অনুভবে
পর্ব-১২
নিলুফার ইয়াসমিন ঊষা
রবিবারে সকাল দশটা সোজা অফিসে আসতে বলা হয় তাকে। সময়ের আগেই পৌঁছায় সে। সেখানে যেয়ে দেখে রিহার্সাল রুমে অন্য কেউ নেই, জোহান ছাড়া।
জোহানকে দেখে অবাক হয় সে। জোহান তো আরও দশদিন পর আসতো। জোহান মোবাইল টিপছিলো। এর দরজা খোলার শব্দে তাকায় ইনারার দিকে, “সরি, আপনাকে চিনলাম না।”
প্রশ্নের উওর দিলো না ইনারা। জোহানকে দেখে তার গলায় যেন শব্দেরা গুচ্ছ বেঁধেছে। হাজার কথা বলতে চাইছে সে, পারছে না।
জোহান উঠে এসে দাঁড়ায় ইনারার সামনে, “আপনাকে জিজ্ঞেস করছি। আপনি এখানে কি করছেন জানতে পারি? আর এই সেক্টরে আপনি এন্ট্রি কীভাবে পেলেন? অনুমতি আছে আপনার কাছে?”
ইনারা দ্রুত মাথা নাড়ায়।
জোহান আবার জিজ্ঞেস করে, “কে দিয়েছে?”
“আমি,” সভ্য দরজার কাছে এসে দাঁড়িয়ে উওর দেয়, “আমি দিয়েছি। ও আমাদের গ্রুপের নতুন এসিস্ট্যান্ট।”
জোহান তাচ্ছিল্য হাসে, “আমি না থাকার সুযোগে নিজের মন মতো একজনকে রেখে দিলি?”
“তো এখন কী তোর থেকে অনুমতি নিতে হবে?”
“একদম।”
” সভ্য কারও থেকে অনুমতি নেয় না। অন্যেরা তার থেকে অনুমতি নেয়। তোর বাবা সবে আমার থেকে অনুমতি নিয়ে একটা কাজ জমা দিলো।”
কথাটা শুনতেই জোহানের চোখে মুখে কেমন ক্রোধ ভেসে উঠে। সে দাঁতে দাঁত চেপে বলে, “আমার বাবাকে মাঝে আনার প্রয়োজন নেই।”
সভ্য ঠোঁটের কোণে তীক্ষ্ণ হাসি এঁকে তার কাঁধে হাত রেখে চোখ টিপ মেরে বলে, “যদি কথা সহ্য করতে না পারিস তাহলে খোঁচা মেরে কথা বলার প্রয়োজন কী?” সভ্য যেয়ে সোফায় বসে। পা’য়ে পা তুলে। কোলে গিটার নিয়ে তা ঠিক করতে থাকে।
সামি, ইরফান এবং ঐশি সভ্যের পিছনেই এসেছিলো। তাদের দুইজনের এমন কথা কাটাকাটি দেখে কেউ কিছু বলার সাহস পায় না। সভ্য যেতেই পরিস্থিতিটা হাল্কা করার জন্য সামি জোহানকে বলে, “ব্রো তোর ট্রিপ এত জলদি শেষ? আরও ক’দিন পর না আসতি?”
“তোর বন্ধুর ঝামেলার কারণে সব ছেড়ে আসতে হয়েছে। এমন কান্ড ঘটায় কেন যে এসব ঝামেলায় পড়বে?”
“আরে তুই তো জানিস সোশ্যাল মিডিয়ায় গুজব ছড়াতে থাকে। সভ্য এমন কিছু করতে পারে না। পাবলিক স্টেটমেন্টও দেওয়া হয়েছে।”
সভ্য তার কাজ করতে থাকে। কারও দিকে না তাকিয়েই বলে, “কিন্তু সামি ও আসলেই বা আমার ঝামেলার সমাধান কীভাবে হতে পারে আমি বুঝতে পারছি না। এর উপর একদিনে রিটার্ন টিকিট পাওয়াও গেছে, অবাক কান্ড!”
সামি বলে, “আহা সভ্য থাক না। কথা বাড়ানোর প্রয়োজন নেই।” আবার সে জোহানের সাথে ইনারাকে পরিচয় করিয়ে বলে, “জোহান ওর সাথে পরিচিত হো। ওর নাম ইনারা। আমাদের গ্রুপের পার্সোনাল এসিস্ট্যান্ট এবং তোর অনেক বড় ভক্ত। এতদিন অনেকবার জিজ্ঞেস করেছে তুই কবে আসবি।”
“তাই না’কি? আমার ফ্যানকে তোর বন্ধু কাজে রেখেছে কথাটা হজম হচ্ছে না।” জোহানের হঠাৎ ভাব পরিবর্তন হয়ে যায়। সে হাসিমুখে ইনারাকে বলে, “নাইস টু মিট ইউ। তুমি আসলে আমার ফ্যান?”
ইনারার গলা দিয়ে শব্দই বের হচ্ছিল না। তার চোখেমুখে খুশির ঝলক উপচে পড়ছে। সে দ্রুত মাথা নাড়ায়।
সভ্য আড়চোখে তাকায় তাদের দিকে। বিরক্তির সুরে মৃদুস্বরে বলে, “সারাক্ষণ বকবক করতে করতে আমার মাথা ধরিয়ে দেয়, এখন তার মুখ দিয়ে যেন কথা বের হচ্ছে না।”
ইনারা বহু কষ্টে বলে, “আমার তো বিশ্বাস হচ্ছে না আপনি আমার কাছে। আপনি বেস্ট, বেস্ট, একদম বেস্ট। আমার কাছে আপনার সব এলবাম, ফটো এলবাম সব আছে। আমার ফোনের গ্যালারিও আপনার ছবি দিয়ে ভরা দেখবেন?”
ইনারা ফোন বের করতে নেবার সময় জোহান ভালো করে দেখে ইনারাকে। সে হঠাৎ করে বলে, “তোমাকে আমি আগেও কোথায় দেখেছি যেন। কোথায় তা মনে পড়ছে না।”
সামি কনুই মারে জোহানকে, “ভাই ওকে তো ছেড়ে দে। ওর সাথে ফাজলামো করবি না।”
“আমি সিরিয়াস।”
এমন সময় একটি ছেলে এসে জোহানকে বলে, “মিঃ জোহান আপনাকে বড় স্যার মনে করেছে।”
“আসছি।”
ছেলেটা যাবার পর জোহান ইনারাকে বলল, “তোমার গ্যালারি পরে চেক করবো। সাথে একটা সেল্ফিও তুলে দিব। তুমি তো এখন আমাদের সাথেই আছো।”
কথাটা জোহান সভ্যকে দেখে বলে। যেন সভ্য বুঝে তারও ভক্তও কোনো দিক থেকে কম নেই। আর মুখের উপর তা প্রদর্শন করাতে অন্যরকম এক আনন্দ পাচ্ছে সে। কিন্তু সভ্যের বিশেষ কোনো প্রতিক্রিয়া দেখায় না। যেন তার কিছুই আসে যায় না।
জোহান বের হবার পূর্বে ঐশির সামনে পড়ে। তার ছোট বোন। তাকে দেখে ঠোঁটের কোণে হাসি এঁকে আগ্রহ সহকারে বলে, “তোর ফেভারিট পারফিউম এনেছি প্যারিস থেকে।”
“আমার এখন আর সে পারফিউম পছন্দের না।”
“তোকে তো বলিনি কোনটা এনেছি।”
“জানার ইচ্ছাও নেই।”
ঐশি অনেকটা রাগী ভাব দেখিয়ে যেয়ে সভ্যের পাশে বসে। হয়তো জোহানের মনও খারাপ হয় তার এমন ব্যবহারে। কিন্তু সে কিছু না বলেই চলে যায়।
ইনারা অবাক ভঙ্গিতে সামিকে জিজ্ঞেস করে, “এটা কি রেগুলার ডোস না আজকে বিশেষ দিন?”
“রেগুলার। ব্রেকফাস্ট, লাঞ্চ, ডিনার তিনবেলা।”
ইনারা ভ্রু কপালে তুলে বলে, “তাহলে তো ফ্রি এর ড্রামা দেখা যাবে। যাই হোক অসভ্য এত কাজ করায় যে মুভি দেখার সময় পাইনা। এখন লাইভ ড্রামা দেখে বেতনের টাকা অসুল করুম।”
সামি হাসে তার কথায়, “আমি এবং ঐশী তো মাঝেমধ্যে পপকর্ন নিয়ে আসি।”
“আচ্ছা ঐশি আপু জোহানের সাথে এমন ব্যবহার করলো কেন?”
সামি এবং ইনারার কথাপোকথন এর মাঝে সভ্য এসে দাঁড়ায়। ইনারার শেষ কথাটা শুনে ফেলে সে। সে কড়া গলায় বলে, “তোমার এত কিছু জানার প্রয়োজন নেই। নিজের কাছে ধ্যান দেও।”
সে সভ্যের কথায় পাত্তাই দেয় না। উল্টো খুশিতে আত্মহারা হয়ে বলে, “আমার জোহান এসেছে। এখন আমার ধ্যান কেবল তার দিকে থাকবে।”
সে লাফাতে লাফাতে সভ্যের পাশ কেটে যায় সোফার দিকে। আর গুনগুন করতে থাকে। সভ্য বিরক্ত হয়ে যেতে নিলেই ইনারা আবার দৌড়ে তার সামনে এসে দাঁড়ায়, “জোহানকে দেখে তো আমি ভুলেই গিয়েছিলাম। সে পোস্টের ব্যাপারে কি হলো?”
“এত কথা বলতে পারব না। আমার কাজ আছে। তুমি জোহান আসার খুশিতে নেচে বেড়াও।” বলেই সভ্য বিরক্তি নিয়ে চলে গেল।
.
.
জোহান অনুমতি নিয়ে মিঃ হকের কক্ষে প্রবেশ করল । সে ফোনে কথোপকথনে ব্যস্ত থাকায় চুপ করে একপাশে দাঁড়িয়ে ছিলো। কল রাখার পর সে জোহানের দিকে তাকায়। কঠিন সুরে বলে, “তোমাকে বলেছিলাম কোথাও যাবার প্রয়োজন নেই। এসব ঘুরাঘুরির শখ থেকে গেলে কীভাবে বেস্ট হতে পারবে? এত বড় এক সুযোগ হাতছাড়া হয়ে গেল।”
জোহান চুপ করে থাকে। সে ভেবেছিলো এই একসাপ্তাহ দূরে থাকার পর তার বাবা সর্বপ্রথম তার খবর জিজ্ঞেস করবে। কিন্তু তার প্রথম কথোপকথনই হয় এই বিষয়ে। ব্যাপারটা হতাশ করে তাকে। তবুও সে কিছু বলে না। চুপ করে শুনে যায়।
মিঃ হক আরও বলেন, “সভ্যের উপর এত বড় অপবাদ লাগার পর তোমার কাছে সুযোগ ছিলো ফ্যান-ফলোয়ার বাড়ানোর। কিন্তু না। জনাব তো ঘুরে বেড়াবে। এ দুইদিনে তোমার আলাদাভাবে ইন্টারভিউর ব্যবস্থা করলে কত ভক্ত বাড়তো তোমার বুঝতে পারছ? এখন তো সুযোগটা হাতছাড়া হয়ে গেছে। সভ্য সাইদকে বলে অলরেডি আসল পোস্টটা মিডিয়ার কাছে দিয়ে দিয়েছে। সে আবার জনপ্রিয়। মানুষ তাকে উল্টো সহানুভূতি দেখাচ্ছে। তার ভক্ত আরও বাড়ছে। আর এদিকে আমার ছেলে ঘুরেফিরে বেড়াচ্ছে। বাহ! ওর থেকে এগিয়ে না থাকতে পারলে কিছু শিখতে তো পারো।” অনেকটা ধমক দিয়ে উঠে সময়।
কিন্তু জোহান গলার স্বর উঁচু করে না। মৃদুস্বরে উওর দেয়, “আর কোথাও যাব না আব্বু।”
মিঃহক চুপ করে থাকে কিছু সময়। তারপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবারও কঠিন গলায় বলে, “দেখ জোহান, আমি যা করছি কেবল তোমার জন্য করছি। জানো তো?”
“জ্বি।”
“আমি চাই তুমি সব সময় সবার থেকে বেশি এগিয়ে থাকো। তোমার থেকে বেশি কৃতিত্ব অর্জন আর কেউ না করতে পারে। আমি তোমাকে ছোটবেলা থেকে সবচেয়ে ভালো সংগীতশিল্পীর কাছে গান শিখালাম। দেশে, দেশের বাহিরের সব জায়গায়। এরপর তুমি যদি কারও থেকে পিছয়ে থাকো তাহলে আমার কেমন লাগতে পারে? তোমার দলের এক-তৃতীয়াংশ ফ্যানরা সভ্য-ভক্ত। একারণে ওকে আমি বের করতে পারছি না। এর উপর দলের সকল দায়িত্ব ওর উপর। আমি চাই তুমি যেন সবার হৃদয়ে রাজত্ব করো। বুঝতে পারছ আমি কি বলছি?”
“জ্বি আব্বু।”
“গুড। আচ্ছা দীপার সাথে কেমন কথাবার্তা চলছে তোমার? ও এখনকার নামকরা অভিনেত্রী। তোমাদের দুইজনের সমালোচনা হলে দুইজনেরই লাভ হবে। আর তোমাদের লাভ মানেই আমাদের কোম্পানির লাভ।”
“বের হয়েই ওকে কল দিব।”
“ঠিক আছে এখন যেতে পারো।”
অতিরিক্ত কোনো কথা না বলে জোহান রওনা দিলো। দরজার কাছে আসতেই থেমে যায় সে। মিঃ হককে জিজ্ঞেস করে, “আব্বু ঐশির সাথে কী তোমার কোনো ঝামেলা হয়েছে? আভাস হলো ওর মন খারাপ।”
“ওর কথা তোমার চিন্তা করার প্রয়োজন নেই। মুখের উপর কথা বলছিলো তাই একটু আদব শিখিয়েছে। মেয়েদের মুখের উপর কথা বলার সাহস থাকবে কেন? মেয়েরা থাকবে পুতুলের মতো। তুমি নাচাবে, তারা নাচবে। এমনিতেই ওর জেদ মেনে দলে আসার সুযোগ দিয়েছি তাও বেয়াদবি করতে আসে। তুমি নিজের দিকে খেয়াল করো। কীভাবে নিজের নাম আরও বড় করবে তার চিন্তা করো। ওর কথা ভাবার প্রয়োজন নেই।”
“আচ্ছা।”
জোহান বেরিয়ে যায় সেখান থেকে।
.
.
দুপুর পর্যন্ত ইনারা জোহানের পিছু ছাড়ে না। জোহানও সভ্যকে দেখানোর জন্য তার সাথে কথা বলে যায়। কিন্তু ইনারাকে তার এতটা পছন্দ হয় না। মেয়েরা হবে মার্জিত এবং শোভন। যেন তাকে এক নজরে দেখেই ভালো লাগে। ইনারা একদম উল্টো। তার কথা বলার ধরণ, ব্যবহার, পোশাক কিছুই মার্জিত নয়। একারণেই তাকে ভালো করে দেখতে মন চায় নি জোহানের। যদিও তাকে কিছুটা চেনা পরিচিত লাগছিলো কিন্তু তাও মনে করতে চাচ্ছে না সে। এমন মেয়ে তার চেনা হবে এই ধারণা করাটাও তার কাছে মন্দ লাগে।
এমনিতেও সে খারাপ ব্যবহার করতে পারে না ইনারার সাথে। তার একটা প্রতিমা আছে তার ভক্তদের নজরে। সবার সাথে ভালো মতো কথা বলতে হয়। এই ইমেজ সে নষ্ট করতে পারে না। কোনো কিছুতেই না।
দুপুরে সকলে একসাথে খেতে ক্যান্টিনে যায়। সভ্য তাদের সাথে যায় নি। এ কারণেই ইনারা সর্বপ্রথম তার জন্য খাবার নিয়ে এলো। এসে দেখে সভ্য পিয়ানো বাজাচ্ছে।
কী মধুর!
বাতাসে যেন মিষ্টি সুর ভেসে উঠে। অকারণে ভালো লাগা সৃষ্টি হয় ইনারার মনের মাঝারে। ঠোঁটের কোনে মিষ্টি হাসি ফুটে উঠে। হাসি নিয়ে সে সভ্যের পাশে যেয়ে দাঁড়ায়, “আপনার জন্য খাবার এনেছি।”
সভ্য একপলকও তার দিকে তাকায় না। জিজ্ঞেস করে, “কেন?”
“কেন মানে? খাবার তো খাওয়ার জন্যই এনে তাইনা? খাবেন।”
বাঁকা হাসে সভ্য। সে দাঁড়িয়ে ইনারার হাতের প্লেটটা পিয়ানোর উপর রাখে। তার দিকে খানিকটা ঝুঁকে আসে।
ইনারা হতবাক। আকস্মিকভাবে সভ্য তার কাছে এসে পরে। বুঝতে পারো না কেন! সে খানিকটা অপ্রস্তুত থাকে।পিয়ানোর ঠিক সামনে দাঁড়িয়ে ছিলো সে। পিয়ানোতে হাত রাখে সে। সভ্য যতটা তার দিকে ঝুঁকে আসে সেও ততটা পিছনে ঝুঁকে। সংকোচন সৃষ্টি হয় তার মাঝে। সে লজ্জারুণ দৃষ্টিতে তাকায় সভ্যের দিকে।
সভ্য ইনারার দিকে ঝুঁকে তার দু’পাশে হাত রাখে পিয়ানোর উপর। তার আঙুলে আঙুল ছোঁয়া লাগে। খানিকটা শিউরে ওঠে ইনারা। সভ্য তাকে জিজ্ঞেস করে, “সারাক্ষণ জোহান জোহান করার পর আজ যখন জোহান এলো তখন প্রতিঘন্টায় তোমার আমার কথা মনে পরছে কেন? সত্যি বলো তো, জোহানকে ছেড়ে আবার আমার প্রেমে পড়ে যাও নি তো তুমি?”
চলবে…..
অনুভবে
পর্ব-১৩
নিলুফার ইয়াসমিন ঊষা
“সারাক্ষণ জোহান জোহান করার পর আজ যখন জোহান এলো তখন প্রতিঘন্টায় তোমার আমার কথা মনে পরছে কেন? সত্যি বলো তো, জোহানকে ছেড়ে আমার প্রেমে পড়ে যাও নি তো তুমি?”
ইনারা চমকে উঠে। সে কী ভেবে একথাটা বলল তা বুঝতে পারছে না৷ সে এমন কোনো ইঙ্গিত দেয় নি তাকে। তবে তার প্রতি অন্যরকম এক সম্মানের অনুভূতি আছে তার মনে। সভ্য যেভাবে তাকে দু’দিন আগে বাঁচালো এতে প্রমাণ হয় সে আসলেই ভালো। কিন্তু কথাটা মুখে প্রকাশ করতে পারে না সে। কেমন অস্বস্তি লাগে তার। এমন কোনো পরিস্থিতিতে সে আগে পড়ে নি। ছেলে বন্ধু কয়েকটা আছে তার। কিন্তু কখনো কেউ এত কাছে আসে নি তার। সভ্যের হঠাৎ এমন করে কাছে আসাটা সম্ভবত তার মাঝে লাজুক ভাব সৃষ্টি করার কারণ।
সে কিছু বলতে পারে না। নম্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে সভ্যের দিকে। হঠাৎ করে দরজা থেকে কিছু শব্দ শোনা যায়। কাশির শব্দ। ইনারা দরজার দিকে তাকিয়ে দেখে জোহান দাঁড়ানো। তাকে দেখে ইনারা ঘাবড়ে যায়। সাথে সাথে সে সভ্যকে সরিয়ে দাঁড়ায়। জোহানকে কৈফিয়ত দেবার চেষ্টা করে সে, “আপনি যেমন ভাবছেন তেমন কিছুই না। আমি তো কেবল খাবার নিয়ে এসেছিলাম।”
সভ্য ইনারার কাঁধে হাত রেখে দুষ্টুমি করে জিজ্ঞেস করে, “ও আমাদের দেখে কী ভাবতে পারে ইনু?”
ইনারা চোখ রাঙিয়ে তাকায় তার দিকে। তাহলে সভ্য এসব ইচ্ছা করে করছিলো? জোহানের সামতে তাকে লজ্জিত করার জন্য? ভাবতেই রাগে শরীর জ্বলে উঠে তার।
জোহান বলে, “তুমি উঠে যাবার পরপরই ফোন বেজে উঠে তোমার। সামি বলল তোমার কাছে যেন নিয়ে আসি।”
ইনারা বিড়বিড় করে সভ্যকে কতগুলো গালি দিয়ে জোহানের কাছে যায়। কিন্তু তার সাথে চোখ মেলাতে পারে না। ফোনটা দিয়ে বেরিয়ে যায়।
জোহান সভ্যের সামনে যেয়ে দাঁড়ায়। বলে, “আমাকে দরজায় দেখে ওর সাথে এমনভাবে কথা বলছিলি তাই না? তোর কি মনে হয় আমি ওকে পছন্দ করি যে তোর এমন ঘনিষ্ঠ হওয়াতে আমার কিছু আসবে যাবে?”
“আমি তো দেখছিলাম আসলেই ইফেক্ট করেছে, নাহয় ওকে ফোনটা হাতে দিয়েই সোজা আমার কাছে এলি কেন? আজ সারাক্ষণ আমাকে দেখানোর জন্যই তো ওর সাথে কথা বলছিলি। যেন আমার তোর ফ্যান-ফলোয়ার সম্পর্কে ধারণা হয়। ইউ নো হোয়াট জোহান, তোকে অন্য কেউ না তোর ইনসিকিউরিটি ইফেক্ট করে। বিশেষ করে আমার থেকে।”
“নিজেকে এতটা গুরুত্ব দিস না।”
“আমার দিতে হয় না। তুই আর তোর বাবাই দেস। একারণেই সেদিনের সামান্য এক পোস্ট এতটা বড় করার জন্য উঠে পড়ে লেগেছিলো তোর বাবা।”
সভ্যের কথাটা শুনে জোহান কপাল কুঁচকে নেয়। তার এমন প্রতিক্রিয়ায় হাসে সভ্য, “মানে তুই জানিসই না তোর বাবা এত বড় কান্ড ঘটালো। সে তোকে জানানোর প্রয়োজনবোধটাও করল না? আহারে!”
“এই ঘটনার সাথে আব্বুর কোনো সম্পর্ক নেই।”
সভ্য তীক্ষ্ণ হেসে আবার পিয়ানোর সামনের চেয়ারে বসে। উওর দেয়, “খোঁজ বের করিয়েছি আমি। পোস্টটা অন্যান্য গ্রুপে যে বাড়িয়ে ছড়িয়েছে সে মিঃ হকের আন্ডারে কাজ করে। তার নাম বলতে চাচ্ছি না। আর না অন্যকাওকে মিঃ হকের এই জঘন্য কাজ সম্পর্কে জানাচ্ছি। কিন্তু একটা কথা বলে দেই আমার ধৈর্য্যর সীমানা পেরিয়ে গেলে অনেক খারাপ হবে।”
“আচ্ছা মানলাম আমার বাবা করিয়েছে এমন। তো কী? তুই এমন কী করবি শুনি?”
সভ্য পিয়ানো কনুই রেখে গালে হাত দিয়ে তাকায় জোহানের দিকে, “তাহলে আমি এবছর কন্টাক্ট রি-নিউ করব না।”
কথাটা শুনতেই জোহান ভয় পেয়ে গেল। কোম্পানির দুই-তৃতীয়াংশ মুনাফা আসে তাদের দল থেকে। কিন্তু দলের কারও সভ্যের মতো বড় ফ্যানবেস নেই। এমনকি সকলের ফ্যানবেস মিলিয়েও সভ্যের সমান হয় না। জোহানের না চাইতেও তা মানতে হবে। তাই তাদের সভ্যকে যে করেই হোক দরকার।
সভ্য শীতল বলায় বল, “নাউ ইউ ক্যান গেট আউট।”
“তোর মনে হয় না অতিরিক্ত এটাটিউড দেখানো হচ্ছে?”
“এখন কি করবো ব্রো আমি এটাটিউড নিয়েই জন্ম নিয়েছিলাম।”
জোহান বিরক্ত হয়। কিন্তু কথা বাড়ানোটা উচিত মনে হলো না তার। তাই সে সেখান থেকে চলে গেল।
লিফটে যাবার সময় সে পথে দেখলো ইনারা ফোনে কথা বলছে। ইনারাকে দেখে তার হঠাৎ করে চোখের সামনে আবছা কিছু দৃশ্য ভাসে। এর উপর ‘ইনারা’ এবং ‘ইনু’ দুটো শব্দই চেনা চেনা লাগে তার কাছে। জোহানের হঠাৎ করে মনে পড়ে দুইবছর আগের কথা। তার দল তৈরি হবার পূর্বে সে সর্বপ্রথম মা’য়ের সাথে বাংলাদেশে এসে শ্রীমঙ্গল যায়। সেখানে সে দেখা করে সারু আন্টির মেয়ের সাথে। তার নামও ছিলো ইনারা। মা তাকে ডেকেছিলো ইনু। চেহেরাটাও মনে পড়ে জোহানের। কান্না করার কারণে সারারাত মেয়েটিকে গান শুনিয়েছিলো সে। পরেরদিন তার সাথে ঘুরেছিলো। তাহলে এই সে ইনারা?
জোহান নিজের উপর চরম বিরক্ত হয়। সে আগে কেমন আজেবাজে মানুষদের সাথে কথা বলতো! যেখানে আজকাল তার একটা গান শুনতে মানুষরা পাগল হয়ে যায়, লক্ষ লক্ষ টাকা আয় করে, সেখানে এমন অমার্জনীয় মেয়েকে সে সেধে যেয়ে গান শোনাচ্ছিল?
আগে কী এতটাই বোকা ছিলো সে?
আর তার মা’য়েরই বা কেমন মানুষদের সাথে বন্ধুত্ব ছিলো। কেউ যদি জানে তাদের জন্য কাজ করা এসিস্ট্যান্ট তার মা’য়ের বান্ধবীর মেয়ে তাহলে তার জন্য কত লজ্জাজনক ব্যাপার হয়ে যাবে। আর এই ব্যাপার যদি জনগণের মাঝে ছড়ায়? না, এ কথা কাওকে জানতে দেওয়া যাবে না। মেয়েটার সাথে কেবল দলের সবাইকে দেখানোর জন্য কথা বলতে হবে। বিশেষ করে সভ্যকে দেখানোর জন্য।
এতটুকু ভেবে জোহান সেখান থেকে চলে যায়।
.
.
“তুই সে একদিনের চক্করে জোহানের পিছনে ঘুরে বেড়াচ্ছিস আর জোহান তোকে মনেও রাখে নি।” সুরভি বলল। ফোনের ওপাড় থেকে। ইনারা কথাটা শুনে মুখ বানায়। একটু আগের সভ্যের কান্ড এখনো সে ভুলে নি। এর উপর সুরভীর এই কথা। সে খিটখিটে মেজাজে বলল, “ভাই সে আমার সাথে একদিন মাত্র সময় কাটালো। এরপর সে এত ফেমাস হবার পর কত মানুষের সাথে দেখা হলো। আমায় কীভাবে মনে রাখবে? আমি যে স্কুলে এতজনের সাথে এত বছর ধরে পড়লাম আমার তো কতগুলোর চেহেরাও মনে নেই।”
“তো তুই তাকে মনে করিয়ে দে।”
“কোন দুঃখে আমি যেয়ে সেধে মনে করাব? যদিও সৌমিতা আন্টি তাকে আমার আসল পরিচয় দেয় নি, তবুও প্রথমে সে আমাকে ভালোবাসবে তারপর তাকে আমার আসল পরিচয় দিব। আমি চাই আমি ঠিক যেমন সে আমাকে তেমনভাবেই ভালোবাসুক।”
“তোর ভালোবাসা এবার সাইডে রেখে বল তো সভ্য কোথায়? একটু কথা বলিয়ে দে।”
ইনারার মনে পড়ে একটু আগের ঘটনা। সভ্যের উপর প্রচন্ড রাগ উঠে তার। আচ্ছা সভ্য কী এমনটা তার থেকে প্রতিশোধ নিতে করেছিলো? জোহানের সামনে তাকে লজ্জা দেবার জন্য করেছিলো? রাগে শরীর জ্বলে তার। সে ঝাঁজালো গলায় বলে, “ওই অসভ্য, বেয়াদব, বান্দরের দলের রাজা, ওই বেহায়া ভূতের নাম আমার সামনে নিবি না। নিজেকে কি মনে করে আল্লাহ জানে! যেমন ভাব করে যেন কোনো দেশের নবাব। আর বেহায়াপনার কথা তো নাই বললাম। আমি যদি পারতাম তাহলে ময়লা নালায় ডোবাতাম শুধু।”
“তাই না’কি?” ইনারার পিছন থেকে প্রশ্নটা আসে।
“তো আর কি?” সে আনমনেই উত্তর দিয়ে চমকে যায়। স্তব্ধ হয়ে যায়। ভয়ে ভয়ে পিছনে তাকিয়ে দেখতে পায় সভ্যকে। মুহূর্তে কাঁদোকাঁদো চেহারা হয়েছে তার। ফোনের ওপাশ থেকে সুরভী জিজ্ঞেস করে, “এটা কী সভ্যের কন্ঠ? আমি কি আসলে সভ্যের কন্ঠ শুনছি?”
ইনারা সাথে সাথে ফোন কেটে দেয়। আমতা-আমতা করে সভ্যকে বলেন, “আ-আপনি কখন এলেন?”
“সময় মতোই এসেছি। আচ্ছা একটা সত্যি কথা বলতো, তোমাকে কি আমার বদনাম করার জন্য কেউ চাকরিতে রেখেছে?”
“ওটা তো আমি ফ্রীতেই মজার সাথে করতে পারি।” বলেই জিহ্বায় কামড় দিল সে, “না মানে কে আপনার বদনামের জন্য আমাকে চাকরিতে রাখবে?”
“আমি বেহায়া তা বলছিলে না?”
“দেখুন আপনি একটু আমার সাথে বেহায়াপনা করেছেন। এটা বলার আমার অধিকার আছে।”
আচমকায় সভ্য ইনারার দিকে এগিয়ে আসে। তার বুঝে উঠার পূর্বেই ঠোঁটের কাছে ঠোঁট এনে থেমে যায়। ইনারা থমকে যায়। কি হলো বুঝতে পারেনা। ভয়ে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। বুকের ভেতরটা ধক করে উঠে। হৃদয়ে এক স্পন্দন যেন স্কিপ হয়ে যায়। এক ঢোক গিলে সে।
সভ্য ইনারার কাছে এসে থেমে যায়। ঠোঁটের কোণায় মৃদু হাসি এঁকে বলে, “বেহায়াপনা করতেন অনেক ভালোমতো করতে পারি। কিন্তু তোমার উপর আমার বিন্দুমাত্র ইন্টারেস্ট নেই।”
ইনারা দ্বিধায় পড়ে যায়। সে সভ্যের কথায় ক্রোধিত হবে না’কি লজ্জিত হবে তার এই কান্ডে। সে মুখ বানিয়ে বলে, “আপনার কি লজ্জা শরম বলতে কিছু নেই?”
“আছে কিন্তু তোমায় দেখলে আসে না।”
ইনারা রাগে সভ্যের পা’য়ে লাথি মেরে সেখানে থেকে চলে যায়। সভ্য ব্যাথায় কুঁচড়ে উঠে। কিন্তু শব্দও করতে পারে না সে। ইনারাকে যেতে দেখে বলে, “কি মনে করেছ তুমি বেঁচে যাবে? তোমার খবর আছে ইন্দুরনী।”
ইনারা পিছন দিকে ফিরে ভেঙিয়ে বলে, “দেখি নিব আপনি কি খবর করে উঠিয়ে ফেলেন, মিঃ অসভ্য।”
.
.
“এক সাপ্তাহ হয়ে গেল। মেয়েটার কোনো খোঁজ তুমি পাও নি? এ কেমন কথা?” জোহান সাইদকে কথাটা জিজ্ঞেস করে। সামনে সাথে বসা সামি এবং সামনে দাঁড়ানো সাঈদ। এই মুহূর্তে তারা জোহানদের বাড়ির ছাদে বসা। জোহানের সিগারেটের সাদা ধোঁয়া মিশিয়ে দিলো রাতের শীতল বাতাসে।
সাইদ জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়েছিল। আজকাল জোহান থেকে অনেক ভয় লাগে। জোহান কখন কি করে সে বুঝতে পারে না। যত বছর পাড় হয় ততই সে অন্যরকম হয়ে যাচ্ছে। আগের মত নম্র, হাসিখুশি, যত্নশীল মানুষ আর সে নয়। যখন সে যাত্রা শুরু করে তখন জোহান এমন ছিলো না। খুবই মিশুক ছিলো। নতুন চাকরিতে জয়েন করায় সাইদ ভীষণ ভয়ে ছিলো কিন্তু জোহানের বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণে তার ভয় মুহূর্তে চলে গেল। কিন্তু আজ এই জোহান তার কতটা অচেনা! যত দিন যাচ্ছে জোহান ততটাই অন্যরকম হয়ে যাচ্ছে।
উত্তর না পেয়ে জোহান আবার ধমক দিয়ে জিজ্ঞেস করল, “আমি কিছু জিজ্ঞেস করছি। মেয়েটার খবর এখনও আমি পেলাম না কেন?”
“মেয়েটার চেহেরাটার বর্ণনাও তুমি ঠিকভাবে দিতে পারছ না। আমি কীভাবে খোঁজার চেষ্টা করব মেয়েটাকে? তুমিই তো মেয়েটাকে ঠিকভাবে দেখ নি। এছাড়া চেহেরা চিনলেও এতগুলো মানুষের মধ্যে একটি মেয়ের খোঁজ নেওয়া কীভাবে সম্ভব?”
“তা তোমার ব্যাপার। চাকরি তো হাতে হাত রেখে বসে থাকার জন্য দেই নি।”
সামি জোহান এর পাশে বসেছিল। সে জোহানের কথা শুনে হেসে ওঠে, “ব্রো ওকে কোম্পানির কাজ করার জন্য রাখা হয়েছে। তোর ব্যক্তিগত পছন্দের মেয়ে খোঁজার জন্য না। সভ্য জানলে কিন্তু তোর কপালে শনি আছে।” কথাটা শুনতে জোহানের রাগ আরো বেড়ে গেল। বিশেষ করে সভ্যের কথা শুনে। সে গলা চড়িয়ে বলল,”আমি কি সভ্য কি ভয় পাই না’কি?”
“পাওয়া উচিত। তুই ভালভাবে জানিস সভ্য কেমন। ওর এমন আনপ্রফেশনাল কাজ একটুও পছন্দ না।”
“তুই আমার ভাই হয়ে ওর প্রশংসা কিভাবে নিতে পারিস?”
“আমি তো সত্যি তাই বলছি।”
জোহান রাগে কটমট করে উঠে যায়। যাওয়ার পূর্বে তার হাতের সিগারেট ঢেলে দেয় সামির জুসের গ্লাসে।
.
.
ইনারা বাড়িতে ফিরে দেখে উৎসব হচ্ছে। অন্তত উৎসবের মতোই। সে দরজায় ঢোকার সাথে সাথে তার ফুপি মুখে মিষ্টি ভরে নিলো। সে আজ মহাখুশি। এতটা খুশি তাকে সাধারণত দেখা যায় না। তাই আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করল, “কী খবর ফুপি এত খুশি কেন আজ?”
“খুশির ব্যাপারই। আইজা একটা ফিল্মে চান্স পাইসে বুঝলি? তাও তোর বাবার সিনেমায়। তোর বোন ফিল্মস্টার হয়ে যাবে। অনেক বড় অভিনেত্রী হবে।”
ইনারার ঠোঁটের হাসি সাথে সাথেই মলিন হয়ে গেল। সে হতবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে, “কী বলছো ফুপি? এটা কীভাবে হতে পারে? আমি গতবছর যখন এত করে বলেছিলাম আমি কলেজের থিয়েটারে অভিনয় করতে চাই আব্বু কত খারাপ কথা বলেছিলো আমায়। কত বকেছিলো। বলেছিলো এই বাড়ির মেয়েদের এসব করা মানা। আর আইজা আপুকে ফিল্মে চান্স বাবা নিজে দিচ্ছে? আমার মানা হলে আইজা আপুর কেন নয়?”
চলবে…..