#অনুতপ্ত ৩য় পর্ব
#সাদমান হাসিব
আনমনে সিগারেট টানতে টানতে কখন যেন সিগারেটের আগুন খসে হাতে পড়ে গেল খেয়ালই করলাম না।
তৎক্ষণাৎ জ্বালা শুরু করলো হাতের উপর,
ইচ্ছা করলেই রুমে এসে ফ্রিজ খুলে বরফ বের করে পোড়া জায়গার উপর দিতে পারতাম, কিন্তু সেই ইচ্ছা করতেছে না। হাতের পোড়ার চেয়ে হৃদয়ের পোড়া ক্ষত টা অনেক বেশি তাই চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলাম।
আস্তে আস্তে আকাশের তারা গুলো মেঘের আড়ালে ঢেকে যাচ্ছে, কালো মেঘের ভেলা তারা গুলোকে আড়াল করে দিচ্ছে। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে আছি পা টনটন করছে, ব্যালকনিতে চেয়ার পাতা আছে এটা আমার এতক্ষণ খেয়াল ছিল না। দাঁড়িয়ে থাকতে-থাকতে পা দুইটা ব্যথা করছে, চেয়ারটা টেনে বসে কখন যে ঘুমিয়ে গেলাম।
কি ব্যাপার তুমি এখানে কেন ঘুমাচ্ছো, আমার সাথে কি এক বিছানায় ঘুমাতে তোমার ভালো লাগে না। তুমি এটা কেন করছো আমি বুঝতে পারছি, তোমার মায়ের জন্য আমাদের মাঝে দূরত্ব সৃষ্টি করতেছ তুমি। কি চাও বাবু ভালো করে বল, আমাকে যদি না চাও কেন নিয়ে আসলে? ডিভোর্স দিতে চাও, আমার সাথে সংসার করবে না।
এত রাতে চিতকার করো না চুপ করো রুবাইয়া, তুমি এত বেশি বুঝো কেন,
বেশি বুঝবো না কি করবো, বিছানায় না ঘুমিয়ে তুমি ব্যালকনিতে চেয়ারে বসে ঘুমাচ্ছো, এতে আমার বুঝার বাকি আছে নাকি কিছু।
আরে তেমন কিছু না, সিগারেট খাবো বলে এখানে এসে বসেছিলাম, কখন যে ঘুমিয়ে গেছি বুঝতে পারিনি, রাত কটা বাজে।
আর কয়টা বাজবে, চারটা বাজে, যদি বিছানায় শুতে চাও তাহলে চলে আসো।
আমি রুবাইয়ার সাথে সাথে রুমে চলে আসলাম, এখন আর ঘুম হবে না জেগে আছি, রুবাইয়া ঘুমিয়ে গেলে আমি উঠে চলে যাব আম্মুর রুমে, আম্মুকে নিয়ে হাঁটতে বের হবো হাঁটতে-হাঁটতে তার সাথে দরকারী কথা গুলো সেরে নেবো। রুবাইয়া আমাকে বলছে বাবু আমার মাথায় একটু হাত বুলিয়ে দাও ঘুমিয়ে যাবো, না হলে এখন ঘুম আসবেনা। রুবাইয়ার কাছে তার আরাম সবার আগে সবসময় বেশি, একটু ঘুম না হলেই সে কেমন ক্লান্ত হয়ে যায়। মাথায় হাত বুলিয়ে দিলাম মিনিট দশেক পরে দেখছি ঘুমিয়ে গেছে। আযানের পর পাখির কিচিরমিচির শব্দ শোনা যাচ্ছে, আমি উঠে ওয়াশরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে আম্মুকে ডাক দিলাম। আম্মু নামাজ পড়ে পান মুখে দিয়েছে।
আম্মু চলো হাটতে বেরোবো।
ঠিক আছে তুই যা আমি আসছি।
আম্মু বোরকা পড়ে বের হলো, সকালে রাস্তায় কোন মানুষজন নেই, গাড়ি নেই চারদিকে সুনসান নিরবতা। আম্মুকে নিয়ে কিছুদুর হেটে পার্কের কাছে এসে বসলাম।
তোমার সাথে কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা আছে এই জন্য তোমাকে বাহিরে নিয়ে এসেছি।
কি এমন গুরুত্বপূর্ণ কথা বল তো শুনি, তোদের সাথে কি আমাকে রাখবি না।
তুমি কিভাবে ভাবতে পারলে আমি এটা বলবো, তোমার ছেলেকে তুমি এমনটা ভাবতে পারলে।
আসলে বাবা আমি চাই তোর সংসার টিকে থাকুক, আমার দাদুভাইকে এতিম করতে চাইনা মা-হারা করতে চাইনা। বাবা মা ছাড়া সন্তানের খুব কষ্ট হয়, তোকে আমি খুব কষ্ট করে বড় করেছি। তোর বাবা বেঁচে থাকলে এতটা কষ্ট আমার করতে হত না। এখন যদি তোদের ছাড়াছাড়ি হয়ে যায় আমার কারনে, আমার দাদুভাই সিরাত কিন্তু বাবার আদর থেকে বঞ্চিত হবে, আইনগতভাবে সিরাত তার মা’র কাছে থাকবে। আবার দুইদিন পর তার মায়ের অন্যখানে বিয়ে হলে তুই যদি নিয়ে আসিস তখন মায়ের আদর থেকে বঞ্চিত হবে।
এরকম কিছু ভাবছি না আমি, তোমাকে অন্য কোথাও রাখা সেটাতো আর সম্ভব না আমার জীবন থাকতে। আমি অন্যকিছু একটা ভাবতেছি, সে বিষয়ে তোমার সাথে কথা বলতে চাই।
ঠিক আছে কি বিষয়ে কথা বলতে চাস বল।
প্রায় ঘন্টাখানেক আম্মুর সাথে কথা বললাম, এখন সকাল সাতটা বাসায় চলে আসছি। রুবাইয়া ঘুম থেকে উঠেছে, সিরাতের কান্নার শব্দ শুনে বললাম কি হয়েছে সে কাঁদছে কেন।
কাঁদবেনা সেই কখন সে ঘুম থেকে উঠেছে, উঠে বাবা বাবা বলে কান্না করছে। তুমি তো সেই কখন গিয়েছো, কি এত কথা বললে এতক্ষণ লাগে।
আম্মুকে সবকিছু বুঝিয়ে বললাম তাই দেরি হয়েছে।
আম্মু কি রাজি হয়েছে এবার বাসা ছেড়ে যেতে।
হ্যাঁ হয়েছে, সে তো আমার কথা ভেবে, আমার ভালোর জন্য অবশ্যই রাজি হবে।
কি সিদ্ধান্ত নিলে আম্মু কোথায় যাবে কোথায় রেখে আসবে।
দেখি কোথায় রাখা যায়।
শোনো আমি বলি কি আম্মুর তো বোন আছে তাদের কাছে রাখবে নাকি বৃদ্ধাশ্রমে রাখবে।
বললাম তো সেখানে ভালো হয় সেখানেই রাখবো।
ওকে আবার এটা ভুলে যেও না।
না না ভুলে যাবো না আমি ভুলে গেলেও তুমি ভুলে যেতে দিবেনা।
বাবু দেখো তুমি কিন্তু সবসময় আমার সাথে খোঁচা মেরে কথা বলো, তোমারে স্বভাবটা আমার একদম পছন্দ না।
আমার তো কোন কিছুই তোমার পছন্দ নয়, ওকে ঠিক আছে এখন আর কিছু বলছি না। ব্রেকফাস্ট রেডি করো, সিরাতকে আমার কোলে দাও। সিরাতকে নিয়ে ছাদে গেলাম, শীতের সকাল রোদের প্রখরতা এখনো তেমন হয়নি। ছেলেটা আমার জন্য পাগল কোলে উঠলে আব্বু আব্বু করে সারা মুখে চুমু দেবে। এই ছেলেটার জন্য রুবাইয়ার মত হীনমন্য মানুষের সাথে সংসার করতে হচ্ছে। সকাল সাড়ে আটটা ব্রেকফাস্ট করতে বসেছি, আম্মুকে ডাক দিলাম, আম্মু এসে ডাইনিং এ বসেছে, সাথে সাথে মুখটা কালো হয়ে গেল রুবাইয়ার। আমি সেইদিকে তোয়াক্কা না করে আম্মুকে বললাম ব্রেকফাস্ট করো। আম্মু আর আমি একসাথে ব্রেকফাস্ট করে উঠে পড়লাম তারপর রুবাইয়া খাচ্ছে। আমাদের সাথে খেতে বলেছিলাম সে খায়নি।
অফিসে গিয়ে বসের সাথে কথা বললাম, 15 দিনের ছুটির জন্য আবেদন করলাম। এতদিনের ছুটি কেন নিব কারণ জানতে চাইল বস। তাকে সমস্ত কিছু বললাম, বস বললেন, তুমি তো তাহলে খুব বেশি ঝামেলায় আছো, সংসারে ঝামেলা রেখে অফিস সামলানো তোমার মাথায় তো অনেক চাপ। ঠিক আছে ১৫ দিনের ছুটি নাও।
বসকে বললাম যদি আমার স্ত্রী রুবাইয়া এসে জিজ্ঞেস করে আপনি বলবেন বাবু চাকরি ছেড়ে দিয়েছে।
বস ঠিক আছে এটাই বলবো বলে আমাকে আশ্বস্ত করলেন।
আমার কলিগদের এটাই বললাম আমার স্ত্রীর জিজ্ঞেস করলে বলবে আমি এখান থেকে চাকরি ছেড়ে দিয়েছি। 15 দিনের ছুটি নিয়ে বাসায় চলে আসছি, রুবাইয়াকে কিছু বললাম না, রুবাইয়া আমাকে জিজ্ঞেস করল কিছু করলে আম্মুকে কোথায় রাখবে। দেখি কাল ব্যবস্থা করব এটা বললে ঘুমিয়ে গেলাম। সকালে উঠে যথাসময়ে ব্রেকফাস্ট করে বের হলাম, রুবাইয়া জানলো আমি অফিসে যাচ্ছি, কিন্তু আমি অফিসে না গিয়ে কুমিল্লা রওনা দিলাম। সেখানে আমার বড় খালার মেয়ে থাকে কুমিল্লা গিয়ে আবার সন্ধ্যার বাসে মানিকগঞ্জ চলে আসলাম। মানিকগঞ্জ আমার ছোট খালা থাকে। ছোট খালাকে বললাম আম্মুকে তোমার কাছে কয়েকদিন রাখবো, তারপর নিয়ে যাব। ছোট খালা বললেন, ঠিক আছে তোর মা অনেকদিন ধরে আসে না আমাদের বাসায়, তোর মাকে নিয়ে আসবি এটা আবার জিজ্ঞেস করতে হয় আমাকে, তুই সঙ্গে করে নিয়ে আসতি।
রাতে খালার বাসায় থাকলাম, রুবাইয়া আমাকে কল দিলে তাকে বললাম অফিসের কাজে এক জায়গায় এসেছি কাল সকালে আসব। সকাল হতেই বাসায় চলে আসলাম। তারপর রুবাইয়া আবার জিজ্ঞেস করছে আম্মুকে কবে রেখে আসবো। বললাম দেখি কি করি, আমার কথায় রুবাইয়া রেগে গেলো।
অফিসের কাজে ঘোরাফেরা করছো আর আমি কি বলেছি সেটা তোমার খেয়াল নেই, তোমার মাকে তুমি তোমার সাথে রাখবে তাই না, অন্য কথাও রাখবেনা এটা ক্লিয়ার করে বলে দাও আমি নিজেই চলে যাই।
তোমার চলে যেতে হবে না আমি আম্মুকে বিকেলে দিয়ে আসব, রুবাইয়া আর কিছু বলল না। আম্মু তার সবকিছু রেডি করে রেখেছে আমি বিকেলে আম্মুকে নিয়ে বের হলাম, মানিকগঞ্জ খালার বাসায় রেখে আবার চলে আসলাম ঢাকায়। মনটা ভীষণ খারাপ কিছু ভালো লাগছেনা, রাতে অনেকক্ষণ কান্না করলাম ছাদে যেয়ে। আমাকে রুমে না পেয়ে রুবাইয়া ছাদে গেলো, সে যেয়ে দেখে আমি কান্না করছি।
খুব ভালোবাস মাকে তাই না, মা বাসা থেকে যেতে না যেতেই শুরু হয়ে গেল তোমার ঢং। আমি যদি চলে যাই আমার জন্য তোমার চোখের এক ফোটা পানি বের হবে না। সাত দিন ছিলাম না কখনো কি কেঁদেছো আমার জন্য? শুধু নিজের ছেলের জন্য আমাকে নিয়ে আসছো নাহলে কখনোই আমাকে নিয়ে আসতে না। তোমার মা ছোট মানুষ না যে তার জন্য কান্না করতে হবে তোমার। সে ভালোই থাকবে সবার সাথে, তুমিও ভালো থাকার চেষ্টা করো স্ত্রী-সন্তান নিয়ে। মানুষের মা-বাবা চিরদিন বেঁচে থাকে না, তোমার মা যদি মরে যেত তাহলে কি তুমি থাকতে না।
আর সহ্য হলো না সাথে সাথেই রুবাইয়ার ঘাড়ে চেপে ধরলাম, একদম চুপ আর একটা কথা বলবি না তোর মত মেয়ের জন্য আমার মাকে আমি পর করে দিয়েছি শুধু তোর জন্য। এখন আমি কাঁদতেও পারবো না, কাঁদলেও তোর হিংসা হয়, তোকে না মেরে ফেলা দরকার না, না তোকে মারব না তোর শাস্তি হবে তোকে আল্লাহ শাস্তি দিবে। কয়েকটা চড় থাপ্পড় লাগিয়ে দিলাম নাকে মুখে, সে আমার এত রাগ দেখে থেমে গেল, আমার এমন ভয়ঙ্কর রূপ রুবাইয়া কখনও দেখেনি। তাকে ছাদে রেখে আমি রুমে চলে আসলাম, শুয়ে পড়লাম বিছানায় আমার ছেলেকে জড়িয়ে ধরে। রুবাইয়া কখন আসছে সেটা আমি দেখিনি ঘুমিয়ে পড়লাম। সকালে উঠে অফিসের কথা বলে বের হলাম, তার আগে রাতের জন্য স্যরি বললাম রুবাইয়ার কাছে।
বললাম মাকে দিয়ে এসেছি এখন তো আর তোমার প্রবলেম নেই, আমার মাথাটা গরম হয়ে গেছিল তাই তোমার শরীরে হাত তুলে ফেলেছি আর কখনো এমন হবে না। এখন আমাদের সংসার খুব সুখের হবে তুমি তো আর রাগ করবে না তাই না।
আমার এমন কথা শুনে রুবাইয়া খুশি হয়ে গেল, তাকে খুশি করার জন্য আমি কথাগুলো বলেছি। বাসা থেকে বের হওয়ার দু’ঘণ্টা পরে বাসায় চলে আসলাম এসে রুবাইয়াকে বললাম, অফিসের কাজে তিনদিনের সফরে চিটাগাং যেতে হবে, আমার সব কাপড় গুলো গুছিয়ে রেখো কাল সকালে রওনা দেব।
এখন আবার চিটাগাং কেন?
অফিস থেকে যেতে বলেছে কি যেন কাজ আছে।
আমি বাসায় একা একা কিভাবে থাকবো।
আচ্ছা আমি চলে যাবার পর তুমি আম্মুকে বল এসে থাকার জন্য, আম্মু মানে আমার শাশুড়ি তাঁর কথা বলেছি।
চলবে,,,,