অনুভবে তুমি পর্ব-১১ এবং শেষ পর্ব

0
2679

#অনুভবে_তুমি
#অন্তিম_পর্ব
#ফারজানা_আক্তার

শিরুফার৷ জ্ঞান ফিরলে সে নিজেকে শোভার রুমে আবিস্কার করে।। চোখ খুলতেই সে লাফিয়ে উঠে বসে।। কারণ ওর সামনে সবাই দাঁড়িয়ে, রাহিল,আদিবা,শোভা নিহান, রোকেয়া আর রমজান সাহেবও আছে,,তুলি তো ওর পাশেই বসে আছে,, মাথাটা কেমন ঝিম ধরে আছে।। আদিবা শিরুফাকে জড়িয়ে ধরে জিজ্ঞেস করে “কি হয়েছে বোন তোর”?

~জ জা জানিনা আ আপু।।
কিছুটা থুতলিয়ে কথাটা বলে শিরুফা,,
~তাহলে নিহানকে দেখে চিৎকার দিয়ে জ্ঞান হারালি কেনো?
কিছু বলতে পারছেনা শোভা।। আতংকে আছে খুব।
নিহান মনে মনে বলে “ভাইয়ার শালি ফাঁসিয়ে দিসনা রে আমায়, আমি কিছুই করিনি।।

শোভা হালকা ধাক্কা দিতেই নিহানের ঘোর কাটে, শোভা হাসতে হাসতে নিহানকে বলে ” কী রে ছোট ভাই, কী শুনতেছি এগুলো তোমার নামে??
সবাই হাসতেছে,রাহিলও তুলিকে কোলে নিয়ে হাসতে হাসতে চলে যায় নিজের রুমে,, রমজান সাহেব আর রোকেয়া বেগমও চলে যায়। শোভা আর আদিবা আছে, নিহান বোকার মতো ফেস করে আদিবাকে বলে “সবাই হাসছে কেনো ভাবি?কি হয়েছে?
~কেনো? তুমি শুনোনি বুঝি শিরু কী বলেছে?
দুষ্টুমির সুরে বলে আদিবা।
~না তো খেয়াল করিনি?
মাথা চুলকাতে চুলকাতে বলে নিহান।।
হেসে দেয় শোভা।। নিহান চোখ রাঙিয়ে তাকাতেই মুখ হাত দিয়ে ঢেকে ফেলে শোভা। শিরুও মুচকি মুচকি হাসে, চোখ এড়ালো না নিহানের।

~বলো ভাবি কি বলেছে তোমার আদুরে বোন।।
~শিরু বলেছে ওদের স্কুলে যাওয়ার পথে একটা পাগল দেখে সবসময় আর তোমাকে নাকি অন্ধকারে সেই পাগল মনে করেছে শিরু তাই,,,,

আর কিছু বলতে পারিনি আমি,, খুব হাসি পাচ্ছে আমার তাই হাসতে হাসতে ওই রুম থেকে বেরিয়ে আসি আমি।।

নিহান আগুনের দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে শিরুফার দিকে,, শিরুফা তো ভয়ে চুপসে গেছে। শোভা আঁড়চোখে নিহানের দিকে তাকায়।। শোভা আছে তাই ওর সামনে কিছু না বলে রাগান্বিত চেহারা নিয়ে হনহন করে সেখান থেকে চলে যায় নিহান।। আর মনে মনে বলে ” আজব তো, এ কেমন মেয়েকে অনুভব করি আমি যে কিনা ১ সেকেন্ডে আমায় রাস্তার পাগল বানিয়ে দিলো” রাগে যেনো মাথা টা ফেটে যাচ্ছে নিহানের।।



আমি রুমে এসে দেখি তুলি আর ওর আব্বু দুষ্টুমি করে বিছানায় শুয়ে শুয়ে। আমাকে দেখে তুলির আব্বু জিজ্ঞেস করে নিহান রেগে যায়নি তো? আমি কি বলবো, আমার যে ভীষণ হাসি পাচ্ছে, হাসতে হাসতে উনার পাশে বসলাম, উনি বললেন “আরে এতো হাসার কি আছে? আমি হাসি একটু দমিয়ে রেখে বললাম জানিনা তবে ভীষণ হাসি পাচ্ছে,,
তারপর আর কোনো কথা না বলে আমরা তিনজন একসাথে দুষ্টুমি করতে লাগলাম।।।

এভাবে কেটে গেলো সাত সাতটা বছর,, তুলির এখন ১০বছর ৭মাস চলে।। আদিবাকে ছাড়া কিছুই সে বুঝেনা আর। স্কুল থেকে ফিরেই আদিবার পিঁছু ছাড়বেনা আর,, রাহিল তো এখন আদিবার প্রেমে মাতাল,, ভীষণ ভালোবেসে ফেলেছে সে এখন আদিবাকে।। আদিবা যেনো সুখের সাগরে ভাসতেছে।।।

পড়ন্ত বিকেল ঝিরিঝিরি বাতাস মনটা ফুরফুরে হয়ে যায় এমন একটা পরিবেশ,, দাঁড়িয়ে আছি বেলকনিতে,, উনি হঠাৎ এসে পেঁছন থেকে জড়িয়ে ধরে আমায়, আমি অবাক হলাম এই অসময়ে উনি হঠাৎ বাড়িতে কেনো,, উনার বুকে মাথা ঠেকালাম, চোখ বন্ধ করে উনাকে বললাম আপনি এই অসময়ে কিভাবে?
~হুস,, আমার বউয়ের কাছে আসার জন্য সময় অসময় লাগবে নাকি আমার…

আমি আর কিছু বললাম নাহ,, চুপচাপ উনার বুকের উষ্ণতা অনুভব করতে লাগলাম,, উনি আমায় বললেন ” আচ্ছা আদিবা তোমার ডেলিভারি ডেট কবে জানি?

~এই তো সামনের ১০তারিখ।।
~তো ৮তারিখ নাকি শিরুফার বিয়ে।
~হুম,, চিন্তা হচ্ছে,, আমিও প্রেগন্যান্ট আম্মু একা সব কিভাবে করবে বুঝতে পারছিনা।
~ঐ পাগলী আমি থাকতে তোমার এতো চিন্তা করার দরকার কি হুম?? কয়েকটা কাজের লোক ঠিক করে দিবো আম্মুর সাহায্যের জন্য।।

আমি একটা সস্থির নিঃশ্বাস নিলাম।। উনি আমার মাথায় বিলি কেটো দিচ্ছেন আমি চোখ বন্ধ করে উনার বুকে মিশে আছি।।



আজ ৮তারিখ। আজ আমার শিরুর বিয়ে,, পাগলীটা কি করছে কি জানি,, যেতে হবে আমায় তাই দ্রুত তৈরি হয়ে নিলাম।

সবাই তৈরি হয়ে এক এক করে ড্রয়িংরুমে এসে হাজির হলাম। কিন্তু নিহান ভাইকে কোথাও দেখতে পেলাম নাহ। পুরো ঘরে সবাই খুঁজেও পেলামনা। পরে কল দিলাম,, এমা এই বাচ্চুর তো ফোনটাও বন্ধ।। হঠাৎ কি হলো বুঝলাম নাহ।
আমরা সবাই চলে গেলাম আমাদের বাসায়, আমাদের বাসা একটু গ্রামের দিকে, এখান থেকে ঠিক দুই ঘন্টার পথ। আব্বু আম্মু শোভা পেঁছনে বসেছে আর আমি উনার পাশে, তুলি আমার সাথেই আমাকে জড়িয়ে ধরে বসেছে। গরমে অসস্থি লাগলেও কিছু বললাম, একমাত্র মেয়ে বলে কথা। তুলি যতক্ষণ আমার সাথে থাকবে ততক্ষণ আমার পেটের উপর থাকবে তার হাত টা,, তার নাকি একটা ভাই চাই,, খুব খুশি মেয়েটা আমার।

অবশেষে অনেকক্ষণ জার্নির পর আদিবারা বাসায় পৌছায়। সবাই বেশ ক্লান্ত। আদিবা তো চোখমুখ বন্ধ করে নিয়েছে, ডেইটের ২দিন আগে এতো লম্বা জার্নি।।
আর শোভা তো ভীষণ খুশি অনেকদিন পর যে দেখা হবে শিরুফার সাথে।

গাড়ি থেকে নেমে ঘরের দিকে পা বাড়াতেই সবার পা থমকে যায়, সামনে নিহান দাঁড়িয়ে। চোখমুখ বেশ লাল হয়ে আছে ওর। শোভা দৌড়ে এসে জিজ্ঞেস করে “কিরে ভাইয়া আমরা সবাই তোরে পুরো বাড়ি খুঁজে অস্থির আর তুই এখানে? এটা কেমন কথা ভাইয়া।
~তুই চুপ কর তো পেত্নি, আব্বু আম্মুর সাথে কথা আছে আমার।

নিহান তার বাবা মায়ের সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই আদিবার মা বাবা বের হয় ঘর থেকে, আর তারা দ্রুত এসে আদিবাকে জড়িয়ে ধরে। আদিবার মা তো কান্নায় ভেঙ্গে পড়েছে খুব, কেউ কিছু বুঝে উঠতে পারছেনা কি হচ্ছে এসব। আদিবা তার মা কে জিজ্ঞেস করে কি হয়েছে? আদিবার মা কাঁদতে কাঁদতে বলে “কি আর হবে রে মা, আমার মেয়ের সর্বনাশ হয়ে গেছে, কেউ আর ওকে বিয়ে করবেনা।।
বলেই একাধারে কাঁদতে লাগে শাহানা বেগম।
~কেনো মা? কি হয়েছে শিরুর?
এমন সময় বধু বেশে শিরুফা ঘর থেকে বের হয়ে সবার সামনে দাঁড়িয়ে মাথা নিচু করে বলে ” আপু উনারা এই বিয়ে ভেঙ্গে দিয়েছে, আর তার সাথে আমার মাথায় দিয়েছে একরাশ অপবাদের বোজা।
এইটুকু কথা বলেই কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে শিরুফা, শোভা দৌড়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরে শিরুফাকে। পাথর হয়ে দাঁড়িয়ে আছে আদিবা, রাহিল এক হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে আছে আদিবাকে।
নিহানের চোখ দিয়ে পানি পড়তে লাগলো যা দেখে রমজান সাহেব আর রোকেয়া বেগম অবাক।

শিরুফা আবার বলতে শুরু করলে তার বিয়ে কেনো ভেঙ্গে দিয়েছে তার আগেই নিহান চিৎকার করে বলে উঠে ওরা যা বলেছে সব মিথ্যা, এই বিয়ে আমিই ভেঙ্গেছি, আমি শুধু তাদের কাছে গিয়ে বলেছি আমি শিরুফাকে ভালোবাসি তারা যেনো এই বিয়ে ভেঙ্গে দেয়, বাকি সব ওরা বানিয়ে বানিয়ে বলেছে।

সবাই স্তব্ধ নিহানের কথা শুনে, চোখ বড় বড় করে তাকায় সবাই নিহানের দিকে। নিহান শিরুফার সামনে দাঁড়িয়ে বলে “বিশ্বাস করো তোমাকে আমি সাত বছর ধরে ভালোবেসে আসছি,আমার ভালোবাসা বিন্দু পরিমাণ মিথ্যা নয়, তোমাকে যেদিন প্রপোজ করেছিলাম সেদিন তুমি আমাকে অপমান করে ফিরিয়ে দাও আর এই রাগের কারণে এতগুলো বছর ধরে আমি তোমার সাথে কোনোরকম যোগাযোগ করিনি কিন্তু যখন তোমার বিয়ের কথা শুনলাম, মাথা উল্টে যায়, কারণ তুমি শুধুই আমার, আমি ছাড়া অন্যকারো জন্য তুমি বধু বেশে সাজতে পারবেনা। তাই তোমার বিয়ে ভাঙতে বাধ্য হয়েছি আমি, সরি।।

শিরুফা কিছু না ভেবেই ঠাস করে নিহানের গালে থাপ্পড় লাগিয়ে দেয়। নিহান শক্ত করে জড়িয়ে ধরে শিরুফাকে, শিরুফা কান্না করে দেয় কামছে ধরে নিহানকে।

সবাই শুধু অবাকই হচ্ছে। রাহিল একটু সামনে এসে বলে ” তুই শিরুফাকে ভালোবাসিস আমাদেরকে বললেই তো পারতি, এতো নাটক করলি কেনো সিনেমার মতো?
শোভা হাসতে হাসতে বলে “আরে ভাইয়া নাটক তো নাটকে হয়, সিনেমায় তো ডুসোম ডিসোম হয়।
~তুই চুপ কর,বেশি বুঝে। তুই বল নিহান।
ধমকিয়ে বলল রাহিল,শোভা চুপ হয়ে যায়।
~কি বলবো তোমাদের ভাইয়া, যাকে ভালোবাসি সে ফিরিয়ে দিয়েছিলো আমায়। তাই আর কাউকে কিছু বলিনি আমি।
কথাটি বলে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে নিহান।
অবশেষে কোনো ভেজাল ছাড়াই তাদের বিয়েটা সম্পূর্ণ হয়, রমজান সাহেব আর রোকেয়া বেগমও কোনো অমত করেনি, মেনে নিয়েছে তাদের ছেলের ভালোবাসাকে।

বিবাহ্ শেষে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিবে সবাই এমন সময় আদিবার ব্যাথা উঠে যায়, দ্রুত ওকে পাশের এক হসপিটালে নিয়ে যাওয়া হয়।



তিনমাস পর

তুলি বিছানায় বসে বসে পাহারা দিচ্ছে তার বোন আহিকে, যেনো কেউ এসে তাকে নিয়ে যেতে না পারে। আর তা দেখে আদিবা হাসতে হাসতে কুটিকুটি।
হ্যাঁ সেইদিন আদিবার মেয়ে বাবু হয়েছিল। বেচারি তুলি কত আশা করেছে একটা ভাইয়ের কিন্তু বোনকেও সে কম আদর করেনা।
আদিবা সোফায় বসে বসে তুলি আর আহিকে দেখছিলো রাহিল এসে আদিবাকে এক হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে বলে ” তুমি আমাকে আর তুলিকে যে নতুন জীবন দিয়েছো তার ঋণ আমি এই এক জীবনে শোধ করতে পারবোনা শুধু এইটুকুই বলবো যে অনুভবে শুধুই তুমি”

আমি উনার মুখে এই সাত বছরে আজ প্রথম শুনলাম এই কথাটি, সত্যি আজ নিজেকে বড্ড ভাগ্যবতি মনে হচ্ছে।
আমি ছলছল নয়নে তাকালে উনার দিকে উনি আলতো করে আমার কপালে ভালোবাসার মিষ্টি রেখা এঁকে দেন।। জয়ের হাসি আমার চোখেমুখে______

#সমাপ্তি

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে