দশম পর্ব
অনিমার বাবা প্রথমেই আমাকে যে প্রশ্নটা করলেন সেটা হল
তোমার ফিউচার প্ল্যান কি
এই প্রশ্নটার জন্য আমি মনে মনে প্রস্তুত ছিলাম, যদিও জানি এর উত্তর যেকোনো মেয়ের বাবারই ভালো লাগবে না; কিন্তু আমাকে আশ্চর্য করে দিয়ে উনি বললেন
বাহ! এতো খুব ভালো কথা। মাস্টার্স শেষ করে পিএইচডি; খুবই ভালো পরিকল্পনা। তোমাকে কি টিচিং এ যাওয়ার ইচ্ছা?
জি আঙ্কেল
তুমি নিশ্চয়ই জানো আমি নিজেও শিক্ষকতা করি।
আমি মনে মনে একটু চমকালাম, তবে সেটা প্রকাশ করলাম না। আমি সত্যিই জানতাম না অনিমার বাবা শিক্ষকতা করছেন। অনিমা কখনো আমাকে বলেনি ওর বাবা কি করেন, আমিও কখনো জিজ্ঞেস করিনি। আজই জানতে পারলাম যে উনি সিলেট সরকারি কলেজের ইংরেজি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান।
আমরা বসেছি বাইরের ঘরে। ওদের বাড়িটা বেশ পুরনো ধাচের, খাবার ঘর এবং বসার ঘর আলাদা আলাদা। পর্দা সরিয়ে কেউ একজন আমাদের খেতে ডাকলো। আমি দরজার দিকে পিছন ফিরে বসায় তাকে দেখতে পেলাম না। হাসান সাহেব বললেন চলো নাস্তা খেতে খেতে কথা বলি
আমরা এখানে এসে পৌঁছেছি আজ সকাল আটটায়। পুকুর পাড় থেকে আমি ওকে সোজা হিয়ার কাছে নিয়ে যাই। ওকে দেখে হিয়ার উচ্ছ্বাসের শেষ ছিল না । অনিমা একটু অস্বস্তি বোধ করছিল কিন্তু হিয়ার আন্তরিকতার কাছে পরাজিত হলো। ওদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ঢাকার টিকেট কাটলাম তারপর ইমেইল করে চেয়ারম্যন স্যারকে জানালাম জরুরী প্রয়োজনে ঢাকা যেতে হচ্ছে। কাজ শেষ করে হলে ফিরতে ফিরতে রাত হয়ে গেল। রাতের খাবার সময় হয়ে গেছে, খেতে ইচ্ছা করছে না। সামনে খুব কঠিন কিছু সময় আসছে। সাধারণত এরকম দুর্যোগময় সময়ে মানুষের পরিবার তাঁর পাশে দাঁড়ায়, তাকে সাপোর্ট করে কিন্তু আমাদের ক্ষেত্রে ব্যপারটা সম্পূর্ণ বিপরীত, আমাদের মুখোমুখি হতে হবে আমাদের পরিবারের।
দুশ্চিন্তায় সারারাত আমার ঘুম হলো না। শেষ রাতের দিকে একটু ঘুম এল, সকালবেলা উঠতেও দেরি হয়ে গেল। নয়টার সময় আমাদের রওনা দেবার কথা। আমি দ্রুত গোছগাছ করে বেরিয়ে পড়লাম। অনিমাকে হল থেকে তুলে নিয়ে সোজা স্টেশনে চলে গেলাম। চট্টগ্রাম থেকে ঢাকার জার্নি সে সময় বেশ দীর্ঘ ছিল। পুরো পথ ও আমার সঙ্গে খুব বেশি কথা বলল না। খেতে বললাম যখন খেল ও না ঠিক মতন। হয়তো আমার মতন ও দুশ্চিন্তায় আছে অনেক। হয়তো আমার উপর ভরসা করতে পারছে না। আমি অবশ্য ওকে কোনো ধরনের আশ্বাসও দেইনি, কিছুই বলিনি, শুধু বলেছি আমি ওর বাবার সাথে কথা বলতে চাই।
ঢাকা পৌঁছাতে পৌঁছাতে সন্ধ্যা হয়ে গেল। আমি ওকে ওর হলের সামনে নামিয়ে দিলাম। বললাম
অনেক ধকর গেছে একটু বিশ্রাম নাও। কাল দুপুরে দেখা হবে। দুটোর পরে এসে কল দিব।
আমি তাকিয়ে দেখলাম ও ভিতরে যাচ্ছে না। ওকে কেমন ক্লান্ত, বিধ্বস্ত, পরাজিত মানুষের মতন মনে হচ্ছে। আমার বুকের মধ্যে একটা ধাক্কার মতন লাগলো। ও কি আমাকে বিশ্বাস করতে পারছে না, নাকি ভরসা করতে পারছে না। আমি এগিয়ে এসে ওর হাত ধরে বললাম
কি হয়েছে, শরীর খারাপ লাগছে?
ও ভাঙ্গা গলায় বলল
তুমি কি বাসায় যাবে এখন?
না, বাসায় যাব না। হলে থাকব আজ, আমার বন্ধুর সঙ্গে। কিছু লাগবে? আমি আসবো আবার রাতে?
তুমি কি সত্যিই সিলেটে যাবে?
হ্যাঁ, একটা কথা জিজ্ঞেস করার ছিল
বল
রাতের বাসে আমার সঙ্গে যেতে তোমার কোন সমস্যা আছে?
ও খুব অবাক হয়ে বলল
না, সমস্যা থাকবে কেন?
আমার খুব সকালেই সিলেট পৌঁছাব
সমস্যা নেই
তাহলে কাল রাতের টিকেট কাটছি, রাত দশটার
আচ্ছা দুপুরে আসবে না তাহলে আর?
ওর বলার ধরন দেখে আমি হেসে ফেললাম। বললাম
আসবো না কেন? তুমি চাইলে সকাল থেকে এসে বসে থাকব
এতক্ষণ পর ও একটু হাসল। আমি তৃষিতের মতন চেয়ে রইলাম। ওর এই একটুখানি হাসি দেখার জন্য আমি যত কষ্ট করতে হয়, করতে রাজি আছি।
দুপুরে আসবো বললেো আসতে পারলাম না, ঝামেলায় আটকে গেলাম। টিকিট পাওয়া যাচ্ছিল না। অনেক কাজ ফেলে এসেছি, একটা দিন নষ্ট করা কোনভাবেই সম্ভব না। এখন মোবাইলের যুগে বিষয়গুলো যত সহজ মনে হয় সে সময় ততটা সহজ ছিল না। আমি আসতে পারছি না এই কথাটা ওকে জানাতেও পারিনি। আমি নিশ্চিত ও আমার জন্য অপেক্ষা করে বসে আছে, হয়তো দুপুরের খায়নি, একসঙ্গে খাবে বলে॥ আমার নিজেরও খেতে ইচ্ছা করল না, কাজ মিটিয়ে আমি ব্যাংকে গেলাম, সেখান থেকে নীলক্ষেত। কয়েকটা বই দরকার ছিল সেগুলো নিয়ে ওর হলে পৌঁছাতে পৌঁছাতে সন্ধ্যা হয়ে গেল।
আমাকে দেখে ও আঁতকে উঠলো । বলল
তোমার এই অবস্থা কেন? কোথায় ছিলে সারাদিন?
আমি হাসলাম একটু, টিকেট দুটো ওর হাতে দিয়ে বললাম
একটু ঝামেলা গেছে। এখন সব ঠিক আছে। কোথাও বসবে?
না। তুমি এখন হলে যাবে। গোসল করবে, খাবে তারপর ঘুমাতে যাবে। রাতে একবারে আমাকে এখান থেকে নিয়ে স্টেশনে যাবে। যাও এখন।
আমি আপত্তি করলাম না। আমার আসলেই একটু বিশ্রামের দরকার। শহীদুল্লাহ হলে আমার এক বন্ধু থাকে। ওর ওখানেই কাল ছিলাম। আমি ওখানেই চলে গেলাম।
বাসে ওকে জানালার সামনে বসিয়ে আমি বললাম
আমি কিছু খাবার কিনে নিয়ে আসি
খাবার আমি নিয়ে এসেছি। তুমি শুধু পানি কিনে আন
আমি পানির সঙ্গে আরও কিছু শুকনো খাবার কিনে আনলাম। বাস আজ সময় মতই ছাড়লো। ও আমার দিকে খাবারের বক্স এগিয়ে দিয়ে বলল
খাও, সারাদিন নিশ্চয়ই কিছু খাওনি। আমি আশ্চর্য হয়ে গেলাম। বক্সের ভেতর গরম খিচুড়ি ডিম ভাজা, আলু ভর্তা। দুদিন পর মনে হয় এত আরাম করে খেলাম। খিচুড়ি আমার খুব প্রিয় খাবার। ছোট ফুফুর হাতের খিচুড়ি আমি ভীষণ পছন্দ করি। অনেকদিন পর সেই স্বাদটা মনে পড়ে গেল। খেতে খেতে ও বলল
আমার রান্না তো ভালো না, কষ্ট করে খেয়ে ফেলো
তোমার অন্য রান্না তো খাইনি। তবে তোমার খিচুড়ি অসাধারণ
ও লজ্জা পেয়ে একটু হাসলো।
বাসের মধ্যে এখনো ঘুম নেমে আসেনি। আমরা দুজন হাতের সঙ্গে হাত জড়িয়ে গল্প করছি। টিভিতে নাটক চলছে॥ আরো ঘন্টাখানেক পর বাসের বাতি বন্ধ হয়ে গেল, টিভি বন্ধ করে গান চালু হলো। ও আমার কাধে মাথা রেখে খুব আস্তে আস্তে বলল
আমার ভীষণ ভয় করছে
আমি ওকে বলতে পারলাম না যে আমার ওর চাইতেও অনেক বেশি ভয় করছে। ওর বাবার কিংবা আমার পরিবারের মুখোমুখি হবার ভয় নয়। সব কিছুকে ছাপিয়ে আমার ভীষণ ভয় করছে এটা ভেবে যে যদি আমি ওকে হারিয়ে ফেলি। আমি ভিষণ আস্তিক ধরনের মানুষ। মনেপ্রানে বিশ্বাস করি যদি সৃষ্টিকর্তা না চান তাহলে আমি কখনই ওকে পাব না। আমি ওর একটা হাত নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে অন্য হাতে ওর চুলগুলো কানের পিছনে গুঁজে দিতে দিতে বললাম
চিন্তা করো না সব ঠিক হবে ইনশাল্লাহ।
ওকে কেমন যেন নিশ্চিন্ত মনে হল। ধীরে ধীরে টের পেলাম ওর নিঃশ্বাস ভারী হয়ে আসছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই ও আমার কাঁধে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়ল। আমি ঘুমাতে পারলাম না। ভয়, অনিশ্চয়তা , দুশ্চিন্তা মিলেমিশে আমার মনের মধ্যে অদ্ভুত এক অনুভূতি তৈরি হলো। হাইওয়ে দিয়ে ছুটে চলা দ্রুতগামী ট্রাকের আলো হঠাৎ হঠাৎ এসে পড়ছে জানালার কাচ ভেদ করে। সেই ছিটকে পড়া আলোয় ওর মুখটা দেখে আমার বুকের ভেতর হাহাকার করে উঠল। আমি ওর একটা হাত আমার বুকের মধ্যে চেপে ধরে রাখলাম।
বাসের মধ্যে খুব লো ভলিউমে একটা বাংলা গান চলছে। গানের কথা এবং সুর আমার ভারাক্রান্ত হৃদয়কে আরো বিষন্ন করে তুলছিল। যেন এই কথাগুলো
গানের কথা নয় আমার নিজেরই কথা
দিয়েছিলে যা, নিয়ে নিতে পারো
লেখা কবিতা, গাওয়া গান যত,
খুঁজে দেখ না, পাবে না কেউ আমার মত
মুছে দিও না শুধু হৃদয় ক্ষত।
চলবে……