অনুভবে
পর্ব-২৬
নিলুফার ইয়াসমিন ঊষা
“কি’রে তোর মনের রাণী এখনো এলো না?” সভ্য কোল্ড ড্রিংক এর গ্লাসে চুমুক দিতে নিবে তখনই সামি কথাটা বলল। মজা নেবার উদ্দেশ্যে। সভ্য তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকায় তার থেকে, “এক সপ্তাহ ধরে কি শুরু করেছিস তুই? তোকে বারবার ওয়ার্নিং দিচ্ছি। ভালো হবে না কিন্তু।”
“আহা আমি কি ভুল কিছু বলছি না’কি? আর প্রেমে পড়লে আধ একটু শুনতেই হয়।”
“তোকে কতবার বলেছি ওকে আমার ভালো লাগে। ভালোবাসা না’কি এখনো তো জানিনা। কি অনুভব করছি বুঝতে পারছি না।”
“অনুভবও করতে পারবি। এত তাড়া কিসের? না তুই কোথায় পালিয়ে যাচ্ছিস, আর না ইনারা। ভালো কথা, আসলে কোথায় আমার পার্টনার? ওকে ছাড়া মজা পাই না। তোরা সবাই এক একটা বোরিং-সোরিং মানুষ। তোদের সাথে থাকতে ভালো লাগে না।”
“আমাদের সাথে তোর ভালো লাগবে কি করে? পাগলের সাথে তো পাগলেরই ভালো লাগে তাই না?”
“হ্যাঁ তা ঠি…” সামি আনমনে উওর দিতে নিয়েই সচেতন হয়ে যায়। সে চোখ দুটো বড় বড় করে তাকায় সভ্যের দিকে, “তুই খবরদার আমাদের ইজ্জত মারবি না।”
“উফফ তুই ওর সাথে থাকবি না তো। ওর মতো ভাষা হয়ে যাচ্ছে তোর। এসব ভাষা আমার পছন্দ না তুই জানিস।”
“কিন্তু যে এসব ভাষায় কথা বলে তাকে তো ঠিকই পছন্দ।”
“আরেকবার এই কথাটা বললে তোর খবর আছে। দেখে নিস।”
“কোন চ্যানেলের খবরটা একটু বলে দিস। আর এখন খবর নে তোর সে অগুছালো মনধারিণী কোথায়? আচ্ছা ওকে আজও ওকি হুডি আর প্যান্ট পরে আসবে?”
“আসলেই বা সমস্যা কোথায়?”
“ভাই বুঝলি ওকে দেখলে আমার ব্রো ব্রো ফিলিংস আসে। সারাক্ষণ যেভাবে থাকে মেয়ে মনেই হয় না। তুই ওর প্রেমে কীভাবে পড়লি বুঝাটা কষ্টকর কিন্তু আমি অনেক হ্যাপি তোদে….” কথা বলতে বলতে থেমে যায় সামি। তার চোখ দুটো বড় বড় হয়ে আসে। সে বারবার পলক ঝপকায়, তারপর চোখ ঢলে নেয়। এটা কি আসলে স্বপ্ন না কল্পনা সে বুঝতেই পারছে না। সে সভ্যের হাত ধরে তার হাত নাড়িয়ে বলল, “ভাই আমাকে চিমটি কাট। আমি কি স্বপ্ন দেখছি না’কি জাগত আছি বুঝতে পারছি না।”
কোনো প্রশ্ন না জিজ্ঞেস করে সভ্য তাকে চিমটি কেটে দেয়। সাথে সাথে সামি লাফিয়ে উঠে। সভ্যকে বলে,”আসলে দিতে বলি নি। আচ্ছা এটা বাদ দিয়ে সামনে দেখ। দেখ এটা কি আসলে ইনারা?”
সভ্য সামির কথায় তার ডানদিকে ফিরে। দোয়ার দিকে প্রবেশ করছে এক কন্যা। তার পরায় এক মিষ্টি গোলাপি রঙের পোশাক। সোনালী রঙের সাজে তার ফর্সা রঙের দেহ অন্যরকম এক উজ্জ্বলতা ছড়িয়ে আছে। তার চারপাশে যেন নূর ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। তার আঁকাবাঁকা সোনালীমাখা চুলগুলো ছড়িয়ে আছে তার পিঠে। তার চুলগুলো সভ্যের ভীষণ পছন্দের। সে চুলে আজ শুভ্র ফুলের সাথে কিছু সোনালী গহনা পরেছে ইনারা। যা তার কেশগুলো সৌন্দর্য হাজারোগুণ বেশি বাড়িয়ে তুলেছে। কেশের সাথে তার পছন্দ ইনারার চোখদুটো। দূর থেকে সে নীলাভ দৃষ্টির দর্শন প্রায় অসম্ভব। একটু কাছে যেয়ে তার চোখে চোখ মিলিয়ে দেখবে কী?
ভাবতে না ভাবতেই সামি তার কাঁধে হাত রেখে অস্থির সুরে বলল, “ভাই তুই ঠিক আছিস? ঠিক আছিস তুই? না, তুই কীভাবে ঠিক থাকবি! ইনারাকে এভাবে দেখে আমারই অজ্ঞান হবার মতো অবস্থ তুই কীভাবে ঠিক থাকবি?”
“এত ঢঙ করছিস কেন? যেন ওকে আগে আর দেখিস নি।”
“দেখেছি বলেই তো এমন করছি। ছেলেদের মত ঘুরাঘুরি করে এই মেয়েকে হঠাৎ করে এমন পরীর মতো দেখালে আর কী প্রতিক্রিয়া দেখাব। তুই এমন রিয়াকশন কীভাবে দিচ্ছিস না? আমার থেকে তো তোর বেশি অবাক হওয়া উচিত। আমার তো এখন ওর প্রতি ভাই ভাই ফিলিংস এসে পড়েছে। কিন্তু তুই তো।এমনিতেই ওর উপর ফিদা। তুই করা না এমন রিয়াকশন দিচ্ছিস না?”
“এত ড্রামাটিক হওয়ার প্রয়োজন নেই। প্রতিদিনের সুন্দর দেখায়। আজ একটু বেশি দেখাচ্ছে। এইতো।”
“তোর ওই ছেলেদের মতো পরিধান করাটা সুন্দর লাগে?”
“তোমার যা পরিধান করে নিজের কাছে নিজের প্রতি আত্নবিশ্বাস সবচেয়ে বেশি বাড়ে তাতেই তোমাকে সবচেয়ে বেশি সুন্দর দেখায়। আর ইনারা লোকদেখানো কাজে বিশ্বাসী না তাইতো ওকে মনে ধরেছে। এছাড়া আমার সাথে যখন ওর প্রথম দেখা হয় তখন ও সেজেগুজেই এসেছিলো।”
“কী বলিস তুই? সে এক নজরে তুই ওর প্রেমে না পড়ে ওর ওই হুডি পরা বেশের উপর প্রেমে পড়েছিস? ওয়েট তুই তো প্রথম দেখার পর ওকে দুই চোখে সহ্যও করতে পারতি না।”
“কি বললাম এতক্ষণ? আর ড্রেস পাল্টালেই তো আর মানুষ পালটে যায় না। মানুষের সৌন্দর্য তার পরিধানে নয়, তার মাঝে।”
.
.
ইনারা দরজা থেকে প্রবেশ করার সময় খেয়াল করে রুমের প্রায় সকলে তার দিকেই তাকিয়ে আছে। তার সাথেই হাঁটছিল প্রিয় এবং সুরভী। সে তাদের দিকে ঝুঁকে জিজ্ঞেস করে, “আমাকে কি বেশি কার্টুন কার্টুন লাগছে? সকলেই এভাবে তাকিয়ে আছে কেন?”
“যাহ বাজে কথা বলবি না। অনেক সুন্দর দেখাচ্ছে। তাই সকলের দৃষ্টি তোর দিকে।”
“থেকেই বা লাভ কি? আগে যাকে দেখাতে চাইতাম সে তো এখন এক শাঁকচুন্নির প্রেমে পড়ে বসে আছে। তার প্রতি আর ইন্টারেস্টও নেই।”
কথাটা শুনে সুরভি হাসলো। কিন্তু প্রিয় বিবাদ করে বলল, “দেখ দীপার নামে কিছু বলবি না। ও আমার পছন্দ অভিনেত্রী।”
“যদি সে আজকে আমার মেজাজ খারাপ করে তাহলে তোর পছন্দের অভিনেত্রীর সাথে তোকেও জুতাপেটা করব। আর ওই দেখ তোর পছন্দের অভিনেত্রী আমাকে দেখে কেমন লুচির মতো ফুলছে। আহ কি শান্তি! সারা জীবন কোন ছেলের জন্য এত সাজগোজ করলাম না। যা এই শাঁকচুন্নিকে জ্বালাতে করেছি। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে ভালোই করলাম। জ্বলছে, পুড়ছে আর লুচির মতো ফুলছে। আর এদিকে আমার কত শান্তি শান্তি লাগছে। একেই বলে নীরব প্রতিশোধ।”
“তুই একটা জিনিস বুঝলি। সেদিন তো তুই ওর মুখের উপর উত্তর দিলি। তবুও তোর পেট ভরল না। আজ আবার এভাবে জ্বালাতে এলি।”
“তুই বুঝবি নারে, বুঝবি না। ইনারাকে যা তা বলে এত সহজে রেহাই পেয়ে যাবে তা হতেই পারে না। সে-ও বুঝুক ইনারাকে যে জ্বালানোর সাহস করে, ইনারা তাকে সহজে ছেড়ে দেয় না। তাকে দশগুণ বেশি জ্বালিয়ে ছাড়ে। আমার সাথে পাঙ্গা, করে দিব তার অহংকার ঠান্ডা ঠান্ডা।”
“তোর কথার আগা মাথা কিছু বুঝার মতো ক্ষমতা আমাদের নেই।” সুরভি বলে। সে আরও যোগ করে, ” এখানে এত সেলিব্রিটি দেখে তো আমি অজ্ঞান হয়ে যাব। আচ্ছা শুন, পঞ্চসুরের সাথে কখন পরিচয় করাবি? আমার হাত পা ঠান্ডা হয়ে আচ্ছে। আচ্ছা আমাকে ঠিক লাগছে তো?”
“আরে ধ্যুর, ওদের সাথেই দেখা করতে যাচ্ছিস। এখানে কুইন ভিক্টোরিয়া এসে তো তোর সঙ্গে দেখা করবে না যে এত ভয় পাচ্ছিস।”
“আগে তুই জোহানের নাম শুনে কি করতি তা ভুলে গিয়েছিস? মনে করাব কী?”
ইনারা লজ্জিত হবার ভয়ে তাড়া দিয়ে বলল, “এই তোরা দাঁড়িয়ে সময় নষ্ট করিস নাতো। আয় আয়।”
সভ্য ইনারার দিকে এগিয়ে যাবার পূর্বেই এসে দেখে মেয়েটা তার দিকেই এগিয়ে আসছে। গাউনে আজ একটু হলেও ভিন্ন দেখাচ্ছে। কোন দেশের রাজকন্যা লাগছে যেন। সে কল্পনা করল, হাজার ফুলের সমাহার একটি খোলা আকাশের নিচে। সে ফুলের মাঝারে এমন ভাবে সেজে বসে আছে ইনারা। প্রিন্সেসের মতো। তার দেহে জড়ানো গয়নাগুলো ফুলের। তার খোলা লম্বা আঁকাবাঁকা কেশে ফুল লাগানো। সে ফুলের আশেপাশের প্রজাপতিরা নেচে বেড়াচ্ছে। হঠাৎ করে একটি প্রজাপতি এসে বসে তার আঙ্গুলের ডগায়। সাথে সাথে একগাল হাসে সে। কিছু শব্দ আসে। ঘোড়ার শব্দে প্রজাপতিটা আঙুল থেকে উড়াল দেয়। তার উড়ে যাওয়া দেখে নীলাভ দৃষ্টি তুলে প্রিন্সেস ইনারা। সাথে সাথে সে দেখতে পায় ঘোড়ায় চড়ে আসছে এক প্রিন্স।
ঘোড়া থামে। তার চক্ষুর সামনেই ঘোড়া থেকে নেমে আছে এক রাজপুত্র। তার দিকে হাত এগিয়ে বলে, “প্রিন্সেস ইনারা আমার হৃদয়ের ক্যাসেলের মহারাণী হবেন আপনি?”
প্রিন্সের চেহারাটা সভ্য কল্পনা করতে পারল না। কিন্তু তার খুব করে ইচ্ছা হয় যেন প্রিন্সটা সে-ই হয়। তাই সে এগোয় ইনারার দিকে। তার হাতটা চাইবে আজকের সভার প্রথম ডান্সের জন্য।
যে ভাবা সেই কাজ। সে-ও এগোয় ইনারার দিকে। কিন্তু সেখানেই থেমে যায়। সে দেখে জোহান এসে দাঁড়িয়েছে ইনারার সামনে। এই এক দৃশ্যই তার মন উদাসীন করতে যথেষ্ট ছিলো। কেন যেন আর সামনে এগোতে ইচ্ছা হলো না তার। সামনে এগোতে পারলো না। পা পিছিয়ে নিলো সে। দেখতে থাকলো এখন কি করে ইনারা।
.
.
জোহান এই প্রথম তার বাবার কথা না ভেবেই ইনারার কাছে যায়। সে ইনারার সামনে এসে দাঁড়িয়ে অস্থির হয়ে তাকে পা থেকে মাথা পর্যন্ত যাচাই করতে থাকে। তার বিশ্বাস হচ্ছে না এটাই ইনারা। সে অমার্জিত, অগোছালো মেয়েটিই তার স্বপ্নচারিনী। কিন্তু এ মুহূর্তে সে সকল কথা বাদ দিয়ে ইনারার সৌন্দর্য যাচাইয়ে ব্যস্ত সে। তার মনে হচ্ছে সাক্ষাৎ কোন অপ্সরা স্বর্গ থেকে নেমে এসে তার সামনে দাঁড়িয়েছে। সে যেন নিঃশ্বাস নিতে ভুলে গেল। তার হৃদয়ের স্পন্দন সেখানেই থেমে গেল। এ তো তার স্বপ্ন থেকেও সুন্দর দৃশ্য।
জোহান নিজেকে সামলে গলা পরিষ্কার করে বলল, “তোমাকে আজ অন্যরকম লাগছে।”
মিষ্টি হাসে ইনারা, “থ্যাঙ্কিউ।”
“তুমি আগে কোনোদিন এভাবে আসলে না কেন?”
“এভাবে? বলেন কি? আমার দম বন্ধ হয়ে আসতেছে। মানুষ এসব পরে কীভাবে? আমার তো মন চায়তেছে এখন দৌড়ে বাসায় যেয়ে আমার গেঞ্জির ভেতর ঢুকি। বাই দ্যা ওয়ে, ওরা আমার বন্ধু। সুরভি ও প্রিয়। আপনাদের দলের অনেক বড় ফ্যান।”
“তাই না’কি? নাইস টু মিট ইউ।”
সুরভি ও প্রিয় উৎসুকতায় কথা বলতে পারে না। যদিও সভ্য তাদের ফেভারিট। কিন্তু দেশের সবচেয়ে বড় গানের দলের সদস্য তাদের সাথে কথা বলছে এতটুকুই শ্বাস রুদ্ধ করার জন্য যথেষ্ট। কিন্তু তবুও তারা নিজেকে সামলে কিছু বলতে যাবে এর পূর্বেই জোহান ইনারাকে বলে, “তোমার সাথে আমার কিছু কথা আছে।”
“আমার সাথে? পরে বলি? আমার বন্ধুরা…”
“প্রয়োজনীয় কথা আছে। বেশি সময় লাগবে না।”
“আমি ওদের এভাবে একা ছেড়ে যেতে পারি না।”
জোহান এবার বিরক্ত হয়। তার মনে, মস্তিষ্কে কি চলছে সে নিজেও বুঝছে কিন্তু সে এতটুকু জানে এই মুহূর্তে সে ইনারার সাথে কথা বলতে না পারলে, শান্তি পাবে না। সে ইশারায় ইনারার বাবা ও আইজাকে দেখিয়ে বলল, “ওটা তোমার বোন না? সে যদি মুশতাক স্যারের ভাগ্নি হয় তাহলে তুমি মধ্যবর্তী পরিবারের মেয়ে কিভাবে হও?”
আইজা এবং নিজের বাবাকে দেখে চমকে উঠে ইনারা। সে জানতো আজ আইজা আসবে কিন্তু তার বাবা যে দেশে আছে এটা তো সে জানে না। সে ঘাবড়ে তাকাল জোহানের দিকে।
সাথে সাথে জোহান মৃদু হাসে। বলে, “চিন্তা করার কারণ নেই। আমার কেবল কিছু প্রশ্নের উওর লাগবে। আসো।”
জোহান হাত ধরে নিয়ে যায় ইনারাকে। দূর থেকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে সভ্য। তার চোখ যেন সরে না ইনারার হাত থেকে। এই দৃশ্যে কেমন চিনচিন ব্যাথা জাগে তার বুকের মাঝারে। সামি তার পাশ থেকে বলে, “দোস্ত আমার তো মনে হচ্ছে ইনারাই জোহানের স্বপ্নচারিণী। মেয়েটাকে গতমাসে কনসার্টে দেখার পর থেকে পাগল হয়ে গেছে। অফিসে ইনারাকে দেখে তাকে চিনলেও বিশ্বাস করতে চাইছিল না যে মেয়েটা আসলেই কনসার্টে দেখা মেয়েটা। তার ড্রেসাপ আর স্বভাবের জন্য। কিন্তু আজ এই সাজে বুঝতে পারছে মনে হয়। একারণেই এভাবে নিয়ে গেল। তুই ওকে থামাচ্ছিস না কেন?”
সভ্য কেমন কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, “ইনারার যা ইচ্ছা ও তাই করতে পারবে। ওকে থামানোর মতো আমার কোনো অধিকার নেই।”
.
.
জোহান ইনারাকে একপাশে নিয়ে যায়, “সত্যি বলো। আসলে কে তুমি?” প্রশ্নটা করে সে ইনারাকে।
ইনারা ঘাবড়ে যায়। সে ভাবে বলবে এটা আসলে তার বোন আইজা নয়। বাহানাটা সে করতে যাবে এর পূর্বেই জোহান বলে, “এটা বলবে না যে আইজা তোমার বোন না। ও আমার সামনে মোশতাক স্যারকে তোমার কথা বলেছে।”
এবার আসলেই ঘাবড়ে যায় সে। হার মেনে বলে, “হ্যাঁ, আইজা আপু আমার বোন এবং আমি মোশতাক আবরারই মেয়ে।”
চোখ দুটো যেন কোটর থেকে বেরিয়ে আসতে চাইলো জোহানের। সে যদিও বুঝতে পেরেছিলো যে মোশতাক সাহেবের সাথে ইনারার কোনো সম্পর্ক আছে কিন্তু ইনারা যে মোশতাক সাহেবের মেয়ে তা সে বুঝতে পারে নি। বিস্ময়ে গলা দিয়ে কথা বের হতে চাইছিলো না জোহানের, “এ-এর মানে তুমি অভিনেত্রী সাইয়ারার মেয়ে?”
ইনারা মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ উত্তর দেয়। জোহান আরও ধ্যান সহকারে দেখল তাকে। এতে দ্বিমত নেই যে অভিনেত্রী সাইয়ারার মেয়ে সে হতে পারে। অভিনেত্রী সাইয়ারা তার সৌন্দর্যের জন্য বিখ্যাত ছিলেন। সে সৌন্দর্যই ভেসে উঠছে ইনারার মুখেতে। এ সৌন্দর্য আগে খেয়াল করেনি কেন সে! কেন আগে চোখে পড়েনি অপরূপ সৌন্দর্যের দৃশ্য।
জোহান হঠাৎ করেই ইনারার গালে হাত রেখে। ইনারার চোখে চোখ রেখে বলল ” আর কোথায় যেন তোমাকে দেখেছি আমি! হ্যাঁ, মনে পড়েছে। শ্রীমঙ্গলে। সে রাতে তুমি তো আমার সাথে ছিল তাই না? মা যে সারু আন্টির কথা বলেছিলো। সে-ই কী অভিনেত্রী সাইয়ারা?”
ইনারা খানিকটা অসস্থি বোধ করে। সাথে সাথে পিছিয়ে যায় সে। উওর দেয়, “জি, বাবা কাউকে আমার পরিচয় দিতে মানা করেছে।”
ইনারার এমন পিছিয়ে যাওয়াটা অপছন্দ হয়েছে জোহানের। অন্যকেউ হলে তার ভীষণ রাগ উঠতো। কিন্তু ইনারার সুন্দর মুখটা দেখে কি সে রাগ করতে পারে? নাহ, অসম্ভব!
এমন সময় এসে হাজির হলো দীপা। একতো ইনারার এরূপ দেখে সে হতভম্ব। এরচেয়ে বেশি ক্রোধিত। আজ কোনো নারীর উপর সকলের দৃষ্টি আটকে থাকতে হলে কেবল তার উপরই আটকে থাকা উচিত। অথচ দোয়ার দিয়ে প্রবেশ করতেই সভার মধ্যমণি হয়ে উঠলো ইনারা। দুজনকে একত্রে এভাবে দেখে তোর মাথা ঠিক রইল না। রাগে ক্ষোভে ফোঁপাতে শুরু করলো। এসে বলল, “হচ্ছেটা কী এখানে?” সে আবার ইনারার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে, “আমার বয়ফ্রেন্ডকে নিজের দিকে আকর্ষণ করার জন্য আজ এত সেজে এসেছ তাই না?”
এবার আসলেই বিরক্ত হয় ইনারা, “আপনার যা ইচ্ছা ভাবতে পারেন। আমি যদি আপনাকে বলি এখানে আমার হুডি আর প্যান্ট পরে ঢুকতে দিবে না, তা কি বিশ্বাস করবেন? না। তাহলে বলে লাভ কী? আমি বরং যাই।”
ইনারা যেতে নিলেই জোহান বলে উঠে, “দীপা প্লিজ। আমাদের ব্রেকাপ হয়ে গেছে। এখন তুমি এ তামাশা না করলেও পারো।”
কথাটা শুনে এক মুহূর্তের জন্য থেমে যায় ইনারা। পিছনে ফিরে একপলক জোহানের দিকে তাকিয়ে আবার সামনে এগিয়ে যায়। চলে যায় সেখান থেকে।”
দীপা বিস্মিত সুরে বলে, “এ কী বলছ তুমি? আমাদের ব্রেকাপ কবে হলো?”
“আজ। এই মুহূর্তে।”
“না, তুমি এমনটা করতে পারো না। এসব ওই মেয়ের জন্য হচ্ছে তাই না?”
“তাই ধরে নেও।”
“জোহান! এর পরিণাম ভালো হবে না কিন্তু।”
জোহান তাচ্ছিল্য হাসে। দীপার দিকে ঝুঁকে তার কানের কাছে এসে বলে, “পরিণাম তোমার খারাপ হতে পারে। কাজের জন্য কত পরিচালক এবং প্রাডিউসারের সাথে শুয়েছ তা ভাইরাল না করতে চাইলে চুপচাপ থাকো। এদিকে তোমার মুখ দিয়ে একটা শব্দ বের হবে ওদিকে তোমার ক্যারিয়ার শেষ।”
জোহান মাথা তুলে। দীপার চেহেরায় অবিশ্বাস্য ভাব দেখে হাসে সে। চোখ টিপ মেরে আবারও সে ইনারার পিছনে যায়।
ইনারার পিছনে ছুটে যেয়ে তার হাত ধরে নেয়। তখনই এনাউন্সমেন্ট হয়, “আজকের সভায় কতগুলো তারকা আছে যারা সভার উজ্জ্বলতায় তারা সাজিয়ে দিয়েছে। চলুন, এই সভাটা আরও সুন্দর করা যায়। আজকের দিনের প্রথম পার্ফোমেন্সটা যেহেতু বিশেষ। একটি বিশেষ ব্যক্তি দ্বারাই তা শুরু করা হোক। সবাই তালির সাথে স্বাগতম করুন আমাদের সকলের প্রিয় সভ্যকে।”
সভ্যের দিকে সকলের দৃষ্টি যে আটকায়। আজ নীল রঙ্গের স্যুটে তাকে কোনো দেশের রাজপুত্র থেকে কম দেখাচ্ছে না। সে যখন হেঁটে হলের মাঝখানে আসছিলো পার্ফোমেন্সের জন্য তখন কারও পলক সরানোর মতো সাহস হলো না। মাঝে এসে দাঁড়াতেই এনাউন্সমেন্ট করা মেয়েটা জিজ্ঞেস করে, “তো আমাদের সকলের মনের প্রিন্স, আপনি আজকের নাচ প্রদর্শন করে আমাদের সকলের মন আবারও কেড়ে নিতে তৈরি তো?”
মেয়েটি মাইক নেয় সভ্যের মুখের কাছে। সভ্য এক মুহূর্ত ভাবে। তারপর তাকায় ইনারার দিকে। আবার তার হাত রাখা জোহানের হাতকে। কিন্তু এবার রাগান্বিত না হয়ে সে শান্ত স্বরে বলে, “প্রিন্স কী তার প্রিন্সেসকে ছাড়া নাচ শুরু করবার দুঃসাহস করতে পারে? কী প্রিন্সেস আপনি কী তৈরি?”
ইনারা সভ্যের কথায় চমকে উঠে। মুহূর্তে এবার সকলের দৃষ্টির আটকায় তার উপর। চারদিকের বাতি বন্ধ হয়ে যায়। কেমন এক গোলাকৃতি আলো এসে পরে সভ্যের উপর। সে এগোয় ইনারার দিকে। আলোটিও তাকে অনুসরণ করে। এতটুকু সময়ে এক মুহূর্তের জন্যও সভ্য তার দৃষ্টি সরায় না। তাকিয়ে রয় ইনারার দিকে। সে দৃষ্টি দিয়েই যেন হৃদয়ে আঘাত করবে।
সে ইনারার সামনে যেয়ে এক হাঁটু গেড়ে বসে হাত এগিয়ে দিয়ে বলে, “প্রিন্সেস, আজকের প্রথম নাচটা কী আমি আপনার সাথে করতে পারি?”
ইনারা খানিকটা অবাক হয় সভ্যের এমন আচরণে। আবার লজ্জাও পায় বটে। তবুও সে কোনো দ্বিধাবোধ না করেই জোহানের হাত থেকে হাত সরিয়ে নেয় এবং হাতটা রাখে সভ্যের হাতের মাঝে। সাথে সাথেই সভ্য তার হাতটা শক্ত করে ধরে নেয়।
চলবে…..
অনুভবে
পর্ব-২৭
নিলুফার ইয়াসমিন ঊষা
ইনারা খানিকটা অবাক হয় সভ্যের এমন আচরণে। আবার লজ্জাও পায় বটে। তবুও সে কোনো দ্বিধাবোধ না করেই জোহানের হাত থেকে হাত সরিয়ে নেয় এবং হাতটা রাখে সভ্যের হাতের মাঝে। সাথে সাথেই সভ্য তার হাতটা শক্ত করে ধরে নেয়।
সভ্য উঠে দাঁড়ায়। ইনারার হাত ধরে তাকে নিয়ে যায় হলের ঠিক মাঝখানে। সে গোলাকৃতি আলোটা এখনো তাদের উপরই স্থির। গান বাজে।
“ডুবে ডুবে ভালোবাসি
তুমি না বাসলেও আমি বাসি…..”
এই ডুবে যাওয়া ভালোবাসার গানের সুরের মাঝে দু’জনে ডুবে গেল একে অপরের মাঝারেতে। প্রেমের সুরভি ছড়িয়ে গেল চারপাশে। সভ্য তার বাহুতে আবদ্ধ করে ইনারাকে। তার নীলাভ চোখের মাঝারে হারিয়ে তার মনে হয় যেন গভীর কোনো সমুদ্রে ডুব দিচ্ছে। সে সাগরের মতো নয়নে আঁকা নীল কাজল। যা তার দৃষ্টির মায়া হাজারোগুণ বাড়িয়ে দিলো।
নাচের তালে তাকে দূরে যেতে দিতে হলেও কেন যেন এত দূরত্বটাও শ্বাসরুদ্ধকর মনে হলো সভ্যের কাছে। ইনারাকে ঘুরিয়ে তার পিঠ নিজের বুকে ঠেকাতেই চুলের মাঝের থেকে ভেসে আসা সুরভী পেল সে। কেমন মিষ্টি নেশা ধরানোর মতো সুরভি। সাথে সাথে সে নিজের নাচের স্টেপ ভুলে গিয়ে নিজের মতো করে নাচ শুরু করে। আচমকায় ইনারাকে নিজের দিকে ফিরায়। মেয়েটা বিস্মিত! হঠাৎ এভাবে তাকে ঘুরিয়ে নেওয়ায় ইনারা বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকায় সভ্যের দিকে। হঠাৎ করে যে তার কি হয়ে যায়। সে বুঝতে পারে না।
সভ্য আলতো করে তার গাল ছুঁয়ে দিতেই চোখ বন্ধ করে নেয় সে। সভ্য তার গাল থেকে ছুঁয়ে যেতে যেতে কাঁধে, এরপর হাতের উপর হাত বুলিয়ে তার আঙ্গুলের মাঝে আঙুল আবদ্ধ করে নেয়। আর গানের সুরে আপন মনে নাচের তাল মেলাতে থাকে। অবশেষে গানের শেষ দিকে সভ্য ইনারাকে ছেড়ে পিঠ করে হাঁটতে থাকে।
সকলে হতভম্ব। এ কি হচ্ছে! হঠাৎ এভাবে নাচের প্রদর্শন ছেড়ে যাওয়াটা যে বেমানান। কেউ তো এটা আশা করে নি। আর সভ্যই-বা এমনটা করছে কেন? সকলেই এই ভাবনার চুড়ান্ত ঘোরে হারানোর পূর্বেই সভ্য থেমে যায়। পিছনে ইনারার দিকে ফিরে দুই হাত মেলতেই ইনারা তার গাউনটা একটুখানি উঠিয়ে দৌড়ে ছুটে আসে সভ্যের বাহুডোরে। এখানেই তাদের নাচের প্রদর্শন এর সমাপ্তি ঘটে।
এভাবে দৌড়ে এসে যেন ইনারার ভারি মজা লেগেছে। সে খিলখিলিয়ে হেসে উঠে। হাসতে হাসতেই সে তাকায় সভ্যের দিকে। সে কেমন চাহনি! চেহারাটা দেখলেই বুকের ভিতর কেমন যেন করে উঠে। চোখে চোখ মেলে। হয় মধুর দৃষ্টি মিলন। সভ্য ইনারাকে মেঝেতে দাঁড় করানোর সময়ও একে অপর থেকে চোখ সরেনা। ঘোর লেগে আছে দুজনের। সে ঘোর ভাঙ্গে ভিড়ের হাত তালির সাথে। তাদের নামের চেঁচামেচি শুরু হয়ে গেছে সভায়। সভার লোকেরা তাদের জুটিটা খুবই পছন্দ করেছে। সবাই প্রশংসায় পঞ্চমুখ।
তবে সেগুলো সকলের যেন পছন্দ হয় নি। এর মধ্যে একজন হলো জোহান। রাগে তার মাথার রগটা লাফাচ্ছে। দাঁতে দাঁত চেপে, মুঠোবন্দী করে সে তাকিয়েই আছে দুইজনের দিকে। সে দৃষ্টি অগ্নিময়। সাথে সাথে সে ভিড় থেকে বের হয়ে কক্ষের শেষ মাথায় প্রস্থান করে। রাগে ফোঁপাচ্ছে সে। একটি টেবিলে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করলো। এই ভিড়ের মাঝে সে কোনো তামাশা করতে পারে না। কিন্তু তার রাগে নিয়ন্ত্রণ আসলো না। সে তার হাতের কাছে থাকা টেবিলটা এক ঝটকায় নিচে ফেলে দিলো।
তার চোখের সামনে ভেসে উঠলো আবারো সভ্য এবং ইনারার কাছে থাকার দৃষ্টিটা। যতক্ষণ সে কেবল সভ্যের পছন্দের পাত্রী ছিল ততক্ষণও ব্যাপারটা মানা যেত। কিন্তু এখন! এখন তো সে জানে ইনারাই তার স্বপ্নচারিনী। যার জন্য নিদ্রাহীন কতগুলো রাত কাটিয়েছে সে। যে নারীটি তার সপ্নের রূপসী থেকেও সুন্দরী। তাকে এভাবে ছেড়ে দিতে পারে না। হঠাৎ তার মাথায় একটু বুদ্ধি আসলো। সে তার পকেট থেকে ফোন বের করে কল দিলো তার মা’কে,
“হ্যালো আম্মু!”
“আরে বাবা জোহান, তুই কীভাবে কল দিলি? সব ঠিক আছে তো? তুই ঠিক আছিস তো বাবা?”
“আমার কিছু হয় নি। শুনো তুমি জলদি করে তৈরি হয়ে পার্টিতে এসে পরো। আমি গাড়ি পাঠাচ্ছি।”
“আমি আসব! কিন্তু তোর বাবা যে রাগ করবে?”
“তা তোমার চিন্তা করতে হবে না। আমি সামলে নিব। আমি, বাবা, ঐশি সবাই আছি। তুমি না থাকলে কেমন দেখায়! এছাড়াও তোমার জন্য একটি স্যারপ্রাইজ আছে।”
“বলিস কি বাবা! তুই বললে আমি আসবো না। অবশ্যই আসবো। এখনই আসছি আমি।”
.
.
অন্যদিকে,
নাচ শেষে অনেকেই সভ্য এবং ইনারাকে ঘিরে দাঁড়ায়। অনেক বড় বড় সেলিব্রিটিও। কিন্তু তার দৃষ্টি খুঁজে তার বন্ধুদের। তাদের জন্য এসব এমনিতেই নতুন, এর উপর দুইজনকে এমন অচেনা পার্টিতে একা ছাড়ায় চিন্তা হচ্ছিল ইনারার। তাদের খুঁজে পাবার পর সে সভ্যের কানের কাছে এসে বছর, “আমার বন্ধুরা আছে তো আমি তাদের কাছে যাই। আপনি একটু ফ্রী হলে আসবেন। ওরা আপনার এবং পঞ্চসুরের অনেক বড় ভক্ত। দেখা করতে চায়।”
বলে ইনারা যেতে নিলেই সভ্য তার হাত ধরে নেয়। ইনারা অবাক হয়ে তাকায় সভ্যের দিকে। সে বলে, “আমাদের ফ্যান হলে তো আমাদের সবার আগে দেখা করা উচিত। ওয়েট করো।”
সভ্য সামি, ঐশি এবং ইরফানকে নিয়ে ইনারার সাথে যায় প্রিয় এবং সুরভির সাথে দেখা করবার জন্য। তাদের দেখেই তো দুইজন বরফ হয়ে যায়। অস্থিরতা ছড়িয়ে যায় দুজনের মাঝে। পঞ্চসুরের সকলের সাথে দেখা করার সুযোগ পেয়েছে তারা বিশ্বাসই করতে পারছে না।
সভ্য হ্যান্ডশেকের জন্য হাত বাড়িয়ে বলে, “হ্যালো। ইনারা অনেক কথা বলে তোমাদের। কেমন আছো?”
সুরভির তো কাঁপা কাঁপি শুরু হয়ে গেছে। তার এমন অবস্থা দেখে ইনারা বলল, “ভাই এত ঢঙ করার কী আছে? উনি তো মানুষই তাই না?”
“উফফ চুপ কর তো তুই বুঝবি না। আমার বিশ্বাস হচ্ছে না। আমি সভ্যের হাত ধরছি। আহ আমার খুশিতে নাচতে ইচ্ছে করছে।” সুরভি অবশেষে সভ্যের সাথে হাত মিলিয়ে বলল।
ইনারা হাত আড়া-আড়ি ভাঁজ করে ভেংচি কেটে বলল, “যত্তসব ঢঙ!”
“তাই না? তাহলে মেডাম আপনি জোহানের সাথে দেখা করার সময় এত ঢঙ করতেন কেন শুনি?”
সভ্য জোহানের কথা শুনে সুরভিকে বলে, “এখন তোমার তো একটু ঢঙ করা চলে। যার চয়েস ভালো তার একটু ঢঙ না করলে হয়? আর তোমার বান্ধবীর তো কাজই এই আজেবাজে বকা।”
“একশো শতাংশ খাঁটি কথা।” প্রিয় বলে।
ইনারা চোখ দুটো বড় বড় করে সভ্যের দিকে তাকিয়ে বলে, “আমি আজেবাজে বকি তাই না? কী বাজে বকলাম শুনি?”
“তোমার সব কথাবার্তাই তো আজেবাজে।”
“আপনি বাজে, রাক্ষস, অসভ্য।”
“আগে নিজের কথা শুনো, তারপর বলো কে অসভ্য?”
“আপনি অসভ্য। আর কে?”
সুরভি ইনারার হাত ধরে ফিসফিসিয়ে বলল, “কি করছিস তুই? এত বড় সেলিব্রিটির সাথে ঝগড়া… ”
সম্পূর্ণ কথা বলার পূর্বেই ইনারা তার হাত ছাড়িয়ে বলে, “উফফ ছাড় তো। দেখছিস না ঝগড়া করতেছি? শান্তি মতো ঝগড়া করতে দে তো।”
সুরভি তো অবাক হয়ে দুজন কে এভাবে দেখতেই থাকে। সভ্য কে সে গত তিন বছর ধরেই ফলো করে আসছে। অথচ তার ব্যবহার সোশ্যাল মিডিয়া থেকে এখানে কতটা আলাদা!
সামি সুরভির পাশে এসে দাঁড়িয়ে বলে, “আরে ওদের ছাড়ো। এটা ওদের প্রতিদিনের রুটিন। তোমরা আমাদের সাথে কথা বলো। ওরা থাক। সারাক্ষণ এভাবেই ব্যাঙ আর ইন্দুরের মতো ঝগড়া করতেই থাকে।”
প্রিয় আর সুরভি একে অপরের দিকে তাকায়। দুইজন অপরিচিত এইসব থেকে। ইনারা সারাক্ষণ সভ্যকে বকলেও সে যে আসলে এভাবে তার সাথে ঝগড়া করবে তার আভাস ছিলো না তাদের।
তাদের প্রথমে খানিকটা অস্বস্তি লাগলেও সামি এবং ঐশি তাদের এই অস্বস্তিকর ভাব একদম দূর করে দেয়। বন্ধুত্বময় স্বভাব তাদের। যেন তাদের সাথে কত কালের পরিচয়। এরপর প্রিয় এবং সুরভি কিছুটা ফ্রী হয় তাদের সাথে।
.
.
আজকের নাচ প্রদর্শন এর পর অনেকেই ইনারার সাথে এসে কথা বলার আগ্রহ প্রকাশ করছে। অনেক বড় বড় সেলিব্রিটি, পরিচালক এসে তার সাথে কথা বলছে। কিন্তু এমন কেন হচ্ছে ইনারা কিছুই বুঝতে পারছে না। আর এত বড় এবং ধনী মানুষের সাথে কথাও বলতে পারছে না। শত হোক, এখনো তার বয়স কম। এছাড়া তার পরিবারের কয়েকজন এবং কিছু বন্ধুবান্ধব ছাড়া কারও সাথে মেলামেশা করা হয় নি। তাই এত ফর্মালিটিসহ কথা সে বলতে পারে না। ইতিমধ্যে যখন ঐশি এবং ইরফানের পার্ফোরমেন্সের এনাউন্সমেন্ট করা হয়। ইনারা যেন একটু বাঁচে। সবার ধ্যান তার থেকে যেয়ে আটকায় হলের মাঝখানে। আগের মতোই আলো নিভে যায়। এমন সময় কেউ একজন হাত ধরে তাকে নিয়ে যায় রুমের একপাশে।
ইনারা কিছুই বলে না। হাল্কা আলোয় তার বাবার চেহেরাটা সে ঠিকই চিনতে পারছে। তাই চুপ করে গেল তার সাথে। ইনারাকে নিয়ে যেয়ে তার ছাত ছেড়ে মুশতাক সাহেব রাগান্বিত সুরে বলে, “তুমি এখানে কী করছ ইনারা? আর তুমি সভ্যের সাথে নাচছিলে কেন? তুমি কী ভুলে গেছ আমি তোমাকে বলেছি কেউ যেন না জানে তোমার আসল পরিচয়।”
ইনারা মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। সে মৃদুস্বরে বলল, “কেউ তো জানে না। শুধু জোহান জেনে গেছে। তাও আপনার আর আইজা আপুর কথায়। আমার দোষ কোথায়?”
“তুমি আমার সাথে তর্ক করছো?”
“উঁহু, যা সত্য তা বলছি।”
কথাটায় মুশতাক সাহেবের রাগ উঠলেও এখানে তো আর সে কোন বাজে প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারেনা এই সভাই। তাই সে ইনারার হাত শক্ত করে ধরে এবং কঠিন গলায় বলে, “তোমাকে আমি আগেও বলেছি, আমার সাথে এভাবে কথা বলার সাহস করবে না। এসব বেয়াদবি তোমাকে শিখায় কে? আর তুমি এখানে করছোটা কি? ”
ব্যথায় কুঁকড়ে ওঠে ইনারা। এক ঝটকায় তার বাবার হাত সরিয়ে নেয়। এবার ভারী রাগ উঠে তার। কিন্তু সে নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণ করে বলে, “আপনি না বলেছেন আপনি আমাকে আর টাকা দিবেন না। কিন্তু আমার তো নিজের খরচা লাগে না’কি? আমি চাকরি করি এই কোম্পানিতে। এবার জেনে খুশি?”
মুশতাক সাহেব ইনারার উপর হাত তুলতে যেয়েও থেমে যায়, “আস্তো বেয়াদব মেয়ে তো তুমি। কেউ নিজের বাবার সাথে এমন ব্যবহার করে?”
“বাবা বলেই আদবে আছি, নাহলে অন্যকেউ এভাবে শক্ত করে আমার হাত ধরলে তার হাত ভেঙে দিতাম। আর আপনি আমার গায়ে হাত তোলার অধিকার কোথায় পেলেন।”
“আমি তোমার বাবা।”
“কেবল শাসনের বেলায় বাবার অধিকারের কথা মনে পড়ে? সারাবছরে তো আপনার মনে থাকে না যে আপনার একটা মেয়েও আছে। আর খবরদার আমার সাথে এমন ব্যবহার করার কথা চিন্তাও করবেন না। নাহলে সবার সামনে আপনার আসল রূপ দেখিয়ে দিব।”
এবার রাগে ফেটে পড়ে মুশতাক সাহেব অগ্নি দৃষ্টিতে তাকায় ইনারার দিকে, “তুমি আমাকে শান্তি দিলে না। একটু খুশি থাকলে আমার দিনটা কীভাবে বিগড়াতে হয় তা ভালো করেই জানো। আসলেই একটা অলক্ষ্মী তুমি। তুমি জীবনে থাকতে কেউ কখনো সুখী থাকতেই পারে না। যখন সাইয়ারা জীবিত ছিলো তখন ও সুখী ছিলো না, এখন আমি। তোমার কি মনে হয় আমি সাধে সাধে সারাবছর বাড়ির বাহিরে থাকি। আমি আমার নিজের বাড়িতে এজন্যই যাই না যে তোমার চেহেরাটা আমার দেখতে হবে। তোমার জন্ম হওয়াটাই ভুল ছিলো। এখন থেকে যা করার করো। আমি আর কিছু বলবো না।”
মুশতাক সাহেব যাবার পর ইনারা তার হাত দেখে। তার হাতে পরা ছিলো এক কাঁচের ব্রেসলেট। এটা তার মা’য়ের ছিলো। আজ সে প্রথম এটা পড়েছে। তার চাপ দিয়ে ধরায় ব্রেসলেটটা ভেঙে তার হাত ঢুকে পড়েছে। কিন্তু এর থেকেও বেশি আঘাত লেগেছে তার বাবার কথায়। বুকের ভেতর কেমন যন্ত্রণা করছে। তার চোখদুটো ছলছলে হয়ে আসলে। না, তার আর এই জমজমাট, হৈচৈ ভালো লাগছে না। তার একটু নীরব স্থান দরকার।
খুঁজে খুঁজে প্যালেসের শেষের দিকে একটা বেলকনি পেল সে। এদিকে কেউ নেই। সে সেখানেই যেয়ে দাঁড়ায়। তার হাত থেকে কাঁচটা বের করতেই চোখ বন্ধ করে নেয় ইনারা। তার চোখে জমে থাকা জল টুপ করে পরে তার গাল দিয়ে। কিন্তু এই মুহূর্তেও হাত থেকে তার বুকের পীড়াটা বেশি যন্ত্রণাদায়ক। তার কানে বারবার এই শব্দগুলোই গুঁজছে,
‘আসলেই একটা অলক্ষ্মী তুমি। তুমি জীবনে থাকতে কেউ কখনো সুখী থাকতেই পারে না। যখন সাইয়ারা জীবিত ছিলো তখন ও সুখী ছিলো না, এখন আমি।’
‘তোমার জন্ম হওয়াটাই ভুল ছিলো।’
দম বন্ধ হয়ে আসছে ইনারার। কাঁপা কাঁপা নিশ্বাস ফেলছে সে। কিন্তু কিছুতেই যে কাঁদতে পারবে না সে। কেউ যদি তাকে খুঁজতে খুঁজতে এসে পড়ে। কান্না থামানোর চেষ্টায় মুখ চেপে ধরে সে। কান্না থামে না। কিন্তু কান্নাটা নিরব হয়। কিছুক্ষণ পর যখন তার কান্না কমে তখন সে ভাঙা ব্রেসলেটটা দেখে বলে, “মা সত্যিই কি আমার জন্য তুমি অসুখী ছিলে? তুমি কি এজন্যই আমাকে ছেড়ে চলে গেছ না। আমি অনেক সরি মা, সরি, সরি।”
বুকে জড়িয়ে ধরে তার মা’য়ের ব্রেসলেটটা ইনারা।
“তুমি তাহলে এখানে।” হঠাৎ সভ্যের কন্ঠ শুনে ইনারা তার চোখ মুছে নেয়। তারপর স্বাভাবিকভাবে তাকায় সভ্যের দিকে, “আপনি এখানে?’
“তোমাকে খুঁজতে খুঁজতে আসলাম। তোমার পছন্দের ব্লুবেরি কেকও আনলাম।”
ইনারা মুখ ফেরাতেই সভ্যের চোখে মুখে চিন্তার ছাপ এঁকে উঠে, “কী হয়েছে তোমার তুমি ঠিক আছো তো?”
“আরে আমি তো ঠিকই আছি। আমার সম্ভবত চোখে এলার্জি আছে। অনেকের কাজলে এলার্জি থাকে। সুরভিরও আছে। একটু যন্ত্রণা করছিলো। এখন ঠিক আছে।”
“সত্যি বলছো তুমি?”
“আপনার সাথে মিথ্যা বলতে যেন আমার বয়েই গেছে। দেখি দিন তো, আমার কেকটা দিন।”
ইনারার একটি বিশেষ গুণ রয়েছে। সে মুহূর্তেই নিজের মুখের ভাব পরিবর্তন করতে পারে। এমন ভাবে তার অনুভূতি লুকাতে পারে যে সামনের জন কিছু বুঝতেই পারে না। তাই সভ্যও তার কথাটা সত্য মনে করে নিলো। ইনারার হাতে কেকের প্লেট দিয়ে সে তাকায় আকাশের দিকে।
ইনারা হঠাৎ করেই জিজ্ঞেস করে, “আচ্ছা আপনাকে একটা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করি?”
“তুমি অনুমতি নিচ্ছো? বাহ! সূর্য কোন দিক থেকে উঠলো?” মশকরা করে বলল সভ্য। কিন্তু ইনারা আর দুষ্টুমি করে না তার সাথে। সে প্রশ্ন করে, “আচ্ছা আপনার মা বা বাবা কি কখনো এত নারাজ হয়েছে যে তারা আপনার মুখও দেখতে চায় নি?”
কপাল কুঁচকে যায় সভ্যের, “এ কেমন প্রশ্ন। কোনো মা বাবাই এমন হয় না। উল্টো তারা তোমার জন্য নিজের সকল খুশি ত্যাগ করতে একবিন্দুও আফসোস করে না। কিন্তু তুমি হঠাৎ করে এমন প্রশ্ন করছ কেন?”
“না। কিছু না। আচ্ছা আপনি কেক খেয়েছেন? অনেক মজা খেয়ে দেখুন।”
“আমার মিষ্টি খাবার ভালো লাগে না।”
“আমি সাধছি তাই আপনার খেতেই হবে। নিন।”
ইনারা জোর করে সভ্যের মুখের সামনে চামচ নেওয়ায় সে ইনারার হাত ধরে নেয়। সাথে সাথে ইনারা শব্দ করে উঠে। তার একদম কাটা স্থানে ধরে সভ্য।
সভ্য অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে, “আমি তো আলতো করে ধরেছি। তোমার ব্যাথা লেগেছে?”
“আরে না। যাক আজকে আপনাকে জিততে দিলাম। খাওয়ালাম না। এরপর আর ছাড়বো না। আসুন এবার ভেতর যাই।”
সভ্য ইনারার এমন অস্বাভাবিক ব্যবহার দেখে একটুখানি অবাক হয়। ইনারা এগিয়ে গেল সে পিছনে যেতে নিলেই সে দেখতে পায় তার হাতে রক্ত লেগে আছে। সে চিন্তায় পড়ে যায়, হঠাৎ রক্ত এলো কোথা থেকে?
সে তাকায় ইনারার দিকে। ছুটে যেয়ে তার সামনে দাঁড়ায়। আদেশের সুরে বলে সভ্য, “তোমার হাত দেখাও।”
“হাত দেখাব? কেন?”
“দেখাও।” কাঠখোট্টা গলায় বলে সে।
“উফফ বাবা আপনিও কম জ্বলান না দেখছি।”
ইনারা তার বাম হাত দেখায় সভ্যকে, “এবার খুশি। আসেন।”
ইনারা যেতে নিলেই সভ্য তার হাতের প্লেট নিয়ে, নিচে রেখে তার ডান হাত রেখে। হ্যাঁ, তার ধারণাই ঠিক। ইনারার হাতের কিছু অংশ কেটে রক্ত বের হচ্ছে। তার এতটুকু আঘাতেই মাথায় রক্ত চড়ে আসে সভ্যের। সে অগ্নিদৃষ্টিতে তাকায় ইনারার দিকে, “কে করেছে এমনটা?”
“আরে চিন্তা করেন না তো। এটা তেমন কিছু না।”
“আমি জিজ্ঞেস করছি কে তোমাকে কষ্ট দিয়েছে?”
উচ্চ স্বরে বলায় কিছুটা ঘাবড়ে উঠে ইনারা। ভয়ও পেয়ে যায় সে সভ্যের এমন রাগ রেখে। সভ্যের রাগ সে আগে দেখেছে কিন্তু এমন রাগান্বিত মুখ আগে সে দেখে নি।
চলবে…..