্য হয় না। নিরাপত্তাহীনতায় নির্ঘুম রাত কাটে আমার। অশান্তি লাগে সারাক্ষণ। ইনারা আমার পাশে থাকলেও কেন যেন মনে হয় দূরে সরে আছে। তুই ওর দিকে তাকালে, ওর পাশে থাকলে, ওর সাথে থাকলেও আমার সহ্য হয় না।” গলার স্বর উঁচু হয়ে আসে তার। তারপর হঠাৎ করে নম্র হয়ে আসে, “তুই আমাকে বলেছিলি আমি বন্ধু হিসেবে একবার বললে তুই তোর গান ছেড়ে দিবি। আমি অনুরোধ করছি। প্লিজ চলে যা। আমি তোকে এখানে জোর করে এনেছিলাম আর এখন অনুরোধ করে যেতে বলছি। আমাদের বন্ধুত্বের খাতিরে।”

সভ্য ফিরে শক্ত করে জোহানের কলার চেপে ধরে। রাগে, না কষ্টে এই বুঝার সামর্থ্য এখন আর তার নেই। তার চোখে পানি জম আছে। বুকের ভেতর আটকে রয়েছে এক আকাশ যন্ত্রণা। হাত কাঁপছে তার। দাঁতে দাঁত চেপে সে বলল, “ইনারাকে একটা কষ্ট দিলেও তোর জীবন নিয়ে নিব আমি। মনে থাকে যেন। ওর চোখে এক ফোঁটা জলও যেন না আসে।”
“আসবে না। ওয়াদা দিলাম।”
সভ্য জোহানের কলার ছেড়ে তাকে ধাক্কা দিয়ে বলল, “নাউ গেট লস্ট।”
জোহান তবুও কিছু মুহূর্ত সেখানে দাঁড়ায়। তারপর চল যায়।

সভ্য সে একই স্থানে দাঁড়িয়ে থাকে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা মেঝের দিকে। কল আসে তার। সামির কল। সে যন্ত্রের মতো করে তার দিকে তাকায়। আর লাউড স্পিকারে দেয়। ওপাশ থেকে সামির কন্ঠ শোনা যায়, “দোস্ত ইনারার জন্য কোন ফুল আনব? লাল গোলাপ? তোর ভালোবাসার প্রতিক হিসেবে লাল গোলাপ দিবি? ” সম্পূর্ণ কথা শেষ হবার পূর্বেই সভ্য ছুঁড়ে মারে তার হাতের ফোনটা। মুহূর্তে টুকরো টুকরো হয়ে যায় যন্ত্রটা।

সে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে মেঝেতে। নিঃস্ব লাগছে তার নিজেকে। সে জীবনে কখনো কেঁদেছে বলে মনে নেই। কিন্তু আজ তার চোখের জল এমন অবাধ্য হলো কেন? কেন এই ভালোবাসা নামক যন্ত্রণা তার জীবনে এলো যখন তার ভাগ্যেই এই অনুভূতিটা ছিলো না? কেবল যন্ত্রণা দিতে? নিজের বুকের বা’পাশের দিকের শার্ট আঁকড়ে ধরে সভ্য। বুকের ভেতরটা বেশ ব্যাথা করছে।
.
.
ইনারা ভীষণ খুশি মনে ছিলো তাই সে আজ প্রিয় এবং সুরভির সাথে সময় কাটাতে যায় সুরভির বাসায়। আজ সেখানেই থাকবে সে। খুশির কারণ হলো আজ সে পরিচালক আলতাফের সাথে দেখা করতে গিয়েছে। ইউনিভার্সিটির থিয়েটারে তার অভিনয় দেখে তাকে নিজের সিনেমায় কাস্ট করতে চাইতেন তিনি। জোহানই তাদের মিটিং ফিক্স করিয়ে দিয়েছিলো। আর তাকে একটা মুভির অফার দিলো। যদিও প্রধান চরিত্রে না। অবশ্য অনেক বছর ইন্ডাস্ট্রিতে থাকলেও তার ছবিতে কাজ পাওয়া যায় না। সেখানে প্রধান চরিত্রের আশা করাটাও বোকামি। যতটুকু পেয়েছে এটাই তার জন্য ঢের। তার ইচ্ছা করছে সভ্যকে এখনই কল দিয়ে খুশির খবরটা জানিয়ে দিক। কিন্তু না। সে খবরটা এখন দিবে না। সভ্য আগে আসুক, তারপর তাকে স্যারপ্রাইজ দিবে।

পরেরদিন সকালেই ইনারা যায় কোম্পানিতে। সকলকে এই খুশির খবরটা দিতে চায় সে। এছাড়া জোহান বলেছে মিঃ হক তাকে তাদের কোম্পানির অংশ হবার অফার দিয়েছে। এ বিষয়েও কথা বলবে সে। কিন্তু সবাইকে খুশির খবরটা দেওয়ার পূর্বেই সে জানতে পারে গতকাল সভ্য এসেছিলো। সভ্য এসেছিলো? তবুও তার সাথে দেখা না করে চলে গেল? এটা কী করে সম্ভব? সে সভ্যকে কল দিয়ে না পেয়ে কল দেয় সামিকে, “হ্যালো পার্টনার ইনারা বলছি।”
“কী চাই?”
“তুমি এভাবে কথা বলছ কেন? আচ্ছা এটা বাদ দেও তুমি আজ কোম্পানিতে আসো নি?”
“না।”
“সভ্যের সাথে তুমি? সভ্য না’কি দেশে ফিরেছে শুনলাম। আমার সাথে দেখা করে নি কেন?”
“কারণ তার ইচ্ছা হয় নি। তোমার সাথে ও কেন দেখা করবে শুনি?”
ইনারার খুব আজব লাগে সামির ব্যবহার, “তুমি এভাবে কথা বলছ কেন?”
“এতকিছু বলতে পারব না। কেবল এতটুকু বুঝে নেও যে আর সভ্যের সাথে যোগাযোগ করার কোনো প্রয়োজন নেই। ”
“প্রয়োজন নেই মানে? কী হয়েছে সভ্যের?”
“সব ছেড়ে চলে গেছে ও। ওর স্বপ্ন, ওর ক্যারিয়ার, সব।”
“কী বলছ তুমি এসব? তোমার কাছে ওর নতুন কোনো নাম্বার আছে? দেও তো। আমি উনার সাথে কথা…”
“কোনো প্রয়োজন নেই।” ধমকে উঠে সামি, “সভ্য তোমার মতো মেয়ের চেহেরাও আর দেখতে চায় না। কথা বলা তো দূরের কথা। আমার সাথেও আর যোগাযোগ করার প্রয়োজন নেই।”
বলেই সে কল কেটে দিলো। ইনারা হতভম্ব। কি হলো সে কিছুই বুঝতে পারলো না। সে আবার কল দিতেই দেখে সামি তাকে ব্লক করেছে।

সে কিছুই বুঝতে পারছে না। কি করেছে সে? সামি তার সাথে এমন ব্যবহার করল কেন? আর সভ্যই বা তার সাথে কথা বলতে চাইবে না কেন? কি করেছে সে? হঠাৎ তাকে অশান্তি ঘিরে ধরে। সে কি করবে বুঝতে পারে না। তবুও সে নিজেকে সংযত রাখে মিঃ হকের সাথে কথা বলতে যায়। সেখানে জোহানও ছিলো। কন্টাক্ট নিয়ে কথা বলা শেষে জোহানের সাথে বাহিরে আসে সে। তখন জোহান তাকে জিজ্ঞেস করে, “কী ব্যাপার? তোমার মুখ এমন মলিন লাগছে কেন?”
ইনারা মাথা নাড়ায়, “কিছু না।”
“কিছু তো হয়েছে।”
“সভ্যকে নিয়ে চিন্তা করছিলাম।”
সভ্যের কথা শুনতেই রাগে জোহান হাত মুঠোবদ্ধ করে নিলো।

ইনার মুখ থেকে সভ্যের নাম শুনলেই কেন যেন তার গা জ্বলে ওঠে। কিন্তু তা ইনারার সামনে প্রকাশ করল সে, “সভ্য আমাদের কন্টাক্ট রিনিউ করতে চায় না। ও বিদেশে শিফট হচ্ছে। ও সেখান থেকে পেপার ওয়ার্ক করে আমাদের জানাবে।”
চমকে উঠে ইনারা, “সভ্যের সাথে তো আমার দুইদিন আগেও কথা হয়েছে। সে আমাকে কিছু বলেনি তো।”
“জানি না হঠাৎ কি হয়েছে। ওরে সিদ্ধান্তে যতটা আমাদের গ্রুপের ক্ষতি হয়েছে ততটাই ক্ষতি হয়েছে কোম্পানির। সব ইনভেস্টর বাবাকে জিজ্ঞাসাবাদ করছে। এখানে বাবাকে কি করবে বলো। আমার খুব চিন্তা হচ্ছে।”
“না, নিশ্চয়ই কোনো কারণ আছে সভ্যের এসব করার পিছনে। আমি… আমি যে করেই হোক খোঁজ নিচ্ছি।”
ইনারা সামনে এগিয়ে যেতে নিলেই জোহান তার হাত ধরে নেয়, “তোমার ওর খোঁজ না করাটা সবচেয়ে বেশি ভালো হয়।”
“মানে কী? উনি হঠাৎ করে চলে গেছে আর আমি তার খোঁজ করব না?” রাগান্বিত সুরে বলে ইনারা।

জোহান বুঝতে পারে ইনারার সাথে এভাবে কথা বললে হবে না। তার ব্রেনের সাথে খেলতে হবে। ইনারার আত্মসম্মান তার সবচেয়ে বেশি প্রিয়। তার আত্মসম্মানে আঘাত করতে হবে। সে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “তোমার কারণে বলছিলাম। ও তোমার নামে যা বলল এরপর… থাক, বাদ দেও। তুমি তাকে খুঁজতে চাইলে খুঁজতে পারো।”
“আপনি কি বলতে যেয়ে থেমে গেলেন?”
“কিছু না। আসো তোমাকে বাসায় পৌঁছে দেই।”
“টপিক পাল্টাবেন না। বলুন সভ্য কী বলেছে?”
“আহা বললাম তো কিছু না।”
“আপনি বলবেন কি-না?”
দীর্ঘশ্বাস ফেলে জোহান। উদাসীন হবার নাটক করে বলে, “আমি জানি তুমি কষ্ট পাবে তাই বলতে চাইছিলাম না। আমি গতরাতে সভ্যকে কিছু কথা বলতে শুনেছিলাম তোমার নামে।”
“কী কথা?”
“যে… যে তোমার মধ্যে সমস্যা আছে। যে কারও সামান্য এফোর্টেই গলে যাও। ও কিছু রোমেন্টিক কথা বলেছে আর তুমি লজ্জা পেয়ে গেছ। তার প্রেমে পড়ে গেছ। যে কেউ চাইলেই তোমাকে প্রেমে ফালাতে পারে। তুমি একবার আমার প্রেমে পড়েছিলে তো ক’দিন পর ওর প্রেমে পড়ে গেছ। ও কেবল মজা নিচ্ছিল তোমার।”
“আপনি মিথ্যা বলছেন। সভ্য আমাকে এসব বলতে পারে না।”
“আর আমি তোমার সাথে মিথ্যে বলব কেন? ”
“তা আমি জানিনা। কিন্তু আমার সভ্যের উপর বিশ্বাস আছে। ”
“আমি তো তোমাকে কথাগুলো বলতে চাইনি। তুমিই জোর করলে। এছাড়া আমি তোমাকে সহজ ভাষায় বলেছি। তোমার চরিত্র নিয়ে আরও বাজে কথা শুনেছি। কিন্তু তা মুখে আনার মতো ক্ষমতা আমার নেই। এই নিয়ে গতকাল ঝগড়াও লেগেছিল আমাদের। দেখ ইনারা তুমি কথাগুলো বিশ্বাস করো বা না করো আই ডোন্ট কেয়ার। আমরা ক’দিন আগে ফ্রেন্ডশিপ করেছি। আমি চাই না এ বিষয় নিয়ে আমাদের বন্ধুত্বে কোনো ফাঁটল আসুক। আমি তোমার সাথে সভ্যকে নিয়ে আর কোন কথা বলবো না। আর আমি এটাও চাই না যে তুমি আমার সাথে ওকে নিয়ে কোনো কথা বলো। কারণ আমি নিজের কানে ওর বলা কথা শুনেছি। আসো তোমাকে বাসায় দিয়ে আসি।”
ইনারাকে অস্থির দেখা গেল। সে বলে, “ড্রাইভার আছে। আমি যদি তে পারব।”
বলে সে চলে গেল।

জোহান সেখানে দাঁড়িয়েই উনার যাওয়ার পথ দেখছিল। সে বাঁকা হেসে তার হাত পকেটে ভরে বলে, “সরি সুইটহার্ট তোমাকে পাওয়ার জন্য একটু কষ্ট দিতে হচ্ছে তোমাকে। মিথ্যা বলতে হচ্ছে। বাট আই প্রমিজ এরপর তোমার জীবন সুখে ভরিয়ে দিব। এখন হয়তো তুমি আমার কথা বিশ্বাস করতে চাইছো না। কিন্তু আমি জানি যখন তুমি আর সভ্যের খুঁজে পাবে না তখন আমার কথা মানতে বাধ্য হবে।”

ইনারা গাড়িতে উঠে বারবার কল করতে থাকে সভ্যকে। কল ধরে না কেউ। অস্ট্রেলিয়ার নাম্বারেও কল করে পায় না। আগামী কয়েকদিনে সে সভ্যের বাসায় যায়, কোম্পানিতে খোঁজ নেয়, তার অস্ট্রেলিয়ার ভার্সিটির নাম্বার জোগাড় করে সেখানেও কল দেয় কোথাও পায় না। এমনকি কোম্পানি থেকে তার তথ্য চায় কিন্তু বিশেষ কিছু পায় না সে।
.
.
দেখতে দেখতে ছয় মাস কেটে যায়। ইনারা প্রথম চার মাস খোঁজ করার পর ক্লান্ত হয়ে হাল ছেড়ে দেয়। পঞ্চসুরও ভেঙে যায়। এখন যে যার পথ বেছে নিয়েছে। এই ছয় মাসের মধ্যে প্রতিটা মুহূর্তে তার সভ্যের প্রতি রাগ এবং ঘৃণা বাড়তে থাকে। একটা মানুষ কি এভাবে হারিয়ে যেতে পারে? তার কি একটিবারও মনে পড়ে না তার কথা? তার সাথে কাটানো সকল মুহূর্তই কি এতটা তুচ্ছ ছিলো সভ্যের জন্য? এই এক কথা ভেবে কতরাত যে নির্ঘুম কাটে তার।

কেউ একজন ঠিকই বলেছ, একটি মানুষের জন্য জীবন শূন্য হয়ে যেতে পারে কিন্তু কারও জন্যই জীবন থেমে থাকে না। ইনারা পড়ালেখার পাশাপাশি নতুন সিনেমায় কাজ করা শুরু করবে। তবুও আজ পর্যন্ত কেউ তার আসল পরিচয় জানে না। তাকে নিউ ফেস হিসেবে পোস্টার প্রকাশ করা হয়েছে। সকলের কাছ থেকে অনেক প্রশংসাও পেয়েছে সে। তার সৌন্দর্যের জন্য। আগামী মাস থেকে শুটিং শুরু হবার কথা। ক’দিনের মাঝেই খুব ব্যস্ত হয়ে পড়বে সে তাই আজ সুরভীকে নিজের বাসায় নিয়ে এসেছে গল্প করার জন্য। দরজা দিয়ে ঢুকতেই তার ডাক পড়লো। মুশতাক সাহেব ডাকছেন।
“আব্বু ডেকেছ?”
মুশতাক সাহেব পায়ের উপর পা তুলে চা’য়ে চুমুক দিচ্ছিলেন। ইনারার দিকে তাকালেন তিনি। সাথে তার পেছনে থাকা সুরভীর দিকেও তাকালেন। সুরভি সালাম দেওয়ায় উওরও দেয়।
আজকাল মুশতাক সাহেব আর খারাপ ব্যবহার করে না ইনারার সাথে। বিশেষ করে অভিনয়ের কথা বলার সময় ইনু ভেবেছিল অনেক বড় একটা তামাশা করবেন সে। অথচ সে কিছুই বললেন না। হয়তো জোহানের ঘর থেকে তার বিয়ের প্রস্তাব এসেছে একারণেই। তার সাথে বিয়ে হলে মুশতাক সাহেবের সব দিক থেকে লাভ হবে না?

মুশতাক সাহেব বললেন, “তাহলে কি ভাবলে তুমি যখন জোহানকে নিয়ে।”
“আমি আগেও বলেছি আমি আগে আমার ক্যারিয়ার করতে চাই তারপর বিয়ে। অন্তত পক্ষে পাঁচ বছর পর।”
“দেখ ইনারা, তোমার মা চাইত তুমি জোহানের সাথে বিয়ে করো। এটা তার শেষ ইচ্ছা ছিল। আমি কেবল তার শেষ ইচ্ছা পূরণ করতে চাই। এছাড়া তুমি জানো এই ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি কত খারাপ! আমি চাইনা তুমি কোন ধরণের সমস্যায় জড়িত হও। জোহন তোমার ভালো খেয়াল রাখতে পারবে।”
“খেয়াল রাখার সাথে বিয়ের কোনো সম্পর্ক নেই।”
“কিন্তু আমি তোমাকে ওর হাতে তুলে দিয়ে চিন্তা মুক্ত হতে চাই।”
ইনারা এবার বিরক্তির স্বরে বলে, “আমি এখন বিয়ে করতে তৈরী না। সে এখন বলছে আমাকে সাপোর্ট করবে। ভবিষ্যতে কি?”
“আচ্ছা, ঠিক আছে তোমার বিয়ে করা লাগবে না।” অনেকটা রাগ রাগ ভাব নিয়ে বললেন মুশতাক সাহেব, “তোমার মা’য়ের কোনো মূল্য নেই তোমার কাছে। আর না তার ইচ্ছার মূল্য আছে।”
“আপনি জানেন আমার মা’কে আমি কতটা ভালোবাসি। সে তো এটাও চাইতো আমি জীবনে সফলতা অর্জন করি। তার এ ইচ্ছা অপূর্ণ রাখি কীভাবে?”
“আচ্ছা ঠিকাছে বিয়ে নাহয় পরে করলে বাগদান করতে তো মতো সমস্যা নেই। তাই না?”
“না।” স্বাভাবিক গলায় উত্তর দিলো ইনারা, “কোনো সমস্যা নেই।”

সুরভি চমকে উঠে তার উওর শুনে। এরপূর্বে ইনুর বলা কোন কথাই তাকে বিস্ময়ে ফেলতে পারে না। অথচ এ কথা শুনে সে যেন আকাশ থেকে পড়লো।

ইনারা জিজ্ঞেস করে, “আমি কি এখন আমার বান্ধবীকে নিয়ে রুমে যেতে পারি?”
মুশতাক সাহেব অনুমতি দেয়।
ইনারা সুরভির হাত ধরে বলে, “আয়।”

রুমে ঢুকতেই সুরভির প্রশ্নের বর্ষণ শুরু হয়, “এটা কি হলো ইনু? কি বাগদানের জন্য এভাবে হ্যাঁ কি করে বলতে পারিস? তুই সভ্যকে ভালোবাসিস।”
সভ্যের নাম শুনলেই মাথায় রক্ত উঠে যায় তার। সে বিছানায় ব্যাগ রেগে সুরভির দিকে তাকিয়ে চেঁচিয়ে উঠে, “আর কই সে সভ্য? কোথায়? আমি তো তাকে দেখছি না। ইনফ্যাক্ট ছয়মাস ধরে তাকে দেখতে পারছি না আমি।”
“তাই বলে এভাবে যে কারো সাথে বিয়ের জন্য হ্যাঁ করতে পারিস না। জোহানকে তিনি যে অন্য মেয়ের সাথে ঘনিষ্ঠ অবস্থায় দেখেছিস। তুই কি করে ওর সাথে থাকতে পারবি?”
“এছাড়া দীপার সাথে তখন ওর সম্পর্ক ছিলো। এটা ওর পাস্ট ছিলো। সবার পাস্ট থাকে।”
আই ডোন্ট ইভেন কেয়ার ও কার সাথে ছিলো। আমার এখন আর কিছু আসে যায় না। যার প্রতি আমার ফিলিংস নেই সে যাই করুক না কেন আমার কষ্ট লাগবে না। এই প্রেম-ভালোবাসা-বিয়ে এসব ফালতু কথা।”
“তুই এটা সভ্যের উপর রাগ করে করছিস। তুই নিজে বলেছিস তোর তার কথায় বিশ্বাস নেই তাহলে কেন?”
“কারণ সে লোকটা আমাকে ভালোবাসার অনুভূতি দিয়ে হারিয়ে গেছে।” তার গলার স্বর হঠাৎ করে মৃদু হয়ে আসে, “একবারও আমার খোঁজ নেয় নি। আমি আজ পর্যন্ত প্রতিরাতে তাকে কল দেই। এই আশায় যে সে কলটা ধরবে। কিন্তু সে ধরেনা। পৃথিবীর অন্য কোণে সে ঠিকই সুখে আছে। আর এদিকে আমি অচেনা এক অপেক্ষায় ভুগছি। এখনও বেনামি সম্পর্কে বেঁধে আছি আমি। যে সম্পর্কের স্বীকারোক্তি অন্যপাশ থেকেই আসে নি। এই সম্পর্কটা আমার কাছে এখন খাঁচার মতো লাগে। মনে হয় আমি এই খাঁচায় বন্দী। দম আটকে আসে আমার। অন্যকারো দাঁড়াই হোক না কেন আমি এই খাঁচা থেকে মুক্তি পেতে চাই। হোক তা জোহান। তার সাথে এখন অনেক ভালো বন্ধুত্ব হয়ে গেছে। এই বন্ধুত্ব দিয়েই জীবন কেটে যাবে। সাথে আমার মা’য়ের ইচ্ছাও সম্পূর্ণ হবে। আর আমি জানি জোহান ওদিন বাড়িয়ে বলেছে। আমাকে পাওয়ার জন্যই বলেছে। সভ্য আমার চরিত্র নিয়ে কথা বলতেই পারে না। কিন্তু একটা কথা ঠিক বলেছে। আমার ভালোবাসার মজা বানিয়ে হারিয়ে গেছে ও। এর জন্য আমি তাকে কখনোই ক্ষমা করব না। কখনো না।”
“ইনু হতে পারে সে কোনো কারণে গেছে।”
“তাই বলে সকলের সাথে দেখা করল অথচ কেবল আমার সাথে দেখা না করে যাবে? তার মনে আমাকে নিয়ে কোন অনুভূতি না থাকলে কেনো কাছে আসতো আমার? কেন এমন কথা বলতো যেন মনে হতো সে ভালোবাসতো আমায়? আমার চোখের মতো সুন্দর চোখ না-কি সে কখনো দেখে নি। প্রতিরাতে সে চোখ ভিজে তার কারণে। এ জলের মূল্য সে দিতে পারবে। আমার মাঝেমধ্যে নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে তার লেখা সে অর্ধ গানটি পড়লে। বুকে ব্যাথা করে তার স্মৃতি মনে পড়লে।” গলা কেঁপে উঠে ইনারার। সে আবার বলে, ” এভাবে ছেড়ে যেতেই হলে কেন অনুভব করাল আমি তার জন্য বিশেষ। এটা কি ধোঁকা দেওয়া না? আমার ভালোবাসার অপমান না? চোখে চোখে হাজারো আশা দিয়ে আমাকে নিঃস্ব করে চলে গেছে সে। সে মানুষটাকে আমি ক্ষমা করব? অসম্ভব!”
“ইনু আমার কথা শুন।”
“সুরভি আমি আর কোন কথা শুনতে চাই না। জোহানের সাথে আমি বিয়ে করবো। নিজের ভালোবাসাকে সুযোগ দিয়ে দেখে নিয়েছি। সে ভালবাসা অসমাপ্ত থেকে গেছে। এখন না হয় আমার মায়ের শেষ ইচ্ছাটাই পূরণ করি।”
সুরভী দীর্ঘশ্বাস ফেলল। সে জানে ইনারাকে বুঝিয়ে লাভ নেই। সে একবার জেদ ধরলে তার সিদ্ধান্ত পাল্টানো যাবে না। আর কি বলে সে আশ্বাস দিবে? অপেক্ষা করতে বলবে? পাগলের মতো সভ্যের খোঁজ করল ইনু। কিন্তু ফলাফল শূন্য।

সে রাতে সুরভি ঘুমিয়ে পড়ে। কিন্তু ঘুম নেই ইনারার চোখে। আজকাল রাতে তার ঘুম আসে না। নির্ঘুম কাটে সারারাত। রাতের নিরবতা ভয়ঙ্কর লাগে তার কাছে। সভ্যের সাথে তার স্মৃতিগুলো চোখের সামনে ভাসতে থাকে। আচ্ছা, রাত এত ভয়ঙ্কর হয় কেন? মানুষ দিনে তার সকল অনুভূতি যে সিন্দুকে আটকে রাখে, রাতে সে বিনা অনুমতিতে সে অনুভূতি সিন্দুক থেকেই বেরিয়ে এসে তাকে গভীরভাবে বশ করে নেয়। হাজার চেয়েও সে অনুভূতি সিন্দুকে ভরে রাখতে পারে না মানুষ। একাকিত্বতায় যেন আবেগ নামক ভয়ঙ্কর জিনিস আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে।

সুরভির দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে ইনারা। তারপর ফোন হাতে নিয়ে কল দেয় সভ্যকে। ফোন অফফ। প্রতিদিনের মতো। সে উঠে যায় বারান্দায়। তার হাতের মুঠোয় সভ্যের লেখা গানটা। সে কাগজে এক বিন্দু অশ্রুজল পরে। ভেজা অংশটার দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো ইনারা। তার বুক চিরে বেরিয়ে এলো দুঃখ-নিঃশ্বাস। সে আকাশের দিকে তাকালো। বলল, “আহা প্রণয়ী!”
.
.
আরও দুইমাস কেটে যায়। ইনারার শুটিং শুরু হয়েছে। সে একটা এডও করেছে। প্রতিদিনই তার কাজ থাকে। তাই সকাল সকাল বের হতে হয়। রাতেও ঘুম হয় না তার। কিন্তু আজ তার ছুটি। তাই একটু ঘুমাচ্ছে সে। কিন্তু এ ঘুমও কপালে জুটে না তার। ফোনের রিং বেজে উঠে। সে ঘুমঘুম চোখে কল রিসিভ করে কানের কাছে নিয়ে বলে, “হ্যালো।”
“ইনু…তুই ঘুমাচ্ছিস?”
“হুঁ আজ শুটিং নেই। তোর সকাল সকাল কী হলো? কল দিচ্ছিস কেন?”
“তুই খবর শুনিস নি? নিউজ চ্যানেল যেয়ে দেখ জলদি।”
“ধ্যুর ঘুমাতে দে তো। এভাবে বলছিস যেন আকাশ ভেঙে পরছে।”
সুরভী চিন্তিত কন্ঠে বলল, “তাই ভেবে নে। সর্বনাশ হয়ে গেছে ইনু।”

চলবে…..

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে